ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য
গদ্যকার, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা
শান্তি বলে একজন আছেন বলে জানি। তিনি পুরুষ কী মহিলা কী ভিন্নতর লিঙ্গের মানুষ তা আমার জানা নেই। শুধু এটুকু জানি যে তেমন তেমন আতান্তরে পড়লে বা বিশেষভাবে কুপিত হলে লোকে বিপদের বা কোপের কারণকে ওই নামে আখ্যায়িত করে থাকে। বলাই বাহুল্য, সেই ডাক আদরের নয়! এই নোবেল শান্তি পুরস্কারের কথা শুনলে শান্তির সেই হতভাগ্য পুত্রটির কথাই আমার সবথেকে বেশি মনে আসে।
শান্তি ও তাঁর সেই হতভাগ্য পুত্রটির উপর ঈশ্বরের অশেষ কৃপা বর্ষিত হোক। আমরা বরং নোবেল শান্তি পুরস্কারের দিকে মন দিই।
এই শান্তি পুরস্কার ও তার প্রাপকদের নিয়ে পুরস্কার কর্তৃপক্ষ প্রায় চিরটাকালই সাংঘাতিক সমস্ত নজির রেখেছেন। নোবেল-নামাঙ্কিত অন্যান্য পুরস্কারের ক্ষেত্রে যতটা না জলঘোলা হয়েছে (বিজ্ঞানের কারবার সব ফস করে বুঝে ফেলাও সহজ ব্যাপার নয়, এ-ও একটা কারণ হতে পারে), এই শান্তি পুরস্কারকে নিয়ে হয়েছে তার শতগুণ। আসলে, এই পেরাইজ নিয়ে কর্তৃপক্ষ বরাবরই এমন কিছু ‘মৌলিক ধারণা’-র পরিচয় রেখেছেন, নিন্দুক, মতান্তরে কুৎসাকারীরা, কোনওদিনই তার মর্ম উপলব্ধি করে উঠতে পারেনি। এমতাবস্থায় ‘কলিযুগ’, ‘কলিযুগ’ বলে হা-পিত্যেশ ছাড়া কীই বা করা যায়?
মৌলিক ধারনার ব্যাপারটা কতকটা এইরকম। প্যালেস্টাইনের ইয়াসের আরাফত নোবেল পেলেন, আবার পেলেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়িৎজাক রাবিন বা বিদেশমন্ত্রী শিমোঁ পেরেজ! হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে নাম ঊঠল ভিয়েতনামের ল দুক থো-এরও! ওই সেই ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা’ না কী যেন একটা কথা আছে না? ব্যাপারটা বোধ হয় অনেকটা তেমন। আবার দেখুন, ওবামা সাহেব আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হতে না হতেই পুরস্কার! মন্দ লোকে বলছে, ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমাদ কুড়ি বছর ধরে এরিট্রিয়ার সঙ্গে ঘটে চলা গোলমাল থামানোর জন্য পেরাইজ পেলেন ২০১৯-এ। এরপর ওঁরই নিজের দেশের উত্তরে গোলমাল লাগল ২০২০ সালে, যে গোলমাল দমনে, নিন্দুকেরা বলে, আহমাদ সাহেব এমন কিছু কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন যাতে নাকি মানবাধিকার বলে কোনও একটা ‘অজানি দেশের না-জানি কী’ একটু টোল খেয়ে গেসল। আমাদের পাশের দেশ, শরৎবাবুর বর্মা, সেখানে অং সাং সু কি রোহিঙ্গাদের উপরেও ওই আহমাদ-দাওয়াই দেওয়াতে তাঁরও পেরাইজ ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি ওঠে, যে পেরাইজ উনি পেলেন ১৯৯১ সালে।
তা এইবারের পেরাইজের ক্ষেত্রেও যথারীতি কিছুটা মৌলিকত্বের ছাপ বাবুরা রেকেচেন! আমাদের অ-ভূমি আ-ভূমির মত ওঁদের এবারের পেরাইজের থিম হল ইউক্রেনের যুদ্ধু! এবারের এই পুরস্কার অর্পণ করা হয়েছে একটি মানুষ ও দুটি সংস্থাকে। মানুষের নাম আলেস বায়ালিয়াৎস্কি। তিনি বেলারুস বা বাইলোরাশিয়ার বাসিন্দা ও ‘মানবাধিকার’ কর্মী। আর সংস্থাদুটির মধ্যে একটির নাম ‘মেমোরিয়াল’, যার অবস্থান রাশিয়াতে, আর অপরটির নাম ‘সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিস’, যার অবস্থান ইউক্রেনে। মুশকিলের ব্যাপার হলে এই দুটি সংস্থার কাজের মূল ক্ষেত্রও মানবাধিকার! বলাই বাহুল্য, এই তিন প্রাপকই রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ নিয়ে খড়্গহস্ত।
শিক্ষিত পাঠক, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের প্রতি আমার প্রচ্ছন্ন মদত রয়েছে— হুট করে এমন কিছু ভেবে বসবেন না যেন! এই রচনায় রাশিয়া সঠিক কর্ম করেছে না ইউক্রেন, এ-নিয়ে কোনও প্রতর্কেরই সূত্রপাত হোক এমন আমি চাইছি না।
বরং যুদ্ধের কথায় আসা যাক।
চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে হালের ১৩ নভেম্বর তারিখ পর্যন্ত রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেনে মৃত্যু হয়েছে ৬,৫৫৭ জন অযোদ্ধা সাধারণ মানুষের। আহত হয়েছেন ১০,০৭৪ জন। তথ্যসূত্র: রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার বিভাগের হাইকমিশনারের দফতর।
সংখ্যা দিয়ে মৃত্যুর ভয়াবহতাকে খাটো বা মহান করতে যাবার চেষ্টা অবশ্যই অপকর্মবিশেষ। তবু একটা কথা না বলে পারা যায় না। ২০১৪-র পর থেকে নভেম্বর ২০২১ পর্যন্ত ইয়েমেন যুদ্ধে, যাকে সিভিল ওয়র বলা হলেও যুদ্ধটা আসলে হচ্ছে সৌদি আরব ও ইয়েমেনের মধ্যে— মোটের উপর মারা গিয়েছেন ৩,৭৭,০০০ সাধারণ মানুষ। এই সংখ্যাটি হিসাব কষে বের করেছে ইউএনডিপি। এই সংস্থা আরও বলছে, এর মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের কারণে মারা গিয়েছেন দেড় লক্ষের মত মানুষ। বাকি যারা, তাঁদের মৃত্যু হয়েছে স্রেফ না খেতে পেয়ে, বা অপুষ্টিজনিত রোগে।
ইয়েমেনে কোনও মানবাধিকার আপিস নেই, না? কেন ক্ষমতাচ্যূত রাষ্ট্রপ্রধানের ডাকে সৌদি সেখানে লড়তে গেল, আর কেনই বা আমেরিকা সেখানে সাহায্যের ‘অস্ত্র’ বাড়িয়ে দিল, এই সহজ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয় বলেই হয়ত মানবাধিকার নামক ধোঁকার টাটির দরকারটা পড়ছে না।
আরব বসন্ত নামের যে পাতাঝরার ঋতুকে আমরা চিনেছি, সেই ২০১১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সিরিয়ায় নিহত— আবারও সেই ‘গৃহযুদ্ধ’-এই— তিন লক্ষেরও বেশি মানুষ। এই তথ্যেরও সূত্র রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার বিভাগের হাইকমিশনারের দফতর। মানবাধিকার মাস্তানদের অবশ্য এসব নিয়ে বিশেষ হেলদোল নেই। তাঁরা বিচার করে সেখানকার ‘শ্বেত হেলমেট’-দের প্রায় দিয়েই দিয়েছিলেন প্রাইজটা— ২০১৬ সালে। নিন্দুকেরা আবার বলে, এই ‘শ্বেত পাগুড়ি’-র দল নাকি প্রকৃতপক্ষে আসাদবিরোধী শক্তির (আইসিস-সহ, যে আজ্ঞে) হাত শক্ত করছিলেন।
বস্তুত, এই গৃহযুদ্ধ বা আতঙ্কী উৎপাতের নামে যুদ্ধ চলছে প্রায় সারা পৃথিবী জুড়েই। এর সিংহভাগ চলছে আফ্রিকায়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ-উপদ্রুত দেশগুলোর মধ্যে সবথেকে খারাপ অবস্থায় আছে মায়ানমার, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, ইথিওপিয়া (হ্যাঁ!), সোমালিয়া আর সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক। এর সবটাকেই গৃহযুদ্ধ বলে বিশ্বাস করে নিলে অশ্বে হাসবে প্রকাশ্যে, আর অশ্বতরেরা নুকিয়ে! অর্থনৈতিক যুদ্ধে আক্রান্ত দেশগুলোর কথা নয় বাদই দিলাম।
এবার আসা যাক প্রাপকদের কথায়।
আলেস বায়ালাৎস্কি, আগে যেমন বললাম, একজন মানবাধিকার কর্মী বলে নিজেকে পরিচয় দেন। সোভিয়েতের পতনকালে বেলারুসে যে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ‘গণ-অভ্যুত্থান’ হয়, তিনি ছিলেন তার একজন সমর্থক ও প্রথম সারির মুখ। বলা হয়ে থাকে, নতুন বেলারুস রাষ্ট্রের প্রথম পতাকাটা তিনিই তুলেছিলেন। হ্যাঁ, এ-কথা স্বতন্ত্র যে সেই বিপ্লবের ফসল লুকাশেঙ্কোই আজ তাঁকে কর ফাঁকির অভিযোগে জেলে পুরেছেন। বিগত কয়েক বছর ধরে বেলারুসে নতুন করে গণতন্ত্রের অভাব অনুভব করা যাচ্ছে, এবং গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরীরা সে নিয়ে যথারীতি চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। সেই চিন্তকের দলে নাম লিখিয়েছিলেন আলেসও। এবারে ইউক্রেন আক্রমণকালে বেলারুস রাশিয়ার পক্ষ নেওয়ায় এঁদের সকলেরই দুশ্চিন্তা বেড়েছে, এবং এইসব গণতন্ত্রদায়গ্রস্ত পিতাঠাকুরেরা এবারের শান্তিনোবেলের জন্য তাই আলেসকে ‘চুনে’ নিয়েছেন।
‘মেমোরিয়াল’-এর জন্মও ১৯৮৭ সালে, সোভিয়েতে মানবাধিকারের অভাবের তাড়নায়। কম্যুনিস্ট অত্যাচারে পীড়িত ও নিহত— কেউ বলেন লক্ষ লক্ষ কেউ বলেন কোটি কোটি— মানুষজনকে মনে রাখার উদ্দেশ্য নিয়েই এই সংস্থা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গত বছর থেকে পুতিন সরকারের সঙ্গে এঁদের মনকষাকষি শুরু হয়েছে। সোভিয়েত-মুক্তির এতকাল পরেও এই মুক্তিদূতেদের ভোগান্তি দেখে পশ্চিমা প্রেস পুতিনকে রাশিয়ার কম্যুনিস্ট শাসনের প্রায় উত্তরাধিকারী বানিয়ে তুলেছে। নইলে কিচ্ছু মিলছে না!
তিন নম্বরে আছেন ইউক্রেনের সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিস। ২০০৭ সালে স্থাপিত হলেও এই সংস্থাটি সকলের নজরে পড়ে ২০১৩-র কিয়িভে ‘ইউরোময়দান’ প্রতিবাদের পর থেকে। কী ছিল এই প্রতিবাদের বিষয়? ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তির খসড়া বাতিল করা! তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ছিলেন রাশিয়াপন্থী, অতএব পশ্চিমী দাদাদের কাছে অস্পৃশ্য। তাঁর এই চুক্তির খসড়া বাতিলকে এই দাদারা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি, সুতরাং ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের কাছে ‘স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ’ করা ছাড়া উপায়ান্তর থাকেনি! আর এই প্রতিবাদে এবং প্রতিবাদ দমনে কোথায় কোথায় মানবাধিকারের ননীর শরীরে খোঁচা লেগে গেল সেই হিসাবরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন এই সেন্টার। দাদারা এখন মনে করছেন যে, যুদ্ধের পর পুতিনবাবু এই ইয়ানুকোভিচকেই সিংহাসন দিতে চান। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে তা হতে দেওয়া যায় না বলেই এই নোবেলপ্রদান।
নোবেল শান্তি পুরস্কার কার পাওয়া উচিত তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। বিশেষ করে এইবার তিনজন ভারতীয়ের নাম ওঠায় অনেকেই বেশ উৎফুল্লিত হয়েছিলেন। তবে এই পেরাইজ কার পাওয়া উচিত নয়, বছর-বছর ভরে দরদিয়া নোবেল কমিটি তাঁর বা তাঁদের তালিকা প্রকাশ করে আমাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে চলেছেন। এই জন্যেই তাঁরা ধন্যবাদার্হ।