চার নম্বর নিউজডেস্ক
কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্র রাজনীতিতে মুক্ত ও গণতান্ত্রিক পরিসরের দাবি, তা নিয়ে দীর্ঘদিনের চাপানউতোর, কর্তৃপক্ষের দমন-পীড়ন ও তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের ১২ দিন ব্যাপী অনশন— এই ঘটনাক্রমে আপাতত ছেদ পড়ল গত ২২ ডিসেম্বর ছাত্র সংসদের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। এই নির্বাচন অনেক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, কর্তৃপক্ষের জোরালো বাধা উপেক্ষা করে ছাত্ররা নিজেরাই নিরপেক্ষ পরীক্ষকের উপস্থিতিতে এই নির্বাচনের সম্পন্ন করল। ডাঃ বিনায়ক সেন, বোলান গঙ্গোপাধ্যায় সহ বিশিষ্ট মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীরা মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন ও এই নির্বাচন মেডিকেল কলেজে গণতান্ত্রিক পরিসর ফিরিয়ে আনার দিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করছেন।
ডাঃ বিনায়ক সেনের সঙ্গে আমরা কথা বলেছিলাম ছাত্রদের এই অনশন আন্দোলন শেষ হওয়ার পর। তিনি বলেন, “আমার মনে হয় যে একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যেভাবে বাতিল করা হয়েছিল, সেটা ঠিক ছিল না। এবং ছাত্ররা যারা এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটিকে আবার লাগু করাবার চেষ্টা করেছে, তাদের প্রয়াসগুলিকে উৎসাহ জোগানোটাই সমীচিন হত। ওদের এই প্রয়াসটাকে সফল করার জন্যই ওরা অনশন আন্দোলনে নেমেছিল। আমার মনে হয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের এই কমিটমেন্টকে উদযাপন করা উচিত।”
স্বাভাবিকভাবে, রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ কলেজ কর্তৃপক্ষ এই নির্বাচনকে অবৈধ মনে করছে। তাদের কথা অনুযায়ী, এই আন্দোলন মাত্র ৫০ জনের আন্দোলন ও মেডিকেল কলেজের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রীরা এই আন্দোলনের সঙ্গে নেই৷ অথচ আমাদের প্রাপ্ত তথ্য অন্য কথা বলছে। আমরা এই আন্দোলনের অন্যতম দুই সৈনিক রণবীর সরকার এবং অপন সামন্তের সঙ্গে কথা বলেছি। ছাত্র সংসদের নির্বাচন পরবর্তী প্রেস রিলিজ থেকেও জানা যাচ্ছে, ২২ তারিখের নির্বাচনে কলেজের চারটে শিক্ষাবর্ষের মোট ১০০০ জন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ৭৮৮ জন অর্থাৎ প্রায় ৭৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রী নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন৷ সংখ্যাটা যেকোনও নির্বাচনে গড় অংশগ্রহণের চেয়ে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি৷ দ্বিতীয়ত, পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটি নিরপেক্ষ জুরি ও ইলেকশন কমিটির উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়৷ শুধু তাই নয়, নির্বাচন চলাকালীন তা পুরো সময় জুড়ে সোশাল মিডিয়ায় লাইভ প্রচার করা হয়েছিল। ফলে পরবর্তীতে কোনও জটিলতার সৃষ্টি হলে, এই লাইভ ভিডিও একটি প্রামাণ্য ডকুমেন্ট হিসেবে রয়ে যাবে।
রাজ্যের প্রায় সমস্ত কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন বর্তমান শাসক দলের জমানায় একটি অস্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে৷ অভিযোগ— যেখানে শাসক দলের ব্যানারের জয় সুনিশ্চিত নয় সেখানে ভোট করানো হচ্ছে না। অথবা ভয় দেখিয়ে চোখ রাঙিয়ে শাসক দলের জয় সুনিশ্চিত করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গকে বিরোধীশূন্য করার যে ঘোষিত নীতি রয়েছে রাজ্যের শাসক দলের, পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে ছাত্র সংসদের নির্বাচন, কোথাও সে নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম বরদাস্ত করা হচ্ছে না৷
এই সময়ে দাঁড়িয়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচন ও সেই নির্বাচনে বিরোধীদের জয় এক অন্য নজির তৈরি করল যা রাজ্যের সামগ্রিক রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির পক্ষে স্বাস্থ্যকর। এই গণতান্ত্রিক পরিবেশের চর্চা রাজ্যের সমস্ত কলেজে ছড়িয়ে পড়ুক। ‘ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে শাসকদলগুলির দাদাগিরি বন্ধ হোক।’
নির্বাচনের পর মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের প্রেস রিলিজ বলছে, ইউনিয়ন শুধুমাত্র ২০ জন নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধির নয়, ইউনিয়ন সবার। যারা ভোট দিলেন, এমনকি যারা দিলেন না, তাদের প্রত্যেকের দাবিদাওয়া নিয়ে মেডিকেল কলেজ স্টুডেন্ট ইউনিয়ন আগামীর লড়াই চালিয়ে যাবে৷
এই উচ্চারণ পশ্চিমবাংলার ছাত্র রাজনীতিকে কাঙ্ক্ষিত অক্সিজেন জোগাবে, অন্যান্য কলেজের আন্দোলনকে পথ দেখাবে— আপাতত এই আশাটুকু করাই যায়।