Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মোহন ভাগবতের প্রবচন ও প্রকৃত বচন

মোহন ভাগবতের প্রবচন ও প্রকৃত বচন | নন্দন রায়

নন্দন রায়

 



প্রাক্তন প্রশাসক, প্রাবন্ধিক, লিটল ম্যাগের সঙ্গে যুক্ত

 

 

 

 

কিছুদিন আগে সংবাদমাধ্যমে হইচই পড়ে গিয়েছিল যখন আরএসএস-এর সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত লখনউ শহরের একটি মাদ্রাসায় গিয়ে সেখানকার ইমামের সঙ্গে দেখা করেন এবং কিছুক্ষণ আলাপচারিতা করেন। তিনি বলেন যে মুসলমানরা যদি হিন্দুদের ‘কাফের’ বলে সম্বোধন না করে এবং তারা যদি এই ঐতিহাসিক সত্য মেনে নেয় যে তাদের পূর্বপুরুষরা হিন্দুই ছিলেন, তাহলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে আর বৈরীভাব থাকবে না। এবং পশ্য পশ্য, কী আশ্চর্য, তিনি একথাও বলেন যে সব মসজিদের খাঁজে খাঁজে শিবলিঙ্গ খোঁজার দরকার নেই। এহেন সদ্ভাবনার বার্তা মোহন ভাগবত নিজে মাদ্রাসায় গিয়ে দিয়ে এলেন! চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। বিজেপি-আরএসএস চক্রের বিরোধী যে বিপুল জনতা আছে, তারাও ধন্ধে পড়ে ভাবতে শুরু করলেন, তবে কি সঙ্ঘ-পরিবারের হৃদয় পরিবর্তন ঘটতে চলেছে? পাঠকগণ আশ্বস্ত হোন। হৃদয় পরিবর্তনের মতো এমন অসম্ভব কিছু ঘটেনি। ‘পরিবার’ ১৯২৫ সালে যে মতাদর্শে স্থিত ছিল, আজও তা-ই আছে।

মোহন ভাগবতের এই সুচতুর ‘চাল’টিকে বৃহত্তর সামগ্রিক পরিসরে দেখতে হবে। যেমন এইমাত্র বলা হল, আরএসএস-এর একমাত্র অপরিবর্তনশীল অ্যাজেন্ডা হল ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। তার মানে যেন এটা ভেবে বসা নয়া হয় যে হিন্দু-রাষ্ট্র মানে হচ্ছে গরিষ্ঠ গোষ্ঠীর শাসন। বরং তার নির্গলিতার্থ হচ্ছে কার্যকরভাবে সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক সংগঠনটির একনায়কতান্ত্রিক শাসন। প্রয়োজনে এই একনায়কত্ব একটি গণতান্ত্রিক্ খোলসের মধ্যে সাজিয়ে এমনভাবে পরিবেশন করা হবে যেন হিন্দু ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছে মনে হয় এ তো তাদেরই শাসন। বিজেপি যে স্লোগান তুলেছে— বিরোধীমুক্ত ভারত— সেটা এই লক্ষ্যের দিকে নির্দেশ করে। হিন্দু রাষ্ট্রের এই ধারণায় অন্তর্লীন হয়ে আছে এক ‘অপর’-এর ধারণা। অর্থাৎ যারা ‘আমাদের’ নয়, সেই মুসলমানরা এই দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকবে, তা তারা যতই ‘কাফের’ বলা বন্ধ করুক এবং নিজেদের পূর্বপুরুষদের হিন্দু বলে জাহির করার চেষ্টা করুক না কেন।

আরএসএস গঠনের দিন থেকেই তারা মুসলমানদের ‘অপর’ বলে চিত্রিত করার চেষ্টা লাগাতার চালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু নিজেদের একমেবদ্বিতীয়ম অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়িত করতে মাঝেমধ্যে কিছু কৌশলী চাল চেলে দেয়। ভাগবতের মাদ্রাসাযাত্রাও এমনই এক কৌশল, যাতে আসন্ন ২০২৪-এর ভোটে কিছু অনন্যোপায় মুসলমান ভোট বিজেপি হাতিয়ে নিতে পারে। এই ঘটনার মধ্যে এর বেশি কিছু অর্থ খোঁজা নিরর্থক। তাঁর এই সফর ও সেখানে বলা তাঁর বার্তার মধ্য দিয়ে মোহন ভাগবত চেষ্টা করেছেন মানুষজনকে বিশ্বাস করাতে যে এর মধ্যে গভীর তাৎপর্য আছে। আমরা যদি সেই তাৎপর্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করি, তাহলে আমরা আরএসএস-এর পাতা ফাঁদে পা দেব। আমরা তাঁকে এ কথা জিজ্ঞাসা করতে ভুলে যাব যে মসজিদে মসজিদে শিবলিঙ্গ খোঁজার দরকার নেই বলে তিনি যে বিবৃতি দিয়েছেন সেটা কি নিম্নস্তরের একটা চালাকি নয়? তা-ই যদি না হবে তবে বজরং দল প্রভৃতির যে লোকেরা জ্ঞানবাপী মসজিদের ভেতরে ‘শিবলিঙ্গ’ পুজো করার দাবী তুলে বেনারসে তথা উত্তরপ্রদেশে শোরগোল পাকিয়ে তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? কেন তাদের কাজের প্রকাশ্যে নিন্দা করছেন না?

দুটো কথা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। প্রথম কথা, আরএসএস ও বিজেপির নেতৃত্বের মুখের কথায়, লিখিত বিবৃতিতে বিশ্বাস ন্যস্ত করা চরম মুর্খামির কাজ হবে। কারণ তাঁরা যা বলেন এবং নিজেদের শাসিত রাজ্যগুলিতে বাস্তবত যা করেন, তার মধ্যে কোনও সাযুজ্য নেই। এ কথা আমরা কিছুতেই ভুলে যেতে পারি না যে গত ১৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী যখন তার ভাষণে মেয়েদের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছেন, তখনই গুজরাটের জেল থেকে বিলকিস বানোকে ধর্ষণে এবং তার শিশুকন্যাকে মাটিতে আছড়ে হত্যা করার অপরাধে দোষী সব্যস্ত এগারোজন আসামীকে সাজা মকুব করে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তাদের পুষ্পমাল্যে ভূষিত করা হচ্ছে! এখন আরও জানা যাচ্ছে যে খোদ কেন্দ্রীয় সরকারই সাজা মকুবে সায় দিয়েছে।

দ্বিতীয় কথা, হিন্দুত্ববাদী যে অসংখ্য সংগঠন গোটা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে, আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পৃথক অস্তিত্ব থাকলেও তারা কাজ করে পরস্পরের সাথে তাল-মিল রেখে, প্রণালীবদ্ধভাবে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে। সঙ্ঘ-পরিবার কথাটি তাই খুবই সুপ্রযুক্ত। সঙ্ঘ-পরিবারের সদস্য সংগঠনগুলির এই আপাত পৃথকীকরণ খুব ভেবেচিন্তেই করা হয়েছে, কারণ বজরং দল গোমাংস নিয়ে যাওয়ার অপরাধে একজন মুসলমানকে পিটিয়ে মেরে ফেললে বিজেপিকে তার দায় স্বীকার করতে হয় না। মহাত্মা গান্ধিকে যখন হত্যা করা হল, তখন আরএসএস-এর প্রতি অভিযোগের আঙুল উঠেছিল। আরএসএস শিশুর সারল্যে ‘শিহরিত’ হয়ে সেই অভিযোগ অস্বীকার করে। অথচ বহু প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশকে জানিয়েছিলেন যে তাঁরা স্বয়ংসেবকদের মিষ্টি বিতরণ করতে এবং গান্ধিহত্যার জন্য উল্লাস প্রকাশ করতে দেখেছিলেন। সুতরাং ভাগবতের সফর ও বার্তার বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই।

যদি মুসলমানরা কাফের বলা পরিত্যাগ করে এবং পূর্বপুরুষদের হিন্দুত্বের স্বীকৃতি দেয়, তাহলেই হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সব দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে যাবে, এমন ভাবনা খুবই শিশুসুলভ। কারণ হিন্দু-মুসলমান বৈরিতার অবসান মানে হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিরও অবসান। তাহলে রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রতে আবার ফিরে আসবে বেকারি, দারিদ্র্য, মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয়গুলি। তখন আরএসএস-বিজেপি চক্র দেশের বর্তমান দুর্দশার জন্য নিজেদের অপদার্থতা ছাড়া আর কাকে দায়ী করবে?

 

আরএসএস-এর মতাদর্শগত নির্মাণ

আসল কথা হচ্ছে ভাগবতকথিত ইস্যুগুলি হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যেকার সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কোনও কারণই নয়। এই সাম্প্রদায়িক বিভাজন আসলে আরএসএস-এর নির্মাণ, তাদের মতাদর্শগত অস্তিত্বের জন্যে এই ‘নির্মাণ’ প্রয়োজন। মুসলমানদের ‘অপর’ বলে, ‘বিদেশি’ বলে এবং ‘যত নষ্টের গোড়া’ বলে দাগিয়ে দিতে পারলে এক হিন্দুত্ববাদী আইডেন্টিটি সচেতনভাবে অবয়ব ধারণ করে। ইতিহাসের বিচারে এটি একটি অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক ঘটনা। রোমিলা থাপারের মতো ইতিহাসবিদ দেখিয়েছেন যে এমনকি উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগেও বিভিন্ন প্রকারের ‘হিন্দু’দের ‘Hindu group of religions’ বলে উল্লেখ করা হত। একীভূত অবিভক্ত হিন্দু পরিচয়সত্তার ধারণার কোনও অস্তিত্ব তখন ছিল না। আজকের মতো একীভূত, অবিভক্ত ও অপরিবর্তনশীল হিন্দুত্ববাদী পরিচয়সত্তার নির্মাণ এবং তার বিপরীতে অনুরূপ একীভূত অবিভক্ত ও অপরিবর্তনশীল মুসলমান পরিচিতির নির্মাণ অপেক্ষাকৃত একটি সাম্প্রতিক ও আধুনিক ঘটনা এবং এই নির্মাণের পেছনে আরএসএস-এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বলা বাহুল্য এই নির্মাণের প্রয়োজনেই দুই ধর্মের প্রান্তিকতায় অবস্থিত অজস্র ধর্মীয় উপগোষ্ঠীগুলির স্বাধীন অস্তিত্বকে অবহেলা করা হয়েছে। হিন্দুদের কাফের বলা এবং হিন্দু-উত্তরাধিকার স্বীকার না করাই এই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেকার বৈরিতার উৎস, এই আজগুবি তত্ত্ব মেনে নিলে বাস্তবে আরএসএস-এর এই দর্শন মেনে নেওয়ার সামিল হবে যে হিন্দু ও মুসলমান দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর অপরিবর্তনীয় এবং মনোলিথিক সম্প্রদায় হিসেবে শতাব্দীর পর শতাব্দী পরস্পরের চিরশত্রু হিশেবে বিরাজ করছে। যখনই এই শত্রুতার মনোভাব তীব্র হয়েছে, যেমন ২০১৪ সালের লোকসভার নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে মুজফফরনগর দাঙ্গার ঘটনায়, অথবা ২০১৯-এর নির্বাচনের আগে পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনায়, তখনই বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অমীমাংসেয় বৈরিতা নিরন্তর জাগিয়ে রাখাটা অতএব হিন্দুত্ববাদীদের অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব ফিরিয়ে আনার জন্য মোহন ভাগবত যে দুটি ‘শর্তের’ প্রস্তাব দিয়েছেন তা নেহাতই অভিসন্ধিমূলক। সেই অভিসন্ধি হল ২০২৪-এর ভোটে যদি কিছু সংখ্যালঘু ভোট বিজেপির বাক্সে পড়ে। এরকম একটা সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমরা স্টকহোম সিনড্রোম-এর কথা শুনেছি। এমন একটা সময় আসে যখন নিপীড়িত তার পীড়নকারীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। ২০২৪-এ এমন কিছু ঘটনা ব্যতিক্রম হিসেবে হলেও ঘটতে পারে।

আরএসএস মুসলমানকে যে হিসেবে দেখে, সেটা তাদের স্বকপোলকল্পিত নিজস্ব এক নির্মাণ যার সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই। বস্তুত, নিজেদের কল্পিত এই নির্মাণে মুসলমানকে যে দানবিক চেহারা দেওয়া হয়েছে, আরএসএস তাকে ব্যবহার করে রক্ত-মাংসের আসল মুসলমানকে পিটিয়ে মেরে ফেলার জন্য। এই কল্পিত নির্মাণ অবিকলভাবে ততক্ষণ টিঁকে থাকবে যতক্ষণ না পর্যন্ত বাস্তবের মুসলমানের সঙ্গে আদানপ্রদানের মাধ্যমে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের আলোকে কল্পিত নির্মাণকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া্ না যায়। এটা সঙ্ঘীরা জানে না এমন নয়, আর তারা একথা জানে বলেই পাঠক লক্ষ করে দেখবেন যে গোঁড়া সঙ্ঘীরা রক্তমাংসের আসল মুসলমানের সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনে কোনও সম্পর্ক রাখে না। এবং ঠিক এই কারণেই সাধারণ হিন্দুরা যখন মুসলমানের সঙ্গে দৈনন্দিন আদানপ্রদানের অভিজ্ঞতায় ভিন্ন ধারণা পোষণ করতে উদ্যোগী হয়, তখন সঙ্ঘীরা এই সাধারণ হিন্দুদের অভিজ্ঞতালব্ধ স্বাভাবিক ধারণা খণ্ডন করতে উঠে-পড়ে লাগে, অজস্র অসম্ভব যুক্তির অবতারণা করে, হিন্দুকে তারা বোঝায়, এসব আসলে মুসলমানদের ‘লাভ জিহাদের’ ষড়যন্ত্র, তোমার ঘরের মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে ভুলিয়ে ধর্মান্তরিত করতে চায়।

আসলে কি সামাজিক, কি অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে মুসলমানরাই সবচেয়ে নিপীড়িত ও দুর্দশাগ্রস্ত। অথচ এদের প্রতি ন্যূনতম সহানুভূতি প্রকাশ করা অথবা দেশ ও দশের প্রতি এদের কোনওরূপ অবদান স্বীকার করা মানেই হচ্ছে আরএসএস কল্পিত দানবিক মুসলমানের নির্মাণটি ভেঙে ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া। যে গুটিকয় মুসলমানকে আরএসএস মাঝে মাঝে কুমিরছানার মতো তুলে ধরে জনসমক্ষে প্রদর্শন করে, আরএসএস-এর মতে তারা আসলে মুসলমান নয়।

 

আরএসএস-এর সহস্রমুখী অবতার

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। ভারত সরকার কিছুদিন আগে পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া নামের একটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নাকি সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লালু প্রসাদ বলেছেন, একই কারণে আরএসএস-কেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত। সকলেই জানেন যে মহাত্মা গান্ধির হত্যার পরে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করেছিলেন (অদৃষ্টের কী পরিহাস, সেই মহাত্মা গান্ধি থেকে শুরু করে সর্দার প্যাটেল, নেতাজি সুভাষ, মায় লালবাহাদুর শাস্ত্রী পর্যন্ত প্রায় সমস্ত কংগ্রেস নেতাদের বিজেপি হিন্দুত্ববাদী জাতীয় নেতা বলে আত্মসাৎ করে নিয়েছে। ব্যতিক্রম কেবল জওহরলাল নেহরু এবং ইন্দিরা গান্ধি। আবার এ বিষয়টিকে অদৃষ্টের পরিহাস বলে লঘু করাও উচিত নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে আরএসএস-এর শূন্য অবদানকে ধোঁয়াশায় আড়াল করতে এই আত্মসাতের রাজনীতির যেমন প্রয়োজন ছিল, তেমনই নেহরু-ইন্দিরার কর্পোরেট স্বার্থ থেকে সযত্ন ব্যবধান রক্ষা করা ও আপসহীন ধর্ম-নিরপেক্ষ অবস্থান হিন্দুত্ববাদীদের হজম করা সম্ভব নয়, কারণ তাদের মতাদর্শ ঠিক এর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে)। সেই নিষিদ্ধকরণ প্রত্যাহার করা হল যখন আরএসএস এই মর্মে একটি মুচলেকা দিল যে অতঃপর তারা রাজনীতির সঙ্গে সব সংস্রব ছিন্ন করবে। পরবর্তীকালে তারা এই প্রতিশ্রুতির প্রতিটি শব্দ লঙ্ঘন করেছে শুধু নয়, হিংস্রতাকে হাতিয়ার করে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উঠেপড়ে লেগেছে। নিজেদের সাংস্কৃতিক সংগঠন বলে দাবি করলেও, বিদেশি রাষ্ট্রদুতেরা, কর্পোরেট প্রভুরা, বিদ্বজ্জনেরা আরএসএস-এর প্রধান (সরসঙ্ঘচালক)-এর দরজায় সেলাম জানিয়ে যান। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রী-নেতারা তো সারাক্ষণ ভিড় জমিয়েই রেখেছেন, এমনকি সদ্য-নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মহোদয়া পর্যন্ত সমস্ত প্রোটোকল তুচ্ছ করে মোহন ভাগবতের আশীর্বাদ নিতে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সুতরাং পপুলার ফ্রন্ট নিষিদ্ধ করার একই লজিকে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করার দাবি যুক্তিযুক্ত।

আমরা অবশ্য কোনও সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে। কোনও সংগঠন যদি সন্ত্রাসবাদের মতো অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িত থাকে, তবে দেশের বিদ্যমান আইন অনুসারেই তার মোকাবিলা করা সম্ভব— তার জন্য ইউএপিএ ইত্যাদির মতো নিবর্তনমূলক আটক আইনের প্রয়োজন নেই। তদুপরি জনমানসে তাদের ক্ষতিকর প্রভাবের মোকাবিলা করার জন্য পালটা ইতিবাচক প্রভাবের প্রসার ঘটাতে হবে প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিসমূহের দ্বারা আরও বেশি করে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে।

 

মোহন ভাগবতের আরও বক্তব্য

প্রতি বছর বিজয়া দশমীর দিনে আরএসএস-এর সরসঙ্ঘচালক একটি ভাষণ দেন যেখানে আগামী বছরে কোন বিষয়গুলিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে সেগুলিকে নির্দেশ করেন। এবছরে তার প্রবচনে মোহন ভাগবত বলেছেন, ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার ভারসাম্যের পরিবর্তন রোধ করা দরকার, নইলে সেটা ভৌগোলিক সীমানা পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়। সুতরাং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আইন প্রনয়ণ করা উচিত। ভাগবতের ইঙ্গিত স্পষ্ট— মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হিন্দুদের বিপন্ন করে তুলেছে। এমনকি ভারতের ভৌগোলিক সীমারেখাও বিপন্ন হতে পারে। অথচ ভারত সরকারেরই সাম্প্রতিক ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে দেখিয়েছে যে ভারতে সব ধর্মীয় গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে জন্মহার কমে আসছে, আর জন্মহার হ্রাসের ক্ষেত্রে মুসলমানরা অন্য সব ধর্ম-গোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। মুসলমানদের জন্মহার ১৯৯২-৯৩ সাল থেকেই দ্রুতহারে কমছে। বস্তুত, আজকের দিনে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে জন্মহারের ফারাক নামমাত্র। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই মুসলমানের মোট জনসংখ্যা ভারতে হ্রাস পেয়ে যাবে। যদি ১৯৯১ সালের মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি-হার অবিকৃত রেখে হিসেব করি, তাহলে মুসলমান জনসংখ্যা হিন্দু জনসংখ্যার সমান হতে ২২০ বছর লাগবে। আর এখন মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির যা হার, তাতে ভারতের মোট জনসংখ্যায় মুসলমানের সংখ্যা তো বাড়বেই নয়া, উলটে কমে আসবে।

সারা বিশ্বে এই সত্য অবিসংবাদীভাবে প্রতিষ্ঠিত যে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার যত বাড়বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ততই কমবে। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে জনসংখ্যার বিচারে তুলনীয় যে দেশটি আমাদের প্রতিবেশী, সেই চিনে জন্মনিয়ন্ত্রণের যাবতীয় আইন বাতিল করে এখন প্রতিটি চিনা দম্পতিকে আরও সন্তান উৎপাদনে উৎসাহিত করা হচ্ছে, কারণ তা না হলে দেশটি ক্রমশ বৃদ্ধদের দেশে পরিণত হবে, ফলে তার উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে।

আমাদের দেশেও কেরল সহ দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে জন্মহার কম এবং উত্তরপ্রদেশ সহ হিন্দি বলয়ে জন্মহার বেশি। মোহন ভাগবত যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে এতই চিন্তিত, কেন তিনি তার অনুগামী উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীকে কেরলের পথ অনুসরণ করার উপদেশ দিচ্ছেন না? বিজেপিশাসিত আরেক রাজ্য কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীকে কেন তিনি শিক্ষাঙ্গনে হিজাব নিষিদ্ধকরণের আদেশ তুলে নিতে বলছেন না যাতে মেয়েরা আবার শিক্ষার আলো পেতে পারে? এবং জন্মহার বৃদ্ধি রোধে শিক্ষিত মায়ের উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারে?

জনসংখ্যার হার নিয়ে এত কথা বলা মানে আরএসএস-এর পেতে রাখা ফাঁদে পা দেওয়া। কারণ ভাগবতরা চান লোকে এইসব ধাপ্পাবাজির বিরোধিতা করতে মেতে উঠে দেশের আসল সমস্যা, অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা, রুটি-রুজির সমস্যা, কর্মসংস্থানের সমস্যা, কর্পোরেট শোষণ ও সামাজিক নিপীড়নের সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে ভুলে যাক আর সেই ফাঁকে ভাগবতের কথাগুলো সঙ্ঘের প্রচারযন্ত্রের দ্বারা বহুগুণ পল্লবিত হয়ে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুণ দ্বিগুণ জ্বালিয়ে তুলুক।

ভাগবত যখন বলেন যে দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সবাইকে বৃহৎ হিন্দুত্বের ছাতার নিচে নিয়ে আসতে হবে, তখন কেন তিনি উচ্চবর্ণের সঙ্গে ছোট জাতের ছেলে অথবা মেয়ের বিবাহের কারণে সঙ্ঘটিত ‘অনার কিলিং’-এ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দাবি করেন না? তিনি তো আরএসএস-এর মহা-নির্দেশক, তবে তিনি কেন তার সংগঠনকে ‘অনার কিলিং’ প্রতিরোধ করতে বলেন না? সকলেই যখন হিন্দু, তখন এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সমসত্ত্ব মজবুত করতে কেন তিনি তার সংগঠনকে অসবর্ণ বিবাহে উৎসাহিত করতে আহ্বান জানান না? উচ্চবর্ণের দ্বারা ক্রমবর্ধমান দলিত নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বয়ংসেবকরা কেন আন্দোলন করে না? আসলে এসবের কোনওটাই আরএসএস-এর অ্যাজেন্ডায় নেই।

অথচ এর বিকল্প গত ৭০ বছর ধরে এদেশের শাসনপ্রণালীর মহান পুস্তকে নির্দেশ করা আছে— ভারতের সংবিধানে দেশের যাবতীয় অধিবাসীকে মৌলিক অধিকার-সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যারা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার ভোগ করবে এবং রাষ্ট্রের কর্তব্য হবে সেই নাগরিকদের সমদৃষ্টিতে সেবা করা।