Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এক দক্ষিণবঙ্গীয়র খোলা চিঠি— মৌসুমী তোমাকে

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 


প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

এ তো ভারি রঙ্গ জাদু
এ তো ভারি রঙ্গ!
উত্তর হল বানভাসি,
খরায় জ্বলে দখিন বঙ্গ!
এ তো ভারি রঙ্গ…

বুড়ো বয়সে ছড়া কাটতে মন্দ লাগল না। আপনাদেরও নিশ্চয়ই খারাপ লাগেনি। আর লাগবেই বা কেন? এই সময়ের নিদারুণ আবহিক বৈপরীত্যের বিষয়টি তো আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। পাশাপাশি এই সময়ের অন্যতম জনপসন্দ বয়সোচিত শব্দবন্ধটির সঙ্গে কে না পরিচিত— ‘বয়স হল নিছকই একটি সংখ্যা’। তাহলে! বুড়োমানুষের ছড়া কাটা দোষের হবে কেন!

আসলে, দোষ হল মৌসুমীর— সে কথা দিয়েও কথা রাখেনি। আর তাই, এই বঙ্গের এমন হাল। একই মুদ্রার দুই পিঠে দুই ছাপের মতো মৌসুমীর অভিব্যক্তিতেও এমন বৈপরীত্য, চরমতা। শোনা যাক…

 

কথা দিয়েছিলে…

মৌসুমী কথা দিয়েছিলে এবারও ঠিক ঘড়ি ধরে, ক্যালেন্ডারের দিন-তারিখ মিলিয়ে জম্বুদীপে এসে হাজির হবে। তোমার প্রচারবিভাগের সচিব এক প্রেস-নোট জারি করে বলেছিলেন— বিগত তিন বছরের মতো এ-বছরও তুমি স্বাভাবিক ছন্দেই আছ। ‘তাই জম্বুদ্বীপবাসীরা, আপনারা আশঙ্কিত হবেন না।’ আমরাও সচিবের অমন আশ্বাসবাণীতেই ভরসা রেখেছিলাম। আর তোমার আসা তো শুধু নিয়মরক্ষার জন্য আসা নয়, আমাদের জন্য, তোমার অগণিত গুণমুগ্ধ জম্বুদ্বীপবাসীর জন্য অনেক অনেক আশা নিয়ে আসা। আর কে না জানে—

তুমি আসবে বলে প্রাণ উন্মুখ,
বীজেরা শুকিয়ে যায়নি।
তুমি আসবে বলে কোমর বাঁধছে
দেশভরা চাষি-চাষিনী।
তুমি আসবে বলে মূল্যসূচক
আজ থমকে রয়েছে বাজারে,
তুমি আসবে বলে জমে যাওয়া পুঁজি
খাটবে এবার শেয়ারে।

অথচ আমাদের হতমান করে তুমি এলে না মৌসুমী! অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নিলে অভিমানিনী দয়িতার মতো। কেন?…

 

জম্বুদ্বীপ— তোমার লীলাক্ষেত্র

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত অংশে মরশুমি মরুতের আসা-যাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে এই অবসরে একটু খোঁজখবর নেওয়া যাক, একদম স্কুলে ভূগোলপাঠের মতো করে। গোড়াতেই বলি, পার্থিব বায়ুমণ্ডলে যতরকম নাটকের অভিনয় হয়, তার পেছনে সর্বদা সক্রিয় থাকেন প্রবল প্রতাপান্বিত রুদ্রতেজা মার্তণ্ডদেব। যাত্রাদলের অধিকারী মশাইয়ের মতো মার্তণ্ডদেব ঠিক করে দেন বসুধা আবাসনের কোথায় কখন কোন পালার অভিনয় হবে। বৃহত্তর জম্বুদ্বীপেও এমনটাই দস্তুর। ২১ মার্চের পর থেকে মার্তণ্ডদেব উত্তরে আসন পাতার তোড়জোড় শুরু করেন। নায়েকদের কাছে সব খবর পাঠান— ওহে রুদ্র, ওহে সজল, প্রেষ, পবন, জলদ… আমি আসছি। তোমরা সব তৈরি হও। জম্বুদ্বীপে রীতিমতো উৎসবের সাড়া পড়ে যায়।

নামে জম্বুদ্বীপ হলেও আসলে তা হল একটি উপদ্বীপ, অর্থাৎ তিনদিকে জলবেষ্টিত। জল ও ডাঙার এই নিবিড় নৈকট্য মৌসুমী মরুতের আসা-যাওয়ার বিষয়টিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। মার্তণ্ডদেব তাঁর রুদ্রতেজে তপ্ত করেন এই দুই অংশকেই। তবে এখানেও একটু মজা আছে। মজাটা হল এই যে, গলাগলি করে থাকলেও ডাঙা আর জল মার্তণ্ডতাপে সমানভাবে আতপ্ত হয় না। ভৌত চরিত্রের বিপরীত বৈশিষ্ট্যের কারণেই ভূমিভাগ দ্রুততর উত্তপ্ত হয় তরল সলিলপূর্ণ জলভাগের তুলনায়। এমন স্বতঃস্ফূর্ত তাপীয় বৈপরীত্যের কারণেই দুই অংশের প্রেষ বৈশিষ্ট্যের ফারাক দেখা যায়। তাপের প্রভাবে মরুৎকণাগুলি পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়, ফলে প্রেষমান হ্রাস পায়, ও ডাঙার ওপর এক আপাত বায়বীয় শূন্যতার সৃষ্টি হয়।

প্রকৃতির রাজ্যে প্রাকৃতিক তন্ত্রে কোনও শূন্যতাই স্থায়ী নয়, যদি না সেখানে মানুষ নামক স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ প্রাণীটির হস্তক্ষেপ ঘটে। আর সেই কারণেই জলভাগের ওপর থাকা আপেক্ষিকভাবে উচ্চতর প্রেষ অঞ্চলের মরুৎ জলভাগের ওপর থেকে বিপুল পরিমাণে জলীয় পসরা নিয়ে জম্বুদ্বীপের ওপর আছড়ে পড়ে। ভিস্তির মশকের মতো শরীর নিংড়ে জম্বুদ্বীপের আনাচেকানাচে জল ঢেলে দেয় সাগরবাসী বারিবাহরা। এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না তেমনটা কিন্তু মোটেই নয়, তবে এবার যেন বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। তৃষিত চাতকের মতো আমরাও তোমার পথপানে আকুল নয়নে চেয়ে রইলাম। কিন্তু হায়! তোমার দেখা নাই গো, তোমার দেখা নাই! কেন এমন বিমুখতা, মৌসুমী?

 

তোমার মন বোঝা ভার…

মৌসুমী মরুতের মন বোঝা ভার। তবে বিশেষজ্ঞরা বসে নেই। দিনরাত এক করে তাঁরা এমন ঘটনার কার্যকারণ অনুসন্ধানে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন। এমন অনিয়মিতির প্রধান কারণ অবশ্যই বিশ্ব-উষ্ণায়ন। পৃথিবীর গড় তাপমান ক্রমবর্ধমান, যার ফলে বসুধা আবাসনের তাপীয় বাতাবরণেরই কেবলমাত্র পরিবর্তন হচ্ছে না, সামঞ্জস্য রেখে অন্যান্য আবহিক সূচকসমূহের আচরণগত পরিবর্তনও ক্রমশ প্রকট হচ্ছে।

অনেকটা সাগরীয় পথ অতিক্রম করে মৌসুমী মরুৎকে জম্বুদ্বীপের অন্দরে প্রবেশ করতে হয়। তাকে স্বাগত জানাতে খোলা থাকে দুই প্রধান প্রবেশদ্বার— একটি বঙ্গোপসাগরীয়, অন্যটি আরব সাগরীয় ফটক। দিনক্ষণ মেনে যাতে এই প্রবেশপর্বের সমাধা হয় তার জন্য মাসখানেক আগে থেকেই কোমর বেঁধে তৈরি হতে থাকে ঘূর্ণিবাতেরা। নিদেনপক্ষে কালবৈশাখীর হাত ধরে মৌসুমী মরুৎ একটু একটু করে মূল ভূখণ্ডের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। বিগত কয়েক বছর একের পর এক ঘূর্ণিবাতের প্রভাবে মৌসুমী মরুতের আবির্ভাবপর্বটি ত্বরান্বিত হয়েছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টির সম্ভারে বারংবার সিক্ত হয়েছে, বিপর্যস্ত হয়েছি আমরা। অথচ এইবার?

সুপ্রিয় পাঠক, চলুন একবার স্মৃতিপথ ধরে ছেলেবেলায় ঘুরে আসি। জানি, এই সময়কে পেছনে ফেলে চার-সাড়ে চার দশক পেছনে ফেরা মোটেই সহজ নয়, তবুও সেই ফিকে হয়ে যাওয়া স্মৃতিখাতার পাতা ওল্টালেই আমরা যে ছবিটা দেখতে পাব তা হয়তো অনেকটা এইরকম— গরমকাল… দ্রুত পা চালিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা… কোনওরকমে বই-ব্যাগ রেখে সামান্য কিছু মুখে গুঁজে বা না-গুঁজেই দে ছুট, দে ছুট… গন্তব্য খেলার মাঠ… বল পেটাপেটি… ঘাম ঝরানো… মাঝেমাঝে তর্ক-বিতর্ক-গলাগলি… আকাশ কালো হয়ে যাওয়া… শনশন বাতাস… মেঘ গর্জন… সৌদামিনীর চকিত চাহনি… ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি… দে দৌড়, দে দৌড়… সোজা বাড়ি। বেশ কয়েকদিনের একটানা দাবদাহের অসহনীয় অবস্থার পর এই ঝড়-বাদল আনত স্বস্তি— কালবৈশাখীর বৃষ্টি। কালবৈশাখীর সংখ্যা গুনেই আমজনতা বলে দিতে পারত মৌসুমী মরুতের আগমনের দিনক্ষণ-তারিখ। একালে যেমন পাড়ায় পাড়ায় খুঁটিপূজার সুবাদে আমরা জেনে যাই তিনি আসছেন, অনেকটা সেরকমই।

কোথায় কালবৈশাখীর সেই দস্যিপনা? কালবৈশাখীর হাত ধরেই মহাসাগরীয় আবাস ছেড়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসত মৌসুমী মরুৎ। সেই সব আজ অতীত। কালবৈশাখী কি তার সমস্ত দাপট হারিয়ে নিছকই একটি আভিধানিক শব্দে পরিণত হতে চলেছে? আবহবিজ্ঞানীরা মনে করেন বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে প্রথাগত তাপক্ষেত্রের পরিবর্তনই হয়তো এমন অস্বাভাবিকতার জন্য দায়ী। ভরসা ছিল ‘অশনি’র ওপর। ২০২২ সালের প্রথম ঘোষিত ঘূর্ণিঝড় অশনি মৌসুমী বায়ুকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে তেমন কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি খানিকটা আশা ও আশঙ্কা জাগিয়েও। বারংবার গতিপথ পরিবর্তন করে অবশেষে অশনি একটি সাধারণ নিম্নচাপে পরিণত হয়। এর প্রভাবে উপকূলবর্তী অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা ও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে খানিকটা বৃষ্টি হলেও মৌসুমী মরুৎকে সক্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তেমন কার্যকর হয়ে উঠতে পারল না। উপযুক্ত আপ্যায়নের অভাবে মুখ ভার করে দূরে সরে রইল মৌসুমী। আশাহত হলাম আমরা।

এই অবসরে চলতি বছরের অস্বাভাবিক তাপ-পরিস্থিতি বিষয়ে দু-একটা কথা বলে নিই। এই বছরে প্রাক-মৌসুমী পর্বে মার্চ-এপ্রিল মাসে ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তৃত অংশ জুড়ে তাপপ্রবাহের বিপুল দাপট লক্ষ করা গেছে যা আবহবিজ্ঞানীদের মতে লাল সঙ্কেত। এমন অবস্থা সৃষ্টির জন্য বিশ্ব-উষ্ণায়নই যে দায়ী সে কথা জানাতে ভোলেননি আবহবিজ্ঞানীরা। এমন প্রবল দাবদাহের কারণে উপমহাদেশ হারিয়েছে তার মৃদুমন্দ বসন্ত ঋতুকে যার ফলে মার খেয়েছে উত্তর-পশ্চিম ভারতের গম উৎপাদন। পর্যবেক্ষণ সূত্রে জানা গেছে ১৯৯০ থেকে ২০২০ এই তিন দশক সময়কাল জুড়ে পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলই ছিল প্রধান তাপক্ষেত্র। এই অঞ্চলের তাপমান স্বাভাবিকের তুলনায় ১ ডিগ্রির মতো বেশি থাকায় তার প্রভাব পড়েছে উপমহাদেশের ওপর। কোনও কারণে এই বিন্যাস-ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটলে তার অনিবার্য প্রভাব পড়ে মৌসুমী বায়ুর মতো এক অতিসংবেদনশীল বায়বীয় অতিথির আসা-যাওয়ার দিনলিপিতে। বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে একই সঙ্গে বাড়ছে উপমহাদেশের স্থলভাগ এবং সংলগ্ন মহাসাগরীয় জলভাগের উষ্ণতার পরিমাণ। সুদূর সুমেরু অঞ্চলের হিমবাহের দ্রুত গলনের কারণে উপমহাদেশের বার্ষিক বৃষ্টির পরিমাণে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এই প্রবণতা জারি থাকলে আগামীদিনে এই অঞ্চল উষায়ন-জনিত আবহিক বিপর্যয় যেমন, বন্যা, খরা, সমুদ্র জলতলের উচ্চতাবৃদ্ধি, তাপপ্রবাহ, অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত, কৃষি উৎপাদনে ঘাটতি এবং বাস্তুতান্ত্রিক বন্ধ্যাত্বের শিকার হতে চলেছে। এরপর কোথায় যাব আমরা?

আরও একটি বৈশ্বিক বিষয় মৌসুমী বায়ুর এই খামখেয়ালিপনার সঙ্গে জড়িত বলে মনে করছেন আবহবিজ্ঞানীরা, আর তা হল লা নিনার প্রভাব। এই বছরও লা নিনা দক্ষিণি সমুদ্রে যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছে। বিগত দুটি বছরের মতো এই বছরও লা নিনার প্রভাব সক্রিয় থাকায় মৌসুমী বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনার কথাই জানিয়েছিলেন ভারতীয় আবহবিজ্ঞানীরা। ভারত মহাসাগরের ওপর ‘নেগেটিভ ডাইপোলে’র অবস্থান তাঁদের এই অনুমানকে জোরদার করেছিল অনেকটাই। কিন্তু মানুষী হস্তক্ষেপের দৌরাত্ম্যে এই চেনা নিয়মে প্রবল ব্যত্যয় ঘটেছে বলে ধারণা আবহবিজ্ঞানীদের। আইএমও ঢোক গিলতে বাধ্য হয়েছে এই বলে যে, মৌসুমী বায়ুর আসার বিষয়ে যেসব প্রচলিত মডেলের ভিত্তিতে তারা পূর্বানুমান করেছিল তা অনেকটাই অসার প্রতিপন্ন হয়েছে। আসলে প্রাকৃতিক তন্ত্রের ওপর মানুষের অনাবশ্যক, অবাঞ্ছিত খবরদারি এই বায়বীয় শৃঙ্খলায় কতটা প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে আরও দীর্ঘ অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে। লা নিনা ও এল নিনো সমুদ্রজলের তাপীয় ভারসাম্যের ওপর প্রভাব ফেলে। এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে মহাদেশের আবহিক ঘটনাক্রমের অভ্যস্ত দিনলিপিতে। এ-বছর কি তেমনই কিছু ঘটল?

 

খেলিছ বৃষ্টি লয়ে?

দক্ষিণবঙ্গ সহ পূর্ব ভারতের একটা বড় অংশে এ-বছর পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি হয়নি। দাম চড়িয়ে ডিসকাউন্ট দেওয়ার মতো মাঝেমধ্যে এলোমেলোভাবে বৃষ্টি হলেও খরিফ চাষের জন্য তা মোটেই যথেষ্ট নয়। এ এক নতুন প্রহেলিকা! সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে এক আশ্চর্য নতুন তথ্য। মৌসুমী বৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করার লাগাম নাকি চলে গিয়েছে লা নিনার হাতে। এই নিবন্ধের গোড়াতেই বলেছি সংলগ্ন সমুদ্র ও উপদ্বীপীয় স্থলভাগের তাপীয় বৈপরীত্যই মৌসুমী বায়ুর গমনাগমনকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই স্থলভাগের পাশাপাশি জলভাগের তাপ-পরিস্থিতির বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই বছর প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরের জলভাগের তাপীয় চরিত্র অত্যন্ত অনিশ্চিত প্রকৃতির। পুরনো অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাকে কোনওভাবেই মেলানো যাচ্ছে না। একই মঞ্চে যুযুধান সামুদ্রিক নিনো সূচক (Ocean Nino Index) এবং লা নিনার প্রভাব সমান সক্রিয় রয়েছে। কখনও এ বাড়ে তো কখনও সে। এই যুদ্ধে কে জিতবে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল কেননা এর মাঝে অনেক অনেক যদি, কিন্তু, হয়তো, নতুবা জড়িয়ে আছে। এই জট চট করে কেটে যাওয়ার কোনও ইঙ্গিত এখনও স্পষ্ট নয়। উত্তরের দুয়ার ছুঁয়ে মৌসুমী অক্ষরেখা দক্ষিণে খানিক সক্রিয় হতে দিন কয়েকের বৃষ্টিতে কিঞ্চিৎ স্নাত হয়েছিল দক্ষিণবঙ্গ। কিন্তু তাতে তিয়াস মিটল কই!

 

স্ট্রাবো উবাচ…

বহু, বহুকাল আগে গ্রিক দার্শনিক তথা ভূগোলবিদ স্ট্রাবো (৬৩-২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মন্তব্য করেছিলেন— If you are late in sowing, you are late in everything. অর্থাৎ তুমি যদি শস্যবীজ বপনে বিলম্ব করো, তাহলে পরবর্তী সব কাজেই তোমার বিলম্ব ঘটবে। যে-সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে স্ট্রাবো এই কথাগুলো বলছেন সেই সময়ে গোটা দুনিয়ার মানুষের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন একান্তভাবেই ছিল কৃষিকেন্দ্রিক। ফলে সঠিক সময়ে ভূমিকর্ষণ ও বীজবপনের কাজ সম্পন্ন করতে না পারলে তা দেশের সর্বক্ষেত্রেই বিপর্যয় ডেকে আনবে, বিলম্ব ঘটবে সমস্ত কাজে। শিল্প বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বহুবিধ যন্ত্রের আবিষ্কার জমির ওপর মানুষের নির্ভরতার পরিমাণ কমালেও, খাদ্য ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হিসেবে কৃষির গুরুত্ব কমে গেছে তা কিন্তু নয়। ভারতবর্ষের মতো দেশে কৃষি আজও গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় আয়ের অংশীদার। এদেশে কৃষির সাফল্য, কৃষকের সমৃদ্ধি, খাদ্যশস্যের মূল্যমান, সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের স্বস্তি সবকিছুই মাটির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে সম্পর্কিত। লক্ষ করার বিষয় হল, এদেশের কৃষির সাফল্য-অসাফল্য নির্ভর করে বৃষ্টির ওপর। এই কারণে মৌসুমী মরুৎ যদি কোনও কারণে পর্যাপ্ত জলের পসরা না নিয়ে আসে তাহলেই আশঙ্কার কালো মেঘের আনাগোনা বেড়ে যায়। এমনই ঘটছে আমাদের রাজ্য সহ পূর্বভারতের কৃষিনির্ভর রাজ্যগুলোতে। একেই মুদ্রাস্ফীতির হার বল্গাহীন অশ্ব হয়ে আপন খেয়ালে ছুটছে, তার ওপর দেশের কৃষি তথা শস্য উৎপাদন মার খেলে আগামী দিনে কী হাল হবে তা গুরুতর ভাবনার বিষয় তো বটেই।

 

কথা দিয়েছিলে… আমাদের ভিজিয়ে দেবে… অথচ!

মৌসুমী! কথা দিয়েছিলে ঠিক সময়ে এসে আমাদের ভিজিয়ে দেবে বলে কিন্তু এলে না সেভাবে। দুনিয়াজুড়ে অসুস্থ বাতাবরণ। আমরাও তার শিকার হলাম। কথা হচ্ছিল শ্রীরাম মাহাতো, সুবল প্রামাণিক, ছত্রধর সিং, গোপাল যাদব, আরও আরও অনেকের সঙ্গে। সকলেরই আক্ষেপ মৌসুমী ছলনাময়ী! ঝাড়খণ্ডের শ্রীরাম মাহাতো তার সাড়ে তিন একর শুখা জমির দিকে ছলছল চোখে তাকিয়েছিল। ইতোমধ্যে হাজার পনেরো টাকা খরচ হয়ে গেছে বীজ-সার-কীটনাশকের পেছনে। ভাড়া করা ট্রাক্টরে জমি চষতেও এখন খরচ বিস্তর। চাতকের চাহনি নিয়ে সে তোমার আগমনের প্রতীক্ষা করেছে। আর দিনাজপুরের সুবল প্রামাণিকের পাঁচ বিঘা জমির পাট এখনও জাক দিয়ে উঠতে পারেনি পর্যাপ্ত জলের অভাবের জন্য। কৃষি বিপর্যস্ত হলে আমরা বাঁচব কী করে?

এমন অবস্থা গোটা পশ্চিম ইউরোপের। খরায় জ্বলছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস। আমরা বিহ্বল, হতবাক। এখানে তুমি অভিমান করে আমাদের এড়িয়ে রয়েছ, আর ওখানে বৃষ্টির সুষম তন্ত্রটাই গেছে বিলকুল বিগড়ে। পৃথিবী ভাল নেই, বাতাবরণ ভাল নেই, প্রাকৃতিক তন্ত্রগুলির প্রচল শৃখলা ভাল নেই, আমরা— এই ধরিত্রীর সন্তানেরা ভাল নেই। একরাশ শঙ্কা নিয়ে এভাবে থাকাকে কি বেঁচে থাকা বলে? তুমিই বলো মৌসুমী…