আহমেদ-খান হীরক
তৃতীয় পর্বের পর
কারেন্ট যাওয়া রাতে
রাত আটটা।
বিটিভির খবর মাত্র শুরু হয়েছে। আমরা পাটি পেতে খেতে বসেছি। খবর দেখতে দেখতে খাওয়া– এর পরেই ডিডি-ওয়ানে চলে যাবে চ্যানেল। সুপারি গাছে বাঁধা অ্যান্টেনাটা ঘুরিয়ে উত্তর-দক্ষিণে রাখলে ভারতীয় ওই চ্যানেলটা ঝকঝকে আসে টিভিতে। নটায় শুরু হবে চিত্রাহার। সিনেমার গানের অনুষ্ঠান। মুক্কালা মুকাবেলা লায়লা ওহো লায়লা এ ধরনের একটা গান বাজিমাত করেছে। এই গান দেখার জন্য বাড়ির ছোটরা মুখিয়ে থাকি। চিত্রাহার ছাড়া এই গান দেখা সম্ভব না!
ঠিক তখনই কারেন্টটা যাবে।
কারেন্ট মানে ইলেকট্রিসিটি এ জ্ঞান তো বহুত পরে হয়েছে। আর এই জ্ঞান হওয়ার পরেও এখনও কারেন্ট গেল কারেন্ট এলই বলি।
তা কারেন্ট গেল!
জ্বলে উঠল হারিকেন। দপদপ করছে। খেতে খেতে এই আলো-আঁধারিতে আম্মা বিরক্ত। কারেন্টঅলাদের গুষ্টি উদ্ধার হতে থাকে।
আমরা বাড়তি ভাত না নিয়ে প্লেট গুটিয়ে উঠে পড়ি। প্রচণ্ড গরম। ঘাম। এর মধ্যে ভাত খাওয়া ঠিকঠাক হয় না।
এর মধ্যেই কেউ না কেউ প্রস্তাব দেন, চল ছাদে যাই!
বড়রা ছাদে যায় আগে আগে, গিয়ে পাটি পেতে দেয়। হাতে হাতপাখা। বাতাস নেই। খোলা আকাশ। তাতে তারার খেলা। পাশের শিমুল গাছটার দিকে তাকিয়ে বড়দের দীর্ঘশ্বাস— আল্লাহ, গাছের একটা পাতাও নড়ছে না!
আমরা ছোটরা যাই পিছে পিছে। একজনের হাতে টর্চ লাইট। সিঁড়ির ওপর আলো ফেলতে ফেলতে যেতে হয়। নাহলে সাপের ওপর পাড়া দিলেই হয়েছে। এদিকে গোখরা সাপের ভয়। গোখরা বাস্তু ও সুবোধ সাপ। সজ্ঞানে মানুষকে কাটতে চায় না। তাদের নেকনজর থাকে হাঁস-মুরগি আর কবুতরে। কিন্তু মানুষের নজর যদি কমজোর হয়, আর তাদের গায়ে-লেজে পা দিয়েই ফেলে তাহলে তারা আর কী করবে? নিজেকে বাঁচাতে তো কামড় দেবেই!
আর দিলে বাঁধন দেয়ারও সময় পাওয়া যাবে না। মুখে রক্ত উঠে মরতে হবে।
এত কাছে আর সাধারণ মৃত্যু নিয়ে আমরা যখন ছাদে উঠি, ছাদে তখন বড়রা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। এর মধ্যে কারও হয়তো মশাও লাগছে। আর প্রতিটা সমস্যার জন্য তখন গালাগালি করা হচ্ছে কারেন্টের গুষ্টিকে।
এরকম সময়গুলোতে কীভাবে কীভাবে যেন ছমছমে গল্পের সূত্রপাত হত।
আব্বা হয়তো তখন আকাশ দেখাচ্ছিলেন আমাদের।
কোনটা কোন গ্রহ, সপ্তর্ষি কোনটা, বলদের ডহর (মিল্কিওয়ে) কোনটা এগুলো বেশ চিনিয়ে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন। ছুটন্ত কোনও তারা দেখে রকেট রকেট বলে উত্তেজিত হচ্ছিলেন, এরকম সময়ে কীভাবে যেন গল্প ঘুরে যায় ভৌতিক দিকে।
আমার ভূত ও ভৌতিক গল্পগুলোর জন্ম আসলে ওই অন্ধকারের ছাদের ওপর।
ছমছমে সব গল্প।
ছবি আপা ছিলেন আমার মেজ বোনের বান্ধবী। তারোপর একই পাড়ার বাসিন্দা। তখন তাদের বয়স পনের কি ষোল। একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়া তার সাথে প্রাণের বান্ধবী হয়ে ওঠায় তাদের সারাক্ষণই একই সাথে কাটত।
তখন বর্ষাকাল।
পুনর্ভবা পানিতে উপচে পড়েছে। দুইপাড়া ছাপিয়ে পানি ঢুকে পড়তে চাইছে জনপদেও।
পাথর গুটিয়ে ওঠাতে ওঠাতে পাড়ে আর জায়গা বিশেষ নাই। তবু ঘাটটা ছবি আপাদের প্রিয়। দুপুরের গোসলটা সেখানেই সারতে যান তারা।
কোনও একটা কারণে স্কুল ছুটি হতে সেদিন দেরি হয়েছিল। টিপটিপ বৃষ্টিও ছিল। বইখাতা রেখে গোসলে যেতে যেতে সেদিন দুপুরটা গড়িয়ে গিয়েছিল। ছবি আপা, মেজ বোনসহ পাড়ার ছোট-বড় সখিরা হল্লা করে পুনর্ভবাকে মাতিয়ে তুলল। শুরু হল পানিতে লুকাচুন্নি (লুকোচুরি) খেলা। পাড়ের ঝোপ থেকে শুরু করে ডুব দিয়ে থাকা থেকে কচুরিপানার ভেতর কোথায় না লুকাত সব। ছবি আপাও লুকিয়েছিল কচুরির আড়ালে। লাবণী তাকে দেখতে পায় কি পায় না এরকম একটা ভয়ে সেই আড়াল থেকে আরেক কচুরির দিকে যাওয়ার ফাঁকে তার পা ধরে কেউ টান দিল।
ছবি আপার বুঝতে বাকি থাকল না ধরা পড়ে গেছে সে। এবার তাকেই চোর হতে হবে। হেসে উঠতে চাইল পানির ওপর। কিন্তু না, পারল না। কেউ যেন তাকে টেনে নিয়েই যেতে থাকল। ছটফট করে উঠল ছবি আপা। পা ঝাড়া দিয়ে আবারও উঠতে চাইল ওপরে। সম্ভব হল না। এবার একটা স্পষ্ট হাতের স্পর্শ পেল কোমরে। হাত, কিন্তু মানুষের মতো না যেন। আর সেই হাতটা তাকে টেনে নামাতে থাকল অনেক অনেক নিচে। ছবি আপার শরীরের ওপর দিয়ে পানি কেটে যেতে থাকল। ছবি আপা আতঙ্কের সাথে নিচের দিকে তাকালেন। অন্ধকার। নিরেট অন্ধকার। কিছু নেই।
পানির অনেক অনেক অনেক আর অনেক নিচে, সেই পাতালে, একটা রাজার প্রাসাদ।
ছবি আপা সেই প্রাসাদে দেখতে পেলেন নিজেকে। যেন একটা দরবার। দরবারে বেশ কিছু মানুষ। কিন্তু মানুষই কি ওগুলো? মানুষের থেকে অনেক বেশি লম্বা। ইয়া বড় বড় আলখেল্লা পরনে। চোখগুলো কেমন রক্তাভ।
ছবি আপার একটা হাত এই রকম একটা লম্বা মানুষ শক্ত করে ধরে আছে। ছবি আপা বিস্ময়ে এতই অভিভূত যে নিজের হাত ছাড়ানোর চিন্তাও পর্যন্ত তার নেই। সেই দরবারের সিংহাসনে খুব তীব্র সফেদ একটা আলখেল্লা পরে বসে আছে একজন। ফকফকে সাদা দাড়ি আর চুল। এত মসৃণ, যেন হাত দিলেই গলে যাবে।
সিনেমার মতো সব ঘটে যেতে লাগল ছবি আপার চোখের সামনে। সিংহাসনে বসা লোকটা কি জ্বিনের বাদশা? হঠাৎই কেমন রাগান্বিতভাবে তাকালেন তিনি ছবি আপার দিকে। পরক্ষণেই ছবি আপার সাথের লোকটার দিকে।
: ইনসান ধরে এনেছিস পাতালে? তোর সাহস তো কম না!
ছবি আপার হাত ধরে যে লোকটা বা জ্বিনটা ছিল সেও কেমন ঝ্যানম্যান করে উঠল।
: দেখতে বহুত সুন্দর লাগছে। পরীর মতো সুন্দর। ইনসানের বেটি এত্ত সুন্দর হয় না। তাই আনছি!
বাদশা বললেন, যা এক্ষুণি যা! একে এক্ষুণি ফেরত দিয়ে আয়! যেখান থেকে আনছিস সেইখানে ফেরত দিয়া আয়!
: দিতাম না। এরে ফেরত দিতাম না আব্বাহুজুর।
: তাইলে কী করতি ইনসানের বেটি নিয়া, অ্যা?
: আমি এরে বিয়া করতাম। একে আমার বহুত পছন্দ হয়েছে!
: বিয়া করতি? মাথা খারাপ তোর। জ্বিন আর ইনসানের বিয়ার বিধান নাই। আর যা বিধান নাই তা এই পাতালে হওয়া যাবে না। যা, এরে যেখান থেকে আনছিস সেইখানে ফেরত দিয়া আয়, যা!
ছবি আপার সব কিছু কেমন যেন ঘোরের মতো লাগে। আসলেই কি এসব হচ্ছে? আসলেই কি? ছবি আপা হাত মোচড়ায়। তাতে ব্যথা লাগে। কঁকিয়ে ওঠে সে। জ্বিনের ব্যাটা হাত ছাড়ে না তার। ভয়ানক ক্রূর চোখে সে তাকিয়ে থাকে। জ্বিনের বাদশা খেপে আগুন।
: কী বললাম, কানে যায় না তোর? যা এরে রাইখা আয়… কোথা থেকে আনছিস এরে, অ্যা?
: ঘাট থেকে।
: ছিছিছি! ইনসানেরা এখন নিশ্চয় এই বেটিরে খুঁজছে। বেটি, তোমার কি ভয় লাগে?
ছবি আপা কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। জ্বিনের বাদশার কণ্ঠ হঠাৎই মোলায়েম। বলে, তুমি কিছু মনে কইর না বেটি আমার। আমার এই ব্যাটা তোমার রূপ দেখে টাশকি খেয়ে তোমারে এখানে ধরে এনেছে। তোমারে বিয়া করে এখানেই রাখতে চায়। আমি জানি তুমি তা চাও না! চাও কি?
ছবি আপা দ্রুত মাথা নাড়ায়। সে চায় না। জ্বিনের ব্যাটা আরও ক্রুদ্ধ হয়। বাদশা বলেন, তুমি কি ইনসানের কাছে ফিরা যেতে চাও? তোমার মা-বাবার কাছে ফেরত যাইবা তুমি?
ছবি মাথা নাড়ায় দ্রুত। সে ফেরত যাবে। জ্বিনের বাদশা আবার তীক্ষ্ণচোখে তার ব্যাটাকে দেখেন। বলেন, এই এক ভুল যেন বারবার না হয়। ইনসানের এই বেটিরে যেখান থেকে পেয়েছিস রেখে আয়!
এরপর অনেকক্ষণ শোঁ শোঁ আওয়াজ হয়। সেই শোঁ শোঁ আওয়াজের মধ্যে ছবি আপা যখন চোখ খোলেন তখন দেখেন তিনি পাথর ঘাটের হলুদ পাথরের কাছে কাদামাটিমাখা পড়ে আছেন। সন্ধ্যা পার হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। হ্যাজাক আর পাঁচ ব্যাটারির টর্চ নিয়ে কারা যেন ছবি ছবি বলে ডাকছে। ছবি আপা একবার বলতে চান তিনি এইখানে পড়ে আছেন, কিন্তু পারেন না। আবার জ্ঞান হারান।
ছাদের ওপর, অন্ধকারের ভেতর এই গল্প শুনতে শুনতে আমাদের গলা শুকিয়ে যেত, জিভ ভারী হয়ে যেত। খস করে একটা পাতা খুলে পড়ার শব্দেই তখন চমকে উঠতাম। চিরপরিচিত পাথর ঘাটকেই তখন দুর্ভেদ্য আর দুর্জ্ঞেয় মনে হত। চাইলে ছাদ থেকে পাথর ঘাট দেখা যেত, কিন্তু আমরা সেদিকে তাকাতে পারতাম না!
গল্পের পরে কেউই অনেকক্ষণ কথা না বলে খালি ভারী ভারী শ্বাস ফেলে বসে থাকত। তখন হয়ত কেউ বলে উঠত, ছবি হয়ত সব খেয়াল দেখছিল। জ্বিনের ব্যাটা ক্যান তাকে ধরে নিয়ে যাবে?
তখন অন্য কেউ উত্তর দিত, সেই সময় ছবি দেখতে ছিল পুতলার মতো।
আরেকজন বলত, পুতলা ক্যান, ছবি ছিল পরীর মতন সুন্দর। তাকে তো জ্বিন ধরবেই!
: তাইলে ফেরত দিল ক্যান?
: ওই যে জ্বিনের বাদশার অর্ডার! না ফেরত দিয়া উপায় কী!
: অতক্ষণ পানির নিচে কেউ বাঁচে?
আমাদের মনেও তখন ওই প্রশ্ন সওয়ার করে। তাই তো, অতক্ষণ পানির নিচে কেউ বাঁচে নাকি? গল্পকথক তখন বলে, ওই সময় যারা ছবিকে দেখেছে তারা বলে…ছবির শরীর ছিল ঘন নীল! এমন নীল যে চামড়া কাটলে তখন বোধহয় নীল রক্ত বাইর হয়ে আসত! আর ছবি যে বাঁচছে তা শুধু ওই বাদশার জন্যই বাঁচছে! কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা এই কদিনের পরই ছবি তার বালিশের তলায় একটা কোমরবিছা পায়। বারো ভরি সোনার কোমরবিছা। ওই কোমরবিছা চাইলে এখনও কেউ গিয়ে দেখতে পারে ছবির কাছে। ছবির বিয়ে হয়েছে…
এরপর ছবি আপার কোথায় বিয়ে হয়েছে, কয়টা ছেলে-মেয়ে এসবের বৃত্তান্ত চলে আসে, গল্প ধীরে ধীরে বৈষয়িক হয়ে ওঠে… আমরা ছোটরা ছবি আপার পাতালপুরীতে যাওয়ার গল্পেই মত্ত থাকি। মাঝে মাঝে মনে হয় ওই কোমরবিছাটা যদি একবার দেখতে পেতাম। আমাদের ধারণা হয় জ্বিনের ব্যাটা ভালোবেসে ছবি আপাকে ওই কোমরবিছা উপহার দিয়েছে। আমাদের তখন ছবি আপাকেও দেখতে ইচ্ছা করে।
কিন্তু সে সময়েই বেরসিকের মতো কারেন্ট চলে আসে। আমরা হইহই করে ছাদ থেকে নেমে দেখি চিত্রাহার শেষ হয়ে গেছে! আমরা আরেকবার কারেন্ট যাওয়ার অপেক্ষা করতে থাকি। অপেক্ষা করতে থাকি আরেকটা কোনও গল্পের।
পঞ্চম পর্ব আগামী সংখ্যায়