Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আবাস দুর্নীতি ও তার ভবিষ্যৎ

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 



গদ্যকার, প্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর

 

 

 

 

একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে— “যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ!” ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত (তখনও সেই জেলা ভেঙে ঝাড়গ্রাম নতুন জেলা হিসেবে গঠিত হয়নি) নেতাই গ্রামে যে ভয়াবহ গণহত্যা ঘটেছিল, সেই ঘটনার প্রসঙ্গে অন্যতম অভিযুক্ত তৎকালীন শাসকদল সিপিএমের স্থানীয় নেতা তথা বিনপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক অনুজ পাণ্ডের প্রাসাদোপম বাড়ি নিয়ে সেসময়ে খবরের কাগজ, সংবাদমাধ্যমে প্রচুর আলোচনা দেখা গিয়েছিল। ১১ বছর পেরিয়ে পঞ্চায়েত ভোটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার দুর্নীতির খবর যখন রাজ্যের সংবাদমাধ্যমে মূল আলোচ্য বিষয় হিসেবে উঠে আসতে শুরু করেছে, তখন সেই প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে ১১ বছর আগেকার সেই কথাই হঠাৎ কী করে জানি আমার মনে পড়ে গেল। দুর্নীতি বিষয়টা স্বভাবগতভাবে নিম্নগামী। উপরতলা থেকে নিচতলার অভিমুখেই তার যাতায়াত। আমরা যারা শহর কলকাতার বাসিন্দা পঞ্চায়েত বা স্থানীয় দুর্নীতির পরিমাণও যে কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছতে পারে তা অনেক সময়েই ঠাহর করে উঠতে পারি না। কেবল সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে পঞ্চায়েত বা জেলা পরিষদের নির্বাচন ঘোষণা হলে পরে কানাঘুষোয় সে খবর শুনতে পাই। ২০১৮ সালেও তা পেয়েছিলাম। জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকায় সেই নির্বাচনে বর্তমান শাসকদলের যে অত্যন্ত খারাপ ফল হয়েছিল তার কারণ হিসেবে পঞ্চায়েত সদস্যদের লাগামছাড়া দুর্নীতিই অন্যতম কারণ বলে তৃণমূল কংগ্রেসের উপরমহলের নেতারা মনে করেছিলেন। এমনকি সেই সময়েই নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনের অন্যতম নেতা শেখ সুফিয়ানেরও প্রাসাদোপম বাড়ির রাজকীয়তা দেখে বিরক্ত হয়ে প্রকাশ্যেই উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। শোনা যায় সেই কারণেই তিনি কোনও এক জেলা সফরের সময় সুফিয়ানের বাড়িতে আহারাদি সারতেও রাজি হননি। যদিও এমন একেকটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইঙ্গিতেও তেমনটা কাজ হয়ে উঠতে পারেনি। ফল হিসেবে এই ২০২২-এ দাঁড়িয়েও আমরা সেই পুরনো দুর্নীতিকেই আবারও নতুন রূপে প্রত্যক্ষ করেছি।

আলোচনা প্রসঙ্গে সম্পর্কিত ঘটনাগুলির একটি সময়ক্রম এখানে তুলে ধরতে চেষ্টা করব। গত ২৪ নভেম্বর কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার আওতাতে পশ্চিমবঙ্গে মোট ১১ লক্ষ বাড়ি তৈরির জন্য ১৩,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। এই বরাদ্দ টাকার মধ্যে ৮,২০০ কোটি টাকা কেন্দ্রের তরফে রাজ্যের কাছে পাঠানোরও বন্দোবস্ত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই টাকা পাঠানোর ফলে গত প্রায় এক বছর ধরে সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতে কেন্দ্রীয় সাহায্য আসা যে বন্ধ হয়ে রয়েছিল সেই অচলাবস্থার অবসান ঘটে। এর জন্যও অবশ্য কম ঘটনার ঘনঘটা দেখতে হয়নি। ২০২০ সাল থেকে তৃণমূল সরকার সামাজিক উন্নয়নখাতে বরাদ্দ অর্থের নয়ছয় করে চলেছে এই অভিযোগ তুলে রাজ্য বিজেপির নেতারা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দরবার করে এসেছিলেন। কার্যত সেই অভিযোগকেই মান্যতা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সামাজিক প্রকল্পগুলিতে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয় এবং গত বিধানসভা নির্বাচন থেকেই কেন্দ্রের এই ‘বিমাতৃসুলভ’ আচরণকে তৃণমূল কংগ্রেস তার রাজনৈতিক প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করে এসেছে। এই বছরের জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বিষয়ে কাজ খতিয়ে দেখতে বাংলায় আসে। ফিরে গিয়ে তাঁদের রিপোর্ট জমা পড়ার পরবর্তীতে গত নভেম্বরে নতুন করে আবারও অর্থ বরাদ্দ করা হয়। এই সময় তৃণমূল সরকারের তরফেও প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় যাঁরা বাড়ি পেতে চলেছেন, অর্থাৎ কিনা উপভোক্তা তালিকায় যাঁদের নাম উঠেছে (মনে রাখতে হবে এই তালিকাতে নাম তোলার জন্য বিবেচনাধীন আবেদনপত্রগুলি জমা পড়েছিল ২০১৮ সালে, আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে), তাঁদের নামগুলি যাচাই করতে শুরু করে। এই যাচাই প্রক্রিয়াতেই বেরিয়ে আসে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির হদিশ। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি সমস্ত জেলাতেই হাজার হাজার এমন মানুষের নাম তালিকাতে উঠেছে বলে দেখা যায়, যাঁরা কোনওভাবেই এই প্রকল্পের অংশীদার হতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার নিয়ম অনুসারে কেবল যাঁদের নিজস্ব বাড়ি নেই তাঁরাই যে এই প্রকল্পের অংশীদার হতে পারেন এমনটা নয়। নিজস্ব বাড়ি না থাকলেও, যদি কোনও ব্যক্তি দুইচাকা বা চারচাকা গাড়ি, মোটরচালিত নৌকো, যন্ত্রচালিত ট্রাক্টর ইত্যাদির মালিক হন, বা তাঁর মাসিক আয় যদি ১০,০০০ টাকা বা তার বেশি হয়, অথবা তিনি বা তাঁর পরিবারের কেউ যদি আয়কর দেওয়ার যোগ্য হন, অথবা তাঁর যদি ৫ একর বা তার চাইতে বেশি বহুফসলি জমি বা ল্যান্ডলাইন ফোন, রেফ্রিজারেটর অথবা ৫০,০০০ টাকা বা তার চেয়ে বেশি মূল্যের কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা থেকে থাকে, তবে তিনিও এই আবাস যোজনার মাধ্যমে বাড়ি তৈরির টাকা পাবেন না, এমনটাই বলা রয়েছে। এমন সমস্ত নিয়মকানুনের গণ্ডি থাকা সত্ত্বেও আধিকারিকেরা দেখতে পান হাজার হাজার মানুষের নাম রাজ্যের তরফে বানানো এই প্রাথমিক উপভোক্তা তালিকায় উঠে এসেছে, যাঁরা কিনা কোনওভাবেই এই প্রকল্পের সুবিধা পেতে পারেন না। স্বভাবতই রাজ্য রাজনীতি জুড়ে এখন এই নিয়ে তোলপাড় পড়ে গিয়েছে।

আধিকারিকেরা বিস্মিত হয়ে দেখেছেন এমন সমস্ত মানুষের নামও এই তালিকায় রয়েছে যাঁরা কিনা দোতলা বা তিনতলা বাড়ির বাসিন্দা। গ্যারাজে সাজানো চারচাকার বাহার। মেঝেতে ঝকঝকে মার্বলের চমক। আধিকারিকদের প্রশ্নের জবাবে কেউবা সাফাই গেয়েছেন এই বাড়ি তাঁদের ২০১৮ সালের পরবর্তীতে বানানো। কেউ বা এমনও বলেছেন যে, এই বাড়ি তাঁদের কারও নয়। তাঁদের আত্মীয়ের বাড়িতে তাঁরা আশ্রিত অবস্থায় রয়েছেন। যদিও শাক দিয়ে এই মাছের গন্ধ কোনওভাবেই ঢাকা পড়তে পারেনি। রাজনীতির রং প্রকটভাবেই পরিলক্ষিত হয়েছে। এলাকায় এলাকায়, পঞ্চায়েতের পরে পঞ্চায়েতে দেখা গিয়েছে দুর্নীতির দশা। পঞ্চায়েতপ্রধান অথবা পঞ্চায়েত সদস্যদের নাম তো তালিকাতে উঠেইছে, এমনকি তাঁদের সাত-আট-দশজন অবধি আত্মীয়, পরিজন, কাছের মানুষদের নাম এই তালিকাতে জায়গা করে নিয়েছে। শাসকদলের দিকেই সবচেয়ে বেশি করে অভিযোগের আঙুল উঠছে কারণ রাজ্যজুড়ে সিংহভাগ পঞ্চায়েতেই তাঁদের দাপট রয়েছে। একাধিক জেলা থেকে দলে দলে পঞ্চায়েত সদস্যদের প্রাণভয়ে পদত্যাগ করার মতো ঘটনাও ঘটতে শুরু করেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের উচ্চতর নেতৃবৃন্দের তরফে কড়া কিছু বিবৃতি আসার পরেপরেই এমন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পালা শুরু হয়েছে। যদিও তার কতখানি সত্যি, আর কতখানিই বা জনগণ (পড়ুন ভোটার)-এর চোখে ধুলো দেওয়ার প্রচেষ্টা তা কেবল সময়ই বলতে পারবে। কোনও রাজনৈতিক দলের পঞ্চায়েত সদস্যেরাই এই দুর্নীতির আওতা থেকে বাদ পড়েননি। হুগলিতে যেমনটা বেছে বেছে বিজেপি-কর্মীদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তেমনই অন্যত্র বিজেপি নেতা বা পঞ্চায়েত সদস্যদের নামও বেআইনিভাবে এই তালিকায় উঠে গিয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের বাবার নামও প্রাথমিক উপভোক্তা তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বলে খবর। যদিও ২০১৮ সালে যখন এই তালিকার জন্য নাম নেওয়া হচ্ছিল সেই সময়ে নিশীথ প্রামাণিক তৃণমূল কংগ্রেসেরই সদস্য ছিলেন। পরে তিনি বিজেপিতে যোগদান করেন। দুর্নীতির শিকড় যে সর্বত্রগামী। লঙ্কায় যে একবার পদার্পণ করেছে, রাবণ যে তাকে হয়ে উঠতেই হবে— এই তো ঐতিহ্য বরাবরের!

পাশাপাশি আরও একটি ঘটনার কথা জানা যাচ্ছে। মূলত এই তালিকার স্ক্রুটিনি করতে গিয়ে রাজ্যের তরফে আশা কর্মীদের একাংশকে বিশেষভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। দুর্নীতির কথা তাঁদের স্ক্রুটিনির মাধ্যমে সামনে আসতেই তাঁদের উপরেও প্রভাবশালী দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা ও পঞ্চায়েত সদস্যেরা চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছেন বলে অভিযোগ সামনে এসেছে। উত্তর ২৪ পরগণার স্বরূপনগর এলাকায় ৩৯ বছর বয়সী আশাকর্মী রেবা বিশ্বাসের আত্মহত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী বিজেপি নেতৃবৃন্দ পূর্বোক্ত অভিযোগকে সামনে নিয়ে এসেছেন। সব মিলিয়ে শাসক দল তৃণমূল যে বিশেষভাবে এই ঘটনার ফলে অস্বস্তিতে পড়েছে তা বলাই যায়। কাটমানি ও তার পরবর্তীতে এসএসসি দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় ইতিমধ্যেই বেকায়দায় পড়েছে শাসকদল। যদিও তাঁদেরই তরফে করা স্ক্রুটিনির কারণে আবাস যোজনার দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এসে পড়েছে, তবুও দিকে দিকে তাঁদেরই দলভুক্ত পঞ্চায়েত সদস্যদের ভুরিভুরি সম্পত্তির হদিস ও একই সঙ্গে তাঁদের বা তাঁদের পরিজনদের নাম এই তালিকাতে উঠে যাওয়া— দুইয়ে মিলেই মুখ পুড়েছে তৃণমূলের।

যদিও রাজনৈতিকভাবে এতে কি তৃণমূলেরই দীর্ঘমেয়াদে সুবিধা হতে চলেছে? একদিকে তাদেরই স্ক্রুটিনির ফলে এই দুর্নীতি ধরা পড়ায়, বিষয়টিকে নিঃসন্দেহে সাফাই হিসেবে তারা ব্যবহার করতে চাইবে। অন্যদিকে এই স্ক্রুটিনির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু সংখ্যক দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে লোকদেখানো ব্যবস্থা নিয়ে জনগণের চোখে তাদের ভাবমূর্তিটিকেও সহজেই আবার কিছুটা স্বচ্ছ করা যাবে। পরবর্তীতে আসবে দীর্ঘমেয়াদে সুবিধার প্রসঙ্গ। ডিসেম্বর ২০২১ থেকে ১০০ দিনের কাজের মানরেগা প্রকল্পেও মোদি সরকার বাংলা ও অন্যান্য রাজ্যের বরাদ্দ বন্ধ করে রেখেছে। সম্প্রতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য অনুসারে এই প্রকল্পে বাংলার বকেয়া বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় ৫,৪৩৩ কোটি টাকা। আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগকে সামনে রেখে মোদি সরকার আবারও অনায়াসেই এই প্রকল্প-সহ অন্যান্য সমস্ত সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বাংলার বরাদ্দ অনির্দিষ্টকালের জন্য এমনিভাবেই আটকে রেখে দিতে পারে। সেই ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে তৃণমূল কংগ্রেসেরই প্রচারের সুবিধা হবে বলে মনে করছি। অন্যদিকে রাজ্যের বিভিন্ন পঞ্চায়েত ও জেলা পরিষদভুক্ত এলাকাতেই বাম-বিজেপি জোটের যে প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে রাজ্য তথা দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে তা আরওই অবিন্যস্ত, অগোছালো, ও বিপজ্জনক দিকে চালিত করেছে। দেশ ও সংবিধানের প্রধান শত্রু যে ফ্যাসিস্ট বিজেপি, তারই সঙ্গে যত ক্ষুদ্র যত নিচতলাকার মঞ্চেই হোক না কেন, জোট করলে পরে আদতে যে তা জনগণের সঙ্গে, সংবিধান ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও নিজেদের রাজনৈতিক কেরিয়ারের পরিপ্রেক্ষিতেও পুরোপুরিভাবে আত্মহত্যার সমতুল— রাজ্যের বামপন্থীদের তা বোঝায় সাধ্যি কার! একুশের নির্বাচনে আইএসএফের সঙ্গে জোট করে যে ভরাডুবি প্রত্যক্ষ করেছিল বাম-গণতান্ত্রিক জোট, সেই থেকেও যদি তাদের দূরদৃষ্টি না এসে থাকে— রাজ্যের ভবিষ্যৎ তখন অন্ধকারের হাতেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। এই অন্ধকার থেকে মুক্তির পথ কোথায়, সময়ের উপরে হাত তুলে রেখে ভরসা করা ভিন্ন উপায় দেখছি না।