Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লাল গানে নীল সুর: সুকুমার রায়

লাল গানে নীল সুর: সুকুমার রায় | বর্ণালী মৈত্র

বর্ণালী মৈত্র

 



 

 

 

তখন সকলে মিলিয়া অর্ফিয়ুসকে মারিয়া তাহার দেহ নদীতে ভাসাইয়া দিল। সেই দেহ ইউরিদিসের নাম উচ্চারণ করিতে করিতে ভাসিয়া চলিল। শূন্যে আনন্দধ্বনি শুনিয়া সকলে বুঝিতে পারিল, আবার তিনি ইউরিদিসকে ফিরিয়া পাইয়াছেন।

ম্যাজিশিয়ান অর্ফিয়ুস, বীণাবাদক অর্ফিউস— যার বীণার সুরে আকাশ ভরে ওঠে। মূর্ছনায় ফুলে ওঠে বুক, সমুদ্রের গর্জন স্তিমিত হয়— বন্যপ্রাণী হয় অনসূয়া। যখন সে মনের খুশিতে টইটম্বুর, তখন তার বীণায় বাজে আনন্দভৈরবী, আবার যখন সে ইউরিদিসকে দেখে তখন সে বীণায় টোড়ি ঠাটে মধুবন্তী বাজে। বিলীয়মান সন্ধের ছায়ায় মধুবন্তীর সুরে মাতাল হতে-হতে ইউরিদিস যখন অসাবধানে সর্পদংশনে মৃত, তখন সে বীণায় বেজে ওঠে শিবরঞ্জনী।

যে অর্ফিউস এই অনিন্দিত বিচিত্র সুরের বিহ্বলতায় ভরে নিতে পারে সমস্ত জীবন, নিশ্চয়ই কোনও আশ্চর্য পুরুষের ঔরসজাত? ঠিক। অর্ফিয়ুসের পিতা ছিলেন সৌন্দর্যের দেবতা জুপিটারপুত্র আপোলো— স্বর্গের বীণকার ছিলেন তিনি। আপোলোর এই বীণায় সুর দিলেন অর্ফিউস। পিতার উত্তরাধিকারের যোগ্য মর্যাদা দিলেন স্বর্গ মর্ত্যে সুরের আবেশে ঘোর লাগিয়ে।

 

দুই.

ঘোর লাগাতেন উপেন্দ্রকিশোরও। চোখ বন্ধ করে আচ্ছন্ন হয়ে বেহালা বাজাতেন— বাজাতেন হারমোনিয়ামও। যে যন্ত্রদুখানা আদতে পশ্চিমের হলেও, আত্মীয়তার সূত্রে বদ্ধ আমাদের প্রাণে। উপেন্দ্রকিশোরের দুটো বইও আছে এই যন্ত্রদুটিকে সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে সরল করে দেখাতে। এক— ‘হারমোনিয়াম শিক্ষা’, ডোয়ার্কিন অ্যান্ড সন, ১৮৮৮; আর দুই— ‘বেহালা শিক্ষা’, ডোয়ার্কিন অ্যান্ড সন, ১৯০৪। মনে রাখতে হবে, তৎকালীন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে রবীন্দ্রনাথের গানে বেহালার সহযোগিতা তেমন জনপ্রিয় ছিল না, যতটা ছিল এসরাজের। উপেন্দ্রকিশোর পাখোয়াজ শিখেছেন মুরারি গুপ্তর কাছে। পাখোয়াজের আদিগুরু এই মুরারি গুপ্ত।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘বীণাবাদিনী’ পত্রিকার মলাট এঁকেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। এও তো একরকম গানকেই ছুঁয়ে থাকা। নয় কি? শুধু ‘বীণাবাদিনী’ কেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘সঙ্গীত প্রকাশিকা’র  দ্বিতীয় সংখ্যায় মুরারি গুপ্তের ছবিখানাও তো এক অসামান্য গুরুতর্পণ।

বাদ্যযন্ত্রের চেয়েও গানবাজনার আর একটু কাছাকাছি ছিল উপেন্দ্রকিশোরের ব্রহ্মসঙ্গীতগুলি। অনবদ্য সব রাগে সেইসব গান বুনেছেন তিনি। বিভাস, মুলতান, সিন্ধুরা, বেহাগের সুরে সেই ভগবতপ্রেমের আখ্যান, দীনদয়ালের বুকভরা ঠান্ডা সুবাস যেন সত্যই চিরশান্তির পায়ে আশ্রয় দেয়। দক্ষিণী সুরেও উপেন্দ্রকিশোর স্বচ্ছন্দ— ‘বরষ পরে পিতার ঘরে মিলিনু সকলে’ গানের ধরনও স্বতন্ত্র। সরল পথেই যে সুর দিয়ে শুশ্রূষা করা যায়, তা তিনি অসুস্থ কন্যার মাথার পাশে বসে বেহালায় সুর তুলে প্রমাণ দিয়েছেন। যখন রোগশয্যায় কিছুতেই যন্ত্রণার প্রশমন নেই, চোখে নেই ঘুম— তখন পিতার সুরের উষ্ণতা কী এক অলীক জাদুতে ঘুম পাড়িয়ে দিত! কেবল কন্যার যন্ত্রণার নয়, নিজের অন্তিম মুহূর্তে রোগশয্যাতে উঠে বসেও সেই বেহালাখানিই বাজাতেন, নিজেরই কাছে নিজের মুক্তি চেয়ে— সে কথা পুণ্যলতা চক্রবর্তীর ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’ বইখানি থেকে জানতে পেরেছি আমরা খানিক।

এই আলাদা রকমের শিল্পী মানুষটি যাঁর বাবা, তিনি কেমন করে সুরের ধারার একটি ধারে বাসা না-বেঁধে রইবেন? এর সঙ্গে যদি থাকে পিসি মৃণালিনী বসুর কন্যা মালতীর চিকন গলার স্বর? যদি এসে যুক্ত হয় পিসতুতো ভাই জিতেন বসুর ওস্তাদি গানের নেশা? থাকে উপেন্দ্রকিশোরের ভগ্নিপতি হেমেন্দ্রমোহন বসুর ফোনোগ্রাফ রেকর্ড তৈরির দৃষ্টান্ত?

 

তিন.  

তখন তো অনিবার্যতই অর্ফিয়ুস তার বীণায় বাজাবে সেই সুর, যে সুরে ‘দিনের আলোয় কাটে অন্ধকার’! যেখানে ‘লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ’!

১৩ নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে লাহাদের বিশাল যে লালবাড়িতে ১৮৮৭-তে বীণকারের জন্ম, সেই বাড়ির প্রায় উল্টোদিকেই ছিল ব্রাহ্মসমাজ। তাঁরা দোতলায় থাকতেন আর একতলায় ছিল ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয় ও তার বোর্ডিং। ১৮৮০-তে আনন্দমোহন বসুর উদ্যোগে যে বালক-বালিকা সম্মেলন উৎসবের উদ্যোগ নেওয়া হয়, সুকুমার সেই কর্মকাণ্ডের বিশেষ অংশীদার ছিলেন, ১৯১১-য় বিলেত যাওয়ার আগে অবধি। ১৯১৩ সালের এক্কেবারে শেষ থেকে ব্রাহ্মসমাজের বেশ কিছু জরুরি অবস্থানে থাকলেও ১৯১৬ থেকে আর তিনি ব্রাহ্মসমাজের প্রত্যক্ষ কোনও পদে থাকতে চাইলেন না। এই সময় থেকে এক্কেবারে রোগশয্যার আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন নেপথ্য নায়কের ভূমিকায়।

১৯১৭-র জানুয়ারিতে সুকুমার রায় এবং প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের নেতৃত্বে তরুণ  ব্রাহ্মদের দাবি উঠল, রবীন্দ্রনাথকে সমাজের সম্মানিত পদে বরণ করে নিতে হবে। এই দাবিতে অনেক প্রাচীন নেতা আপত্তি জানালেও শেষ পর্যন্ত ১৯২১-এর মার্চ মাসে শহর ও মফস্বলি সমস্ত সভ্যের রেফারেন্ডামে রবীন্দ্রনাথ সমাজের সম্মানিত সভ্য নির্বাচিত হলেন। ১৯১৭ থেকে ১৯২১— এই পাঁচ বছরের লড়াইয়ের মাঝখানে সম্ভবত ১৯১৮-য় রবীন্দ্রনাথেরই দুটি গানের ছায়ায় সুকুমার লিখলেন দুটি ব্রাহ্মগান। একটি হল, ‘প্রেমের মন্দিরে তাঁর আরতি বাজে’— যাতে অনেকটা ‘ছিল যে পরাণের অন্ধকারে’ গানটির সুরের আদল। আর দ্বিতীয় গান ‘নিখিলের আনন্দ গান এই প্রেমেরই যুগল বন্দনায়’— যার সুরে খানিক রবীন্দ্রনাথের ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে’ গানটির সাযুজ্য মেলে। তবে ব্রহ্মসঙ্গীতের যে টিপিকাল ধরতাই, তা এই গানদুটিতে অনুপস্থিত। স্বাভাবিক যে ভক্তি, যে নিবেদন বিশ্ববিধাতার প্রতি থাকে, এই গানগুলোতে তা আমরা খুব যে দেখতে পাচ্ছি এমনটা নয়। বরং যৌথ যাত্রার এক শান্ত সুন্দর ছবিই তাঁর প্রিয়।

ব্রাহ্মপরিবেশের দলাদলি, তিক্ততা, সঙ্কীর্ণতা— এসব যে ক্রমাগত তাঁকে, তাঁর বিশ্বাসের মাটিকে আলগা করে দিচ্ছে, তীব্রভাবে ‘drastic irrevocative step’ নিতে হচ্ছে তাঁকে, নিতে হচ্ছে কিন্তু তার কোনও ব্যাখ্যা নিজেকেও দিতে পারছেন না ঠিক-ঠিক; এই সময়ই তিনি রবিবাবুর গানের সুরে আশ্রয় খুঁজেছেন— ব্রাহ্মসমাজের জন্য লিখে ওঠা গানে কথার ভাগটা নিজের রেখে সুরে হাজির করেছেন প্রিয় মানুষ— রবিবাবুকে। ১৯১৮-য় সুকুমার এই গানদুটি লিখছেন। রবীন্দ্রনাথকে ব্রাহ্মসমাজের সম্মানিত সভ্য হিসেবে নির্বাচিত হতে দেখার তখনও বছরতিনেক দেরি।

 

চার. 

ঠিক বছরতিনেক নয়, বছর সাতেক আগে অবশ্য অসামান্য কখানা দিন তাঁর কেটেছে রবিবাবু-সঙ্গে। বিএসসি পাশ করে গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি নিয়ে ১৯১১ সালে যখন বিলেত গেলেন, সে বছরই রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশতম জন্মোৎসব উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে সুকুমার গান করে শোনালেন ‘অদ্ভুত রামায়ণ’। অবশ্য এই সংস্পর্শেরও বহু আগে রবিবাবু তাঁর বাবার বেহালা বাজনায় মুগ্ধ। প্রতিবছর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে উৎসবের সময় উপেন্দ্রকিশোর রবীন্দ্রনাথের নতুন-নতুন গানের সঙ্গে বেহালা বাজাতেন। বিলেত যাওয়ার আগের বছর সুকুমারের নেতৃত্বে বেরোল ‘আলোক’ নামে একটি পত্রিকা। যে পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম পাতাতেই রবীন্দ্রনাথের গান—

আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো।

সুকুমার তখন তবে রীতিমত রবীন্দ্রনাথের একান্ত কাছের! ততদিনে রবীন্দ্রনাথের ‘বৈকুন্ঠের খাতা’ নাটকে সুকুমার কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।

১৯১১-র এক্কেবারে শেষদিকে ৭ অক্টোবর বোম্বে থেকে জাহাজে চেপে সুকুমার পাড়ি দিলেন বিদেশ। মুদ্রণশিল্পের কাজ শিখতে, এই সময় লন্ডনের ‘Quest’ পত্রিকায় তাঁর একটি প্রবন্ধ বেরোল, যেটি পত্রিকায় প্রকাশের আগে তিনি পাঠ করেন ‘East and West society’-তে ২১ জুলাই ১৯১৩। প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘The Spirit of Rabindranath Tagore’। এতে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কবিতার অনুবাদও ছিল। ছিল Gitanjali: Songs offerings থেকেও ব্যবহার করা দুটো কবিতা। শুধু তা-ই নয়, ১৯ জুন ১৯১২ লন্ডনে উইলিয়াম পিয়ারসনের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে ‘সুদূর’, ‘পরশপাথর’, ‘সন্ধ্যা’, ‘কুঁড়ির ভিতর কাঁদিছে গন্ধ’ ইত্যাদি অনুবাদ তিনি পাঠও করেন। ১৯১৩-য় লন্ডনে যেসব বাঙালি রবীন্দ্রভক্ত ছাত্র ছিলেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র সুকুমার রায়েরই সন্ধান পাওয়া যায়, যিনি সেই সময় রবীন্দ্রনাথের কবিতার তর্জমা করেছিলেন। দু-একখানা প্যারোডিও তিনি বানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান আর কবিতা নিয়ে। কখনও মন্‌ডে ক্লাবের আমন্ত্রণপত্রের বয়ানে, কখনও বা চলচিত্তচঞ্চরীর সমাপ্তিসঙ্গীতে। মনডে ক্লাবের ২ নম্বর আমন্ত্রণপত্রে ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’-র প্যারোডি:

কেউ বলেছে খাব খাব,
কেউ বলেছে খাই,
সবাই মিলে গোল তুলেছে—
আমি তো আর নাই।
ছোট্‌কু বলে, “রইনু চুপে
ক’মাস ধরে কাহিল রূপে!”
জংলি বলে, “রামছাগলের
মাংস খেতে চাই।”
যতই বলি “সবুর কর”—
কেউ শোনে না কালা,
জীবন বলে কোমর বেঁধে,
“কোথায় লুচির থালা?”
খোদন বলে রেগে মেগে
ভীষণ রোষে বিষম লেগে—
“বিষ্যুতে কাল গড়পারেতে
হাজির যেন পাই।

এই প্যারোডির প্রসঙ্গে আর একটি স্মৃতিচারণের উল্লেখ না-করলেই নয়! ১৯৪৬-এ কালিদাস নাগ একটি স্মৃতিকথায় লিখছেন,

রবীন্দ্রনাথের যখন ৫০ বছর বয়স তখন একবার আমরা থার্ডক্লাসের টিকিট করে শান্তিনিকেতন যাই। পথে পরিচয় হয় সুকুমার রায়ের সঙ্গে। তিনি বিলেত যাবেন। তখনি দেখেছি সত্যকে ভেতর থেকে টেনে বের করে তার যে রূপ দেখলে হাসি পায়, সেই রূপ ফুটিয়ে তোলার জন্মগত অধিকার ছিল তাঁর। তাঁর প্রকাশক্ষমতা ছিল অসাধারণ।… রবীন্দ্রনাথের আশ্রমে তখন পয়সার টানাটানি। শালপাতায় নুন রেখে কাঁকরভরা চাল ডাল খেতে হত। তখন সুকুমার রায়ের হাসির হররা শোনা গিয়েছিল। খাচ্ছেন আর মুখে মুখে গান রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের অনুকরণে, এই তো ভাল লেগেছিল আলুর নাচন হাতায় হাতায়…

আবার অন্যত্র রবীন্দ্রনাথের গানে বর্ষা বর্ণনা হচ্ছে—

বিশ্ববীণার বিশ্বজন মোহিছে
স্থলে জলে, নভতলে, বনে উপবনে নদী-নদে

গিরি গুহা পারাবারে…

আষাঢ়ে নব আনন্দ-উৎসব নব
অতি গম্ভীর, অতি গম্ভীর,
নীল অম্বরে ডমরু বাজে
যেন রে প্রলয়ঙ্করী-শঙ্করী-নাচে
করে গর্জন নির্ঝরিণী সঘনে…

পুণ্যলতা চক্রবর্তীর ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’তে আমরা এই গল্পের প্যারোডি দেখেছি,

বৃষ্টি বেগ ভরে রাস্তা গেল গুলিয়ে
ছাতা কাঁধে, জুতা হাতে, নোংরা  ঘোলা কালো,
হাঁটু জল ঠেলি চলে যত লোকে।
রাস্তাতে চলা দুষ্কর মুশকিল বড়
অতি পিচ্ছিল, অতি পিচ্ছিল, অতি পিচ্ছিল

বিচ্ছিরি রাস্তা

ধরণী মহা দুর্দমগ্রস্তা
যাওয়া দুষ্কর মুশকিল রে ইস্কুলে
সর্দি-জ্বর বৃদ্ধি বড় নিজি লোকে বদ্ব্যি ডেকে

তিক্ত বড়ি খায়।

[‘ছেলেবেলার দিনগুলি’, পৃঃ ১৩০]

এহেন প্যারোডি রচয়িতার ‘মেঘ বলেছে খাব খাব’ গানের প্যারোডির পরের পাতাতেই স্থান পাচ্ছে,

গান-১

ছুটিল কি আজি ঘুমের ঘোর?
কত আর বল রবে বিভোর
পরদ্বারে গিয়ে ভিখারীর সাজে
ফিরে এলি ঘৃণা অপমান লাজে,
আর সে ভরসা কোথা রে তোর?
ঘরের সন্তান ফিরে আয় ঘরে
আয় ফিরে আয় মায়ের আদরে।
শোন্‌ রে শোন্‌ রে ডাকেন জননী
জন্মদুখিনী জননী তোর।

কে জননী? কার জননী?

 

পাঁচ.

একেবারে ছোট্টবেলায় বাড়িতে ভাই-বোনেদের জন্মদিনে নানানরকম সাজগোজ করে অভিনয় করাও ছিল রঙিন জীবনের সুলুক। সুকুমার নিজেই লিখছেন সেই নাটক, যা তিনি অভিনয় করাবেন। বাড়িতেই গড়ে তুলছেন একটি ক্লাব— ‘ননসেন্স’ তার নাম। প্রথম যে নাটকটি লেখা হল, তার নাম ‘রামধন বধ’। যে সাহেব নেটিভ নিগার দেখলেই নাক সিঁটকোয়, বেগে তেড়ে মারতে আসে, বিদঘুটে গালি দেয়, পুলিশ ডাকে— সেই সাহেবের জব্দ হওয়ার গল্প। সময়টা ১৯০৫, ইংরেজ গভর্মেন্টের বাংলাদেশকে দুভাগে ভেঙে দেওয়ার জল্পনা তখন তুঙ্গে। রাস্তায়-রাস্তায় শোভাযাত্রা, রাখি বন্ধন— সকাল হতে না-হতে মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে। আক্ষরিক অর্থেই তখন ‘বাঙালির প্রাণ, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন, এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।’

এই ‘রামধন বধ’ নাটকেরই গান ‘দেশী পাগলার দলের গান’,

আমরা দেশী পাগলার দল
দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল…
(যদিও) দেখতে খারাপ টিকবে কম দামটা একটু বেশি
(তা হোক) তাতে দেশেরই মঙ্গল।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার মারাত্মক অস্ত্র এইসব লাইন। ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা থেকে মুক্ত করতে চাওয়া হচ্ছে মানুষকে। মানুষ জোটবদ্ধ থাকবার জন্য, বাঙালি জাতিকে ভাগ হতে না-দেওয়ার জন্য ‘অখণ্ড-বঙ্গ-ভবন’ তৈরি করল। ঠিক করল, কেউ বিদেশি জিনিস পারতপক্ষে কিনবে না, দেশি জিনিস যতই মোটা বা খারাপ হোক না কেন— সাধ্যমত তা-ই ব্যবহার করবে। তাতে একদিকে যেমন দেশি শিল্পের উন্নতি হবে, অন্যদিকে কোটি কোটি টাকার বিলাতি জিনিস যে আমাদের দেশে বিক্রি হয়ে লাভের টাকাটা বিদেশে চলে যায়, সেটাও বন্ধ করা যাবে। ওপরের গানখানা এইসব ভাবনাচিন্তাকেই প্রতিফলিত করে নিঃসন্দেহে।

‘সুকুমার পরিক্রমা’ গ্রন্থে পবিত্র সরকার তাঁর ‘সুকুমার রায়ের নাটক প্রকরণ’ প্রবন্ধে ‘ঝালাপালা’ নাটকের রচনাকাল নিয়ে বিভ্রান্তির উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “কেউ বলেন ১৯০৭, আবার কেউ বলেছেন ১৯১১।” কিন্তু ‘প্রস্তুতিপর্ব, সুকুমার রায়’ বিশেষ সংখ্যায় পুলক চন্দ এক্কেবারে স্পষ্ট করেই ১৯১১ সালকে এ নাটকের রচনাকাল বলে উল্লেখ করেছেন। ‘ঝালাপালা’ একপ্রকার যাত্রা। আর যাত্রা মানেই পালাগান। পালাগান মানেই জুড়ির দল। এই জুড়ির দলের গলায় সুকুমার বেঁধে দিলেন স্বদেশিয়ানার ঢাক। কেবলচাঁদের গাওয়া ‘হায় রে সোনার ভারত দুর্দশাগ্রস্ত হইল’— জাতীয়তাবাদী ও স্বদেশিমূলক গানের প্যারোডি। এই গানের সুরে হয়তো সবসময় প্যারোডির লক্ষণ প্রকট নয়, তবে কবিতা ভেবে পড়লে মন্দ হয় না। ননসেন্স ক্লাবে যখন এইসব নাটকের অভিনয় হত, তখন বিষয়টা চমৎকার দাঁড়াত।

পুণ্যলতা চক্রবর্তী ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’তে লিখেছেন,

‘ননসেন্স ক্লাবে’র অভিনয় এমন চমৎকার হত, যারা নিজের চোখে দেখেছেন তারাই জানে। মুখে বর্ণনা করে তার বিশেষত্ব ঠিক বোঝানো যায় না। বাঁধা স্টেজ নেই, সিন নেই, সাজসজ্জা ও মেকআপ বিশেষ কিছুই নেই, শুধু কথায়, সুরে ভাবে-ভঙ্গিতেই তাদের অভিনয়ের বাহাদুরি ফুটে উঠত। দাদা নাটক লিখত, অভিনয় শেখাত আর প্রধান পার্টটা সাধারণত সে নিজেই নিত। ‘প্রধান’ মানে সবচেয়ে বোকা আনাড়ির পার্ট। হাঁদারামের অভিনয় করতে দাদার জুড়ি কেউ ছিল না।

এ নাটকে কেবলচাঁদের প্রথম গান,

আহা, পড়িয়া কালের ছেড়ে মোরা কি হনু রে?

কোথায় ভীষ্ম, কোথায় দ্রোণ কোথা কর্ণ ভীমার্জুন?

এই অংশে রয়েছে আমাদের দেশের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের সন্ততিরা কীভাবে মাটির সঙ্গে মিশে ‘কেঁচোর মতো খাবি খাচ্ছে’, ‘কেবল আপিস কেটে নধরপুষ্ট তনু’ ধ্বংস করছে তার ছবি। অনেকে মন্তব্য করেছেন, ‘অতীতের ছবি’ কবিতায় ভারত ইতিহাসের যে আখ্যানটিকে সাড়ম্বরে পেশ করা হয়েছিল, গানদুটির শব্দচয়ন, ছন্দ, স্বরভঙ্গি তাকেই আক্রমণ করে। খানিকটা ঠিক। এ গানে পাঁচালির সুর এবং বারবার প্রথম লাইনে ফিরে আসার কীর্তনসুলভ ভঙ্গি একে আলাদা করেছে অন্য গানের থেকে। এ নাটকের শেষ গান ‘ওরে ও চণ্ডীচরণ। তোমার কি নাইরে মরণ!’ আশ্চর্য এই, এই গানের চারটি লাইন পাওয়া যায় সমস্ত ছাপা বইতে, কিন্তু ছাপা স্বরলিপিতে এর আরও কখানা লাইন কেমন করে এল?

কেমন করে মহাকাব্যের অতিলৌকিক জগৎ থেকে চরিত্রদের নামিয়ে এনে মজার সুরে তাদের ঘরের মানুষ করে নেওয়া সম্ভব তা বেহারীর গান প্রমাণ করেছে, করেছে বিশ্বম্ভর এবং নারদ-এর গানও ‘শব্দ-কল্পদ্রুম’-এ। এ নাটকও প্যারোডিতে ভরা ননসেন্স প্রতিভা।

‘লক্ষণের শক্তিশেল’-এও প্যারোডি আছে অনেকখানি। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর কথা মনে পড়ায়। মজার মজার গানে ভাসতে ভাসতে খেয়ালই থাকা দায় যে চরিত্ররা মহাকাব্যিক। যাঁরা বুঝতে পারেননি সুকুমারের আসল টার্গেট, তাঁরা সমালোচনায় মুখর হয়েছেন: ‘ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করা উচিত নয়’ (সুকুমার রায়, লীলা মজুমদার)।

তবে টার্গেট শব্দটার মধ্যে যে দৃঢ়তা থাকে, তত দৃঢ় অর্থে সুকুমার এসব নাটক লিখেছেন কি! সমসাময়িক রাজনৈতিক চালচিত্র সেখানে নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু কৌতুক ছিল তাঁর ভাষার মধ্যে ভাষা। ছড়া, পাঁচালি, হরিনাম, কীর্তন বা ধ্রুপদী গানের ঢং যখন তির্যক বাক্যের ডানায় বসেছে— তখনই সে গানের আলাদা লেভেল। সেবাব্রত চৌধুরী ‘সুকুমার রায়ের নাটক প্রসঙ্গে’-তে লিখছেন,

আমাদের মঙ্গলকাব্যে ময়মনসিংহ গীতিকায় অক্ষরবৃত্ত-স্বরবৃত্তের এই অবিরাম মেলামেশা হামেশাই মেলে। গানের চতুর্মাত্রিক পদে (foot): অতিরিক্ত রুদ্ধ দলের সমাবেশ করতে গিয়ে একরকম ধ্বনি-সংঘর্ষের কৌতুক তৈরি হয়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও এরকম করেছেন। সুকুমারের ‘লক্ষণের শক্তিশেল’ নাটকে ‘আজকে মন্ত্রী-জাম্বুবানের বুদ্ধি কেন খুলছে না/ সঙ্কটকালে চট্‌পট্‌ কেন যুক্তির কথা বলছে না।’ গানটিতে তালের সঙ্গে গানের কথা-বিন্যাসের এই দ্বন্দ্ব আছে, প্যারোডির মেজাজে। [পৃ: ১৪৫]

জননী, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, স্বদেশিয়ানা সমস্ত শব্দ যেসব গানে যুগের পর যুগ ধরে লালিত— যাদের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুল, যতীন্দ্রনাথ— এঁদেরই পঙক্তিতে আমরা ভালবাসার অক্ষরে লিখব সুকুমার রায়ের নাম। বিলেতে পড়াশুনো করতে গিয়ে এসেক্স হলে মাঘোৎসবে বাঙালির চিরকালীন ধুতি চাদরে গেয়েছেন ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা’, গেয়েছেন ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’। লিখেছেন, ‘অতীতের ছবি’-তে, মূলত ব্রাহ্মধর্মের মহিমা, গুরুত্ব ও ব্রাহ্মসমাজের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনার উদ্দেশ্যে, সম্ভবত সুকুমারের শেষ লেখা (১৯২২), তবু তারই মধ্যে মানবতাবাদীর স্বদেশচেতনা জাতীয় ভেদবুদ্ধির জন্য বেদনা ব্যক্ত—

ছিল এ-ভারতে এমন দিন
মানুষের মন ছিল স্বাধীন;
সহজ উদার সরল প্রাণে
বিস্ময়ে চাহিত জগৎ পানে।
*      *      *      *

ভেদবুদ্ধিময় মানব মন
নব নব ভেদ করে সৃজন।
*      *      *      *

ভেদ জনে জনে, নারী ও নরে
জাতিতে জাতিতে বিচার ঘরে।
*      *      *      *

নিজ ধনবান নিজ বিভব
বিদেশীর হাতে সঁপিয়া সব,
ভারতের মুখে না ফুটে বাণী,
মৌন রহে দেশ শরম মানি।

কিন্তু ছবিখানা তো অতীতের নয়! এই ছবি তো আজকের, গতকালের, আগামীকালের! আগামীকাল যেখানে কুমড়োপটাশ খালি রাধাকৃষ্ণের নাম গান করবে বিশুদ্ধ বেহাগে!

 

ছয়.

যে বেহাগের আলাপে আকাশকুসুমকে ফুটে উঠতে হয়, কিংবা সারেগামাকে ধেয়ে যেতে হয় টিমটিম গতিতে, সঙ্গীতজ্ঞরা জানতেন?

বিলেত থেকে ফেরার পর তোড়জোড় হল সুকুমারের বিয়ের। পাত্রী নির্বাচনের আগে তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, কেমন পাত্রী তাঁর পছন্দ। সুকুমার মাত্র দুটি গুণের উল্লেখ করেছিলেন। এক, এমন মেয়ে যে গান গাইতে পারে। দুই, যাকে রসের কথা বুঝিয়ে বলতে হয় না। সুপ্রভা দেবীর গানের গলা ছিল অপূর্ব। যে মাজা-গলা, চাঁচা সুরের আহ্লাদীপনার খবর আমাদের পাওয়া হয়ে গিয়েছে বছর কয়েক আগে, সুরে সুরে ভরিয়ে দিয়ে সে গলার মিঠে তান সুকুমারের সব দুঃখ ভুলিয়ে দিল।

কিন্তু দুঃখের পার আছে?

ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের ব্যবসায় দেখা দিতে লাগল অনেক সমস্যা। ১৯২০-র শেষের দিকে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গেও ছিন্ন হতে থাকল প্রত্যক্ষ যোগ। মত্ত মাদল বাজিয়ে শুরু হওয়া জীবনে কোথায় যেন তাল কাটতে শুরু করল। ১৯২১-এ এল কালব্যাধি! যার কোনও ওষুধ তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। হয়নি হয়নি। তা বলে তো আর মুখের হাসি, বুকের জোর ফুরিয়ে যেতে দেওয়া চলবে না। দীর্ঘ অসুস্থতা সত্ত্বেও, রোগশয্যা থেকেও প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ‘কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই’ (১৯২১) বইটির কল্পনা ও রচনায় সাহায্য করেছিলেন, যার পরিণতিতে ১৯ মার্চ ৪৪৬-২৩৩ সমর্থনে সম্মানিত সদস্য হিসেবে রবীন্দ্রনাথের মনোনয়ন ব্রাহ্মসমাজে সুকুমারের শেষ দান। আর ১৯২২-এর মাঘোৎসবে সমাজের বালক-বালিকাদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রকাশ করলেন ‘অতীতের ছবি’ গৌরবগাথা— ব্রাহ্মসমাজে তাঁর শেষ উপহার।

 

সাত.

আর্ফিয়ুসের হাতে আর বীণা নেই, সে বীণা পড়ে আছে পৃথিবীর প্রান্তে। আর অর্ফিয়ুসের মৃতদেহ ভেসে চলেছে নদীতে। মাথার ওপর আকাশ। সে আকাশে প্রতিবিম্বিত বীণার ছবি আর মৃত অর্ফিয়ুসের দেহ। সে দেহে শান্তির বার্তা। সুখ নয়— দুঃখ নয়— অবিরাম শান্তির বার্তা নিয়ে যাবে এ দেহ— এক পৃথিবী থেকে আরেক পৃথিবীর দিকে। সে পৃথিবীতে ঘুমন্ত দালানকোঠা শান্তির সুরে জেগে উঠবে, পুরনো বাড়ির অলিন্দে গজিয়ে ওঠা অশ্বত্থগাথায় দোলা দেবে ললিত, মালকোষের মূর্ছনা পথে-প্রান্তরে ঘোষণা করবে রাত্রির স্তব্ধতা।