সৌম্য মণ্ডল
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেশের মানুষ কপাল চাপড়ে বলে— কোন দেশে যে জন্মেছি রে ভাই! চিন সহ অন্যান্য অবাধ্য দেশগুলোর মোটামুটি এরকমই একটা চিত্র হাজির করতে চায় পশ্চিমি মিডিয়া। বলশেভিক বিপ্লবের পর যে উদ্ভট গালগল্পের প্রাতিষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয়, শীতল যুদ্ধের সময়ে যা আরও উদ্ভটতর হয়ে ওঠে, সোভিয়েত পতনের পর যা কিছুটা কমে আসে, তা আবার শুরু হয়েছে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শি জিনপিং-এর আমলে এক সুপারপাওয়ার হিসেবে চিনের উত্থানের মধ্যে দিয়ে। বিশেষজ্ঞরা যাকে বলছেন কোল্ড ওয়ার ২.০।
এই কোল্ড ওয়ার ২.০-কে আমরা দেখতে পাই নিউইয়র্ক টাইমস সহ বিভিন্ন পত্রিকায় কিছু সাংবাদিকের ছবি ছেপে তাদের চিনের চর হিসেবে অভিযুক্ত করার মধ্যে দিয়ে। টুইটারের দ্বারা চিন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশের সরকারি বেসরকারি নির্বিশেষে সংবাদমাধ্যম, এমনকি রেডফিশের মত সংবাদমাধ্যমগুলোর হ্যান্ডেলের তলায় “স্টেট এফিলিয়েটেড মিডিয়া” লিখে রাখার মধ্যে দিয়ে। অন্যদিকে আমেরিকা বা ইউরোপীয় সরকারগুলোর সহায়তাপ্রাপ্ত বা সরকারি সংস্থাগুলোকে স্টেট এফিলিয়েটেড বলে দেগে দেওয়া হয় না।
এই কোল্ড ওয়ার মানসিকতা আমরা দেখতে পাই যখন নিয়ম করে মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলোতে কার্পেট বম্বিং করা আমেরিকা চিনে উইঘুর মুসলিমদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে মরাকান্না জোড়ে। বলাবাহুল্য উইঘুর ইস্যুতে চিনকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনঠাসা করাটাই আমেরিকার উদ্দেশ্য। যদিও দেখা গেল প্রমাণহীন উইঘুর নির্যাতনের ভুয়ো গল্পের প্লাবনের মাঝেই ২০২২ সালের মার্চ মাসে ৫৭টি সদস্য দেশবিশিষ্ট অরগানাইজেশান ইসলামিক কোওপারেশনের (OIC) কনফারেন্সে প্রথমবারের মত আমন্ত্রিত হল চিন।
আমরা মূল ধারার খবরে এও দেখলাম যে চিনে নাকি ব্যাঙ্ক বাঁচাতে ট্যাঙ্ক নামানো হয়েছে! একটি গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রতারনার বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষোভ ঠেকাতে ট্যাঙ্ক নামাবার খবর সম্পর্কহীন ভিডিও সহ ব্যাপক প্রচার হল। দেদার শেয়ারও হল। কেউ যৌক্তিকতা ভেবে দেখলেন না!
আমরা দেখলাম সেনা অভ্যুত্থানে শি জিনপিংকে ক্ষমতাচ্যুত করার গল্প তিন-চার দিন ধরে মুলধারার সংবাদমাধ্যমে রটানো হল। এই নিয়ে চিনা পার্টি, সরকার বা শি কোনও বিবৃতিও দিলেন না। কারণ সম্ভবত বিগত ৭৫ বছরে অপপ্রচার শুনতে শুনতে তাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। তারপর স্বাভাবিকভাবেই কোয়ারেন্টাইন থেকে বেরিয়ে এসে শি পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি কর্মসূচি আরম্ভ করে দিলেন। এবং তৃতীয়বারের জন্য সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন।
সর্বশেষ প্রপাগান্ডা যুদ্ধের নমুনা হল চিনের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, যিনি বৃদ্ধ হয়েছেন, পার্টি কংগ্রেস চলাকালীন অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে, অন্য এক পার্টিকর্মীর হাত ধরে বিশ্রাম নিতে নিয়ে যাওয়ার ভিডিওকে, জোর করে হু-কে পার্টি কংগ্রেস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বলে প্রচার করা। যদিও হু আগের কংগ্রেসের পর পলিটব্যুরো বা স্ট্যান্ডিং কমিটিতে ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তাঁকে তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে শি-এর পাশেই বসানো হয়েছিল। একজন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে গোটা দুনিয়ায় মিডিয়ার এই কূটকাচালি সাংবাদিকতার অসুস্থতার নমুনা নয় কি?
ভারতের বেশ কিছু মিডিয়ার ক্ষেত্রে একটা মজার জিনিস দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এই মিডিয়ারা প্রচণ্ডভাবে মোদি সরকারের সমর্থক। কিন্তু মোদি সরকারের বিদেশনীতি যখন আমেরিকা বা ইজরায়েলের অনুসারী হয় না তখন তারা মোদি সরকারের সমালোচনা করে থাকে। বোঝাই যায় যে তাদের টিকি কোথায় বাধা আছে।
প্রপাগান্ডা যুদ্ধ যে প্রায়সময় যুদ্ধের প্রপাগান্ডা হয়ে দাঁড়ায়, তার অসংখ্য উদাহরণ আছে। যেমন ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মিথ্যা অভিযোগে যুদ্ধ বাধিয়ে দেশের রাষ্ট্রপতিকে ফাঁসি দিয়ে, লাখ লাখ মানুষকে খুন করে, সভ্যতাকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হল। কিন্তু গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পরেও কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রপতির আন্তর্জাতিক আদালতে কোনও বিচার হল না।
বিশেষত চিন যেহেতু ভারতের প্রতিবেশী দেশ তাই চিনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির প্রভাব ভারতের জনগণের উপর পড়তে বাধ্য। বেপাড়ার কুখ্যাত গুন্ডা-দাদা যদি প্রতিবেশীর সম্বন্ধে কানে বিষ ঢালে তবে অবশ্যই তা নিয়ে সতর্ক থাকতেই হয়। কারণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিটা প্রতিবেশীদেরই হবে।
মাও সেতুং শত্রুর আয়নায় নিজেকে চিনে নেওয়ার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ভাল। মাও-জমানাতেই শেষের দিকে কোল্ড ওয়ারের প্রেক্ষিতে দুনিয়ার পয়লা নম্বর দুশমন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে শত্রুতা লঘু হতে শুরু করেছিল। নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য পদ পেয়েছিল চিন। পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে মার্কিন পুঁজিকে ডেকে আনে মাও-পরবর্তী চিনা নেতারা। চিনে পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই (চিনা নেতারা যাকে সমাজতন্ত্রের বস্তুগত প্রেক্ষাপট প্রস্তুত করা মনে করেন) চিনবিরোধী প্রচার কমে আসছিল। কিন্তু শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই আবার ব্যাপকভাবে ঠান্ডা যুদ্ধ পরিস্থিতির বিকাশ হতে শুরু করল দুনিয়া জুড়ে। মাও-এর পর শি জিনপিং ছাড়া আর কোনও চিনা নেতা পশ্চিমি মিডিয়ার প্রচারের দ্বারা এইভাবে আক্রান্ত হননি। সম্ভবত লেনিন, স্তালিন, মাও-এর পর শি জিনপিং-ই হতে চলেছেন কর্পোরেট মিডিয়ার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত কমিউনিস্ট নেতা। কিন্তু কেন এমন ঘটছে? ব্যবসায়ীদের থেকে পরিস্থিতির জরিপ সবচেয়ে ভাল আর কে-ই বা করতে পারে? দেখা যাক “শত্রু” অর্থাৎ বৃহৎ আন্তর্জাতিক বুর্জোয়াদের পত্রিকাগুলো কী বলছে?
সম্ভ্রান্ত বুর্জোয়া পত্রিকা টাইম ম্যাগাজিনে ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত প্রবন্ধে লেখা হয়েছে—
For the last 40 years, we have assumed China was becoming more like “us”— abandoning the shackles of communism, and adopting the “free” market. Thus, Xi’s moves have been a surprise to many savvy observers of China, including top strategists in the White House.
China’s growth over the past four decades has positioned state capitalism as a durable foil to the orthodoxy of free markets. Our last 40 years of assumptions in dealing with China have been shown to be wrong. As Xi moves into his third term, we need to examine Mao’s ideas and ideals for a more accurate perspective on how China will be governed in the future. Knee-jerk condemnation as a result of our own ideologically driven blind-spots will only lead to a misunderstanding of China and its ambitions. Accurate knowledge is the foundation of a more effective policy of engaging with America’s most serious long-term competitor. As Sun Tzu said more than two thousand years ago, “know the enemy and yourself; in a hundred battles you will never be in peril.[1]
৪ ডিসেম্বর ২০২০ টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় China Buries Deng Xiaoping: Xi may have over-reached. His ‘getting strong is glorious’ strategy triggers global backlash শিরোনামে অনুরাগ বিশ্বনাথ-এর প্রবন্ধে লেখা হয়েছে—
China’s post-1978 success was built on Deng ‘burying Mao’, ushering in China’s ‘second revolution’. Today, Deng may be at the receiving end, being buried by Xi Jinping’s ‘third revolution’.[2]
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে রাম মাধবের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে যার শিরোনাম Undoing Deng, Xi returns to Mao’s coterie, Stalin’s brutality.[3]
৭ জুন ২০২২ ব্লুমবার্গে টম হ্যানকক লিখেছেন— Marxism Makes a Comeback in China’s Crackdown on ‘Disorderly Capital’.[4]
২০ সেপ্টেম্বর ২০২১-এ Xi Jinping Aims to Rein In Chinese Capitalism, Hew to Mao’s Socialist Vision শিরোনামে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি প্রবন্ধে লেখা হয়েছে—
The message was clear: In today’s China, Marxism is back, and investors had better take note.[5]
বুর্জোয়ারা যেটাকে হঠাৎ করে চিনের মার্কসবাদী বা মাওবাদী বাঁক হিসেবে দেখছেন, চিনের “সমাজতন্ত্রে”র ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখলে (ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা চক্রান্তনির্ভর অতিবাম বা বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে) বোঝা যাবে চিনা কমিউনিস্টদের সুদীর্ঘ পরিকল্পনার ফলই হল আজকের শি-এর ‘বাম বাঁক’। সমাজতন্ত্র হওয়ার কথা ছিল উন্নত পুঁজিবাদী সমাজে। কিন্তু বাস্তবে শ্রমিকরা ক্ষমতায় এল রাশিয়া, চিনের মত দেশে, যেখানে পুঁজিবাদটাই ঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। এইরকম অ-পরিণত পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্র গড়ার কঠিন কাজটা কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন নেতারা। আর সেই পরীক্ষানিরীক্ষা থেকেই সমৃদ্ধ হয়েছে মার্কসবাদ। সেই পরীক্ষানিরীক্ষার জোরেই চিন সহ বেশ কিছু দেশ বিপ্লবকে টিঁকিয়ে রাখতে পেরেছে। এক সময়ে ব্যাপক অগ্রগতির পর সোভিয়েত শিবিরের বা চিনের অর্থনীতির স্থবিরতা তাত্ত্বিকদের নানাভাবে ভাবিয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে মাও প্রযুক্তি, উৎপাদনশীলতা বা দক্ষতার অভাবকে মেটাতে চাইলেন জনগণকে মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করে। অন্যদিকে দেং মনে করতেন চিনের মত পশ্চাৎপদ দেশে এক পাত্র থেকে সবার খাওয়ার ধারণা, সবার সমান উন্নতি, সমস্ত দেশের এক সঙ্গে উন্নতি বা মাও-এর “কমন প্রস্পারিটির” কর্মসূচি এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চারিজম। সারপ্লাস সম্পদ এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত না হয়ে ছড়িয়ে পড়লে উৎপাদিকা শক্তির দ্রুত বিকাশ সম্ভব নয়। ফলত চিন পিছিয়েই থাকবে, সমৃদ্ধ সমাজতন্ত্রে কখনওই পৌঁছাতে পারবে না। উৎপাদিকা শক্তির অতি দ্রুত বিকাশ ঘটাতে হবে। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই উৎপাদন সম্পর্ক বদলাতে পারে। দেং এই ধারণা রাখলেন যে প্রথমে কিছু মানুষ বড়লোক হবে, তারপর সবাই বড়লোক হবে, প্রথমে কিছু অঞ্চল উন্নত হবে তার পর সমস্ত অঞ্চল উন্নত হবে। মাও মনে করতেন সমাজতন্ত্রেও শ্রেণিসংগ্রাম প্রধান। অন্যদিকে দেং মনে করতেন শ্রেণিসংগ্রামকে অস্বীকার করলে সমাজতন্ত্র টিঁকবে না। কিন্তু বর্তমানে যেহেতু শ্রমিকরা ক্ষমতায় আছে তাই উৎপাদিকা শক্তি বা প্রযুক্তির পশ্চাৎপদতার সঙ্গে জনগণের জীবনের মান উন্নয়নের দ্বন্দ্বটাই প্রধান।
ইউরোপ আমেরিকা কয়েকশো বছর ধরে পৃথিবীতে লুটপাট চালিয়ে তাদের পুঁজিবাদী বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করেছে। কিন্তু চিনে দ্রুত প্রযুক্তির বিকাশের জন্য এই সম্পদ আসবে কোথা থেকে? চিনে ব্যাপকভাবে বিদেশি পুঁজি, প্রযুক্তি ডেকে আনা হল। কিন্তু বিদেশি পুঁজির কাছে দেশ বিকিয়ে গেল না।
পুঁজি শ্রমের সঙ্ঘাতে শ্রমের দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়িয়ে রাখল শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র। বাজারকে ব্যবহার করা হল শ্রমিক পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপকভাবে দক্ষতা বৃদ্ধিতে। ভারতে হয়েছে ঠিক তার উলটো। এখানে খোলা বাজারের নামে সরকার নিজেই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডোবাবার পরিকল্পনা করে থাকে। ২০০৮-এর সঙ্কটের পর থেকে চিনা কমিউনিস্টরা উপলব্ধি করলেন যে চিনের ব্যাপকভাবে প্রযুক্তি বা উৎপাদিকা শক্তির উন্নতি ঘটেছে। চিন এখন আর সস্তা শ্রমের পশ্চাৎপদ দেশ নেই। পণ্যবৈচিত্রে সমৃদ্ধ এক সমাজে পরিণত হয়েছে। জনগণের জীবনের মানের খুব দ্রুত উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ব্যাপক ধনবৈষম্য। পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় সমস্যাগুলোকেও ডেকে এনেছে।
এই প্রেক্ষিতে ক্ষমতায় আসলেন শি জিনপিং। ১৯৮১ সালের পরে ২০১৭ সালের পার্টি কংগ্রেসে দেশের প্রধান দ্বন্দ্ব বদলাল। নতুন দ্বন্দ্ব হল বৈষম্যমূলক উন্নয়নের সঙ্গে উন্নত সমাজতান্ত্রিক জীবনযাপনের দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ কিছু মানুষ বড়লোক হয়েছে, এবার সবাই বড়লোক হবে, দেশের কিছু অঞ্চল ব্যাপক উন্নতি করেছে, এবার গোটা দেশের উন্নতি করার সময়। এখন পার্টির লক্ষ্য হল আয়-বৈষম্য কমানো, পরিবেশ রক্ষা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে বাড়িয়ে চলা ইত্যাদি। শি ফিরিয়ে আনলেন মাও-এর কমন প্রস্পারিটির কর্মসূচি। বার বার পার্টির যুব কর্মীদের মনে করাতে থাকলেন— আমরা আমাদের মূল উদ্দেশ্য যেন ভূলে না যাই। শি-এর কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা পরিসর বর্তমান প্রবন্ধে নেই। তবে পশ্চিমি মিডিয়ার চিন-বিরোধী প্রপাগান্ডার অভিযোগগুলোকে ভাল করে বিশ্লেষণ করলেও বিরাট কর্মযজ্ঞের অনেকটাই হদিস পাওয়া যায়।[6]
চিনের অভ্যন্তরীণ এই পরিবর্তন প্রতিফলিত হয় তার বিদেশনীতিতেও। ৩ ধরনের লোন বিভিন্ন দেশ চিনের কাছে পেয়ে থাকে। উচ্চ সুদে বেসরকারি লোন, কম সুদে সরকারি লোন আর শূন্য সুদের সরকারি লোন। এই সরকারি লোনগুলো নমনীয় শর্তে দেওয়া হয়ে থাকে। বিদেশি লোন আমেরিকা বা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোও দিয়ে থাকে। পশ্চিমিরা লোন দেওয়ার সঙ্গে আরও বিভিন্ন শর্ত দিয়ে থাকে। লোনপ্রাপ্ত গরিব দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, কৃষি সমস্ত কিছুকে নির্ধারণ করে দেওয়ার অন্যায় আবদার থাকে সাম্রাজ্যবাদীদের লোনে। ঋণদাতাই ঠিক করে দেবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পরিবহনে বা কৃষি উপকরণে সরকার ভর্তুকি দেবে কি দেবে না? কী হবে পেটেন্ট নীতি। একে কর্পোরেট মিডিয়া আর বুদ্ধিজীবীরা স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট বলে থাকে, একই জিনিসকে চিনের ক্ষেত্রে বলা হয় ঋণের ফাঁদ। যদিও চিনের লোনের শর্তে চিনা সংস্থাকে দিয়ে কাজ করাবার শর্ত ছাড়া অন্য কোনও শর্ত থাকে না। সাম্রাজ্যবাদীদের লোনগুলো দেওয়া হয়ে থাকে স্বল্পমেয়াদি লাভের ক্ষেত্রে, মূলত ফাটকা ক্ষেত্রে। অন্যদিকে চিনের লোন এসে থাকে পরিকাঠামো উন্নয়নে, যেখান থেকে এক্ষুনি মুনাফা আসার কোনও সম্পর্ক নেই। ফলত গরিব দেশগুলোকে চিনের আর্থিক সহায়তার ফলে বাজারের নিয়মেই সাম্রাজ্যবাদ পরিচালিত আর্থিক সংস্থাগুলো বিপদে পড়ছে। এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার দরিদ্র দেশগুলো সাম্রাজ্যবাদের নয়া-ঔপনিবেশিক আন্ডার ডেভেলপমেন্টের ফাঁদ ভেঙে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ব্যাপকভাবে দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে চিন। বিশ্বব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ-ভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তারা ২৮.৮ শতাংশ রপ্তানি বাড়িয়েছে গড়ে।[7]
বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর জন্য নিজের বিশাল বাজার খুলে দিয়েছে চিন। চিনা সরকারের ভাষায় যাকে বলে “উইন উইন সিচুয়েশন”। স্বাভাবিকভাবেই এই ঠান্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষিতে আমেরিকাপন্থী শিবিরের মতলব ভারতকে বা ভারতের জনমতকে চিনের জুজু দেখিয়ে আমেরিকার নয়া-ঔপনিবেশিক শোষণ জোরদার করা। সম্ভাব্য চিন-বিরোধী যুদ্ধে আমাদের দেশের যুবসমাজকে কামানের খোরাক বানানো। কিন্তু অন্যদিকে ভারতের জোটনিরপেক্ষ অবস্থান অন্যান্য দেশের মত ভারতেরও দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়াতে পারে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে।
আমেরিকা বা ইউরোপ যে উন্নতি করতে কয়েকশো বছর সময় লাগিয়েছে চিন এই উন্নতি করেছে মাত্র ৪০ বছরে। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে শ্রমিকশ্রেণির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়া এই দ্রুত বিকাশ সম্ভব ছিল না। সুতরাং ইউরোপ-আমেরিকার থেকে চিনের পুঁজির সঙ্কট অনেক বেশি। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকায় সঙ্কটগ্রস্ত পুঁজিবাদ ক্রমাগত সব কিছুর আরও উদারিকরণ করেছে, পুঁজিপতিদের আরও বেশি ছাড় দিয়েছে, ফাটকা খেলায় ঢুকে গেছে। অন্যদিকে চিনে হয়েছে ঠিক উলটো। চিনে সবচেয়ে বড় আবাসন জায়েন্ট দেউলিয়া হয়ে গেলে চিনা সরকার তাকে বেল-আউট করতে যায়নি। শি বলেছেন আবাসন জনগণের বসবাসের জন্য, ফাটকা খেলার জন্য নয়। শেয়ার মার্কেটকে প্রভাবিত করে ফাটকাবাজিকে কড়া হাতে দমন করতে জ্যাক মার মত ধনকুবেরদের উপর বিশাল অঙ্কের ফাইন চাপানো হয়েছে। ধনকুবেরদের উপর নজরদারি এমনকি জেলে ঢোকানোর অভিযোগে লাগাতার অভিযুক্ত হয়ে আসছেন শি। অন্যদিকে ব্যাপকভাবে শ্রমিকদের পরিচালিত সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করা হয়েছে। অলাভজনক খাতে সরকারি ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু কেন এমন হল? ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে চিনের এই বৈপরীত্যের কারণ সম্ভবত এই যে ইউরোপ-আমেরিকায় যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই অতি ধনী পুঁজিপতি। অন্যদিকে চিনে যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন বা আছেন, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা, তারা কেউই নিজেরা পুজিপতি নন, এঁরা হলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বা অভিজাত শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী। ফলে যে করে হোক পুঁজিবাদকে টিঁকিয়ে রাখার কোনও দায় এদের যেমন নেই, তেমনই সমৃদ্ধ সমাজে সমাজতন্ত্র হলে তাঁদের কোনও ক্ষতিও নেই। চিনের সঙ্গে আমেরিকা-ইউরোপের অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক নীতিকে নতুন কায়দার সাম্রাজ্যবাদ বলাটা অনেকটা গরুকে সিংযুক্ত ঘোড়া বলার মত। দুইয়ের মধ্যে থাকা বিস্তর পার্থক্যকে অনুধাবন না করতে পারলে শেষকালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থই সুরক্ষিত হয়। সোভিয়েত শিবিরের পতন যেমন দুনিয়া জুড়ে বাম আন্দোলনে হতাশা, বিষণ্ণতা ডেকে এনেছিল, তেমনই চিনের উত্থান আবার উৎসাহ জুগিয়েছে। লাতিন আমেরিকা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে বামশক্তির উত্থান ঘটছে। কারণ চিনের ঋণ এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক আমেরিকার ব্ল্যাকমেলিং বা নিষেধাজ্ঞার জোরকে ভোঁতা করে দিয়েছে। ট্রটস্কি যে কারণে জার্মানিতে দ্রুত বিপ্লবের আবদার জুড়েছিলেন, চিনের উত্থান সেই কারণটাকেই শেষ করে দিয়েছে। মাও বা স্তালিন যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সমাজতান্ত্রিক গঠনকাজ শুরু করেছিলেন, আগামী পৃথিবীতে নতুন বিপ্লবকে সেই প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে না। শুধু বামপন্থীরা নয়, বিভিন্ন দেশের রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থী শক্তিও আমেরিকার দাদাগিরির বিরুদ্ধে সুর চড়াতে পারছে।
চিনে মানুষের জীবনের মানের ব্যাপক উন্নতি হওয়ার ফলে সেখানে শ্রম আর সস্তা নয়। ফলত বিদেশি সংস্থাগুলো চিন থেকে চলে যেতে চায় সস্তা শ্রমের দেশে। চিন ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ ডেকে আনতে পেরেছিল কারণ একদিকে গরিব দেশ তাই শ্রম সস্তা, অন্যদিকে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক সরকারি ব্যবস্থাপনার জন্য শ্রমিকরা ছিলেন অত্যন্ত উৎপাদনশীল, দক্ষ। নতুন প্রযুক্তির জন্য শ্রমিকরা কাজ হারালে শিক্ষিত দক্ষ শ্রমিকদের সরকার খুব দ্রুত নতুন প্রযুক্তি বা নতুন ধরনের কাজের উপযুক্ত করে নিতে পারে। এখন চিন থেকে পুঁজি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ভারত সরকারের পক্ষে ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়ে এখানে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করা যেত যদি আমেরিকার কাছে মাথা নিচু না করে বেসরকারিকরণের বদলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ জনকল্যাণমূলক খাতে সরকারি খরচ বাড়িয়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে নজর দেওয়া যেত। যদি ভারত সরকারও চিনের মত বড় বাজারকে কাজে লাগিয়ে দরকষাকষির ভিত্তিতে দেশের শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থরক্ষা করতে পারত। অবশ্য তার জন্য এমন একটা সরকার প্রয়োজন যারা অতিধনী ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করার বদলে দেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবে। একচেটিয়া পুঁজির হাত থেকে নতুন উদ্ভাবক স্টার্টআপগুলোকে রক্ষার জন্য আইন বানাবে। জোটনিরপেক্ষ নীতি বজায় রেখে চিনের সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক প্রতিযোগিতার বদলে মার্কিন শিবিরে ভারতকে সামিল করার যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে তার ফলে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ শুধু হাতছাড়া হবে না, সেটা দেশের ব্যাপক মানুষে জীবনের মান উন্নয়নের পক্ষেও সহায়ক হবে না বলাবাহুল্য।
[1] Marquis, Christopher. What Xi Jinping Draws from Mao’s Legacy. TIME. Oct 13, 2022.
[2] Viswanath, Anurag. China Buries Deng Xiaoping… triggers global backlash. TOI. Dec 4, 2020.
[3] Madhav, Ram. Undoing Deng, Xi returns to Mao’s coterie, Stalin’s brutality. The Indian EXPRESS. Sep 10, 2022.
[4] Hancock, Tom. Marxism Makes a Comeback in China’s Crackdown on ‘Disorderly Capital’. Bloomberg. Jun 7, 2022.
[5] Wei, Lingling. Xi Jinping Aims to Rein In Chinese Capitalism, Hew to Mao’s Socialist Vision. The Wall Street Journal. Sep 20, 2021.
[6] Vaswani, Karishma. Changing China: How Xi’s ‘common prosperity’ may impact the world. BBC News. Oct 7, 2021.
[7] Devonshire-Ellis, Chris. China’s Belt And Road Initiative Member Countries: Exports Up 28% In Three Years. Silk Road Briefing. Nov 11, 2020.