Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সদর্থক পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে, তবে এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি

স্বাতী মৈত্র

 



অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

বিসিসিআইয়ের সেক্রেটারি, জয় শাহ, গত ২৭ অক্টোবর একটি টুইটে ঘোষণা করেন যে তাঁরা ভারতীয় ক্রিকেটে লিঙ্গভিত্তিক বেতন-অসাম্য ঘুচিয়ে দেওয়ার পথে একটি প্রথম পদক্ষেপ নিতে চলেছেন। মেয়েদের জাতীয় ক্রিকেট দল এরপর থেকে সমস্ত আন্তর্জাতিক খেলায় পুরুষদের সমান পারিশ্রমিক পাবেন। অর্থাৎ, টেস্ট ম্যাচ খেলবার জন্য তাঁরা ৪ লাখ টাকার বদলে ১৫ লাখ টাকা পাবেন, একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলবার জন্য জন্য তাঁরা ১ লাখের বদলে ৬ লাখ টাকা পাবেন, এবং টি-২০ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলবার জন্য তাঁরা ১ লাখ টাকার বদলে ৩ লাখ টাকা পাবেন। সমকাজে সমবেতনের এই নীতি লিঙ্গনির্বিশেষে ক্রিকেটমহলে প্রশংসা পেয়েছে। মহিলা দলের অধিনায়ক, হরমনপ্রীত কৌর, এই পদক্ষেপকে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট ইতিহাসে ‘রেড লেটার ডে’ আখ্যা দেন। শচীন তেন্ডুলকর বলেন, ক্রিকেটজগতে লিঙ্গসাম্য আনবার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ এই পদক্ষেপ।

এ কথা উল্লেখযোগ্য যে ভারতীয় ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক স্তরের খেলোয়াড়দের রোজগারের মধ্যে ম্যাচ ফি একটি অংশ মাত্র। পুরুষ এবং মহিলা খেলোয়াড়দের রোজগারের সর্ববৃহৎ অংশ তাঁদের কেন্দ্রীয় চুক্তির অর্থ। বিসিসিআইয়ের তরফ থেকে কিছু বাছাই করা খেলোয়াড়দের বাৎসরিক চুক্তি দেওয়া হয়। এর ফলে তাঁরা চোট-আঘাত পেয়ে ম্যাচ খেলতে না পারলে অথবা কোনও কারণে দল থেকে বাদ পড়লেও তাঁদের রোজগারে সমস্যা হয় না, তাঁরা নিশ্চিন্তে খেলায় ফিরে আসতে পারেন। এক্ষেত্রে কিন্তু বৈষম্য থেকেই যায়। মহিলা খেলোয়াড়দের মধ্যে উচ্চতম গ্রেডের খেলোয়াড়রা যত টাকা পান, তা পুরুষদের নিম্নতম কন্ট্র্যাক্টের থেকেও কম। মহিলা ক্যাপ্টেন হরমনপ্রীত কৌরের চুক্তি যেমন বছরে ৫০ লাখ টাকার। পুরুষ ক্যাপ্টেন রোহিত শর্মার চুক্তির অঙ্ক সেখানে বছরে ৭ কোটি টাকা। ম্যাচ ফি যদি লিঙ্গসাম্যের পথে বিসিসিআইয়ের প্রথম পদক্ষেপ হয়, তাহলে আশা করে যায় বোর্ডের তরফ থেকে এই বৈষম্য মেটানোর চেষ্টাও অচিরেই করা হবে। এ ছাড়াও, বোর্ডের বার্ষিক রোজগারের ১৩ শতাংশ পুরুষ আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা পান, ১০.৩ শতাংশ পুরুষ ঘরোয়া খেলোয়াড়রা পান, এবং ২.৭ শতাংশ ভাগাভাগি করে দেওয়া হয় মহিলা ও জুনিয়র দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে। এ ক্ষেত্রেও যে বৈষম্য ভয়ঙ্কর, তা বলাই বাহুল্য।

মহিলা খেলোয়াড়দের রোজগারের পথে আরও একটি বৃহৎ বাধা ম্যাচ খেলবার সুযোগ। গত এক বছরে ভারতীয় পুরুষ দল ৮টি টেস্ট ম্যাচ, ১৮টি একদিনের ম্যাচ ও ৪০টি টি-২০ ম্যাচ খেলেছে। সেখানে মেয়েদের দল একটিও টেস্ট খেলেনি, ১৮টি একদিনের ম্যাচ ও ২৩টি টি-২০ ম্যাচ খেলেছে। গত কয়েক বছরে বিদেশি দলগুলিও ভারতীয় মেয়েদের সঙ্গে খেলতে এ দেশে আসেনি। অতএব, খাতায়কলমে হরমন ও রোহিত যদিও দুজনেই টেস্ট ম্যাচ খেলবার জন্য ১৫ লাখ টাকা পাবেন, বাস্তবে হরমন হয়তো এক টাকাও টেস্ট খেলে রোজগার করবেন না। কারণ সেই খেলাই তো আয়োজন করা হয়নি! ম্যাচ আয়োজন করা যেহেতু বোর্ডের মূল কর্তব্যগুলির একটি, এই বিষয়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে প্রত্যাশা অনেক।

ভারতীয় বোর্ড কিছুদিন আগে মহিলা আইপিএল ঘোষণা করেছে। এ কথা খেয়াল রাখতে হবে যে মেয়েদের ডোমেস্টিক ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ভারত অন্যান্য দেশের থেকে অনেকটা পিছিয়ে এই মুহূর্তে। ভারতের মেয়েরাই অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লিগ অথবা ইংল্যান্ডের দা হান্ড্রেড মাতিয়ে দিয়ে আসেন, কিন্তু ভারতীয় দর্শকেরা তাঁদের সেইভাবে দেখার সুযোগ পান না। এর আগেই নিউজিল্যান্ড পুরুষ ও মহিলা দলের ম্যাচ ফি সমান করে দিয়েছে। ইংল্যান্ড আগামী কয়েক বছরে মহিলা ক্রিকেটের বাজেটে সাড়ে তিন লক্ষ পাউন্ড বৃদ্ধি ঘোষণা করেছে। অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হলে ভারতীয় বোর্ডকে আরও অনেক বেশি এ বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করতে হবে। নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে যেমন সমকাজে সমবেতনের নীতি কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক স্তরে নয়, জাতীয় স্তরেও ঘোষণা করা হয়েছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে অর্থ না থাকলে যে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নতি করা সম্ভব নয়, তা বলাই বাহুল্য। সে কথা মাথায় রেখে বিসিসিআই বহুদিন ধরেই পুরুষদের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার সুযোগ ও রোজগারে সুযোগ বৃদ্ধি করেছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে এখন সিনিয়র মেয়েরা দিনে ২০ হাজার টাকা পান। পুরুষ ক্রিকেটে সমপরিমাণ অর্থ দেওয়া হয় আন্ডার-১৯ খেলোয়াড়দের! মহিলা ক্রিকেটে ঘরোয়া স্তরে সমবেতন না হলে আগামী দিনের ক্রিকেটারদের উঠে আসা সহজ হবে না।

ভারতীয় বোর্ডকে মহিলা ক্রিকেটের প্রচার ও সম্প্রচার প্রসঙ্গেও আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। এ কথা যদিও সত্যি যে আজকের দিনে মেয়েদের খেলা আগের থেকে অনেকটা বেশি টিভিতে দেখা যায়, তাও পুরুষ ক্রিকেটের তুলনায় সেখানে প্রচার অনেকটাই কম বিসিসিআইয়ের তরফ থেকে। ঝুলন গোস্বামী বা মিতালি রাজের সেরা খেলাগুলো বহু ক্রীড়াপ্রেমীর দেখবার সৌভাগ্য ঘটেনি, কারণ তা আদৌ সম্প্রচার হয়নি। খবরের কাগজে তা নিয়ে লেখালিখিও সেরকম দেখা গেছে, তা নয়। অনেক সময় দেখা যায় যে বোর্ডের চেয়ে বেশি প্রচার প্রাক্তন খেলোয়াড় বা ক্রিকেটপ্রেমীরা করছেন, যা পুরুষ ক্রিকেটে অভাবনীয়। ইংল্যান্ডে সেখানে সচেতনভাবে মহিলা ক্রিকেট ও ফুটবলের প্রচার করবার ফলে জনপ্রিয়তা অনেকটাই বেড়েছে। এক টিকিটে পরপর হান্ড্রেডে মহিলা ও পুরুষ ম্যাচ দেখবার সুযোগ দর্শকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে, দেখা গেছে দর্শক মেয়েদের খেলা দেখতেও মাঠে ভিড় করে আসছেন। ম্যাচ খেলার ও দেখার সুযোগ না বাড়লে স্পনসর ও বিজ্ঞাপনদাতারা কেন এগিয়ে আসবেন, এ কথা বোর্ডকে ভেবে দেখতে হবে।

সব মিলিয়ে এ-কথা বলা যায় যে যদিও সমকাজে সমবেতনের নীতি হিসাবে ভারতীয় বোর্ডের মহিলা খেলোয়াড়দের সমান ম্যাচ ফি দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, সার্বিকভাবে মহিলা ক্রিকেটের উন্নয়নের প্রশ্নে ভারতীয় বোর্ড এখনও অনেকটাই পিছিয়ে। বোর্ডে ও অন্যান্য প্রশাসনিক সংস্থানেও মেয়েদের প্রভাব বা অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে, যার ফলে মহিলা ক্রিকেট অনেকটাই ব্রাত্য হয়ে রয়েছে। আইপিএলের চিয়ারলিডারদের কেন্দ্র করে নগ্ন উল্লাস অথবা ধারাভাষ্যকার মন্দিরা বেদিকে কটাক্ষ করার দিন হয়তো ভারতীয় ক্রিকেটে আর নেই, তবে এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি।