দেবকুমার সোম
কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
পূর্ব-প্রসঙ্গ: উপন্যাস ও রাজনীতি
১৭৭৮ সালে হুগলি প্রেস থেকে ছাপানো হয় হলহেড-এর ব্যাকরণ। কোম্পানি তার কর্মচারীদের বাংলাভাষা শিক্ষার জন্য প্রথম এই বই ছাপে। এরপর পর্যায়ক্রমে বাংলাভাষায় বই ছাপা হতে থাকে শ্রীরামপুর প্রেস থেকে। এর আগুপিছু সময়ে ফোর্ট উইলিয়ম স্কুলে লাইব্রেরি তৈরি হলে কোম্পানি কর্মচারীদের কাছে বাংলা বই সহজলভ্য হয়। তখনকার দিনে বাংলা বই নির্মাণ যেমন ছিল শ্রমসাধ্য, দামও ছিল সাধারণের সাধ্যাতীত। কোম্পানি সকলের সুবিধার কথা বিবেচনা করে ফোর্টে লাইব্রেরি চালু করেছিল। কিন্তু সে ব্যবস্থা মোটেও ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ সুযোগসন্ধানী রাইটার্স–ফ্যাকটাররা লাইব্রেরি থেকে দেদার বই চুরি করতে শুরু করে। ১৭৮০ সাল নাগাদ রাইটার্স বিল্ডিং চালু হলে কর্মচারী যাদের মাইনে তিনশো সিক্কা টাকা পর্যন্ত, তাদের থাকার আলাদা ব্যবস্থা হল। মূলত হেস্টিংসের সময় থেকে কর্মচারীদের বিলাসজীবনের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের শুরু। তখন সিভিলিয়নদের (আন্ডার রাইটার, রাইটার, ফ্যাকটর অবধি) হিন্দুস্তানি ভাষাশিক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক। এর দরুন বছরে কুড়ি পাউন্ড গ্র্যাচুইটি তারা পেত। কোম্পানির সিভিলিয়নরা ভাষাশিক্ষার জন্য ব্যক্তিগত মুনশি রাখত; বইচুরি সেই কারণেই। কর্নওয়ালিসের সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পাশাপাশি রাইটার–ফ্যাকটারদের সহবত শেখানোর চেষ্টা আরও স্পষ্ট হয়। তাঁর সময় কোম্পানি চ্যাপবুক ছাপানোর ব্যবস্থা করে। চ্যাপবুক ধারণাটা ইউরোপ থেকে নেওয়া। তখনকার সময় ইউরোপেও বইয়ের দাম ছিল বেশ উঁচুতে। ফলে প্রকাশকেরা সস্তা কাগজে নিম্নমানের ছাপা বই সাধারণের সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসে। এই বইগুলোর নাম ছিল চ্যাপবুক। ঝাঁকামুটে করে ফেরিওলারা লোকের দোরে-দোরে বই ফেরি করত। ফেরিওলাদের বলা হত চ্যাপম্যান। সেই থেকে এই ধরনের বইয়ের নাম হয় চ্যাপবুক। সেই মডেলে কলকাতায় মুটেরা বাংলা বই দেশিপাড়ায় বাড়ি বাড়ি ফেরি করত। তারা ঝাঁকা মাথায় বই নিয়ে দক্ষিণপূর্বে সিমলে, বাহির সিমলে যেমন যেত, তেমন পূর্বে হোগলকুঁড়ে বা শ্যামপুকুর। উত্তরে চিৎপুর। পশ্চিমে গরাণহাটা। খানিক দক্ষিণে জোড়াসাঁকো পর্যন্ত ছিল তাদের গতায়াত। বই বিক্রি হত মূলত ধারে। মাসকাবারি ব্যবস্থায়। এসব ছিল বটতলার প্রথম যুগের প্রকাশনা।
১৮১৬ সালে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য নামে এক উদ্যোগী পুরুষ বাংলা প্রকাশনা শিল্প শুরু করেন। তিনিই প্রথম ‘সচিত্র অন্নদামঙ্গল কাব্য’ প্রকাশ করেন। তখনকার ডিহি কলিকাতায় লালদিঘির পাশে একমাত্র বইয়ের দোকান ‘সেন্ট অ্যান্ড্রুজ় বুক শপ’। বই আসত জাহাজে করে বিলেত থেকে। তখনকার দিনের বাঙালির আজকের মতো বই পড়ার অভ্যাস ছিল না। এসব অভ্যাস ইউরোপের এনলাইটমেন্টের প্রভাব। গঙ্গাকিশোর তাঁর জীবিকা শুরু করেন শ্রীরামপুর প্রেসের সামান্য কম্পোজ়িটর হিসাবে। পরবর্তীকালে তিনি ধাপে-ধাপে মেশিনম্যান, ক্যানভাসার ইত্যাদি হয়ে কলকাতায় এসে প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করলেন। হিন্দু কলেজ স্থাপিত হলে ১৮১৭ সালে ‘স্কুল বুক সোসাইটি’র জন্ম হয়। উদ্দেশ্য স্কুলবই অর্থাৎ পাঠ্যপুস্তক ছাপানো ও বিপণনের ব্যবস্থা করা।
এরই কিছু বছর আগে চিৎপুর রোডের ওপর ফুটপাতে বই বিপণি শুরু হয়ে গেছে শোভাবাজার রাজবাড়ির উদ্যোগে। উদ্দেশ্য ছাপা সাহিত্য (সেকালে মূলত ধর্মগ্রন্থ বিষয়ক বইকেই এই মর্যাদা দেওয়া হয়। এমনকি মঙ্গলকাব্যও ধর্মীয় পুস্তক হিসাবে বিবেচিত হত) সম্পর্কে নাগরিকদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করা। বটতলা ছিল ‘সেন্ট অ্যান্ড্রুজ় বুক শপ’-এর ভারতীয় সংস্করণ। শোভাবাজার রাজবাড়ির উদ্যোগে এই ব্যবসা। শোভাবাজারে যে জায়গায় বই বিক্রি হত, সেখানে ছিল প্রকাণ্ড একটা বটগাছ। সেই সূত্রে ‘বটতলার সাহিত্য’। কালে-কালে বটতলায় ধর্মপুস্তকের পাশাপাশি প্রহসন কিংবা চটুল আর নিচুস্তরের সাহিত্যগন্ধী বইও প্রকাশিত হতে থাকে। কোম্পানি আমলের শেষের দিকে বটতলা থেকে বই বিক্রি উঠে এল গোলদিঘি অঞ্চলে। আর বাংলা প্রকাশনায় ব্যবসায়িক মডেলের সূত্রপাত ঘটালেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৮৪৭ সাল নাগাদ বিদ্যাসাগর আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের একটা পুরনো কাঠের প্রেস কিনে নিজের বই নিজেই ছাপাতে শুরু করেন। প্রেসের নাম দেন ‘সংস্কৃত গ্রন্থালয়’। তখনকার দিনে বিদ্যাসাগরের লেখা পাঠ্যপুস্তক উত্তর-পূর্বে কাছাড় থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে দ্বারভাঙা পর্যন্ত বিস্তৃত বাংলা স্কুলগুলোতে পড়ানো হত। এছাড়া তিনি স্বয়ং ছিলেন স্কুল কমিটির অন্যতম প্রধান। ফলে তাঁর প্রেস থেকেই ছাপানো হত সিলেবাস কিংবা প্রশ্নপত্র। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য তিনি নিজের বই ছাড়াও অন্যের লিখিত বই বিক্রি করতেন। তাঁর ব্যবসার মডেল ছিল অন্য লেখকের বা প্রকাশকের বই তাঁর ‘সংস্কৃত গ্রন্থালয়’ থেকে বিক্রি করে নিজের বই বিক্রির কমিশন কেটে বাকিটা প্রকাশককে দেওয়া। আজ প্রায় ১৭০ বছর পার করেও কলেজ স্ট্রিটের বই ব্যবসায় সেই মডেল অপরিবর্তীত। গত ১৭০ বছরে দুনিয়ে এদিক-ওদিক হয়ে গেল কিন্তু বাংলা বই প্রকাশনা শিল্পের কোনও কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটল না।
ব্রিটিশরাজ ক্ষমতায় আসার পরে ধীরে-ধীরে গোলদিঘিকে কেন্দ্র করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দু, হেয়ার, বেথুন স্কুলের পত্তন যেমন হল, তেমন হিন্দু কলেজ তার নিজস্ব ভবন তৈরি করে এই অঞ্চলে উঠে এল। নাম হল প্রেসিডেন্সি কলেজ। তার সঙ্গে যোগ দিল সংস্কৃত কলেজ, মহাবোধি সোসাইটি এমন আরও প্রতিষ্ঠান। জায়গাটার সার্বিক চরিত্র গেল বদলে। যদিও প্রাথমিক অবস্থায় কলেজ স্ট্রিট থেকে মূলত পাঠ্যপুস্তক ছাপা হত। আর বটতলায় সাহিত্যনির্ভর বই। কালে-কালে বাংলার রেনেসাঁর সুবাদে বাংলা সাহিত্যের প্রকাশনার গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন ঘটল। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মাইকেল এঁদের প্রতিভায় বিচ্ছুরিত হল আজকের কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া।
বিদ্যাসাগর মশায়ের সময়কালের আর্থরাজনৈতিক অবস্থান এখন আর নেই; অথচ, খোলনলচে সমেত বাংলা প্রকাশনা শিল্পের আদল প্রায় একইরকম রয়ে গেছে। বাঙালির শিল্পপতি হয়ে ওঠার ধারাবাহিক ব্যর্থতার করুণ চিত্র সর্বত্র; এর মধ্যে বাংলা প্রকাশনার ছবিটা আরও করুণ। আমাদের জাতিগত দীনতা ছাড়াও ফাঁকিবাজি আর অসৎবৃত্তি এই প্রকাশনা শিল্পের সম্ভাবনাকে সমূহে নষ্ট করেছে। ইংরাজিতে যাকে বলে এন্টরাপ্রেনারশিপ; সেটার কতগুলো পূর্বশর্ত রয়েছে। সৎ উদ্যম যেমন তার অন্যতম, তেমন পুঁজির বিনিয়োগও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যবসায় পুঁজির বিনিয়োগ থাকে না, সে–ব্যবসা মূলত দালালি। সত্যি হলেও এই, বাংলা প্রকাশনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁদের সিংহভাগ বিনা-পুঁজির ব্যবসার মডেল হিসাবে প্রকাশনা শিল্পকে দেখতে চান। অধিকাংশ প্রকাশক লেখকের অর্থে এবং কষ্টে বই ছাপেন; কিংবা কমিশনভিত্তিতে বই বিক্রি করে জীবনধারণ করেন। এর ফলে প্রায় ঝুঁকিহীন অথচ ঝুঁকিপূর্ণ একটা ভূগোল রচিত হয়েছে বাংলা প্রকাশনায়। যে কারণে আজ বিশ্বায়নের কালপর্বে এসেও বাংলা প্রকাশনা শিল্প কলেজ স্ট্রিট চৌহদ্দির বাইরে বের হতে পারেনি। চায়ওনি। ফড়ে, দালাল, কমিশনজীবীদের রমরমায় গ্রন্থনির্মাণ শিল্পটার বিকাশ ঘটেনি বাংলাভাষায়।
আমরা মূল আলোচনার আগে সামান্য কয়েকটা বাক্যে এই শিল্পের একটা রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
এখন বাংলায় দু ধরনের প্রকাশক। এক ধরনের প্রকাশক যাঁরা পাঠ্যপুস্তকের সহয়িকা বই ছাপান। তাঁদের বিজ্ঞাপন যেমন, বিক্রিও তেমন। আজ বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার মান এতটাই নিম্নমুখী যে, মূল পাঠ্যপুস্তকের কোনও মর্যাদা নেই। সেগুলো সরকারি প্রেসে, সরকারের খরচে ছাপা হয়। তা দিয়ে ব্যবসা হওয়ার যেমন কোনও জো নেই, তেমন সেইসব পুস্তক পড়িয়ে শিক্ষক বা শিক্ষায়তনের কর্তাদের পকেটে অতিরিক্ত কিছু আসে না। ফলে রাজ্যের পঙ্গু শিক্ষাব্যবস্থায় সহায়িকার রমরমা। ছাত্র কিংবা অভিভাবকেরা জানেন কোন সেই জাদুকরের হাতের ছোঁয়ায় এইসব সহয়িকা গ্রন্থ হয়ে উঠেছে সাফল্যের চাবিকাঠি। সহয়িকা গ্রন্থ অনুশীলন না করলে পিছিয়ে পড়তে হবে, কারণ প্রশ্নকর্তা কিংবা শিক্ষাসংসদের বিদগ্ধজনেরা যে মূল পাঠ্যপুস্তকে নয়, সহয়িকাতেই তাঁদের মোক্ষ খুঁজে পান। প্রশ্নপত্র সেখান থেকেই তৈরি করা হয়; সাফল্যের মেড-ইজ়ির হদিশও সেখানে থেকেই পাওয়া।
দ্বিতীয় ধরনের প্রকাশনা ব্যবসা যা চলছে মাটির প্রদীপের মতো; সেই ব্যবসার গলিঘুঁজি ভ্রমণ এই অধ্যায়ের উদ্দেশ্য। বলাবাহুল্য এইসব গলিঘুঁজি কাশীর গলির মতো গোলকধাঁধায় ভরা। এবং এখানেও ‘ধর্মের ষাঁড়’-এর সংখ্যা নিতান্তই বেশি। অর্থাৎ তারাই সংখ্যাগুরু। এই দ্বিতীয় ধরনের ব্যবসাদারেরা নিজেদের সাহিত্যের প্রকাশক এবং প্রচারক এমন একটা সাইনবোর্ড পিঠে বেঁধে ঘোরেন। বহু বছরের ব্যবহারে যদিও জীর্ণ হয়েছে সেই সাইনবোর্ড, তবুও সেটাই তাঁরা অক্লেশে বয়ে চলেছেন। আর এই বহনক্ষমতার দরুন তাঁরা নিজেদের সমাজের এক বিশিষ্ট জীব হিসাবে দেখতে এবং ভাবতে ভালবাসেন। তাঁরা কেউ উদ্যোগপতি নন, দালাল, ভদ্র ইংরাজিতে বললে কমিশন এজেন্ট। সামান্য পুঁজির সঠিক লগ্নি আর সৎ পরিশ্রম একজন উদ্যোগপতির সবচেয়ে বড় গুণ। সেই সামান্য পুঁজি কালে-কালে তাকে হয়তো পুঁজিপতির মতো একটা বিচ্ছিরি চরিত্র বানিয়ে দিতে পারে, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ, মূল কথা পুঁজির বিকাশ না হলে শিল্প হয় না।
প্রথমেই আমরা ব্যবসায়ী উদ্যোগের মূলসূত্রগুলো একবার ঝালিয়ে নিতে চাই, বুঝে নিতে চাই ব্যবসায় সাফল্যের শর্তগুলো কী?
ব্যবসার প্রথম শর্ত পুঁজি। শুরুতে উদ্যোগপতিকে সেই পুঁজি ঢালতে হলেও, পরে ব্যবসা থেকেই পুঁজির প্রয়োজনীয় বিকাশ ঘটে। ব্যবসায় মুনাফা দুধরনের— স্বল্পকালীন (যেমন প্রতিবছরের লাভ) আর দীর্ঘকালীন (যেমন গুডউইল, বিশ্বাসযোগ্যতা। এগুলো পারিভাষিক ভাষায় ইনটেনজিবল)। ব্যাবসার বাঁহাতে পুঁজি কিংবা দায় থাকলে ডানহাতে থাকে সম্পদ যা তৈরি হয় মুনাফা থেকে। এর অর্থ ব্যবসায় পুঁজি হল দায়— যিনি লগ্নি করেছেন, তার কাছে এই দায় যতদিন ব্যবসা সচল, ততদিন থাকতে বাধ্য। এক কথায় লগ্নিকারী আর ব্যবসা দুই ভিন্ন অস্তিত্ব। ব্যবসা হল নাবালক; তার রক্ষার দায় মালিকের। নাবালক আর তার অভিভাবক যেমন একই সত্তা নয়, ব্যবসায়ও তাই। সেই মালিক একক, অংশীদারী, কিংবা ডিরেক্টর যাই হন, তাঁর ক্ষমতা কিন্তু আইনের চোখে সীমাবদ্ধ। এই সাধারণ সমীকরণ আমাদের বাংলাসাহিত্যের প্রকাশনজগতে প্রায় অচল। আমাদের অধিকাংশ প্রকাশকই নিজেকে প্রকাশনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে পারেন না। চানও না হয়তো। অথচ, পুঁজির সঠিক ব্যবহারে বাংলা প্রকাশনায় সাফল্য পাওয়া যায়, তার উদাহরণ বিশ্বভারতী কিংবা উদ্বোধনের মতো প্রকাশনা সংস্থা।
সামান্য পুঁজির ব্যবসা হিসাবে বাংলা প্রকাশনা সফল মডেল হতে পারে, যদি স্বল্পকালীন মুনাফা পাখির চোখ না হয়।
যেকোনও উদ্যোগের পেছনে থাকে বিষয়ের প্রতি ভালবাসা। কিন্তু সেই ভালবাসা যখন রুটিরুজি, সম্মান আর কীর্তির সমনাম হয়ে ওঠে তখন নিছক ভালবাসা যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় বিষয়ের প্রতিটা খুঁটিনাটির প্রতি দরদ; উদ্ভাবনীশক্তির প্রয়োগ, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। ব্যবসায়িক উদ্যোগ তখনই একটা শিল্প বা বাণিজ্য হিসাবে স্বীকৃতি পায় যখন সংখ্যাগুরু উদ্যোগপতি সততার সঙ্গে দরদ, উদ্ভাবনী শক্তি আর রিসার্চ-ডেভেলপমেন্টের মধ্যে দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। দুঃখের কথা কলকাতার বইব্যবসায়ীরা ব্রিটিশদের সান্নিধ্যে দীর্ঘকাল থাকলেও ইংরাজি বইয়ের প্রকাশনার কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করলেন না। বরং এই প্রসঙ্গ উঠলে তাঁদের অজুহাত সেভাবে বই প্রকাশ করলে বইয়ের দাম যা দাঁড়াবে, তাতে ক্রেতা পাওয়া যাবে না। তাই সাহিত্যের নামে যাবতীয় অখাদ্য ছাপানো আর পরিবেশনায় তাঁদের নজর। পুঁজির বিকাশ এখানে কীভাবে হবে যদি না পুঁজিকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়? আমাদের ভাষার লেখকেরা যেমন সাহিত্যকীর্তিতে জন্মনিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসী নন, তেমনই প্রকাশকেরা। সম্বচ্ছর বইমেলা নামে পার্বণকে সামনে রেখে নিম্নমানের অগুনতি বই প্রকাশিত হয়। যাঁরা এই পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত তাঁরা স্বল্পমেয়েদি মুনাফাকেই পাখির চোখ করেছেন। ফলে লেখক যেমন জনপ্রিয়তার লোভে গু–গোবর যা পারেন লিখে ছাপাতে চান, প্রকাশকও। কড়ির বিনিময় সেসব ছেপে পকেট ভারী করেন। বই প্রকাশ যে নির্মাণ, সেই মূল কথাটাই উহ্য থেকে যায়। এর দরুন আমাদের চিত্রশিল্পীরা, যাঁরা বইয়ের মলাট এঁকে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করেন, তাঁরা যেমন বঞ্চিত হন, তেমন বাঁধাইশিল্পী কিংবা প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত প্রুফরিডার, কম্পোজিটারাদেরও নিচু নজরে দেখা হয়। শ্রদ্ধা নেই যে ব্যবসায়, বাকিদের ঠকিয়ে (এই ঠকানোর মধ্যে পাঠকও থেকে যান) মুনাফা আর জনপ্রিয়তা যেখানে একমাত্র কাম্য, সেখানে পুঁজির বিকাশের কোনও সম্ভাবনা থাকার কথা নয়। হয়নি।
বাংলা সাহিত্যকে পুনর্জীবন দিতে গেলে প্রকাশকদের মেধা আর পরিশ্রমের সঠিক প্রয়োগ দরকার। তাঁদেরও বুঝতে হবে সাহিত্য কী? কাকে বলে সাহিত্য? সমাজে তার ভূমিকাটা কেমন? রাজনেতাদের বই (যা সাহিত্যপদবাচ্য নয়) ছাপিয়ে ক্ষমতার শীর্ষে ওঠার চেষ্টা যেমন নিকৃষ্ট, তেমন লেখকের কষ্টের পয়সা পকেটস্থ করে তাদের সাহিত্যচর্চাকে খুন করা আর যাইহোক কোনও সৎ শিল্প প্রচেষ্টা নয়। একজন দক্ষ সম্পাদকের দায় যেমন অনামী/অখ্যাত লেখককের প্রতিভাকে লালন করা, তাকে প্রকাশ আর পরিচর্যা করা, ঠিক তেমনই একজন প্রকাশকের লগ্নি হওয়া উচিত প্রকৃত সহিত্যকাজে। কারণ তাঁর ব্যবসা বই প্রকাশ, দালালি নয়। এর জন্য প্রথমেই প্রকাশককে সাহিত্য সম্পর্কে নিরন্তন জ্ঞান আহরণ করতে হবে। সারাদিনের কাজের মধ্যে বই কেনাবেচার আগে তাঁর উচিত, অন্তত একটা বই বা লেখা পড়া, দেখা আর বোঝা। প্রয়াশ দেখা যায় বঙ্গীয় প্রকাশকেরা বইয়ের মলাট উল্টেপাল্টে দেখে তাঁদের দায়সারা মন্তব্যটুকু রাখেন, যেন ওখানেই বইটার মোক্ষ লুকিয়ে আছে। বাকিটা পাঠক আর আলোচকের দায়িত্ব। তাঁরা ভুলে যান বইয়ের প্রচ্ছদ নির্মাণের প্রধান কাজ মূল বইকে সুরক্ষিত রাখা। যে কারণে আমরা বিদেশি বইয়ে সাধারণত আর্টওয়ার্ক নয়, বইয়ের বিজ্ঞাপন আর লেখকের প্রশস্তি দেখতে পাই। বিদেশি প্রকাশন সংস্থাগুলোর উদ্দেশ্য মলাটে বিজ্ঞাপন দিয়ে বইটা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করা। আমাদের এখানে প্রকশকেরা তার ভেতরে আর ঢুকতে চান না। দেখতে চান না বইটার মধ্যে লিখিত বস্তুটা কেমন? ছাপার ভুল, বানান ভুল, তথ্যের ভুল এসব কতটা? কীভাবে তার পরিমার্জন করা দরকার? যেখানে গুণমানের চেয়ে সংখ্যামান প্রধান বিবেচ্য, সেখানে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না।
আজকাল কথাপ্রসঙ্গে ‘কপি এডিটিং’ শব্দটার চল শোনা যায়। লোকে বলেন, আমাদের এখানে কপি এডিটিং থাকলে বইয়ের মান বাড়বে, দামও। অথচ কপি এডিটিং আমল পায় না। একথা সত্যি কপি এডিটর একটা সম্মানজনক পেশা, বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয় পাঠক্রম আছে। বিদেশি প্রকাশনায় কপি এডিটর না থাকলে বই নির্মাণ সম্ভব নয়। অথচ বাংলা বইয়ের প্রকাশনায় এ বিষয় দামের কথা বলে সকলেই এড়িয়ে যেতে চান। কেন? প্রথমত বাংলায় কপি এডিটিং বলে কোনও পেশা নেই। এর দরুন ওভাবে কেউ ভাবতে চান না। দু–একজন প্রকাশক জাঁক করে বলেন বটে যে তাঁরা কপি এডিট করে বই প্রকাশ করেন, কিন্তু তাঁরা ভুলে যান অধ্যাপক কিংবা সাহিত্যের ছাত্র হলেই কেউ কপি এডিটরের সম্মান পেতে পারেন না। যিনি কপি এডিটর হবেন, তাঁর দায়িত্ব-কর্তব্য লেখকের চেয়ে কম নয়, বরঞ্চ কোনও-কোনও বিষয়ে বেশি। দ্বিতীয়ত আমাদের লেখকেরা মনে করেন তাঁরা সর্বজ্ঞ। তাঁদের কোনও লেখা এডিট করা যাবে না। বানান ভুল, ছন্দ ভুল, ব্যাকরণ ভুলে ঠাসা সেসব সাহিত্যই দু-মলাটের মধ্যে ছেপে বাজারজাত হয়। অপদার্থ প্রুফরিডার গালি খান।
প্রকাশকেরা উত্তরে বলতে পারেন বাণিজ্যসফল লেখক ছাড়া বই ছাপিয়ে ফায়দা কী? তিনি ব্যবসা করতে এসেছেন, দানছত্র খুলে বসেননি। যুক্তিটা ভুল নয়, তবে ওপর থেকে দেখা। বাণিজ্য কাকে বলে? আর কাকেই বলে সফলতা? এই দুটো শব্দের উত্তর পেলেই আমরা আশাকরি সমস্যাটা ধরতে পারব। আগেই বলা হয়েছে ব্যবসার মুনাফা স্বল্পমেয়াদি যেমন, তেমন দীর্ঘমেয়াদিও বটে। বই প্রকাশনা শিল্পে এই দীর্ঘমেয়াদি মুনাফার দিকটাই বেশি। দীর্ঘমেয়াদে প্রকাশক তার গুডইউল তৈরি করলে পাঠক, আলোচক কিংবা সাহিত্যিক সকলের কাছে সম্ভ্রম আদায় করা যায়, যা থেকে পরবর্তী সময় ব্যবসায় শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। দীর্ঘমেয়াদি মুনাফা অর্জনের জন্য কখনও-কখনও স্বল্পকালীন ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। এটাই বাণিজ্য। ব্যবসায় লাভ-লোকসান অঙ্গাঙ্গী। আর যে সাহিত্য সফল, তার খানিক ধারাবাহিকতা তো থাকবেই? কিন্তু দেখা যায় বাণিজ্যসফল লেখকদের নাম আর নিশান তাঁদের মৃত্যুর একবছরের মধ্যেই বাজার থেকে উবে যায়। তাহলে একে কি সফলতা বলা যায়? আমাদের সমাজে আর পাঁচটা জিনিসের মতো সাফল্য সম্পর্কেও খুব গোলমেলে একটা ধারণা রয়েছে। সেই ধারণা নিয়ে সাফল্য-ব্যর্থতাকে বিচার করা হয়। দুটো বই বেশি কাটতি, সাহিত্য পুরস্কার কিংবা বড় বাণিজ্যিক কাগজে লেখা ছাপানোকে যদি সাফল্য মেনে নিতে হয়, তবে বাংলা সাহিত্যে অমিয়ভূষণ, কমলকুমার, নবারুণ ভট্টাচার্যদের নাম কাটা পড়া দরকার। নাম কাটা পড়বে মানিকবাবু কিংবা সতীনাথ ভাদুড়ি মশাইয়েরও। কারণ তাঁরাও জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় সাফল্যের এই শর্তগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। পাঠককে সত্যিকার সাহিত্যের ভাগ দিতে গেলে অবশ্যই সেসব লেখকের তলাশে থাকতে হবে, যাঁদের লেখায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, সাহিত্য তেলেভাজা নয়, গরম গরম পরিবেশনে তার কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই।
বাংলা প্রকাশনার দুর্দিন যা নিয়ে আজ সকলেই কমবেশি হা-হুতাশ করেন, এর-তার ঘাড়ে দোষ চাপান। প্রকাশকেরা যেমন মনে করেন আজকাল পুরনো দিনের মতো সাহিত্য লেখা হয় না, কারণ অযোগ্য লেখকে বাজার ছেয়ে গেছে। তেমন লেখককূলও মনে করেন প্রকাশক মাত্রই ঠকবাজ। অবশ্য এরই মধ্যে দুতরফে বেশ মাছ আর মেছুয়া সম্পর্ক স্থাপিত হয়। লেখক পয়সা গচ্চা দিয়ে কিংবা রয়েলটি না পেয়েও বই ছাপাতে দেন। প্রকাশক সেই বই ছাপিয়ে পয়সা কামান। আর এই পুরো ব্যবস্থাটা চলে বাৎসরিক বইমেলাকে কেন্দ্র করে। সংখ্যাগুরুর সর্বগ্রাস সমাজজীবনে প্রচলিত মুদ্রাদোষ। যেমন দুর্গাপুজো। উৎসব মোচ্ছবে অবনত হয়ে বাংলার অর্থনীতি থেকে রাজনীতি সবকিছুকেই দখল করে নিয়েছে। যাঁরা রাজপুরুষ, এটা তাঁদেরই পুরনো একটা সংস্কৃতি। পাঠক মনে করে দেখুন, কলকাতায় দুর্গাপুজোর রমরমার শুরু পলাশি যুদ্ধ থেকে লুঠ করা নবাবি টাকায়। এই লুঠ-সংস্কৃতি আজ বাংলা বই প্রকাশনাকেও গ্রহণে ঢেকে দিয়েছে। আমাদের রাজ্যে আজকাল প্রায় মাসে-মাসে ছোটবড় বইমেলা/বইবাজার হয়, হয়ে থাকে। এটা এখন প্রতিষ্ঠিত একটা ধরন, এই মেলা বা বাজার হাটের মতো, এখানে সাহিত্য নয়, বই বিকোয়। যাঁরা সত্যিকার বইপ্রেমী, যাঁরা সারাবছর বই পড়েন, কেনেন, তাদের সামান্য ভগ্নাংশ বইমেলা থেকে বই কেনেন। হুজুগে পাঠক, যাদের কাছে বই প্রেম নয়, পাঠ নয়, সাজিয়ে রাখার মতো কিছু একটা, তারা হামলে পড়ে এসব মেলা কিংবা বাজারে। পাঠক-ঠকানো বই কিনে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বাড়ি ফেরে। বইমেলা আর শারদ সংখ্যার সংস্কৃতি থেকে বের না হলে বাংলা সাহিত্যের, উপন্যাসের কোনও মুক্তি নেই। সাহিত্য অমরতা দাবি করে, সেখানেই তার গ্রহণযোগ্যতা। আজকের সাহিত্যের প্রভাব যদি আগামী প্রজন্মের ওপর না পড়ে, তাহলে ধরে নিতে হবে সেই সাহিত্য অপ্রয়োজনীয়, বাতিল আর তার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসাও ভ্রান্ত। যে কারণে দেখা যায় ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে ওঠা বহু প্রকাশনা, ব্যক্তির মৃত্যুর পর ঝাঁপ ফেলেছে। কারণ, ব্যক্তির পরবর্তী প্রজন্ম প্রকাশনা শিল্পে অনাগ্রাহী। অথচ, খাবারের দোকান থেকে কাপড়ের দোকান, কারখানা থেকে চাষবাস প্রায় প্রত্যেক ব্যবসা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বহে চলে। বাংলা প্রকাশনায় সেটা কখনওই প্রায় হয়ে ওঠে না।
পুঁজিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে সাহিত্যের ওপর লগ্নি করতে হবে। উদাহরণ সিগনেট প্রেস আর তার কর্তা ডিকে। আজও এতদিন পরে ডিকের কথা ওঠে আড্ডা কিংবা বির্তকসভায়। দিলীপ কুমার গুপ্ত বাংলা প্রকাশনায় যে আলোড়ন এনেছিলেন, দুর্ভাগ্য সেই আলোড়নে আলোড়িত হলেন না পরবর্তী আর কেউ। এমনকি যে বিশ্বভারতী আর উদ্বোধনের কথা বলা হয়েছে আগে, তারাও সাহস করে ‘রবিজীবনী’ কিংবা ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’ বা ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’-এর মতো বই ছাপাতে পারেনি। ‘বেস্ট সেলার’ শব্দটা সাহিত্যের ক্ষেত্রে অশ্লীল, সেই অশ্লীলতাকে নিয়ে যাবতীয় কামড়াকামড়ি; মারপিট; পুরস্কারটুরস্কার। যেখানে উদ্যোগপতি নিজেই সাহিত্য সম্পর্কে, তার লেখককুল সম্পর্কে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেন, সেখানে পুঁজির বিকাশ হওয়ার কথা নয়। তবু এরই মধ্যে গুটিকয়েক প্রকাশনা অন্যদের কোণঠাসা করে সর্বস্বক্ষমতা দখলে নেমেছেন। এই কর্দযতার সঙ্গে মিশেছে শাসনক্ষমতা। বইমেলার কর্তৃত্ব ইত্যাদি। আমাদের বলার কথা এই, যদি সত্যি বাংলা প্রকাশনা শিল্পের কোনও ভবিষ্যৎ না থাকে, তাহলে তা নিয়ে তাবড়-তাবড় মেধাজীবীদের এমন আদেখলেপনা কেন? কেন তাঁরা পুরস্কার, বইমেলার উদ্যোক্তা কিংবা রাজনীতির কেষ্টবিষ্টুদের কাছের মানুষ হয়ে উঠতে চান? আমাদের মনে হয় প্রশ্নটা যেমন সহজ, উত্তরটাও ঠিক তেমন সকলের জানা।
বাংলা সাহিত্যের সার্বিক অবক্ষয়, অবনতির অন্যতম মূল কারণ দালালশ্রেণির হাতে বাংলা প্রকাশনা ব্যবসার কর্তৃত্বটা চলে যাওয়া। বিদ্যাসাগর তাঁর একক দক্ষতায় সে-যুগে প্রকাশনায় এক নীতি চালু করেছিলেন, সেই নীতি কিংবা সমীকরণ থেকে বের হতে চাইছেন না প্রায় কেউ। কারণ পুঁজি ঢালতে সকলেরই অনীহা। পরের ধনে পোদ্দারি করে লেখক আর পাঠক ঠকিয়ে প্রকাশনার নামে যা চলে আসছে, তাতে আগামীদিন আরও অসহনীয় হয়ে উঠবে। এমনিতেই বিনাপয়সায় পিডিএফ বানিয়ে বই বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে কিছু অপরাধী। তারপর ই-বুক, অডিওবুক এসবও জনপ্রিয়তার মুখে। যেভাবে আজ বিভিন্ন অনলাইন অ্যাপের প্রাদুর্ভাবে সহায়িকা পুস্তক ব্যবসা প্রায় লাটে উঠতে বসেছে, আগামীদিনে বাংলা সাহিত্যেও সেই দশা হবে, যদি না প্রকাশনা শিল্পে সততা আর পরিশ্রমের মিশেল ঘটে। যদি না কলেজ স্ট্রিট চৌহদ্দির বাইরে এই ব্যবসাকে নিয়ে যাওয়া হয়। কোভিড মহামারির কারণে বহু যোগ্য মানুষ তাঁদের পেশা হারিয়ে এখন বাংলা প্রকাশনায় ঢুকতে চাইছেন। তাঁরা যদি কয়েকজন দালালের কুক্ষিগত বইব্যবসাকে কেড়ে নিয়ে সর্বজনমান্য করে তোলেন, তখন তাঁদের বোধহয় দোষ দেওয়া যাবে না। এমনকি ইউটিউব চ্যানেলে যেভাবে পুরনোদিনের সাহিত্যকে গল্পপাঠের আদলে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে, তেমনটাও যদি নতুনদিনের সাহিত্যের ক্ষেত্রে ঘটতে থাকে তাহলেও দোষ দেওয়া যাবে না। বিশ্বায়নের যুগে উদ্ভাবনীশক্তি কোনও এক নির্দিষ্ট শ্রেণি বা ভূগোলে আটকে নেই। আজকের ইনফরমেশন টেকনোলজির যুগে লাইব্রেরিও মোবাইল ফোনে এসে গেছে। কাল যদি লেখক নিজেই এই টেকনোলজিকে কাজ লাগিয়ে পাঠকের কাছে সরাসরি পৌঁছে যান, তাহলে অনিবার্য এক বিনাশের ছায়ায় ঢেকে যাবে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ। ফলে আজকের এই বিশৃঙ্খলা থেকে দালাল প্রকাশকেরা বেড়িয়ে আসতে না পারলে তাঁদের সমূহ বিপদ। এবং তাঁদের কোটরনিবাসী সাহিত্যিকদেরও। যাঁরা বিশ্বাস করেন যেনতেনপ্রকরণে বেস্ট সেলার হওয়া, কামিনীকাঞ্চনে ফুলে ওঠাই সাহিত্যকর্ম, প্রকাশকধর্ম।
পুঁজির বিকাশ একান্তই দরকার। সেই পুঁজি ঢালতে হবে নতুনদিনের সাহিত্যের জন্য। সেই সাহিত্যের পাশেই দাঁড়াতে হবে। জোরশোর বলতে হবে নতুন সাহিত্য পড়ুন। সেমিনার, আলোচনাচক্র নয়, পাঠকের কাছে পৌঁছে কথাটা বলতে হবে। নইলে আর কয়েক দশকের মধ্যে কলেজস্ট্রিট বইপাড়া জামাকাপড়ের শপিংমলে পরিণত হবে। অর্থাৎ বলার কথা এই, প্যাকেটজাত হলদিরাম প্রভুজির সোনপাপড়ি নয়, সহৃদয় প্রকাশকেরা পারলে গাঙ্গুরাম কিংবা নকুড়ের মিষ্টির কদর করতে শিখুন। এর জন্য হয়তো প্রচুর আবর্জনা ঘাঁটতে হবে সত্যি, তবে ব্যবসায়িক মেধাবুদ্ধি, যাকে ইংরেজিতে বলে বিজনেস অ্যাকুইমেন, থাকলে আবর্জনার মধ্যে থেকেই পাওয়া যাবে প্রকৃত সাহিত্যের মণিকাঞ্চন। প্রশ্নটা হল উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকা আমাদের বাঙালি প্রকাশকেরা কি সেই দায়িত্ব নেবেন?
[আবার আগামী সংখ্যায়]