বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
রাতজাগা প্যাঁচা
চোখ খুলতে ভয় পাচ্ছিল রেখা।
তার ঘর বরাবরই অনাড়ম্বর। পানাগড়েও ওমনি ছিল। কলকাতায় এসেও সেরকম একটা কিছু বদলাতে দেয়নি। লেখা কতবার বলে চৌকিটা তো পালটাতে দে দিদি। একটা ভাল দেখতে খাট আনাই! রেখা রাজি হয়নি। এই চৌকি আর তোষকে অনেক চোখের জল ফেলার ইতিহাস, বেঁচে থাকার পুঁজি। অন্য কোনও বিছানায় আরাম পাবে না।
পানাগড়ের বাড়ির তুলনায় এখানে ঘর অনেক বড়। সরু চৌকি, বইয়ের দেরাজ আর একটা গদরেজের স্টিলের আলমারিতে কতটাই বা জায়গা নেয়। বাকিটা ফাঁকা, মেঝের মাঝবরাবর একটা কার্পেট। এটার বয়সও কম হল না। ওখানে বসে রেখা রেওয়াজ করে। তানপুরাটা কাপড়ে মুড়ে ঘরের কোনায় দাঁড় করানো। পাশ ঘেঁষে গদিআঁটা চেয়ার। ঘরের আসবাব বলতে এই। ঘিয়ে রঙের দেওয়াল সম্পূর্ণ নিরাভরণ। জানালায় ভারী সবুজ পর্দা। খুব বেশি আলো রেখা পছন্দ করে না। সেই দাবী নিয়েও কেউ ঘাঁটায়নি তাকে। কিন্তু তার বারণ অগ্রাহ্য করে সদ্য নতুন একটা জিনিস আমদানি হয়েছে ঘরে। আয়না। লেখা গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, প্লিজ রাগ করিস না দিদি। আমার এই কথাটা রাখ। নিজেকে দেখার মধ্যে দিয়েই ভালবাসা জাগে। তোর জন্য, সবার জন্য।
কত বছর হয়ে গেছে আয়নায় মুখ দেখতে ইচ্ছে হয়নি রেখার। পারেনি। অথচ ছোটবেলা থেকে কতরকমভাবে সাজতে ভালবাসত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখত। স্কুলে থাকতেই মাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ঠোঁটে আলতা মেখে আয়নার সামনে দাঁড়াত। লিপস্টিক কোথায় পাবে? দেখতে পেলেই মায়ের কী বকা! রেখা কী করবে, মেকআপ করতে ভাল লাগত যে। অথচ অ্যাসিডে পুড়ে সেই ঠোঁট মোমের মত গলে পড়েছে। হাতের আঙুল দিয়ে অনুভব করতে গিয়ে তর্জনীর ডগা বেরিয়ে থাকা দাঁতে লেগে গেছিল। মাসির বাড়ি কলকাতায় এসেছিল তার প্রথম সার্জারির জন্য। চোখের পাতা আর ভুরুর ওখানে পুড়ে গিয়ে প্রায় কিছুই ছিল না। গ্রাফট করবে। একবার কলেজে থাকতে বন্ধুদের সঙ্গে গড়িয়াহাটে এক বিউটি পার্লারে গেছিল ভ্রূ প্লাক করতে। মেয়েটি বোধহয় নতুন ছিল। ভুল করে টুইজারে এমন টান মেরেছিল যাতে রেখার ব্যাথা তো লেগেইছিল, ভুরুর মাঝখানে অনেকটা ফাঁকাও হয়ে যায়। আয়নায় নিজেকে দেখে রেখা মেয়েটাকে শুধু মারতে বাকি রেখেছিল। সেই রেখার এখন কোনও ভুরুই নেই। ভেবেই শিউরে উঠত। তবু নিজেকে দেখতে কেমন লাগছে সেটা জানা ছিল না। জানার কোনও ইচ্ছাও ছিল না। মাসির বাড়ির বাথরুমে বড় আয়না। মনে ছিল না সেটা। বাথরুমে ঢুকতেই সরাসরি সেই আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে হকচকিয়ে গেছিল একেবারে। ক্ষণেকের জন্য পা মাটিতে যেন গেঁথে গেছিল রেখার। ও জানত ওর মুখের অনেক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তাই বলে এইরকম। কে ওই আয়নায়? এটা কি কোনও মানুষের মুখ? মুখের কিছুই বাকি নেই, গলে গলে খসে পড়েছে। ঠোঁট ঝুলে থুঁতনি অবধি নেমে এসেছে, নাকের জায়গায় যেন মাংসের ডেলা, সারা মুখের চামড়া খড়খড়ে। দেখে মনে হয়েছিল কোনও ভুতুড়ে সিনেমার চরিত্র এসে পড়েছে সামনে। সে যে কী কষ্ট। কান্নায় ভেসে গেছিল নতুন করে। রোজই তো কাঁদত। কিন্তু বাথরুমের বন্ধ দরজার আড়ালে নিজের এই ধ্বংসাবশেষ দেখার পর ডুকরানো কান্নার মধ্যে দিয়ে নিজেকে ঘৃণা করতে শিখল রেখা।
কী হবে বেঁচে থেকে? কার সামনে যাবে এই চেহারায়? মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছিল তাকে দেখেই সবাই বুঝি দৌড়ে পালাচ্ছে। বাচ্চারা আঁতকে উঠে মায়ের কোলে মুখ গুঁজছে। রাস্তায় তাকে দেখে যে ছেলেরা শিস দিত, এখন ঘেন্নায় চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আর সামলাতে পারেনি রেখা। এক দৌড়ে মাসির রান্নাঘরে গিয়ে মাংস কাটার ছুরি নিয়ে নিজেকে শেষ করতে গিয়েছিল। ঠিক সেই সময়েই মাসি চা করতে রান্নাঘরে এসে না পড়লে রেখা সেদিন বাঁচত না। এক লহমায় ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত থেকে ছুরি নিয়ে নিয়েছিল। কী করছিস তুই? পাগল হয়ে গিয়েছিস? দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিল। মাসির কাছে আগে কয়েক বছর থেকেছে রেখা আগে। রেখাকে বড় ভালবাসে। সেই ভালবাসার জোরেই ধমক দিয়েছিল। কী করতে চলেছিলি রেখা? দিদি-জামাইবাবুর কথা একবারও ভাবলি না? দেখেছিস ওদের মুখচোখের দিকে তাকিয়ে?
রাগে ফুঁসে উঠেছিল রেখা। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছ কেউ? এটা কি আমি? কোনও জন্তুও এর চাইতে ভাল দেখতে হয় মাসি।
মাসি নরম হয়েছিল। নিজের উদ্গত কান্নাকে চাপতে চাপতে বলেছিল, সেইজন্যেই তো তোর সার্জারি হবে মানু। এইরকম চিরকাল থাকবে নাকি? একটু একটু করে মুখের সবটা ঠিক করে দেবে ডাক্তার।
বিশ্বাস করেনি রেখা। আয়নায় দেখার আগে তাও ভাবত অপারেশন করে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেদিন নিজেকে দেখার পর মনে হয়েছিল, এই মুখের থেকে আর কী উদ্ধার করবে কোনও ডাক্তার? একটা চোখই নেই, অন্যাটাও ঝুলে পড়েছে। পারবে কোনওদিন আর চোখে কাজল পরতে? ওই ঠোঁট ছুঁতে চাইবে কেউ কোনওদিন? কে তাকে বিয়ে করবে আর কখনও? হীরক? ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে পাশে থাকবে সেই ছেলে? মানতে কষ্ট হলেও সেটাই সত্যি। অনেকবার ভেবেছে হীরককে খবরটা জানায়। কিন্তু প্রত্যাখানের কষ্ট সামলাতে পারবে না। মনে ছিল যদি সত্যি তাকে চায়, এরপরেও, নিশ্চয় খুঁজে নেবে। যেভাবেই হোক।
এই ভাবনাটা বর্তমানে ফিরিয়ে আনল রেখাকে। দশ বছর হয়ে গেল, কই কোনও খোঁজ তো করেনি হীরক। এখন আর কষ্ট হয় না। অবচেতনে এই রূঢ় সত্যিটা তো জানতই। সেইজন্যেই নিজেকে ওই আঘাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। শরীরের ঊর্ধ্বে উঠে ভালবাসা হয় না। মুখপোড়া মেয়েকে আপন করে নিতে কেউ আসবে না। জানত সেটা রেখা। সেটা বুঝেই চারপাশের স্বাভাবিক চেহারার সবার প্রতি বিদ্বেষ বুক ঠেলে উঠেছিল সেদিন। সবাই স্কুল, কলেজ, অফিস যাবে। প্রেম করবে, বিয়ে করবে, বাচ্চা হবে। যেখানে খুশি যাবে, কেউ ফিরেও দেখবে না। আর এই চেহারায় সে যেখানেই যাবে হয় লোকে দৌড়ে পালাবে না হলে করুণার চোখে তাকাবে। কেন তার নিজের পিসিরা দেখতে এসে আহা-উহু করেনি? যে পিসিরা ওর রূপের প্রশংশায় পঞ্চমুখ ছিল, তারাই একদম মুখের কাছে বসে তার কথা আলোচনা করেছে। যেন এটা করা যায়। তার কোনও অস্তিত্ব নেই, কিংবা থাকলেও মানুষের সমান নয়। না হলে তারই সামনে কীভাবে জিভে চুকচুক শব্দ তুলে বলতে পারে, আহা রে আমাদের সোনার প্রতিমাকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে! কিংবা মাকে বলেছে বাড়ন্ত মেয়েকে এতদিন ঘরে বসিয়ে রাখলে এই হয় মাধু, আগুনের খাপরা সামলে রাখা কি সোজা? ইচ্ছা করেছিল চিৎকার করে উঠতে। যা মুখে আসে তাই বলতে। কোনওমতে নিজেকে আটকেছে সেদিন। কিন্তু নিজের চোখে এই চেহারা দেখার পরে আর কীভাবে বাঁচবে রেখা? কী লাভ?
মরতেই চেয়েছিল। জীবনের থেকে বিশ্বাস উঠে গেছিল। কিছু ভাল লাগত না। কারও সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছা হত না। যে শান্তি তার দরকার ছিল, যে আশ্রয়ে সে জ্বালা জুড়াতে পারে, সেটা মৃত্যু ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। এই ভাবনাই সারাদিন ভোমরার মতো মাথায় গুনগুন করত তখন। বাপি এসে মাথা নিচু করে পাশে বসে থাকত। বাবা আর মেয়ে পাশাপাশি। কতক্ষণ কোনও কথা হত না, যেন সময় থমকে গেছে। মুখে দাড়ির আগাছা, ক্লিষ্ট চোখে মিনতি, কিছু তো বল। রেখা চুপ থেকেছে। বাপি অবশেষে অস্ফূটে হয়তো বলেছে, এমন কিছু করিস না মা। তোকে দেখে আমার ভয় লাগে। কোনও উত্তর পায়নি। কখনও মনে করিয়ে দিয়েছে সুইসাইড করার চেষ্টা অনেকসময় সফল হয় না, শুধু কষ্ট আরও বেড়ে যায়। প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যতরকমভাবে হয় তার চেহারা ফিরিয়ে আনার। শুধু একটু সময় দে মা। বাপির মুখে কী কাকুতি। নিশ্চয় কষ্ট পাচ্ছিল। কিন্তু নিজের উপর মায়া অবশিষ্ট নেই যার এতটুকু, সে অন্যের যাতনা কীভাবে লাঘব করবে? রেখা শুনত, কিংবা শুনত না। কোনও কথা, কোনও আশ্বাস তাকে স্পর্শ করতে পারত না।
মাও তো বারবার করে বলত। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে রাখু। ধৈর্য ধরতে হবে শুধু। কে জানে মা নিজে সেটা মানত কিনা। অন্তত রেখার মনে সেই বিশ্বাস চারিয়ে দিতে পারেনি মোটেই। তাকে বারবার ঠাকুরের কাছে আশ্রয় নিতে বলেছে, সেখানেই না কি শান্তি পাবে। কিন্তু কোন ভগবানে বিশ্বাস করবে সে? কে সেই ঠাকুর যাকে ভরসা করা যায়? তার কোন দোষে ঈশ্বর এমন শাস্তি দিয়েছেন? এই কথাগুলো জ্বলন্ত লাভার মতো টগবগ করে উঠত বুকের মধ্যে। কিন্তু বেরিয়ে আসত না। তার সমস্ত শরীরে ও মনে যে অবসাদ তাতে কোনও প্রশ্ন করতেও ইচ্ছা করত না। জবাবের প্রত্যাশা থাকলেই তো প্রশ্ন করা যায়। সমাধানের উপায় বুঝলে তবে চেষ্টা করা যায়। কিন্তু রেখা চারদিকে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখেনি। এক অতলান্ত কৃষ্ণগহ্বর যেন তার সমস্ত জীবনীশক্তি শুষে নিয়েছিল। জীবনের সঙ্গে যুঝবার ক্ষমতাটাই চলে গেছিল। সাধও।
রেখা জানে সারাদিন ওরা তাকে চোখে চোখে রাখত। লেখার কাজই হয়েছিল কারণে অকারণে দিদি কী করছে এসে দেখে যাওয়া। একটু বাদে বাদে। পারলে পাশে বসে গল্প করা। কোনওভাবে তার মুখে কথা বলানোর চেষ্টা। কিন্তু রেখার যে কোনও কথা বলতেই আর ইচ্ছা করত না। সবকিছু মেকি মনে হত। একেকটা অপারেশনের পর সবাই যখন আহা এবার কতটা ভাল লাগছে বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করত, গা রি রি করে উঠত রেখার। ভালবাসার কথায় বিষ খুঁজে পেত। স্তোকবাক্য মেকি লেগেছে। যে কোনওরকম উচ্ছলতা জোর করে চাপানো মনে হত। আয়নায় নিজেকে দেখে চেহারায় ভাল কী হয়েছে সেটা বোঝার ইচ্ছেও জাগেনি। বরং ভাল যে হতে পারে না সেই বিশ্বাস দিনে দিনে দৃঢ় হয়েছে আরও। বিষণ্ণতায় ডুবিয়ে দিয়েছে নিজেকে। ইচ্ছায় নয়। ইচ্ছার রশিটাই তো তার হাত থেকে চলে গেছিল। চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছিল রেখা, যার থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনও আশা ছিল না। রেখা যত চুপ হয়ে গেছে, সবাই আরও বেশি বেশি তাকে চারপাশ থেকে আগলে রাখতে চেয়েছে। রাত্রেও আর একা শুতে দিত না তাকে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মা কিংবা বাবা এসে দেখে যেত। লেখিকে সঙ্গে নিয়ে শুতে বলত। কী অসম্ভব বিরক্তিকর এই নজরদারি। হয়তো এটা এড়াবার জন্যেই গান গাওয়া শুরু করল আবার। কারও সঙ্গে কথা বলতে হবে না। নিজে ভেবে কোনও শব্দ তৈরি করতে হবে না। তার গলার স্বর সবাইকে নিশ্চিন্ত রাখবে, একটু বাদে বাদে উঁকি দিয়ে দেখে যাবে না। নিজের মাথার ভাবনাগুলোকেও দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে গানের দরজায়।
ওই গানেই শান্তি পেয়েছিল রেখা।
বরাবরই ভাল গাইত। ছোটবেলা থেকেই গানের গলা। তার গলায় উচ্ছলতা ছিল, সুর ছিল। কিন্তু আগে গানের পিছনে কোনও সাধনা ছিল না। গত দশ বছরে সে যেন নিজেকে গানের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে পেরেছিল। তার গানেও সেই সমাহিত ভাব। কিছু পাবে ভেবে গান গায়নি। নিজের জন্যেই গাওয়া সেই গান। লেখা একদিন এসে বলল, দিদি তোকে সিনেমার জন্য গাইতে হবে।
চমকে উঠেছিল। আমি? সে ভাল গায় কি খারাপ সেটা মাথায় আসেনি। সবার সামনে বেরোতে হবে সেই ভাবনাটাই ওকে ত্রস্ত করে দিয়েছিল। মুখে বলেছিল, সিনেমার গান আমি কী গাইব? অমন ধরনের গান আমি গাই না।
লেখা বুঝিয়েছে, সিনেমার গান, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত। তাহলে প্রবলেমটা কোথায়?
রেখা মানতে চায়নি। আমি কী এমন গাই? কত ভাল ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী আছে, তাদের নিক। বুঝতে পেরেছিল লেখা এখন নামী হিরোইন, দিদির হয়ে সুপারিশ করেছে।
–দিদি, তোর গলা স্বতন্ত্র। একটা আলাদা মেজাজ আছে। মিউজিক ডাইরেক্টার প্রমিত বলেছিল, বিষাদ। ওঁর গলা গানের প্রতিটা শব্দ যেন বুক নিংড়ে গাওয়া। ওটা দারুণ যাবে। লেখা সেটা বলতে চায়নি। তাহলে দিদির দুঃখটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার মতো হত।
–আমার গান তোর মিউজিক ডিরেক্টর শুনল কোথায়? রেখা উল্টো প্রশ্ন করেছে।
লেখা একটু আমতা আমতা করে বলেছিল, সরি দিদি, তোকে লুকিয়ে আমি কিছু গান রেকর্ড করে নিয়ে গিয়েছিলাম। এমনি টেপে। এতেই ওদের পছন্দ হয়ে গেছে।
খুব রাগ হয়েছিল রেখার। সেটা কোনওভাবে চেপে বলেছিল, লেখি তুই জানিস আমি বাইরে বেরোই না। সেটা বদলাবার কোনও কারণ দেখছি না।
রেখা কিছু বললে নড়ানো সহজ নয়। জানত বলেই মুখে কিছু না বলে লেখা সেদিন উঠে চলে গিয়েছিল। কদিন বাদে আবার এল। তবে একা না সঙ্গে কণিকা বলে একটা অচেনা মেয়ে। দেখেই চমকে উঠেছিল রেখা। কণিকার মুখের চামড়ার কুঁচকে থাকা দেখেই বলে দিতে হয় না কীভাবে কী হয়েছে। ডানদিকের কানটাও পুরোপুরি রিকন্সট্রাক্টেড। তারই মতন অ্যাসিড ভিক্টিম।
–কণিকা আমার বন্ধু দিদি। ওর মুখেই শোন ওদের গল্প।
কণিকার সঙ্গে সেদিন অনেক কথা হয়েছিল। কণিকার একটা নাচের স্কুল আছে। অ্যাসিড অ্যাটাকের আগেও ছিল। তবে এখন যে স্কুল চালায় সেখানে তার মতই আরও অ্যাসিড কিংবা আগুনে পুড়ে ঝলসে যাওয়া মেয়েরা আসে। নাচ শেখে। মঞ্চে পরিবেশন করে।
রেখা চমকে গেছিল। মঞ্চে?
কণিকা বলল, রেখাদি, জীবন আমাদের একটাই। বাইরেটা ঝলসে গেছে, তাই বলে আমি মানুষটা কি বদলে গেছি? আমার নাচপাগল প্রাণটা কি হারিয়ে গেছে? যা আমি ভালবাসি সেটা ছেড়ে দিয়ে আমি কেন সেই লোকটাকে জিতিয়ে দেব যে আমার সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে?
মেয়েটার গলায় জোর ছিল। হয়তো মনেপ্রাণে মুখের ওই কথাটা বিশ্বাস করে বলেই অমন জোর।
আমাদের নাচের অনুষ্ঠান আছে সামনের মাসে। তুমি আসো না দিদি?
ওরা চলে গেল। লেখা এই নিয়ে একটা কথাও বলেনি। কণিকা চলে যাওয়ার পরে সেদিন রাতভর ভেবেছে রেখা। পরদিন নিজেই লেখাকে ফোন করে আসতে বলেছিল। আসতেই লেখাকে জড়িয়ে ধরেছিল। এত বছরে প্রথমবার। লেখা তাকে জড়িয়ে ধরেছে, ভালবাসতে চেয়েছে। আসতে দেয়নি। রেখা নিজের চারপাশে একটা পাঁচিল তুলে রেখেছিল। সেটা ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ছিল। লেখার কাঁধে মাথা রেখে সেদিন খুব কাঁদল রেখা।
–কাঁদছিস কেন দিদি?
কীভাবে বলবে রেখা? মনের মধ্যে এক অদ্ভুত চাপা বিদ্বেষ কাজ করত বোনের জন্য। নিজের সঙ্গে তুলনা করে। লেখার তো কোনও দোষ নেই, কিন্তু ওর জীবনকে ঈর্ষা করেছে রেখা। এমনিতে হয়তো কোনওদিন সেটা আসত না। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন তাকে ওই দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রকট নয়, কিন্তু চোরাস্রোতের মতো বয়ে যেত সেই ভাবনা। তুই আমাকে এত ভালবাসিস লেখি!
–সন্দেহ ছিল তোর কোনও? পরক্ষণেই প্রশ্ন করেছিল, তুই যাবি কণিকার নাচের অনুষ্ঠানে?
–ভাবছি রে। এই মেয়েটা আমার থেকে কত ছোট দ্যাখ। কিন্তু নিজের বিকৃতিকে জয় করেছে। শুধু তাই নয় ওর মতো আরও অনেক মেয়েকে হাত ধরে টেনে তুলছে। সেটা তো সোজা কথা নয় রে। আমি ওদের দেখতে চাই। যে সাহস আমার মধ্যে ছিল না, নেই এখনও, ওরা কোথা থেকে পেল সেটা বুঝতে চাই।
মা বাপির সঙ্গে রেখা দেখতে গিয়েছিল সেই নাচ। শ্যামা। শিশির মঞ্চে হল। দেখতে দেখতে গায়ের রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছিল রেখার। কী সাহস এই মেয়েগুলোর। কিংবা কী অনায়াস সাবলীলতা। তাদের মুখ জ্বলে গিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু নিজেকে জয় করার সৌন্দর্যে টলমল সবাই। যেন সমস্বরে বলছে আমার জীবনপাত্র উছলিয়া মাধুরী করেছ দান। সে মাধুরী কেন হারিয়ে যেতে দেবে ওরা? এই মেয়েগুলো যদি পারে সে কেন পারবে না? এটাই নিজেকে বলতে বলতে বাড়ি ফিরেছিল রেখা। সেও পারবে। মন গুনগুনিয়ে উঠেছিল, গোপন ব্যথার নীরব রাত্রি হোক আজ অবসান।
পুরো নাচের মধ্যে মাধুরী রেখার বাঁ হাতের কব্জিটা চেপে ধরছিল মাঝেমাঝেই। রেখা একবারও সরিয়ে দেয়নি। মার কষ্টের হিসাবটা সেদিন বেশি বেশি করে পাচ্ছিল।
পরদিন লেখার ফোন। কেমন দেখলি দিদি?
এর উত্তরে রেখা বলেছিল, আমি পারব লেখা। এত বছর বাদে এক পা চৌকাঠের বাইরে রাখার জন্য তৈরি হয়েছিল রেখা। এতগুলো বছর! ইতস্তত করে যোগ করেছিল, তোর মিউজিক ডিরেক্টর কি এখনও গানের লোক খুঁজছে?
ফোনের অন্য প্রান্তে লেখার গলায় খুশি আটকানো যায়নি। আমি আজকেই খোঁজ নিচ্ছি দিদি। তোর রেকর্ডিং করতে আসতে কোনও আপত্তি নেই তো?
পরদিন লেখা এই আয়না নিয়ে হাজির। ড্রেসিংটেবিল একটা ছোট, তার সঙ্গে আয়না। যারা নিয়ে এসেছিল লেখা তাদের আয়নার উপরের কাগজ খুলতে বারণ করেছিল। ওটাকে ওরা রেখার ঘরে বসিয়ে চলে গেছে, ঢাকাটা খোলেনি। রেখা এতদিন আয়নার সামনে আসেনি, ওটা একটা কঠিন মুহূর্ত তার জন্য। হঠাৎ করে সবার সামনে সেটা ভাল হবে না বুঝেই এমন করেছে লেখা। তার ছোট বোনটা এত বুঝদার হয়ে গেছে! রেখা হৃষ্ট চোখে তাকিয়েছিল বোনের দিকে।
এখন সবাই চলে গেছে। তবু আয়নার দিকে এগিয়ে যেতে সঙ্কটাপন্ন লাগছিল নিজেকে। এতগুলো বছর আন্দাজে আন্দাজে চুলে চিরুনি দিয়েছে। কখনও মা কাছে বসিয়ে চুল আঁচড়ে দিয়েছে। প্রসাধন ব্যাপারটা ভুলেই গেছিল। কী দেখবে এই আয়নায় ভেবেই বুকটা কাঁপছিল রেখার। তেমন ভাল কিছু নিশ্চয় দেখবে না। তার বাঁচোখের জায়গায় চামড়া ঢাকা। আঙুলের স্পর্শে জানে মুখের চামড়া এখানে ওখানে কুঁচকানো। গ্রাফট করেছে অনেকে, কিন্তু তাতে কতটা হয়। হাসপাতালে তাকে দু-একবার দেখিয়েছে, সেও কত বছর আগে। তাই নিজের সৌন্দর্য নিয়ে কোনও অদ্ভুত আশা সে করছে না। কিন্তু ওই মেয়েগুলো তাকে অন্য সৌন্দর্যের খোঁজ দিয়েছে এবার। সে সৌন্দর্যের উৎস এক অপরিসীম শক্তি। সৌন্দর্য শুধু তার মুখের চামরায় নেই, ছড়িয়ে আছে তার সম্পূর্ণতায়, যা ভেতর থেকে আসে। হঠাৎ করে এই বিশ্বাস ফিরে এসেছে মনে। রেখা গাইতে শুরু করল, আমার জীবনপাত্র উছলিয়া মাধুরী করেছ দান। গান অনেকটা সাহস দিল। গাইতে গাইতে আয়নার উপরের কাগজের ঢাকা খুলছিল। যেন সময়ের উপর থেকেই একটা আস্তরণ সরাচ্ছে। শেষবার ঠিকঠাক নিজেকে দেখেছে মাসির বাড়ি, তার প্রথম সার্জারির আগে। এতদিন তার অন্তত চল্লিশটা সার্জারি হয়েছে। তাই আয়নার উপর থেকে ঢাকা সরে যেতে সেভাবে আর চমকে উঠল না রেখা। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে কী নেই সেটা না খুঁজে, কী আছে তার আনন্দ নিতে চাইছিল। এ তো আমি, আমিই। অনেক খুঁত তৈরি হয়েছে মুখে। অজস্র। তবু এ রেখাই। নিজেকে শোনাল রেখা। দুহাতে কাঁচের পাল্লার দুদিকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছিল রেখা। আয়নার সঙ্গে তার আর কোনও শত্রুতা নেই। নিজের সঙ্গেও নেই। লড়াইয়ের জন্য তৈরি।
[আবার আগামী সংখ্যায়]