Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছায়াপাখি, নীল হ্রদের তীরে — পর্ব ৯

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

সোনালি ডানার চিল

হীরকের তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হাঁটার অভ্যাস। বিয়ের পরে মঞ্জিনি তার অনেক দোষগুণ লাঘব করেছে। কিন্তু এই ব্যাপারটি বশে আনতে পারেনি। ট্রেন ধরার তাড়া আছে নাকি তোমার? সবসময়ে এমন হনহন করে হাঁটার দরকার কি বলো তো? একজন মেয়ের সঙ্গে হাঁটতে গেলে একটা মিনিমাম সহবত লাগে, সেটা বোঝো কি?

এরকম নানান অনুযোগ। সেই সময়ের মত লজ্জা পেয়ে গতি ঢিমে করেছে হীরক। কিন্তু ধরে রাখতে পারেনি। হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেন এমন করে তাকে ছুটতে হবে সেটা নিজেও বোঝে না। কিন্তু কিছু মিস হয়ে যেতে পারে জাতীয় ব্যস্ততা মুখে ঝুলিয়ে হাঁটার চিরদিনের অভ্যেস। বদলানো সম্ভব হয়নি। এর ফলে অনেক সময় চেনা লোক পাশ দিয়ে চলে গেছে, একটা ছোট্ট হাসিও উপহার দেওয়া হয়নি। পরে কথা শুনতে হয়েছে।  আজকেও মিস হয়ে যেত। হল না শুধু ওরকম ঝর্নার জল ঝমঝমিয়ে গড়িয়ে পড়ার মতো হাসি যদি ওর পা আটকে না দিত। বড় চেনা হাসি। পিছনে ছেড়ে আসা দিনগুলোর অন্ধকার গহ্বর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা চিরকুটের মতো।

লেখা! লেখি? এখানে, এই দেশে? হেমন্তের হিমেল হাওয়ায় শুকনো পাতার মড়মড় শব্দের গুঞ্জন হীরকের মনে।

না হওয়ার কিছু নেই। সে যদি এখানে আসতে পারে, লেখা কেন নয়। কিন্তু জীবনের পাতা থেকে খসে পড়া এই পরিবারের কারও সঙ্গে যে প্রতিদিনের চলার পথে আবার দেখা হতে পারে কোথাও আবার, সেটাই ভাবতে পারেনি কোনওদিন।

বাবা-মাকে চিনুর বাড়িতে ছাড়তে এসেছে নিউ জার্সি। কালকে অ্যান আরবারে ফেরত যাবে। এসেছিল নিউ ইয়র্কে, ঘুরছিল ম্যানহাটানে। এখানে রাস্তার ভিড়ে কলকাতাকে খুঁজে পায় যেন। কোনও বিশেষ দরকার তো ছিল না। এমনিই ঘুরছিল। সেন্ট্রাল পার্কে ছিল খানিকক্ষণ, ওখানেই গাড়ি রেখে হাঁটা লাগিয়েছিল। এই এলাকায় পার্কিং পাওয়া অত সহজ নয়। হেঁটেই এসেছিল এইট্টি নাইনথ স্ট্রিটে স্কুল অব ফাইন আর্টসে— কোনও শর্ট টার্ম কোর্স করা যায় কিনা সেই ভাবনায়। তারপর এমনি উদ্দেশ্যবিহীন ভাবেই ঘুরছিল। এমন সময়ে এই হাসি।

ঘাড় ঘুরিয়ে হাসির উৎস সন্ধান করতে গিয়ে এক মহিলাকে আরও দুজন লোকের সঙ্গে স্যাক্স ফিফথ অ্যাভেনিউয়ের দরজা দিয়ে ঢুকে যেতে দেখল। পরনে বাঘ রঙের বুটি দেওয়া ছোট ঝুলের ফ্রক। আঁটসাঁট চেহারার মেয়েটি হাই হিলে খটাখট করতে করতে কোটপ্যান্ট পরা আর এক ভারতীয় পুরুষের দিকে চেয়ে হাসিতে ভেঙে পড়ছিল। যেন এদেশেরই মেয়ে, তার চেনা লেখির সঙ্গে কোনও আপাত মিল নেই। অন্য লোকটির লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবিটা বরং আমেরিকার ফ্যাশন ডিস্ট্রিক্টে খাপ খাচ্ছিল না।

হাসিতে চিনে গেছে এমন একটা সুনিশ্চিত ধারনার বুদবুদ জেগে উঠলেও এখনও মুখ দেখতে পায়নি। তাই হঠাৎ করে পিছন থেকে থেকে ডাকার ভরসা তৈরি হয়নি। তাছাড়া সত্যিই কি দেখা করতে চায় হীরক? এতদিন বাদে দেখা করে কোনও না বলা কথা টেনে আনতে চাইবে? যেমন হাঁটছিল সেই গতিতে জনারণ্যে মিশে যাওয়ার প্রবণতা একই সঙ্গে গ্রাস করছিল হীরককে।

মানুষের মাথার মধ্যে পা ঝুলিয়ে একজন বসে আছে। সে কখনও টেনে ধরে, কখনও ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাশ কাটিয়ে যেতে বলে। মুখে হাত চাপা দিয়ে বেরোনো কথা ভিতরে টেনে নেয় সুড়ুত করে। আজ সে পিছন থেকে যেন ধাক্কা মারল। আর পালিয়ে যাস না হীরক। সামনে যা, জীবনযাপনের বন্ধুর পথে কী হয়, সেই পরিণতির মুখোমুখি হ, একবারের জন্য।

সাজানো বাগান তছনছ হবার আশঙ্কা সত্ত্বেও ভূতগ্রস্তের মতো দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল হীরক।

মেয়েটি তখন হাত পা নেড়ে কী চাই সেটা বোঝাচ্ছিল সঙ্গের লোকটিকে। হীরক এত কাছে চলে এসেছে, এমন স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছে যে চড়া মেকআপের আড়াল থেকেও চিরচেনা লেখার মুখটাই মনে হচ্ছে। লোকটি মাথা নেড়ে বলল, ওকে ওকে, বুঝতে পেরেছি অনামিকা, আপনি একটু দাঁড়ান আমি জিজ্ঞেস করছি।

একটু থতমত খেয়ে গেল হীরক। বাঙালিই, কিন্তু এর নাম অনামিকা। লিপিলেখা নয়? এত বড় ভুল হল তার! তখন বড্ড কাছে চলে এসেছে মেয়েটার, চোখে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুত হয়ে একেবারে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল হীরক।

–হীরুদা!

হনহন করে হাঁটতে শুরু করে আবার থমকে পিছন ফেরা।

–হীরুদা, পালাচ্ছ কেন? আমাকে দেখে ভয় পেলে বুঝি? হীরক থমকে দাঁড়াতে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটকামড়ানো হাসিতে মেঘে ঢাকা সূর্যের লুকোচুরি ছড়িয়ে দিল মুখমণ্ডলে। ভূত দেখলেও তো লোকে এমন লম্বা পায়ে পালায় না।

চোখে সেই ঝিলিক। শুধু অনায়াসে ছিটকে আসা কথায় যোগ হয়েছে বিদ্রূপের তীক্ষ্ণতা। কথা বলতে বলতে হীরকের দিকে তরতর করে এগিয়ে আসছিল লেখা। একদম মুখোমুখি। একহাত হীরকের কাঁধে এমন জোরে রাখল যেন লাল রঙে রাঙানো নখগুলো জামা ভেদ করে চামড়ায় বসে যাবে। নিরাভরণ হাতে সোনালি ঘড়ির টিকটিক সময়ের পদধ্বনি হয়ে কানে বাজল হীরকের। ওরা দুই বোনই দেখতে খুব সুন্দর। কিন্তু যে বয়সে হীরক লেখাকে শেষ দেখেছে সে তখনও নারী হয়ে ওঠেনি। না পোশাকে, না সজ্জায় ছিল কোনও চটক। আজকের লেখা নিখুঁত করে আঁকা চোখের গভীরতায়, গাঢ় লিপস্টিকের সীমানা ঘেরা ঠোঁটের ব্যঞ্জনায়, প্রসাধনের পারিপাট্যে আকর্ষণীয়া। সযত্ন রূপটান সৌন্দর্যকে ছেনে পূর্ণতার ডালি সাজিয়েছে। নিশ্বাসের দ্রুততা লেখার চোখেমুখে এক উদ্গত রক্তাভা ছড়াচ্ছিল। এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে লেখার নাকের ডগায় জন্ম নেওয়া শিশিরবিন্দুর মত আর্দ্রতা হীরকের চোখ এড়াচ্ছে না এখন। কস্তূরী হরিণী শরীরের সুগন্ধি মাদকতায় আচ্ছন্ন বোধ করছিল হীরক। ঘটনার এমন আকস্মিকতায় থতমত খেয়েও নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। আর যাই হোক রেখার বোন, ছোট বয়েস থেকে চোখের সামনে বেড়ে উঠতে দেখেছে। তা না হলে এই তীব্র শারীরিক উপস্থিতির প্রতিঘাতে মাটি উপড়ানো তৃণমূলের অবস্থা হত হীরকের। ঘটনার নাটকীয়তায় লেখার দুই সঙ্গীও এখন উৎসুক চোখে চেয়ে আছে।

–আসলে প্রথমে চিনতে পেরেছিলাম ভেবেই পিছন থেকে এগিয়ে আসছিলাম। কিন্তু অনামিকা নাম শুনে ঘাবড়ে গেলাম রে। এখানে এমনভাবে দেখা হবে সেটা তো ভাবিনি।
–তুমি বাংলা সিনেমা একদম দেখো না, তাই না? দেশেও কি যাও না মোটেই? লেখার বলার ভঙ্গিতে অনামিকা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।

বাংলা সিনেমা দেখার প্রশ্ন কেন এল সেটা বুঝল না হীরক। তিন বছর আগে গেছিলাম, ব্যস। এর বেশি ঘনঘন আর যাওয়া হয় না। হীরকের ইচ্ছা হচ্ছিল কাঁধ আঁকড়ানো হাতটা সরিয়ে দেয়। অত্যন্ত আগ্রাসী ভঙ্গিতে কাঁধটাকে বিদ্ধ করছে লেখা এখনও। এই দৃশ্য সামনে দাঁড়ানো অপরিচিত লোকেদের কাছে নায়িকার পুরুষ সংসর্গের উপকথার অপ্রকাশিত এপিসোড মনে হতে পারে। হীরকের কাছে এটা সম্ভাব্য আক্রমণের অস্বস্তিকর প্রস্তুতি। জেনেই তো এগিয়েছিলে হীরক, পা ঝোলানো লোকটি মনে করিয়ে দেয়। এখন আর পালাবার পথ নেই।

এবার কোট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। হীরক যে লেখার আসল পরিচয় বুঝতে পারেনি, তাতে কেমন অস্বস্তিবোধ করছিলেন হয়তো। উনি বাংলা সিনেমার এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা, অনামিকা। উত্তর আমেরিকার বঙ্গ সম্মেলনে আমাদের অতিথি হয়ে এসেছেন।

লেখা সিনেমা করছে! এত নাম করেছে যে এদেশে ডেকে এনেছে? দুর্ভাবনার ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে পরিচিতির আবেগে আপ্লুত লাগল হীরকের। এবার এত মেকআপ আর ফ্যাশনেবল পোশাকের কারণ বোঝা গেল। অনেক কথা ঝরঝরিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। কিছু প্রশ্নও। কিন্তু অপরিচিত আরও দুজনে লোকের সামনে বলতে চাইল না।

–লেখা, তোর সঙ্গে দেখা করা যাবে একবার? যদি খুব ব্যস্ত না থাকিস। বলেই হীরক ভাবল সত্যিই কি এটা বলতে চেয়েছিল— এক অদ্ভুত দোটানার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল মন।
–সত্যিই দেখা করতে চাও হীরুদা? কথা বলতে চাও? তার হ্যাঁ বা না-এর অপেক্ষা না করেই পাশের লোকটিকে বলল, শচীনবাবু! কিছু মনে করবেন না। আমি দোকানের কাজটা পরে করব। আমাকে এঁর সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলতে হবে। আমাকে ফেরত নিয়ে যাবেন? লেখার জীবনে চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে বোধহয় কোনও সীমারেখা নেই। অন্যপক্ষের সম্মতির অপেক্ষা করতে হয় না। হীরককে বলল, আমার সঙ্গে আসতে পারবে তো হীরুদা?
–এখন? একমুহূর্ত ভাবল হীরক। কোনও বিশেষ কাজ তো আর বাকি ছিল না। দেখা করে নিতে কোনও অসুবিধা নেই। যা হয় হবে, কিন্তু সব প্রশ্নের কিছু উত্তর না পেলে দাঁতের ফাঁকে কাঁটা ফোটার স্মৃতির মতো সারাজীবন খচখচ করবে। মুখে বলল, হ্যাঁ বল না আমায় কোন হোটেলে আছিস, আমি ওখানে পৌঁছে যাচ্ছি।
–উনি তো হোটেলে নেই। নিউ ইয়র্কের সুনীল মিত্রের বাড়িতে আছেন। এখান থেকে বেশি দূরে নয়, মিনিট বিশেকের পথ।
–ঠিক আছে, অ্যাড্রেস পেলে সেখানেও গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে যেতে পারি।
–তোমার গাড়ি এখানে রাখা বুঝি? এক মুহূর্ত থমকাল লেখা। আমার সঙ্গেই চলে এসো, প্লিজ। আমি আবার তোমাকে এখানে পৌঁছানর ব্যবস্থা করিয়ে দেব। লেখার চোখেমুখে একটা ব্যস্ততা, হাতের কাছে পাওয়া হীরককে কিছুতেই হারাতে চায় না। কী চায় লেখা, কী বলতে চায়? অভিমান, অনুযোগ, অভিযোগ? এত বছর বাদে কোনও লাভাস্রোত বেরিয়ে এলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বহুদিনের ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরির জেগে ওঠার উষ্ণতা অনুভব করছিল হীরক।

কিন্তু এই অবস্থায় কারও বাড়িতে গিয়ে কথা বলতে হবে এটা একটু অস্বস্তির কারণ। কে এই সুনীল মিত্র, জানাপরিচয় নেই। অন্য লোকের বাড়িতে বসে কী কথা উঠতে পারে সেটা নিয়ে ভাবনা হচ্ছিল। কোথাকার কথা কোথায় ছড়ায়। বাতাস দেওয়ার লোকের তো অভাব নেই।

শচীনবাবু হেসে বললেন, অনামিকা যখন বলছেন চলুন না, আমি আপনাকে আবার এখানে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করব না হয়?

এরপর আর না বলা যায় না। আচ্ছা চলুন, আমি আসছি আপনাদের সঙ্গে। আমার গাড়িটা সেন্ট্রাল পার্কের ওখানে রাখা আছে।

–তাহলে হেমন্ত, তুমি এদের নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াও। আমি গাড়িটা নিয়ে আসছি।

রেখার কথা জানার জন্য ছটফট করছিল হীরক। কিন্তু এখন সেকথা তুলল না। বরং লেখা কতদিনের জন্য এসেছে, কবে থেকে সিনেমা করছে, কী কী সিনেমা করেছে এইসব কথায় বাক্যালাপ সীমিত রাখতে চাইল। লেখার দিক থেকেও তাপমাত্রার পারদ কিছুটা নেমে এসেছিল। কিন্তু এইসব প্রশ্নের উত্তর সংক্ষেপে সেরে হেমন্তর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হীরকের মনে হল লেখা যেন নিজের চারপাশে এক প্রাচীর তুলে দিচ্ছে। একটু আগের ব্যবহারের সঙ্গে একদমই আলাদা। কিশোরী লেখাকে চিনত হীরক, কিন্তু এই নারী তার কাছে প্রাচীন লিপির মতো দুর্বোধ্য।

শচীন গাড়ি নিয়ে আসতে হীরক হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কালো রঙের এসইউভি। হেমন্ত শচীনের পাশে জায়গা নিল। পিছনে লেখা আর হীরক।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। হঠাত লেখা পাশ ফিরে বলল, দিদিকে তোমার মনে পড়ে হীরুদা?

এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে হীরক? কোনওদিনই ভোলার চেষ্টা করিনি তো লেখি।

–তাই নাকি! বিয়ে করোনি? ব্রহ্মচর্য নিয়েছ বুঝি?

গাড়ির আবহাওয়া উত্তপ্ত হচ্ছিল। হীরক এই ভয়টাই পাচ্ছিল। উত্তর না দেওয়াই সঠিক পথ বলে বিবেচনা করল।

–মনে হয় দেওয়ার মতো জবাব নেই কোনও তোমার। তীব্র শ্লেষে জাড়িত হল লেখার কণ্ঠস্বর। তাই না হীরুদা?
–লেখি, এই কথাগুলো যদি এভাবেই বলতে হত, দোকানে দাঁড়িয়েও বলে নেওয়া যেত, তাই না?

লেখা রেগে গেল। কিন্তু কথা বদলে বলল, শুনলে তো আমার নাম বদলে গেছে। একদম কাছের লোকেরা ছাড়া সবাই আমাকে অনামিকা বলেই ডাকে।

হীরক বুঝল এটা রাগের কথা। মুখে বলল, তা বেশ। অনামিকাই বলব। আমার জানা লেখার সঙ্গে তোমার অত কিছু মিল তো নেই। তাছাড়া সত্যিই তো, আমি কোনও কাছের লোকও নই আর।

এরপর গাড়ির পিছনের সিটে আর কোনও কথোপকথন হল না। সুনীলবাবুর বাড়িতে ওঁর স্ত্রী ছিলেন, জয়া। ওদের এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে দেখে একটু অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু শচীন বুঝিয়ে বলতেই মুখে হাসি টেনে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন, আসুন হীরকবাবু। আপনি নিউ ইয়র্কে আমাদের অতিথি, সুনীল বাড়িতে থাকলে খুব খুশি হত।

–জয়াদি, আমি ওঁর সঙ্গে কিছু কথা বলার জন্য বাড়িতে ডেকে এনেছি। আমি ওঁকে আমার রুমটায় নিয়ে যাই?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়। অমায়িক হাসিতে বিস্তৃত হলেন জয়া। বলেছি না, একদম নিজের বাড়ি মনে করে থাকবেন।

বাড়িটা বেশ বড়। পরিপাটি করে সাজানো। লিভিংরুমের মাঝখান দিয়ে উঠে যাওয়া ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে লেখার পিছন পিছন উঠে গেল হীরক। অনুভব করতে পারল তিনজোড়া চোখ তার পিঠের উপর মেলে রাখা আছে। ঘরে ঢুকে হীরকের পিছনে দরজা বন্ধ করে দিল লেখা।

–এবার বলো। বোধহয় এখন আর কোনও উত্তর দিতে জিভ জড়িয়ে যাবে না।
–আচ্ছা সেই প্রশ্নটা? না, ব্রহ্মচর্য নিইনি। বিয়ে করেছি, আমার একটি মেয়েও আছে।
–বাঃ হীরুদা বাঃ! কী সহজে বলতে পারলে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছিল লেখার। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছে হীরকের কাছে। তাহলে দিদিকে কীভাবে মনে রাখলে হীরুদা? স্বপ্নে? ডায়েরির পাতায়? লেখার গলার স্বর চড়ছিল। বলো, জবাব দাও। চুপ করে থাকলে চলবে না আজ। ওর দুই হাত এখন হীরকের কাঁধে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঝাঁকাচ্ছিল তাকে। এত বছরে একবারও তোমার দিদির খবর নেওয়ার কথা মনে হল না? তাই না? এক্কেবারে ভয়ে লেজ তুলে পালালে। এত কাপুরুষ তুমি? ছিঃ!
–আমি পালাইনি লেখা। বরং তোরা সবাই কোথায় হারিয়ে গেলি। ওই ঘটনার পর কয়েকমাসের মধ্যে তোরা দুর্গাপুর ছেড়ে চলে গেছিলি। কেউ তোদের খবর জানত না। হীরকের গলা ফেটে যাচ্ছিল।
–তুমি দিদিকে কতটা ভালবেসেছিলে হীরুদা? কতটা? থরথর করে কাঁপছিল লেখা। কাউকে সত্যিকারের ভালবাসলে এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়া যায়? তোমাকে তখন সবচাইতে বেশি প্রয়োজন ছিল। বলো না হীরুদা। খুঁজে পাওনি, নাকি খোঁজার চেষ্টা করোনি। দিদির মুখোমুখি হতে তুমি ভয় পেয়েছিলে হীরুদা, ভয়। তুমি জানতে যে দিদিকে আর তুমি কিছু দিতে পারবে না। দিতে চাইবে না।

লেখার দুই হাতের নখ হীরকের কাঁধে কেটে বসছিল। লেখার প্রতিটা কথা তার পায়ের তলা থেকে মাটি কেড়ে নিচ্ছিল। হীরক প্রাণপণে মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করল। না, লেখা না। আই আস্কড এভরিওয়ান। কেউ বলতে পারেনি। মাত্র তিন সপ্তাহের জন্যে এসেছিলাম আমি। আমাকে ফিরতেই হত, না হলে হয়তো আরও খোঁজ করতাম। হয়তো কেন, নিশ্চয় করতাম।

–কী সহজ অজুহাতের আড়ালে নিজের পিঠ বাঁচিয়েছ। তোমার প্রেমিকার জীবনকে কেউ তছনছ করে দিয়েছে, তাই তুমি সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়েছ। বাঃ, হীরক দে বাঃ। হীরের টুকরো ছেলেদের তো এমনি হতে হয়। তোমার জন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে গেল, আর তুমি নিজের পথে চলে গেলে। একবারটি ফিরেও তাকালে না।
–মিথ্যে, একদম মিথ্যে। আমি তখনই বিয়ে করিনি। রেখার খবর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। অনেকদিন, মাস, বছর। আমি এদেশ থেকে একটার পর একটা চিঠি লিখেছি, সব আমার কাছে ফেরত এসেছে। তাছাড়া আমার জন্য কেন নষ্ট হবে? আমি কী করেছিলাম? যা করেছে সে তো বীরুদা। হীরকের আর্ত চিৎকার হাহাকারের মতো ভেঙে পড়ল। সুনীল মিত্রের বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে থাকা কারও কানে এই শব্দ পৌঁছাচ্ছে কিনা সে বিষয়ে এখন আর কোনও খেয়াল নেই হীরকের।
–তাহলে তুমি তো জানতে কার জন্য দিদির এই অবস্থা। সে তো দুর্গাপুরে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তুমি তাকে কিছু বলেছিলে? জিজ্ঞেস করেছিলে তোমার প্রেমিকার সঙ্গে সে কেন এমন করল?
–আমার কাছে কি প্রমাণ ছিল যে বীরুদার সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলব? রেখা জানত, তুই জানতিস। তোরা কেন কেস করিসনি? কেন বীরুদাকে জেলে পাঠাতে পারিসনি? হীরক জানে সে এখন ফরিয়াদি উকিলের মতো লজিকালি কেস সাজাচ্ছে।

ঘৃণায় মুখ বেঁকে যাচ্ছিল লেখার। তোমার কোনও ধারণা আছে আমাদের উপর দিয়ে কী যাচ্ছিল তখন? কীরকম ভয়ঙ্কর হুমকি দেওয়া হচ্ছিল? বাপি তখন দিশেহারা। পাশে একটা লোক নেই। আমাদের জীবন থেকে আলোবাতাস কেড়ে নেওয়া হয়েছিল হীরুদা। কেউ ছিল না আমাদের। তুমিও না। ধীরে ধীরে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল লেখা। চোখের জলে মেকআপ ধুয়ে গিয়ে খড়-মাটির কাঠামোর পরিচিতি নিয়ে লেখা ভেসে উঠছিল হীরকের সামনে। সে চেহারা দেখতে পারছিল না হীরক। এক ব্যার্থতার কষ্ট শ্বাসরোধ করে দিচ্ছিল। একটু আগের যুক্তির প্রাচীরে এখন চিড়।

অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলেনি। মনে হচ্ছিল অনন্তকাল। কিংবা কয়েক মুহূর্তে মাত্র, সময় থমকে গেছিল ওই কটি মুহূর্তের জন্যে। খুব ক্লান্ত ধীর কণ্ঠে বলল এবার লেখা। তোমাকে দিদির খুব দরকার ছিল জানো। খুব। কাউকে তো কিছু বলত না দিদি। শুধু আমাকে। মনে মনে তোমাকে খুঁজত।

–তাহলে আমকে একটা চিঠি কেন দেয়নি, একবার?
–দিদি তোমার দয়ার পাত্রী হতে চায়নি হীরুদা। বড় অভিমানী দিদি আমার। অপেক্ষা করেছে তুমি নিজে থেকে আসবে বলে, নিজে এসে বলবে আমার কিচ্ছু আসে যায় না রেখা। তুমি আমার কাছে সেইরকমই সুন্দর আছ। থাকবে।
–আমি তাই বলতে চেয়েছিলাম লেখা। একবার যদি সুযোগ পেতাম। নিজের কানেই কেমন ফাঁকা আওয়াজের মতো শোনাল হীরকের। তবু বলল, যতটা জোরের সঙ্গে বললে সত্যির কাছাকাছি পৌঁছানো যায়।

মাথা নাড়ল লেখা। তুমি পারতে না। আমাদের বাড়ির ঠিকানা জানা থাকলেও পারতে না।

–বিচার হল না, ফাঁসির হুকুম হয়ে গেল। কী করে জানলি আমি কী করতে পারতাম আর কী করতে পারতাম না?
–তুমি সহ্য করতে পারতে না হীরুদা। পালাতে। হীরকের চোখের উপর নিজের কান্না লেপটানো চোখ পুরোপুরি মেলে ধরল লেখা। মনের ভিতরটা পুরোপুরি পড়ে নেওয়ার চেষ্টা ছিল সেই দৃষ্টিতে।
–রেখা এখন কেমন আছে রে? নিজের গলা হীরকের কানেই খসখসে শোনাল। শীতের রুক্ষ ত্বকের মতো সজীবতাহীন। সত্যিই কি রেখা কেমন আছে জানতে চাওয়ার সাহস আছে হীরকের?
–তুমি জানতে চাও হীরুদা? একদম সত্যি? দেখতে চাও তোমার সো-কল্ড ভালবাসার মানুষটিকে। লেখার গলায় হেঁয়ালি আর বিদ্রূপ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল।

রেগে উঠে দাঁড়াল হীরক। তুই কি আমাকে অপমান করার জন্য এখানে ডেকে এনেছিলি? যদি রেখার সম্বন্ধে কিছু বলতে পারিস বল। নাহলে আমি চললাম।

–এতগুলো বছর তোমার এইরকম জানার তাড়া ছিল না হীরুদা। খরখরে গলায় বলে উঠল লেখা। এখন যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এর চেয়ে বলতে পারত, দিনের ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ হীরুদা, সন্ধের ট্রেন ধরতে হলে আজ একটু ধৈর্য ধরো।

লেখার ব্যঙ্গে ভরা হাসিটা সাপের হিসহিসানির মতো শোনাল হীরকের কানে। কিন্তু লেখা ওর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য বসে ছিল না। ধীর পায়ে উঠে নিজের একটা স্যুটকেস খুলল। নিচু হয়ে একটা ম্যাগাজিন বের করে আনল। এইটা দ্যাখো হীরুদা। গত মাসের আনন্দলোক। তোমার অনেক উত্তর জানা হয়ে যাবে। তারপরেও যদি তুমি কিছু জানতে চাও, আমার কাছে এসো। আমি জানাব।

দূর থেকেই হীরকের দিকে ছুঁড়ে দিল ম্যাগাজিনটা। সমস্ত পাতা ফরফর করে ম্যাগাজিনটা উল্টে এসে পড়ল হীরকের পায়ের কাছে। হীরক এক সবহারানো ভিখারির মতো উবু হয়ে বসে কুড়িয়ে তুলল ম্যাগাজিনটা। প্রচ্ছদে লেখা। সঙ্গে ওটা কে? নিজের অজ্ঞাতেই একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল হীরকের গলা দিয়ে। দুঃখের কিছু শব্দ থাকে। অভিঘাত। তার কিছু শব্দ বুক গলা চিরে বাইরে বেরিয়ে আসে, হাওয়া ভারী করে ঝুলতে থাকে। কিন্তু অনেকখানি আটকে থাকে বুকের মধ্যে। বুকের খাঁচায় ঘোরাফেরা করে, ফুসফুস কামড়ে ধরে, হৃদয়ের অলিন্দে ঘনঘন ধাক্কা মেরে সবকটা কপাট খুলে দিতে চায়। জেগে থাকে চারদিক বন্ধ করা গুমগুম শব্দ।

লেখার পাশের মেয়েটির মুখ ঝলসে বীভৎস হয়ে চামড়া কুঁচকে রয়েছে কপাল, গাল, গলা। একদিকের চোখে পাতা বাকি নেই একটুও। মুখের হাসিটাও কি বিকৃত লাগছে! শুধু ডান চোখটার ক্ষতি হয়নি, এমনকি ভুরুর সেই কাটা দাগটাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রেখা!

কী নিদারুণভাবে সেই অপূর্ব সুন্দর মুখের সমস্ত রূপ কেড়ে নিয়েছে অ্যাসিডের নির্মম আঁচড়। আর দেখতে পারছিল না হীরক। যে ভয়ের থেকে পালাতে চেয়েছিল, আজ সেই ভয় দুহাতে তার গলা টিপে ধরেছে। এখন গলা দিয়ে তাই শুধু ভুসভুসে আওয়াজ বেরোচ্ছে। ফেটে যাওয়া বাঁয়া তবলার মতো। খুব কান পেতে শুনলে বোঝা যায় সেটা নির্জন দুপুরে শুকনো পাতার শনশনানির মতো খালি একটি শব্দেই বাজছে— রেখা।

হীরক ছুটছিল। দরজা খুলে হোঁচট খেতে খেতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। ড্রয়িংরুমে বসে থাকা কারও দিকে চোখ ফেরানোর অবকাশ ছিল না। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে ছুটছিল হীরক।

পিছনে রেখারা ছুটে আসছিল। রেখা, শানু, তীর্থদা এমনকি অতীনদাও।

রেখা বলছিল, পারলি না হীরু। তুই আমার পাশে দাঁড়াতে পারিসনি। যখন আমার তোকে সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল, তুই এসে আমার হাত ধরলি না কেন রে হীরু? আমি জানি, খুঁজেপেতে এসে পড়লেও পারতি না। এইভাবে দৌড়ে পালাতিস ঠিক। যতটা ভালবাসলে কুরূপকে আপন করে নেওয়া যায়, অতটা ভালবাসার ক্ষমতা বেশি মানুষের থাকে না।

কানে হাত চাপা দিয়ে হীরক ছুটছিল। এক অন্য হীরক গোঙাচ্ছিল গলার ভিতর। আমার যে একটা সাজানোগোছানো সুখী জীবনের খোঁজ ছিল রেখা। নিটোল, নিখুঁত ছবির মতো। আমি জানতাম না তোকে সেখানে কীভাবে জায়গা দেব।

শানু দুহাত তুলে ডাকছিল। তুই আমার ফোন তুলিস না কেন হীরু? কথা দিলি, কিন্তু রাখলি না। আমার জীবন থেকে যখন সব হারিয়ে যাচ্ছিল, তুই কিন্তু আমার পাশে এসে দাঁড়াতে পারতিস। পারতিস না, বল? একটা অনিশ্চিত ভয়ের হাত আমার গলা টিপতে আসত। তোরা আমাকে সাহস দিতে পারতিস। আমি পাহাড়ের উলটো খাড়াই দিয়ে চূড়ায় ফিরে আসার চেষ্টা করছিলাম হীরু। তোরা কেউ যদি একটা দড়ি ছুড়ে দিতিস, আমি ফিরে আসতাম। চেষ্টা তো করতাম!

আমার নিজের যে ওই একই চূড়ায় পৌঁছানোর ছিল শানু। সময় যে অল্প, কী পড়ার চাপ। জীবনের তরতরিয়ে উঠে যাওয়া সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখার লোভ। আমরা সবাই তখন ছুটছিলাম। একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে যে পড়ে থাকা সাথীর হাত ধরে তুলব, কোথায় সে ফুরসৎ? আমাদের প্রতিযোগিতার জয়রথ তাহলে আমাকে ফেলে পালিয়ে যেত না?

তীর্থদা দাঁড়িয়ে ছিল বুকের উপর দুই হাত জড়ো করে। মুখে মিটমিট হাসি। পারলি না তো হীরক সমাজের মার থেকে নিজেকে বাঁচাতে। তুই ভেবেছিলি সমাজের সমস্ত সমস্যার সমাধান অন্য কেউ করবে আর তুই রাজকন্যা নিয়ে রাজত্ব করবি। বল, তাই ভেবেছিলি না? কিন্তু দ্যাখ, পারা যায় না। সমাজের ওই হাতটা বাধা না পেতে পেতে এত বড় আর লম্বা হয়ে যায় যে সুদূর আমেরিকায় জয়পতাকা উড়ানো রাজকুমারের রাজত্বেও থাবা বসাতে পারে।

তীর্থদা, চলে যাও তুমি সামনে থেকে। সব বাতেলা। তোমাদের আদর্শ মিথ্যে, স্বপ্ন মিথ্যে। তোমার কোথাও পৌঁছাতে পারোনি, কোনওদিন পারবে না। কেন আমি সেই অন্ধ মিছিলে সামিল হব? অতীনদার মতো গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় পড়ে থাকার জন্য?

অতীনদা তার গুলিবিদ্ধ শরীরটাকে টানতে টানতে হীরুর সামনে উঠে দাঁড়াল। হীরু, তুই কি বোকা রে! আমি কি শরীরে গুলি বিঁধে পড়েছিলাম তোকে ভয় দেখানোর জন্য?  আমি গুলি বুকে নিয়ে আমার স্বপ্নের মৃত্যু দেখতে চাইনি। আমি উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলাম তোদের। চেয়েছিলাম তোদের বুকেও বিপ্লবের আগুন জ্বালতে। তুই আমার মৃত্যুটাকে এমনভাবে ব্যর্থ করে দিলি কেন হীরু?

তোমার ইচ্ছে হয়েছে, বিপ্লব করেছ, গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মরেছ। তোমাকে তো তোমার সঙ্গীসাথীরাই মেরেছে। নিজেরা কামড়াকামড়ি করে মরেছ। আমার কোন দায় পড়েছে সেই ঝান্ডা তুলে ভুল পথে দৌড়ানোর। হীরক ফুসফুস থেকে সমস্ত হাওয়া আহরণ করে চেঁচাল।

হীরক সুখী জীবনে বাঁচতে চেয়েছিল। অন্নপ্রাশনের পিতলের থালায় ফুলপাতা দিয়ে লেখা সুখে থাকো আশীর্বাণীকে সফল করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। নীলিমা সারাটা জীবন এক মাসের মধ্যপথ থেকে অন্য মাসের শুরুর দিকে তাকিয়ে সংসারযাপনে জোড়াতালি দিয়েছে। হীরক সেই খামতি পোরাতে চেয়েছিল। বিমল চ্যাটার্জিসাহেবের মতো হতে চেয়েছিল। দেশভাগের সময় সব স্বপ্ন দেশের মাটিতে পুঁতে রেখে এসে মেকানিক হতে হয়েছে। সেই আধাফোটা স্বপ্ন হীরক নিজের জীবনে যখের ধনের মতো আগলে রাখতে চেয়েছিল। লম্বা লম্বা ফোঁড়ে জীবনের রঙিন ছবি তুলে আনতে চাইছিল কাঁথাশিল্পীর নৈপুণ্যে। নীল জ্যোৎস্না রাতে থালার মতো চাঁদখানা দুহাতের দশ আঙুলের বেড়ে আবজে ধরে জীবনের পূর্ণতার সন্ধান করেছে। চাঁদটা গলে গলে এমন অমাবস্যার মুখোমুখি করে দেবে কী করে জানবে হীরক?

হীরক ছুটছিল, প্রাণপণে। সারাজীবনই তো দৌড়েছে। কিন্তু সে দৌড়ে একটা ছন্দ ছিল, একটা উদ্দেশ্য ছিল, যত্নে গড়া একটা দিগদর্শক ছিল। চোখে ঠুলি লাগিয়ে একবগগা ঘোড়ার মতো ছুটেছে। কিন্তু আজকের দৌড় বড় এলোপাথাড়ি। পথ খুঁজে না পাওয়া এক অসহায় বালকের মতো। হীরকের গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছা করছিল। বলতে চাইছিল হারিয়ে গেছি আমি।

চারপাশে ম্যানহাটানের জনারণ্য। প্রাণচঞ্চল, সরব। অথচ হীরকের মনে হল চারদিক খাঁ খাঁ পরিত্যক্ত শ্মশানভূমি। এক অদ্ভুত ঘোর। হীরকের মধ্যেকার মানুষটি যেন ধীরে ধীরে পেঁয়াজের খোসার মতো উন্মুক্ত হচ্ছে। অন্তরমহলের কপাট খুলছে। যা অস্বীকার করেছে, দূরে ঠেলে দিয়েছে, যুক্তির খেলায় জয় করেছে সেইসব পরাজিত চিন্তারা আজ জয়ের স্বাদ পেয়েছে। তারা উঠে আসছে। হাত ধরে টানছে। বুকের মধ্যে ফিসফিস করে উসকাচ্ছে, ফের, হীরু ফের! রক্তপান না করে ছায়াপাখি শরীর পায় না।

 

(‘নীল হ্রদের তীরে’ সমাপ্ত। আগামী সংখ্যায় অন্তিম অধ্যায়ের সূচনা)