Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নোবেল ২০২২: পদার্থবিদ্যা— কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তাৎপর্য বোঝার পথে আরও এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

 



পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

 

২০২২ সালের পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কার একই সঙ্গে গাণিতিক, পরীক্ষামূলক, এবং সর্বোপরি দার্শনিক তাৎপর্য আছে এমন এক বিষয়ের উপর আলো ফেলেছে; বাস্তবজগতের চরিত্রের উপর গবেষণার জন্যই এই পুরস্কার। বিষয়টা পুরোপুরি বুঝতে গেলে উচ্চতর গণিত প্রয়োজন, এই সীমিত পরিসরের লেখাতে সেই আলোচনার সুযোগ নেই। পুরস্কার যাঁরা পেয়েছেন প্রত্যেকেই পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন, কিন্তু সেই সমস্ত পরীক্ষা সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। তবে পরীক্ষাগুলি এতই অসাধারণ যে তা নিয়ে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছা আছে। তাই এই লেখা শুধু যে সমস্যা সমাধানের জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তার আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। গোড়াতেই স্বীকার করে রাখি এই লেখাতে আমি পলাশবরণ পালের ‘বিজ্ঞান: ব্যক্তি যুক্তি সময় সমাজ’ বই থেকে প্রচুর সাহায্য নিয়েছি।

একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। ধরুন আমার হাতে একটা বন্দুক আছে। সামনে আছে একটা দেওয়াল যার মধ্যে পাশাপাশি সমান্তরালভাবে দুটো লম্বাটে গর্ত আছে, তার পিছনে আছে আর একটা দেওয়াল। আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ছি, কিছু গুলি নিশ্চয় ওই দুটো গর্ত দিয়ে গিয়ে পিছনের দেওয়ালে আঘাত করবে। বুঝতে অসুবিধা নেই যে পিছনের দেওয়ালে মাত্র দুটি লম্বাটে এলাকার মধ্যে গুলির চিহ্ন সীমাবদ্ধ থাকবে।

এবার বন্দুকের জায়গায় রাখলাম একটা ইলেকট্রন গান, যার থেকে গুলির বদলে বেরোবে ইলেকট্রন। দুনম্বর দেয়ালের জায়গায় এমন একটা পর্দা রাখা হলে যার উপর ইলেকট্রন কোথায় পড়েছে আমরা বুঝতে পারব। একইরকম পরীক্ষা করলে আমরা কী একই ফল পাব? পিছনের পর্দাতে মাত্র দুটো জায়গাতে ইলেকট্রনগুলো গিয়ে পড়বে? উত্তর হল, না। অসংখ্যবার এই পরীক্ষা করা হয়েছে, প্রত্যেকবারই এক ফল পাওয়া গেছে।

উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া Thierry Dugnolle-এর বানানো এই ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে কেমনভাবে একটার পর একটা ইলেকট্রন পর্দার উপর পড়ে ঘন ও হালকা পটির ঝালর তৈরি করছে। সুবিধার জন্য পটির সংখ্যা কম দেখানো হয়েছে। এমন হতেই পারে দুটো ছিদ্রের ঠিক মাঝখানের পিছনটাতে, যেখানে বন্দুকের গুলি গিয়ে পড়েনি, ঠিক সেখানেই ইলেকট্রনের সংখ্যা সব থেকে বেশি হবে।

দুয়ের এই পার্থক্যের পিছনে আছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এক নীতি যা অনুযায়ী পর্যবেক্ষণ না করলে কণাটির গতির অবস্থা সম্পর্কে অনেক কিছু আমরা সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। গুলি বা আমাদের পরিচিত যে কোনও বস্তুই নিউটনের গতিবিদ্যা মেনে চলে, আমরা যে কোনও মুহূর্তে তার অবস্থান ও ভরবেগ নির্ণয় করতে পারি। আমি দেখি বা না দেখি, প্রতি মুহূর্তে তার অবস্থান ও ভরবেগ আছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ক্ষেত্রে যে মুহূর্তে আমি কণাটিকে পর্যবেক্ষণ করছি না, সেই মুহূর্তে কণাটির অবস্থান বা ভরবেগ সুনিশ্চিত নয়। এই প্রসঙ্গে আসে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতির কথা। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ দেখিয়েছিলেন একই সঙ্গে নির্ভুলভাবে কণার ভরবেগ ও অবস্থান নির্ণয় সম্ভব নয়। অবস্থান যত নির্ভুলভাবে নির্ণয় করব, ভরবেগের ক্ষেত্রে ভুলটা তত বেশি হবে। যে কোনও নির্দিষ্ট অভিমুখে কোনও কণার অবস্থান নির্ণয়ের ত্রুটি ও ভরবেগ নির্ণয়ের ত্রুটির গুণফল একটা নির্দিষ্ট মানের থেকে কমানো সম্ভব নয়, এবং সেই মানটি প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অবশ্য ওই নির্দিষ্ট মানটি এতই ছোট যে অণু-পরমাণুর জগতের বাইরে তার কোনও প্রভাব আমরা বুঝতে পারব না।

হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তাকে আমরা দুভাবে ভাবতে পারি, এক ইলেকট্রনের অবস্থান ও ভরবেগ সুনির্দিষ্ট কিন্তু আমরা তা নির্ণয় করতে পারছি না, সেটা আমাদের সীমাবদ্ধতা। আরও নিখুঁতভাবে মাপলে নিশ্চয় পাব। দুই, সুনির্দিষ্ট মানেরই অস্তিত্ব নেই। নানারকম মান থাকতে পারে, এবং তাদের সম্ভাবনা নির্ণয় করা যায়। প্রথমটা সাধারণ বুদ্ধির সঙ্গে মিললেও দ্বিতীয়টাই আসলে সঠিক। এই অনিশ্চয়তাই বাস্তব, এ আমাদের পরিমাপ পদ্ধতির বা যন্ত্রের সীমাবদ্ধতা নয়। ইলেকট্রনটা গান থেকে রওনা হওয়া এবং পিছনের পর্দার উপর পড়ার মধ্যে আমরা তাকে কোনওভাবে পর্যবেক্ষণ করিনি, তাই সে কোন ছিদ্র দিয়ে গেছে তা বলার আমাদের অধিকার নেই। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ভাষাতে প্রতিটি ইলেকট্রন দুটো ছিদ্র দিয়েই গেছে!

মনে হতেই পারে তা অসম্ভব, যে কোনও একটা ইলেকট্রন একটা নির্দিষ্ট ছিদ্র দিয়ে নিশ্চয় গেছে। এবার তাহলে আমরা ওই দুটো ছিদ্রের পিছনে এমন যন্ত্র রাখলাম যে ইলেকট্রন ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়া মাত্র আমাদের সঙ্কেত দেবে। এবার পর্দাতে কিন্তু আর এক নম্বর চিত্র আসবে না, একেবারেই ঠিক আগে বন্দুকের গুলি যে প্যাটার্ন তৈরি করেছিল তাই ফিরে আসবে। যেই আমরা জানতে পারলাম ইলেকট্রনটা কোন ছিদ্র দিয়ে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে ঝালর অদৃশ্য হয়ে গেল। মনে রাখতে হবে যন্ত্র আছে ছিদ্রের পিছনে; পলাশবরণ পালের অনুসরণে বলি, ইলেকট্রন চেনার যন্ত্রের জায়গায় একটা দাঁড়িপাল্লা বা শারদীয় পত্রিকা রাখলে কিন্তু ঝালরের কোনও পরিবর্তন হবে না। অথচ ইলেকট্রনের পক্ষে আগে থেকে জানা সম্ভব নয় যে ছিদ্রের পিছনে কী আছে। অর্থাৎ আমরা শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ করছি বলেই ইলেকট্রনটা একটি নির্দিষ্ট ছিদ্রের ভিতর দিয়ে গেছে, এবং তখন ইলেকট্রন ও গুলি একই রকম প্যাটার্ন তৈরি করবে। এখানেই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অপূর্ণতা।

 

এবার একটু অন্য কথা ভাবা যাক। বন্দুক থেকে একটা ইলেকট্রন কোন মুহূর্তে বেরিয়েছে আমরা জানি। যদি আমরা ইলেকট্রনকে পর্যবেক্ষণ না করি, তাহলে কিছুক্ষণ পরে তাকে পর্দার উপর কোনও নির্দিষ্ট বিন্দুতে পাওয়ার সম্ভাবনা কত? নিউটনীয় বলবিদ্যার ক্ষেত্রে ইলেকট্রনের অবস্থান ও বেগ থেকে উত্তরটা সহজেই বার করা যায়। উত্তরটা হয় শূন্য না হলে এক; সম্ভাবনা পঞ্চাশ শতাংশ বা তিয়াত্তর শতাংশ হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উত্তর কিন্তু শূন্য থেকে একের মধ্যেও আসতে পারে, এবং তা কণার অবস্থান বা ভরবেগের বিভিন্ন মানের বিভিন্ন সম্ভাবনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এই সম্ভাবনাভিত্তিক চরিত্র নিয়ে বিজ্ঞানীরা একশো বছরের বেশি চিন্তাভাবনা করে চলেছেন। সবার আগে যাঁর নাম করতে হয়, তিনি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তিনি সারা জীবন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এই অনিশ্চয়তাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। সেই বিতর্কের দীর্ঘ ইতিহাসে আমরা যাব না। ১৯৩৫ সালে তিনি অপর দুই বিজ্ঞানী বরিস পোডোলস্কি ও নাথান রোজেন যে পরীক্ষার কথা প্রস্তাব করেছিলেন, তার থেকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতে বাস্তবতার চরিত্র সম্পর্কে এক প্রশ্ন ওঠে, এটি তিন বিজ্ঞানীর পদবীর আদ্যক্ষর নিয়ে ইপিআর (EPR) প্যারাডক্স অর্থাৎ কূটাভাস নামে পরিচিত। সেই পরীক্ষাই কিছুটা উন্নত রূপে করার জন্য এই বছর তিন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

আমরা আইনস্টাইনদের প্রস্তাবের একটা পরিবর্তিত রূপ নিয়ে আলোচনা করব, এই রূপটি বলেছিলেন বিজ্ঞানী ডেভিড বোম। ইলেকট্রন বা অন্যন্য মৌল কণাদের স্পিন বা ঘূর্ণি নামের এক ধর্ম আছে, এই স্পিনের জন্য প্রতিটি ইলেকট্রন একটি ছোট্ট চুম্বকের মতো আচরণ করে, অর্থাৎ তার উত্তর ও দক্ষিণে মেরু আছে। আমরা জানতে চাই ইলেকট্রন-চুম্বকটি কোনদিকে মুখ করে আছে, তাই বাইরে থেকে একটা চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করে ইলেকট্রন তার সঙ্গে কত কোণ করে আছে মাপব ঠিক করলাম। আশ্চর্য বিষয় হল আমরা দেখব যে চৌম্বকক্ষেত্রের অভিমুখ যাই হোক না কেন, ইলেকট্রন-চুম্বক হয় তার সমান্তরাল দিকে মুখ করে থাকবে, নয়তো ঠিক উল্টো দিকে মুখ করবে। নিচের দুটি ছবির মধ্যে চৌম্বকক্ষেত্রকে নব্বই ডিগ্রি কোণে ঘোরানো হয়েছে, কিন্তু ইলেকট্রন-চুম্বককে চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে কখনওই লম্বভাবে পাওয়া যায়নি। আবারও আগের পরীক্ষার সঙ্গে তুলনা করে বলতে পারি পর্যবেক্ষণের আগে ইলেকট্রনের কোনও নির্দিষ্ট অভিমুখ ছিল না, পর্যবেক্ষণের পরে সে বাইরের চৌম্বকক্ষেত্রের দিকের উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট অভিমুখ পায়। মূল কথাটা হল পর্যবেক্ষণ না করলে, বা অন্যভাবে না মাপলে ইলেকট্রনের অভিমুখ সম্পর্কে আমাদের কিছু বলার অধিকার নেই, যে কোনও চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে তার সমান্তরাল বা বিষমান্তরাল থাকার সম্ভাবনা সমান সমান অর্থাৎ পঞ্চাশ শতাংশ।

 

এবার আসি মূল পরীক্ষার কথায়। ধরা যাক দুটো ইলেকট্রন এমনভাবে আছে যাতে তাদের মোট ঘূর্ণির পরিমাণ শূন্য হয়। এক্ষেত্রে দুটো ইলেকট্রন-চুম্বক নিচের যে কোনও ছবির মতো ঠিক বিপরীত মুখে থাকে, আমরা এখানে প্রথম ছবিটার কথাই ভাবি। ধরি এবার ইলেকট্রন দুটোকে পরস্পরের থেকে বহুদূরের দুই পরীক্ষাগারে নিয়ে যাওয়া হল। দুই পরীক্ষাগারেই বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে তাঁরা দু দলই চৌম্বকক্ষেত্রটিকে ওপরের ছবিটিতে যেরকম দেখানো হয়েছে সেই অভিমুখেই রাখবেন। যতক্ষণ না কোনও ইলেকট্রন-চুম্বকের অভিমুখ মাপা হচ্ছে, ততক্ষণ আমরা সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারছি না, সে চৌম্বকক্ষেত্রের সমান্তরাল বা বিষমান্তরাল যা খুশি হতে পারে। এবার এক পরীক্ষাগারে বিজ্ঞানীরা তাঁদের পরীক্ষাগারের ইলেকট্রনটির অভিমুখ মাপলেন, ধরা যাক দেখলেন সেটি চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে সমান্তরালভাবে আছে, সঙ্গে সঙ্গে অন্য ইলেকট্রনটির অভিমুখ নির্দিষ্ট হয়ে গেল, অন্য দল বিজ্ঞানী এবার মাপলে দেখবেন যে তাঁদের ইলেকট্রনটি বিষমান্তরালভাবে আছে। কিন্তু প্রথমদল বিজ্ঞানী যদি তাঁদের ইলেকট্রনের অভিমুখ না মাপতেন, দ্বিতীয় দল তাঁদের ইলেকট্রনকে চৌম্বকক্ষেত্রের সমান্তরাল ও বিষমান্তরাল দুইভাবেই পেতে পারতেন, এবং দুইয়ের সম্ভাবনাই ছিল সমান।

আইনস্টাইনদের প্রশ্ন হল যে একটা ইলেকট্রনের অভিমুখ মাপা হয়েছে, সেজন্য আমরা নির্দিষ্ট অভিমুখ পেয়েছি। কিন্তু অন্য ইলেকট্রনের উপর কোনও পরিমাপ করা হয়নি, তাহলে তার অভিমুখ নির্দিষ্ট হল কেমন করে? মনে হতে পারে প্রথম ইলেকট্রনের অভিমুখ মাপার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় ইলেকট্রনের কাছে কোনওভাবে সঙ্কেত গেছে, তার ফলে সেও নির্দিষ্ট অভিমুখ পেয়েছে; কিন্তু আইনস্টাইনেরই বিশেষ আপেক্ষিকতা অনুসারে কোনও সঙ্কেত আলোর বেগের থেকে বেশি হতে পারে না। ধরা যাক দুটি ইলেকট্রনের একটি আছে পৃথিবীতে, অন্যটি নেপচুনে; তাহলে পৃথিবীতে পরিমাপের সঙ্গে সঙ্গে নেপচুনের ইলেকট্রনের অভিমুখ নির্দিষ্ট হল কেমন করে? আইনস্টাইনরা বললেন প্রকৃতপক্ষে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সম্ভাবনাভিত্তিক চরিত্র অলীক; আসলে ইলেকট্রনটির সমস্ত চরিত্রই নির্দিষ্ট কিন্তু সরাসরি আমাদের কাছে তা প্রকাশিত হচ্ছে না। প্রতিটি ইলেকট্রন সম্পর্কে কিছু বাড়তি তথ্য জানা থাকলে আমরা না মেপেই বলতে পারব সে কোনদিকে মুখ করে আছে। একে বলা হয় Theory of local hidden variable।

 

আইনস্টাইনদের এই গবেষণাপত্র প্রকাশের পরে তিরিশ বছর এমন কোনও পরীক্ষার কথা চিন্তা করা যায়নি যেখানে তাঁদের মত ঠিক না ভুল প্রমাণ করা যাবে। ১৯৬৪ সালে সেই কাজটি করলেন জন স্টুয়ার্ট বেল। বিষয়টি বেশ জটিল, আমরা এই লেখাতে তার মধ্যে যাব না। আগ্রহী পাঠক প্রাথমিক আলোচনার জন্য পলাশবরণ পালের বইটি পড়ে নিতে পারেন, এই লেখার শেষে আরও কিছু তথ্যসূত্র দেওয়া আছে। আমরা শুধু বলতে পারি যে এই বিশেষ উদাহরণের ক্ষেত্রে বেলের পরামর্শ অনুসারে অনেকগুলি এইরকম একজোড়া ইলেকট্রন নিতে হবে, তারপর দুই পরীক্ষাগারে ইলেকট্রনদের অভিমুখ মাপাতে হবে। কিন্তু এর জন্য অন্তত তিনটি বিভিন্নদিকে চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করা হল, ধরা যাক একটি ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে পরীক্ষাগারের চৌম্বকক্ষেত্র উত্তর-দক্ষিণ দিকে মুখ করে আছে, পরের ইলেকট্রনটির জন্য চৌম্বকক্ষেত্রটিকে কোনও একদিকে ষাট ডিগ্রি ঘোরানো হল। বেল দেখালেন আমরা মাপি বা না মাপি ইলেকট্রনের যদি একটা নির্দিষ্ট অভিমুখ থাকে, তাহলে বিভিন্ন জোড়ার ইলেকট্রনদের দুই ভিন্ন পরীক্ষাগারে চৌম্বকক্ষেত্রগুলির সাপেক্ষে কোনদিকে মুখ করে পাওয়া যাবে, তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে যাকে এক অসমীকরণ দিয়ে প্রকাশ করা যায়। একে বলে হয় বেলের অসমীকরণ। আইনস্টাইনরা যদি ভুল বলে থাকেন, অর্থাৎ ইলেকট্রনদের কোনও নির্দিষ্ট অভিমুখ থাকে না, পরিমাপের দ্বারাই তারা নির্ধারিত হয়, তাহলে বেলের অসমীকরণ সিদ্ধ হবে না।

এই অত্যন্ত জটিল পরিমাপের কাজটা করার জন্যই ২০২২ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ১৯৭২ সালে বিজ্ঞানী জন ক্লাউজার ও এক ছাত্র স্টুয়ার্ট ফ্রিডম্যান ইলেকট্রনের পরিবর্তে আলোর কণা ফোটন ব্যবহার করে পরীক্ষা করে করে দেখেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যাই সঠিক উত্তর দেয়, বেলের অসমীকরণ সিদ্ধ নয়। তবু তাঁদের পরীক্ষাতে কিছু ফাঁক ছিল, ১৯৮২ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাঁক বন্ধ করেন আলাঁ আস্পে। ২০১৭ সালে পরীক্ষার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করেন অ্যান্টন জেইলিঙ্গার। অণু-পরমাণুর জগৎ নিয়ন্ত্রণকারী কোয়ান্টাম বলবিদ্যা সম্ভাবনার উপরেই নির্মিত, তার নিচে অন্য কোনও বাস্তবতার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এইরকম দুটি কণা যদি বিরাট দূরত্বেও নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখে তাদের বলে বিজড়িত (entangled) অবস্থা, এরকম ক্ষেত্রে দুটি কণার যতই দূরত্ব হোক না কেন, ধরে নিতে হবে তারা একই তন্ত্র বা সিস্টেমের অংশ। এই বাস্তবতাকে প্রমাণ করার জন্যই এই বছর ক্লাউজার, আস্পে ও জেইলিঙ্গারকে পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। বেল ১৯৯০ সালেই প্রয়াত হয়েছেন, মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এবারের পুরস্কারজয়ীরা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তাৎপর্য বোঝার দিকে আমাদের এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছেন।

 

এই সমস্ত গবেষণা কী আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনো কাজে আসবে? আশ্চর্য মনে হলেও বিজ্ঞানীরা এখনই সেই পথে অনেকটা এগিয়েছেন। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কথা অনেকে শুনেছেন, সেই যন্ত্রে তথ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠাতে এই পদ্ধতি কাজে লাগতে পারে। ইন্টারনেটের সাহায্যে ব্যাঙ্কিঙের ক্ষেত্রে মাঝপথে কেউ সঙ্কেতটি ধরে নিয়ে তার মর্মোদ্ধার করতে পারে সেই সম্ভাবনা থেকেই যায়। বিজড়িত কণাদের ব্যবহার করে এমন পদ্ধতি নেওয়া যায় যে প্রেরক ও প্রাপক ছাড়া কেউ সঙ্কেত পড়ার চেষ্টা করলে সঙ্কেতটি নিজে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে। বাণিজ্যিক বা সামরিক ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতিতে বার্তা প্রেরণের গুরুত্ব সহজেই অনুমান করা যায়। মৌল বিজ্ঞান গবেষণা এভাবে কখন যে প্রযুক্তিতে কাজে আসবে তা আগে থেকে ভাবা শক্ত।

 

তথ্যসূত্র:

  1. পাল, পলাশবরণ। বিজ্ঞান: ব্যক্তি যুক্তি সময় সমাজ।
  2. Brubaker, Ben. How Bell’s Theorem Proved ‘Spooky Action at a Distance’ is Real. QuantaMagazine. Jul 20, 2021.
  3. Wood, Charlie. Pioneering Quantum Physicists Win Nobel Prize in Physics. QuantaMagazine. Oct 4, 2022.
  4. This Month in Physics History: Einstein and the EPR Paradox. APS NEWS, Vol.14, Num.10. Nov, 2005.
  5. Bell’s Theorem.

 

অনেক জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বইতেই ইপিআর কূটাভাস ও বেলের উপপাদ্য নিয়ে আলোচনা আছে, তাদের মধ্যে কয়েকটির নাম নিচে দেওয়া হল: