দেবাশিস সেনগুপ্ত
ক্রীড়াপ্রেমী, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী
কাতার বিশ্বকাপের ৩২টি দেশের ২৮টি দেশ বিদায় নেওয়ার পরে এখন টিঁকে আছে ৪টি দেশ। ৬৪ ম্যাচের বিশ্বকাপের বাকি আছে আর ৪টি ম্যাচ। দুটি সেমিফাইনাল ম্যাচ, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান নির্ধারণকারী ম্যাচ এবং ফাইনাল ম্যাচ। সেমিফাইনালে ওঠা চারটি দল অনেক কসরৎ করে আজ সাফল্যের ফিনিশিং টাচ থেকে আর দু-ধাপ দূরে দাঁড়িয়ে। এবং চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আশা-নিরাশার দোলায় দুলছেন বিশ্বজোড়া ওই চারটি দেশের অগুনতি ফুটবলপ্রেমী সমর্থক। আজ আলোচনা করে দেখা যাক, সেমিফাইনালে ওঠা এই চারটি দলের বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা কতটা। ব্রাজিল, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড, পর্তুগাল সমেত বিশ্ব ফুটবলের অনেক সুপারপাওয়ার বিদায় নেওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে যে অবশিষ্ট চারটি দলের মধ্যে দুটি দেশ ইউরোপের, একটি দেশ লাতিন আমেরিকার এবং অন্য দেশটি আফ্রিকার। প্রথম ম্যাচে ১৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে প্রথম সেমিফাইনালে মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনা আর ক্রোয়েশিয়া। পরের মধ্যরাতেই ফ্রান্স খেলবে মরক্কোর বিরুদ্ধে, দ্বিতীয় সেমিফাইনালে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ফুটবলপ্রেমীদের মতে আর্জেন্টিনা আর ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে আপাতদৃষ্টিতে ফেভারিট আর্জেন্টিনা হলেও এটা ভুলে যাওয়া অনুচিত হবে যে কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের মত হট ফেভারিট টিমকে ১-১ ড্রয়ের পরে পেনাল্টি শুটআউটে ৪-২ গোলে ছিটকে দিয়েই সেমিফাইনালে উঠে এসেছে ক্রোয়েশিয়া। গ্রুপ এফ-এ মরক্কো আর বেলজিয়ামের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করা ক্রোয়েশিয়া ৪-১ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল কানাডাকে। রাউন্ড অফ ১৬-তে ক্রোয়েশিয়া ১-১ ড্রয়ের পরে পেনাল্টি শুটআউটে জাপানকে হারিয়েছিল ৩-১ গোলে। তারপরেই ছিল তাদের ব্রাজিল সংহারের রূপকথা। অন্যদিকে গ্রুপ সি-তে ১ম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে ১-২ হারের ক্ষত সামলে আর্জেন্টিনা পেনাল্টি মিস করেও মেক্সিকো আর পোল্যান্ড, দুটো দলকেই ২-০ গোলে হারায়। এরপরে রাউন্ড অফ ১৬-তে অস্ট্রলিয়াকে তারা হারায় ২-১ গোলে। আর কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডের মত শক্ত বাধা সরাতে ২-২ গোলে ড্রয়ের পরে পেনাল্টি শুটআউটে ৪-৩ গোলে জিতেছিল আর্জেন্টিনা।
আর্জেন্টিনার চিরকালীন মেসিনির্ভরতা কিছুটা হলেও এবারে পর্দা ভাগ করছে দলগত খেলার সঙ্গে। ডি পল, মলিনা, আলভারেজ, ডি মারিয়া, লাউতারো, এঞ্জো (সেমিফাইনাল ম্যাচে কার্ড সমস্যার জন্য থাকবেন না আকুনা) ছাড়াও গোলে এমি মার্টিনেজের জাদু এবং সর্বোপরি মেসির অলৌকিক একটা-দুটো জাদুমুহূর্ত তৈরি করার ক্ষমতাই সেমিফাইনালে কিছুটা হলেও এগিয়ে রাখছে আর্জেন্টিনাকে। উল্টোদিকে প্রতিভায় ঠাসা ক্রোয়েশিয়ার ভাণ্ডারে মিশেলের অভাব শুধু সমন্বয়ে। গ্রুপে তাদের পক্ষে গোল করা ক্রামারিক, লিভাজা আর মাজেরের দিকে তাকিয়ে তারা। লুকা মদ্রিচের অভিজ্ঞতা ক্রোয়েশিয়ার পক্ষে তুরুপের তাস ছিল, ব্রাজিল ম্যাচও ব্যতিক্রম ছিল না। লড়াই হবে তুল্যমূল্য, শেষ হাসি হয়ত হাসবে ৫৫-৪৫ এগিয়ে থাকা আর্জেন্টিনাই। এ ম্যাচ হবে স্কালোনি আর দালিচের ট্যাকটিকাল লড়াইও।
অন্য সেমিফাইনালে নিঃসন্দেহে ফেভারিট ফ্রান্স। কন্তে, পোগবা ও শেষে করিম বেঞ্জেমা ছিটকে যাওয়ায় একটু হলেও কমজোরি ছিল তারা। অধিনায়ক টটেনহ্যামে খেলা গোলরক্ষক হুগো লরিস, পিএসজির হয়ে খেলা ফরোয়ার্ড কিলিয়ান এমব্যাপে, ফরোয়ার্ড বার্সেলোনার ডেমবেলে, ডিফেন্ডার এসি মিলানে খেলা থিও হার্নান্ডেজের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রান্স টিমে খুব একটা সমস্যা ছিল না। অলিভিয়ার জিরুও খেলছেন হিরোর মতই। তিনি অনেকটাই সামলে দিয়েছেন করিম বেঞ্জেমার না থাকা। সঙ্গে গ্রিজম্যান তো আছেনই। ১৯৯৮ সালে খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ী দিদিয়ের দেশঁ গত ২ বছরে ৩-৫-২য়ে টিমকে খেলালেও এখন খেলাচ্ছেন ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে, যা তাঁকে এনে দিয়েছিল কোচ হিসেবে ২০১৮র বিশ্বকাপও। এবারেও অজি (৪-১) আর ড্যানিশদের (২-১) বিরুদ্ধে এই পদ্ধতিতেই ডেমবেলে আর এমব্যাপেকে ব্যবহার করে সফল হয়েছেন কোচ দেশঁ। আর তিউনিশিয়া ম্যাচে শুরু থেকে এমব্যাপেকে না নামানোর ফল ফ্রান্স পেয়েছে হাতে হাতে, ১-০ গোলে হেরে গিয়ে। গ্রুপ ডি-র ৩টি ম্যাচে ৬ পয়েন্ট পেয়ে ১ম স্থানে থাকা ফ্রান্সকে টানছেন এমব্যাপে। কিংবা বলা ভাল এমব্যাপের গতি। রাউন্ড অফ ১৬তে পোল্যান্ডকে ৩-১ গোলে ও কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে এখন মনোবলের তুঙ্গে ফরাসি টিম।
কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের মত ফেভারিট টিমকে ১-০ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে এসেছে মরক্কো, সঙ্গে ছিল ইউসুফ এন নাসিরির অলৌকিক হেডের গোল। তার আগে রাউন্ড অফ ১৬তে স্পেনের মত হেভিওয়েট টিমকে তারা ছিটকে দিয়েছিল টাইব্রেকারে ০-০ (৩-০)। গ্রুপ এফ-এ ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে ০-০ ড্রয়ের পরে তারা বেলজিয়াম (২-০) ও কানাডাকে (২-১) হারিয়ে চমকে দিয়েছিল সবাইকে। ওয়ালিদ রেগ্রাগুইর কোচিংয়ে মরক্কোকে শুরুতে কেউ হিসেবে রাখেননি, এটাই ছিল তাদের প্রধান শক্তি। প্রতিভা আছে মরক্কো শিবিরে, একটু দেখে খেললে আর মার্কিং ঠিক রাখলে তারা শক্ত গাঁট হতে পারে ফ্রান্স টিমের, এটা তারা ইতিমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছে। বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের বড় মঞ্চে না খেলার দুর্বলতা এবারে বুঝতে দেয়নি তাদের তরুণ ব্রিগেড। ভিনদেশে জন্মানো ফুটবলাররাই এবারের মরক্কোর প্রধান চালক। অধিনায়ক ফ্রান্সজাত রোমেইন সাইস খেলেন তুরস্কের বেসিকতাস ক্লাবে, যিনি গ্রুপে একবার বল জড়িয়েছেন বেলজিয়ামের জালে। চেলসিতে খেলেন নেদারল্যান্ডজাত হাকিম জিয়েচ। আর স্পেনজাত নামী ফুটবলার আশরফ হাকিমি খেলেন প্যারিস সাঁ জাঁ ক্লাবে। তাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন সবাই, সেমিফাইনাল ম্যাচে। মরক্কোজাত সেভিলার ফুটবলার ইউসুফ এন নাসিরিও গোল করেছেন কানাডা ও পর্তুগালের বিরুদ্ধে। আশরফ হাকিমির রিয়াল মাদ্রিদ, ইন্টার মিলান ও প্যারিস সাঁ জাঁ ক্লাবে খেলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগছে মরক্কোর হয়ে। ৪-৩-৩ ফর্মেশনের প্রথম টিমে তাদের গোল আগলানো বোনো এখন “টক অফ বিশ্বকাপ”। এমব্যাপের দৌড় কতটা আটকে দেবে আশরফ হাকিমির নেতৃত্বে মরক্কো ডিফেন্স, তার উপর অনেকটা দাঁড়িয়ে থাকবে ২য় সেমিফাইনালের ফল। তবে, সব মিলিয়ে, অনেকটা এগিয়ে আছে ফ্রান্সই।
একান্তই যদি ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনা ফাইনাল হয়, তবে কী হবে? এই ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব এখনই। তবে মাথা বলছে ফ্রান্স আর হৃদয় বলছে আর্জেন্টিনা। মেসি অথবা এমব্যাপে, যার হাতেই বিশ্বকাপ উঠুক, জিতবে ফুটবলই। প্রবীণ মেসি আর নবীন এমব্যাপে, দুজনের মধ্যেই তো ফুটবল নিজেকে বিকশিত করে আনন্দ পায়। মেসি-নির্ভর আর্জেন্টিনা বা এমব্যাপে-নির্ভর ফ্রান্স না, ফাইনালে জিততে হলে ‘টিম আর্জেন্টিনা’ আর ‘টিম ফ্রান্স’কেই ফুটে উঠতে হবে উজ্জ্বল হয়ে। দেশঁ আর স্ক্যালোনিরও অগ্নিপরীক্ষা হবে সেদিন। গতিময় ফ্রান্স না বুদ্ধিদীপ্ত আর্জেন্টিনা, জয়ের মুকুট পরবে কে? কী আছে পথের শেষে? ১৮ ডিসেম্বর ফয়সালা হয়ে যাবে সব প্রশ্নের। আপাতত সেই দিনের জন্য অপেক্ষা।