মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
সেপ্টেম্বর, ২০৩০
If not then you must be trying to hear us and in such cases we cannot be heard. We remain in the darkness, unseen. In the centre of unpeeled bananas, we exist.
–Saul Williams
প্রাগ শহরের এক বিখ্যাত প্রাচীন কনসার্ট হল, সেখানে প্রাগ সিম্ফনি অপেরার অনুষ্ঠানের সন্ধে। ওপরের মাঝখানের একটি বক্সে বসে আছে এক কিশোরী, তার পরিবারের সঙ্গে। সঙ্গীতমূর্ছনায় বুঁদ শ্রোতারা হাততালিতে মুখর। কিশোরী বসেছে তার বক্সের একদম ধারে। হলের হাততালি থেমে গেল। তার মনে হল, তখনও সে হাততালি, কথা শুনতে পাচ্ছে। পাশের বক্স থেকে। বেশ কয়েকবার মনে হয়েছে। ইন্টারভ্যাল হয়ে গেল। এখন হলের আলো জ্বলে যাওয়াতে তাকিয়ে দেখল— কেউ নেই তো ওখানে, বক্সটা সম্পূর্ণ খালি! এত অবাক সে অনেকদিন হয়নি। তার মাথাটা খারাপ হচ্ছে নাকি? নাকি এত পুরনো থিয়েটারের শব্দ কোথা থেকে আসছে বোঝা যায় না…
অক্টোবর ২০১৬
Fiction allows us to both evade truth and to approach it— or rather it’s fiction that allows us to ‘construct’ our world. It’s haunted by the unimaginable and the unspeakable.
–Joshua Openheimer
–এক একটা দিন এরকম আসে। একদম নিখুঁত। তাই না?
দৌড়োতে দৌড়োতে একবার তাকিয়ে নিল দীপিকা। তার সোজা চকচকে বাদামি চুল পনিটেল করে বাঁধা, মুখে একটু চিক চিক করছে ঘাম। সরু চোখ, চোখা নাক, বুদ্ধিদীপ্ত শ্যামলা মুখ. ছোটখাটো পাতলা ট্র্যাকস্যুট পরা চেহারা স্বাস্থ্যের দীপ্তিতে ঝলমল। দৌড়োনো তার অনায়াস, ভারহীন। বেশ খানিকটা লম্বা হওয়াতে জেফ্ তাকে ধরে ফেলছে ঠিকই, কিন্তু আঠাশেই একটু ভারী হয়ে গেছে সে, এখনও বেমানান নয় কিন্তু বোঝা যাচ্ছে দৌড়োতে অভ্যস্ত নয় এই ফিনান্সিয়ারটি।
–আরে একটু দাঁড়া।
–হাঁপিয়ে গেলি? গতি একটু কম করে ফেলল দীপিকা।
–একটুখানি।
বলে বাঁদিকে তাকিয়ে থেমে গেল জেফ, তারপর হঠাৎই বড় বড় পা ফেলে রাস্তার ওপারে। ব্ল্যাক হর্স ড্রাইভের প্রথম বাড়িটার সামনে। দোতলা ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের বাড়ি, প্রকাণ্ড মেপলগাছ বাড়িটার পাশে, তলায় হলুদ, প্রায় মরচেরঙা শুকনো পাতার স্তূপ। মধ্যে মধ্যে উঁকি মারছে লাল। এবার ফল এসেছে বেশ দেরিতে, তাই গাছে এখনও কিছু পাতা অবশিষ্ট আছে, তার মধ্যে আসা সকালের রোদে কেমন মায়াবী ঝিলমিল। বাড়িটার কাচের জানলায় বাইরের আকাশের ছায়া… পাশ দিয়ে অযত্নে শুকনো হয়ে যাওয়া ফুলের বেড…
–এই বাড়িটার কথা মনে আছে তোর? ডনোভান পরিবার থাকত? জেফ বলে উঠল।
–হ্যাঁ। থাকবে না? এরিন ডনোভান আমাদের মিডল স্কুলের লাইব্রেরিয়ান ছিলেন।
দীপিকা আর জেফ ছোটবেলার বন্ধু। স্কুলের এবং একই পাড়াতে তাদের পরিবারের বাস। একই সঙ্গে তাদের বড় হয়ে ওঠা। পড়াশোনা, সাঁতার, গরমের ছুটিতে ক্যাম্পিং, এর ওর বাড়িতে অনায়াস যাতায়াত। এখন দীপিকা সানফ্রান্সিসকোর একটি আর্কিটেকচার ফার্মে কাজ করে, আর জেফ নিউইয়র্কে। তবু, নিজেদের শহরে ফিরলে তাদের দেখা হয়ই।
–এরিন তোকে খুব পছন্দ করতেন, তুই ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এ স্টেটের পুরস্কারটা যখন পেলি… ওনার কী আনন্দ!
হাসি ফুটে ওঠে দীপিকার মুখে। কত স্মৃতি। গল্প লেখা যে তার কী প্রিয় ছিল। তাদের ক্যাম্পের ট্রিপগুলোতে রাত্রে বসে গল্প। কত গল্প তক্ষুনি বানিয়ে বলেছে সে। তার বলা গল্পগুলো বন্ধুদের মুখে মুখে ফিরত।
কোথায় চলে গেছে দিনগুলো! শেষ কবে বসে একটা পুরো বই পড়েছে!
–এই পরিবারের একটা গল্প আছে জানিস জেফ? বাবা মা মারা যাওয়ার পর এরিন এই বাড়িতেই থাকত। গোটা জীবনই।
–বিয়ে করেনি?
–তেমন কাউকে পায়নি হয়তো। বাবা মা পরপর দুবছরের মধ্যে চলে যায়। তারপর থেকে একাই মোটামুটি। ছুটিতে ওর ছোটবোন জেসিকা আসত ছেলেকে নিয়ে। জেসিকা কলেজে পড়তে গিয়ে স্থানীয় একজন বিজনেসম্যানের ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়, তাকেই বিয়ে করে, ফলে ওখানেই থেকে যায়। টেনেসিতে। তবে বেশিরভাগ ক্রিসমাসে বাড়ি ফিরত ছেলেকে নিয়ে, আর আশপাশের থেকে আসত অন্য আত্মীয়রা।
–এরিনের একা লাগত না?
–এরিন একটু একা থাকতেই পছন্দ করত। সারাদিন কাজ, তারপর পড়া, টুকটাক লেখা। টাকাপয়সার চিন্তা ছিল না। পারিবারিক ট্রাস্ট থেকেও টাকা আসত। বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ তাতে হয়ে যেত। এভাবেই দিন চলছিল, তারপর হঠাৎ করে এরিনের জীবনে একটা পরিবর্তন এল।
–কী?
–জেসিকা বাড়িতে ফিরে এল। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না তার। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এল বেলা।
–যাঃ, বেলাটা আবার কে?
কথা বলতে বলতে ওদের দুজনের ছোটবেলার খুব প্রিয় একটা লেকের ধরে এসে গেছে। একটা খালি বেঞ্চে পাশাপাশি বসে তারা।
–বেলা ওদের থেকে অনেকটা ছোট খুড়তুতো বোন, পাশের টাউনে থাকাতে যোগাযোগ ভালই ছিল, খুব ভালবাসত ওরা বেলাকে। বেলা কলেজ শেষ করেনি, রিটেলে, ওয়েট্রেসের কাজ, এসব করত। নিজের বাড়ির সঙ্গেও খুব আলগা সম্পর্ক, কিন্তু এই দুই কাজিন দিদির সঙ্গে বরাবরই ঘনিষ্ঠ। জেসিকা আসার পর বেলা পাকাপাকিভাবে চলে এল।
–হুম, ডিপস গল্পটা কি তুই বানাচ্ছিস? স্কুলের সময়ের মতো?
–তুই শুনতে চাস, না চাস না?
–আরে বল বল। দিব্যি এগোচ্ছে…
–জেসিকা, বেলা আর এরিনের একটা নতুন জীবনযাত্রা শুরু হল। এরিন রবিবার করে চার্চে যেত। তবে সব রবিবার নয়। রিটায়ার করলেও এরিনের স্কুলের কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট ছিল। সারাজীবন উৎসাহী পাঠক হিসাবে বেশ কিছু লেখককে ফলো করত। সায়েন্স ফিকশন বিশেষ করে।
–জেসিকা আর বেলা?
–বেলা একটা বেকারিতে কাজ করত, খুব ভাল লাগত তার। বাড়িতেও আনত নানারকম ব্রেড, ডেজার্ট। এছাড়া উইকেন্ডে এক বন্ধুর হোটেলে রিসেপশনে কাজ করত। একটু গোলগাল হলেও দেখতে বেশ আকর্ষণীয় ছিল প্রায় পঞ্চাশেও। বয়ফ্রেন্ড হয়েছিল কয়েকজন, কিন্তু বেশিদিন কোনও সম্পর্ক টেঁকেনি। খুব একটা সতেজ ছটফটে ব্যক্তিত্ব ছিল বেলার। ও খুব জোর করে জেসিকাকে নিয়ে তিনজনের ছোট আউটিং— সামারে বিচ, কি পাহাড়, কি ট্রেলে হাঁটতে যাওয়া আর মাঝেমাঝে সিনেমা, নাটক, রেস্তরাঁয় খেতে যাওয়া। আসলে জেসিকা খুব গুটিয়ে গেছিল।
–ওর ছেলে আসত না?
–মাঝে মাঝে। তখন বাড়িটাতে আর একটু প্রাণ আসত।
–বুঝতে পারছি এবার একটা কিছু হবে। একটা ঘটনা।
দীপিকার মুখে মৃদু হাসি।
–জেসিকার একটু শরীর খারাপ চলছিল। সাইনাস ইনফেকশন, জ্বর। একদম শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিল। নিজের সমস্যার কথা বিশেষ বলত না বলে একটু বাড়াবাড়িও হয়ে যায়… এরিন একটু অশক্ত হয়ে গেলেও সে-ই বোনের দেখাশোনা করছিল। ওষুধ দেওয়া, জেসিকার ঘরে ঘুমোনো। বাইরে ঠান্ডা। বেলার মনমেজাজও বিশেষ ভাল ছিল না, লুইজ বলে একজন লোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, চ্যাটিং চলত ভালই— দু-তিনটে ডেট বেশ ভাল গেল, দুজনেই বাস্কেটবল ফ্যান, একসঙ্গে খেলা দেখা, অনেকরকম প্ল্যান। কয়েকমাসের মধ্যে বেশ তাড়াতাড়ি কাছে চলে আসছিল দুজন; বেলা খুব খুশি ছিল। কী যে হল, লুইজ হঠাৎ করে একদম কথা বন্ধ করে দিল। বেশ কয়েকটা টেক্সটের উত্তরে জানাল, তার মায়ের শরীর খারাপ, তাই সে ফ্লোরিডায়— কত সময় থাকতে হবে জানে না…
একটু চুপ করে গেল দীপিকা। বেলার কষ্টটা কেমন ঘনিয়ে এল তার গলায়।
–কোনও কোনও টেক্সটের অক্ষরগুলো থেকে মিথ্যের একটা কালো স্রোত বেরোতে থাকে। শূন্যতা ফোন থেকে চুইয়ে চুইয়ে নেমে মেঝেতে গড়িয়ে যায়। এত বড় খাঁ খাঁ বাড়ি, প্রায় সমস্ত বাড়ি অন্ধকার— সামনের টিভিতে চলা বাস্কেটবলের আওয়াজে, মুচড়ে ওঠে ভেতরটা। চ্যানেলটা পাল্টে দেয় বেলা, তারপর সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়ে।… তারপর সকালে ঘটল বুঝলি ঘটনাটা? জেসিকার চিৎকারে ঘুম ভাঙল বেলার। এত তীব্র, এত তীক্ষ্ণ… জেসিকার গলা এমনিতে প্রায় শোনা যায় না, তাই ঘুমের মধ্যে চিনে নিতেও সমস্যা হয়েছিল… তার নাম ধরেই তো…। উড়ে গেল বেলা প্রায় সিঁড়ি দিয়ে। প্যাসেজের শেষে জেসিকার ঘর, জানলার দিকে কোনাচে করে রাখা তার খাট, তার ওপর বসা… কোমর অব্দি কম্বলে ঢাকা… এলোমেলো চুল… হালকা বাদামি চোখগুলো ঠেলে বেরিয়ে আসছে…
–কী হল জেসিকার? সোজা হয়ে বসে জেফ।
–জেসিকার সঙ্গে কথা বলার আগেই বেলার হৃৎপিণ্ড প্রায় গলার কাছে উঠে এল। খাটের দিকে একটা পা এগোনোর আগে সে অনুভব করল তার কাঁধ পেছন থেকে কে যেন চেপে ধরেছে।
–কে? জেফের মুখটাই প্রশ্নচিহ্ন।
দীপিকার গলাটা প্রায় ফিসফিসে—
–সেটাই তো… পাশে কেউই নেই। তারপরই ভেসে এল এরিনের গলাটা— বেলা শোনো, প্লিজ প্যানিক কোরো না। কাল মাঝরাত থেকে আমি আয়নায় নিজেকে আর দেখতে পাচ্ছি না।
–ওহ গড ডিপস… কাম অন! জেফ দীপিকার হাতে একটা থাপ্পড় দিল।
–আরে দাঁড়া, এখনও কিছু হয়নি। অদৃশ্য এরিনের হাত বেলার হাত চেপে ধরল। বলল— আমি সব কিছু অনুভব করছি, কিন্তু নিজেকে আর দেখতে পাচ্ছি না। জেসিকাকে বলেছি ভোরবেলাতেই। কী করব বুঝতে পারছি না— শুধু ঠোঁট কাঁপছে, বেলার মনে হচ্ছে তার শরীরে কোনও সাড় নেই— বেলা এই অবস্থায় প্লিজ তোমাকে মাথা ঠান্ডা করতে হবে। বিশ্বাস করো নিজের হাত পা দেখা না গেলে নড়াচড়াও যায় না। প্লিজ মাথা ঠান্ডা করো— অদৃশ্য এরিনের গলা কাঁপছে। বেলার শরীর একটু স্থিতিতে আসছে। বাঁদিকে হাত বাড়িয়ে একটা রকিংচেয়ারের এক কোণ ধরে নিয়ে নিজেকে একটু স্থিত করল— জেসিকা তুমি ঠিক আছ তো? জেস? জেসিকার গলা থেকে শুধু একটা গোঙানির মতো চিৎকার। কম্বল সরিয়ে দিল সে, তার শুধু ওপরটুকু বিছানার ওপর, কোমরের নিচে থেকে কিছু নেই।… বেলা মাটিতে বসে পড়ল।
–তারপর? জেফের গলাটা প্রায় হাওয়ায় মিশেছে।
দীপিকা কিছুক্ষণ চুপচাপ।
–সন্ধের মধ্যে জেসিকাও অদৃশ্য হয়ে গেল।
একটা সশব্দ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল জেফের মধ্যে থেকে।
দুজনে আবার হাঁটতে শুরু করেছে। এবার বাড়ির দিকে।
–তারপরের কয়েক সপ্তাহ বুঝলি খুব টালমাটাল। জেসিকার শরীর ভাল হল, কিন্তু নিজের হাত পা দেখতে না পেলে চলাফেরা করা রোজকার কাজ, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা, উঁচু নিচু বোঝা এসব নিয়ে দুই বোন বিপর্যস্ত। বেলা প্রাণপণ সাহায্য করার চেষ্টায় কাজ থেকে ছুটি নিল। ওদেরকে বাড়িতে একা ফেলে যাওয়ার ভরসা হল না। মানসিকভাবে তার অবস্থাও তেমন কিছু ভাল ছিল না।… আর একটা ব্যাপারে দুই বোন নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় রইল।
–কী?
দীপিকা উত্তর দিল— বেলার অনেক অনেকবার বলা সত্ত্বেও ডাক্তার বা কোনও তৃতীয় ব্যক্তিকে এই বিষয়ে কিছু জানাল না।
–কেন?
–জানি না। তেমন কিছু জানানোর নেই, শারীরিক কোনও কষ্ট ছিল না, আর…
–আর?
–হাঁটাচলা আর রোজকার জীবনযাত্রায় একটু অভ্যস্ত হওয়ার পর, এক সপ্তাহের মধ্যে দুজনেই বিষয়টা উপভোগ করতে শুরু করলো।
জেফ বলে উঠল— হুমম… তেমনটাই তো হওয়ার কথা।
–এরিন আর জেসিকা যারা বেরোতে ভালোবাসত না, দুজনেই বেরোতে শুরু করল। রেস্টুরেন্টে যেখানে বুফে থাকে অথবা মলে এমন দোকানে যেখানে কিছু জিনিস সরালে বোঝা যাবে না… ওরা যেন কিশোরী হয়ে গেল। নিজেরা খেলছে এবং বেলার সঙ্গেও। ওরা যা নিয়ে আসে বাড়িতে সবই বেলার জন্য। জামাকাপড়, জুয়েলারি, খাবার। বেলার ঘরের ড্রেসারের ওপরে ভর্তি ট্যাগ না-খোলা জামাকাপড়, জুয়েলারি। দুষ্টুমি করে চমকে দেয় ওকে… ওর ঘরে বা বাথরুমে গিয়ে। বাইরে নিয়ে যাওয়ার বায়না করে। সিনেমা হলে, থিয়েটারে সামনে, ভাল সিট, মিউজিয়ামে জিনিস ছুঁয়ে দেখা, যেখানে ঢোকার অনুমতি নেই সেখানে যাওয়া। এসবের পালা শেষ হলে ওরা প্লেনে করে একটা ট্রিপে গেল সমুদ্রের ধারে, ফ্লোরিডার এক নামকরা বিচে। আর সেই সময়ের পর থেকেই বেলা আর নিতে পারল না।
–কী?
–প্রায় সমস্ত কিছুই। শুরু থেকেই ওদেরকে দেখতে না-পাওয়া, ওরা যে জামাকাপড় শখ করে আনত, তা ওর হত না, পরতে ইচ্ছে করত না, পরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করত না। খাওয়ার টেবিলে একা বসে খেতে, টিভিতে একা হাসির সিনেমা দেখতে, টিকিট কেটে থিয়েটারে একা বসতে, বিচে গিয়ে একা, শুধু দুদিক থেকে আসা কথার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগত না। ওরা কিশোরী হতে লাগল আর বেলা বুড়িয়ে যেতে লাগল। তাছাড়া ডাক্তারের অফিস থেকে ফোন আসা শুরু করল, বাড়িতে একজন-দুজন বন্ধু খোঁজ নেওয়ার জন্য এল… সে কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইত না। কী বলবে বুঝতে পারত না। তার মুখের হাসি একদম কমে যেতে লাগল।
–তারপর?
–তিনজনের মধ্যে খিটিমিটি বাঁধতে থাকল। এরিন বা জেসিকারও সমস্যা শুরু হল। এরিনের অনেকদিনের একজন বন্ধু আর প্রিয় লেখক বেড়াতে এলেন, বন্ধু তেমন একটা ছিল না তার— বহু বছর এরিন অপেক্ষা করছিল এঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য— দেখা হল না। ওদিকে জেসিকার ছেলে একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করেছে, তাকে মার সঙ্গে আলাপ করানোর কথা বারবার বলছিল। জেসিকা নানারকম বাহানা দিতে শুরু করায়, কয়েকদিনের মধ্যে ছেলের ফোন আসা প্রায় বন্ধ হতে বসল। তার ওপর জেসিকা খবর পেল ছেলে তার হবু-বৌকে নিয়ে তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেছে। জেসিকা বারবার বলতে শুরু করল সে তার স্বামীর জায়গায় ফিরে যেতে চায়… তার নাকি অনেক হিসাব বাকি আছে। কিছুদিন মনখারাপের পর এরিনের ইচ্ছে তারা ত্রুজে যাবে— শুধু একজনের খরচে সাতদিন কত আরাম আনন্দ। আর বেলা অবুঝের মতো বারবার বলত সেও অদৃশ্য হয়ে যেতে চায়। সে আর এই জীবন চায় না। ঝগড়া কান্নাকাটি— কখনও কখনও সিঁড়ির ধাপে বসে সে কাঁদে। বাগানে কাজ করতে করতে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে একা একা কথা বলে।
–তারপর?
–তারপর কী হল কেউ জানে না। বাড়িটা এরকমই আছে। ভার্চুয়ালি যোগাযোগ হয় বলে সেভাবে হয়তো কেউ খোঁজ করেনি।
দুজনেই একদম থেমে যায়। এখান থেকে দুজনের রাস্তা দুদিকে বেঁকে গেছে।
জেফ চিন্তা করছে।
–আর একটু তো বল? কী হতে পারে? আমার মনে হয় বেলা ওদেরকে ফেলে চলে গেছে। এভাবে থাকতে পারেনি। আর ওরা তো যেখানে খুশি থাকতে পারে।
–তোকে একটা জিনিস বলা হয়নি— দীপিকা বলে— বেলার মনে হচ্ছিল এই অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারে এরিন তাকে কিছু লুকোচ্ছে। এমনকি জেসিকাও।
–কী লুকোচ্ছে? জেফের গলায় কৌতূহল।
–বেলা হঠাৎ করে জেসিকার কম্পিউটারে সার্চ হিস্ট্রি থেকে কয়েকমাস আগের কয়েকটা লিঙ্ক খুঁজে পায়, যেটাতে খবর ছিল— পৃথিবীর বেশ কিছু বড় শহরে যেমন রিও, টোকিও, সোফিয়া, মুম্বাইতে শোনা যাচ্ছে কিছু মানুষ হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে যাচ্ছে।
–মানে? কীভাবে? কেউ তাদের খোঁজ করছে না?
দীপিকা বলল— না। অনেক সময় এরা একা থাকে বা এদের অনুপস্থিতি বুঝতে সময় চলে যায়। কে কার খবর রাখে বল তো? বিশেষত বড় শহরের অ্যাপার্টমেন্টে? আর বয়স্ক মানুষদের? কেউ তেমনভাবে এদের খোঁজেন না কারণ এদের মারা যাওয়ার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার ওপর তাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি লোকের যোগাযোগ আছে। এই প্রশ্ন ওই লিঙ্কে তোলা হয়েছে যে এরা কি স্বেচ্ছায় কোথাও চলে যাচ্ছে?
–তারপর?
–কিন্তু বেলা অনেক রিসার্চ করেও মেনস্ট্রিম মিডিয়া থেকে এই বিষয়ে আর কোনও খবর পায়নি।
বলে হঠাৎ হেসে উঠল দীপিকা।
–বেশ অনেকদিন বাদে একটা বড় গল্প দাঁড়াল। কী বল?
জেফ বলল— আরে তুই তো শেষটাতে মাস্টারস্ট্রোক দিলি। স্বেচ্ছায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে, প্রায় অদৃশ্য মানুষ। আর কত বছর বাদে তোর একটা গল্প শুনলাম বল তো? তবে ডিপস আজও এইটথ গ্রেডের ওয়াশিংটন ডিসি ট্রিপে তোর ওই গল্পটা ভুলতে পারি না।
দীপিকার মুখে তখনও হাসি।
–সেই সারা পৃথিবীতে একটা ভয়ঙ্কর ভাইরাস মহামারির গল্পটা? এক একটা মহাদেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে, ডাক্তারদের কোনওই ধারণা নেই কীভাবে চিকিৎসা করবে? হাওয়াতে ছড়িয়ে পড়ছে? আরে সেরকম সিনেমা একটা পরে বেরিয়েছে। কন্টাজিওন— এ বছরই বোধহয়… দীপিকা বলে উঠল।
–যাই বল… তখন আমরা কত ছোট। তুই এমনভাবে বলেছিলি— বাসে, মিউজিয়ামে এত ভিড়— সত্যি যদি এরকম হয়, আমাদের গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। জেফ বলে উঠল।
–তোর এতদিন বাদেও মনে আছে?
–তাহলেই বোঝ। তোর ক্রিয়েটিভ রাইটিঙে যাওয়া উচিত ছিল ডিপস। সায়েন্স ফিকশন।
দীপিকা ঝরঝর করে হাসল।
–চল এবার যাই। কাল পৌঁছে টেক্সট করিস। ভাল থাকিস। রোজ দৌড়োস।
–তাহলেই হয়েছে। আসি।
দুই বন্ধুর রাস্তা দুদিকে।
অক্টোবর ২০৩০
Uncolored by perception. Clothed to the naked eye. Five senses cannot sense the fact
of our existence. And that’s the only fact. In fact, there are no facts.–Saul Williams
সিয়াটেল শহরে সদ্য ভোর। মধ্যিখানে একর জোড়া বিশাল পার্ক। সেখানে একটি জগিং ট্রেইলে দৌড়োচ্ছেন একজন মহিলা সঙ্গে তার পোষ্য, প্রকাণ্ড গ্রেট ডেন কুকুর। দৌড়োতে দৌড়োতে হাতের শিকলে টান পড়ল।
–কী হল রোরো? রোরো হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেছে।
চোখের এক পাশ থেকে আলো আর রঙের হঠাৎ একটা পরিবর্তন হল মনে হল… হাওয়ায় একটা শিসের মতো আওয়াজ। ওদিকে তাকিয়ে আবার ডেকে উঠল রোরো। বয়স্কদের একটা তাইচির গ্ৰুপ থাকে ওদিকে। পিছনে একঝলক তাকিয়ে দেখলেন। না, গ্ৰুপটা নেই তো ওখানে? সবসময় থাকে তো… মঙ্গল, বৃহস্পতির সকালে…
মনে হল ওখানেই আছে,.. কিন্তু না… কী দেখলেন তিনি তাহলে?
রোরো… ওদিকে যেতে চাইছে। খুব টানছে শিকলটা।
–কাম অন রোরো।
দৌড়োতে দৌড়োতে ভাবছেন কী হল ব্যাপারটা। কত বছর ধরে দেখছেন। গ্রুপটা গেল কোথায়?
কী দেখছে বারবার রোরো ওদিকে?
–লেটস গো।
বারবার পিছনে তাকিয়ে দেখা অনিচ্ছুক রোরোকে টেনে নিয়ে মহিলা আবার দৌড়োতে শুরু করলেন।