বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য
আইনজীবী, রাজনীতিক
আমাদের দেশে বিচারপতি নির্বাচনের জন্য কলেজিয়াম ব্যবস্থা আগে প্রচলিত ছিল না। তবে দেশের সংবিধান কার্যকর হওয়ার সময় থেকেই ভারতের বিচারব্যবস্থায় বিচারপতি নিয়োগের জন্য একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল যে, একটা সময় দেশের সরকার বিচারপতি নিয়োগ ও তাঁদের বদলির ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে শুরু করল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি যখন জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, সেই সময় থেকে বিচারপতি নিয়োগে সরকারি হস্তক্ষেপের কুঅভ্যাসটিও আমাদের দেশে মাথাচাড়া দেয়। তার আগে অবধি বিচারপতি নিয়োগের সাংবিধানিক প্রক্রিয়াটা সুষ্ঠুভাবেই চলছিল।
স্বাভাবিকভাবেই, বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলত, বিচারব্যবস্থায় সরকারি হস্তক্ষেপ নিয়ে আদালতে একাধিক মামলা হয়। আমরা জানি, জুডিশিয়াল রিভিউ বা বৈচারিক পুনর্মূল্যায়ন ভারতবর্ষের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পর্যায়ে পড়ে এবং এই ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানের মূল কাঠামোকে রক্ষা করে চলেছে। সেই কারণেই সমস্ত দিক বিচার-বিবেচনা করে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন যে, চালু যে পদ্ধতি রয়েছে তাতে এক্সিকিউটিভদের, অর্থাৎ এক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়ছে। মনে রাখতে হবে, যেসব মামলা হয় তার বেশিরভাগই সরকারের বিরুদ্ধে হয়। ফলে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকলে তা স্বভাবতই বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতার ওপর আঘাত হানে। এই নিয়ে প্রচুর আলোচনার পর ১৯৯৩ সালে এই কলেজিয়াম ব্যবস্থাটি বেছে নেওয়া হয়, যা বর্তমানে চালু আছে। সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি সহ পাঁচজন ও হাইকোর্টের ক্ষেত্রের তিনজন সবচেয়ে সিনিয়র বিচারপতিকে নিয়ে এই কলেজিয়াম তৈরি করা হয়। এই কলেজিয়াম ঠিক করে দেবে কারা সুপ্রিম কোর্টে ও হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হবেন। এই সিনিয়র বিচারপতিরা যেহেতু দীর্ঘদিন বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, নিজেদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে তাঁরাই উপযুক্ত মানুষকে বিচারব্যবস্থায় নিযুক্ত করতে পারবেন, এমনটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই কলেজিয়াম সিস্টেম চালু হয়। আমরা বলতে পারি, এটাই ছিল সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বিচারপতি নির্বাচনের জন্য এখনও পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ আইন।
এই ব্যবস্থা চলাকালীনও বিভিন্ন সময় নানা প্রশ্ন উঠেছিল। অস্বচ্ছতার প্রশ্নও ওঠে। এই কলেজিয়াম ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করছে অনেকেই বুঝতে পারেন না। আবার কলেজিয়াম থেকে বিচারপতি নির্বাচন করে নাম পাঠানোর পরেও সরকার সে নাম ফেরত দিয়ে দিচ্ছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে। অবশ্য বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে সরকারের নিজস্ব মন্তব্য থাকতেই পারে। এক্ষেত্রে নিয়ম হল, কলেজিয়াম যে সুপারিশ করছে, তা যদি কেন্দ্র সরকার বা রাজ্য সরকার মানতে না চায়, তার নির্দিষ্ট কারণ দেখালে কলেজিয়াম অবশ্যই তা পুনর্বিবেচনা করবে। কিন্তু পুনর্বিবেচনা করে কলেজিয়াম যদি তাঁদের পূর্ব সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন, তাহলে সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করতে সরকার বাধ্য থাকবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার বা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অনেক কম। সমালোচনা ও বিতর্ক থাকলেও এই ব্যবস্থা এতদিন ধরে ভালই চলছিল। আমার নিজেরও একবার সুযোগ হয়েছিল এই সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে হাজির হওয়ার। সে অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এবার, বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা যেটা করতে চাইল তা হল শুধুমাত্র তাদের অর্থাৎ আরএসএস-এর মতাদর্শের অনুসারী বিচারপতিদেরই বিভিন্ন আদালতে নিয়োগ করা হবে। কলেজিয়াম ব্যবস্থার ফলে সেটা করা সম্ভব হচ্ছিল না। আরএসএস-এর যে চূড়ান্ত অ্যাজেন্ডা অর্থাৎ হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, তাতে বিচারব্যবস্থা ও এইসব নিরপেক্ষ বিচারপতিরা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন। বিচার যদি যুক্তিসঙ্গত ও সংবিধানসম্মত হয়, তাহলে তা বিজেপির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার পক্ষে মোটেই লাভজনক নয়। সংবিধান সংশোধন করে নতুন আইন করা হল, ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন। কিন্তু এই নতুন আইনটি কতটা সাংবিধানিক তা বিচারের জন্য আইনটি যখন সুপ্রিম কোর্টে গেল, সর্বোচ্চ আদালত লক্ষ করলেন যে এই আইনে এমন কিছু কিছু ধারা আছে, যেগুলি প্রকৃতপক্ষে বিচারের নিরপেক্ষতা রক্ষার ক্ষেত্রে অসুবিধে সৃষ্টি করতে পারে। এখন দেশের বর্তমান সরকার যদি সততার সঙ্গে কাজ করত, তাহলে সুপ্রিম কোর্ট আইনটির যে ত্রুটিবিচ্যুতির কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলিকে সংশোধন করে তারা আইনটি প্রনয়ণ করতে পারত। সে সাংবিধানিক ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু সে ক্ষমতা তারা প্রয়োগ করল না। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে তাদের অনিচ্ছায় মেনে নিতে হল বটে, ত্রুটিপূর্ণ আইনটি তারা কার্যকর করতে পারল না, কিন্তু আইনটি সংশোধনেরও চেষ্টা করল না। কারণ সুপ্রিম কোর্টের দেখিয়ে দেওয়া ত্রুটিগুলি সংশোধন করে যদি তারা সংশোধিত জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট আইন আনে, তাহলে শাসকের বকলমে সরকারি আধিকারিকদের বিচারপতি নিয়োগে হস্তক্ষেপ করার আর কোনও ক্ষমতাই থাকবে না। অর্থাৎ বিচারব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করা শাসকের উদ্দেশ্য ছিল না, প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল বিচারব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করা। তাই কেন্দ্র সরকার ত্রুটি সংশোধন করে জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট আইন আনার পথে হাঁটল না। পরিবর্তে তারা বিচারব্যবস্থার সঙ্গে চূড়ান্ত অসহযোগিতা শুরু করল। যেমন, কলেজিয়ামের সুপারিশকে নির্বিচারে অমান্য করা, কলেজিয়াম যদি পাঁচজনের নাম পাঠিয়ে থাকে, তাহলে তার মধ্যে থেকে একজন খুঁজে বার করে যাকে সরকার কিছুটা হলেও নিজের অনুসারী মনে করছেন, শুধুমাত্র তাকেই বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করা— এইসব করতে লাগল। এর ফলে বিচারকাঠামোয় একটা চরম অব্যবস্থা তৈরি হল।
বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত, দেশের সমস্ত বিচারকদের মধ্যে তাঁর যে সিনিয়রিটি আছে তার সাপেক্ষে তিনি নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষের প্রধান বিচারপতি হওয়ার যোগ্য। যোগ্যতা ও দক্ষতার দিক থেকে বিচারপতি দত্ত কোনও অংশে খাটো নন, বিচারপতি হিসেবে তিনি যথেষ্ট নির্ভীক। কিন্তু তাঁকে বাদ দেওয়ার জন্য তাঁকে টপকে সরকার দীপঙ্কর দত্তের একজন জুনিয়র পাদরিওয়ালাকে সুপারিশ করানো হল। তার পরে যখন শ্রী দত্ত শেষমেশ কলেজিয়াম সুপারিশ পেলেন, তাঁর নিয়োগকে কোনওরকম যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই তিন মাসের জন্য আটকে রাখা হল। কেন আটকে রাখা হল তা কেউ জানে না। কলকাতা হাইকোর্ট সহ দেশের নানা হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে এইরকম সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়ে দেখানো যায় যে কেন্দ্র সরকার তাদের রাজনৈতিক মতের অনুসারী হিসেবে যাদের যাদের খুঁজে পেয়েছে, তাদের নিয়োগ করার নির্দেশ জারি করেছে, বাকিদের নিয়োগ ছলেবলেকৌশলে আটকে রেখেছে। অর্থাৎ প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে তারা বর্তমানের কলেজিয়াম ব্যবস্থাটাকেই পঙ্গু বা অকার্যকর করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ আছে, যে সরকারের ফেরত দেওয়া নামগুলি পুনর্বিবেচনা করে কলেজিয়াম যদি সেই নামগুলিকেই পুনর্বহাল রাখে, সরকারকে তা মেনে নিতেই হবে। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ সরকার মানতে চাইছে না। মানতে না চেয়ে বিষয়টিকে ঘোলা করবার জন্যে তারা প্রকাশ্যে বিবৃতি দিতে শুরু করেছে। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের নৈতিক দায়িত্ব হল— যতক্ষণ নতুন কোনও আইন না করা যাচ্ছে, ততক্ষণ যে আইনটি বহাল আছে, সেটাকেই তাদের মেনে চলা। কলেজিয়াম ব্যবস্থা নিয়ে কারও বক্তব্য বা ভিন্নমত থাকতেই পারে, তা নিয়ে তর্কবিতর্ক হোক, কিন্তু যতক্ষণ দেশে এই ব্যবস্থা আইনসঙ্গতভাবে কার্যকর আছে এবং এর পরিবর্তে নতুন কোনও আইন না আসছে, ততক্ষণ কলেজিয়াম সিস্টেমকেই মান্যতা ও মর্যাদা দিতে হবে। কিন্তু বিজেপি সরকার নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে কলেজিয়ামকে প্রকাশ্যেই অবজ্ঞা করতে শুরু করে দিল। দেশের আইন প্রসঙ্গে দেশের নির্বাচিত সরকারের এই মানসিকতা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এই নিয়ে পুনরায় সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয় এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রকৃতপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেলকে কঠোরভাবে সতর্ক করেন যে যদি এরপর থেকে বিচারপতিদের নিয়োগ অনর্থক আটকে রাখা হয়, তাহলে আদালতকে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থাৎ স্বয়ং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে একটা দ্বৈরথে প্রবৃত্ত হওয়ার চেষ্টা করছে কেন্দ্রের শাসক দল, যেটা হওয়া একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। অল্প কথায়, এই হল বর্তমানে আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থার দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির চিত্র।
বোঝাই যাচ্ছে, আইন সংশোধন করার ইচ্ছে সরকারের নেই। বরং সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা ব্রুটাল মেজরিটির জোরে এবং যুক্তি-তর্ক-সংবিধান এসব না মেনে শুধুমাত্র মোদিজি কা জয় স্লোগান তুলে আইনসঙ্গত যা কিছু, সবই অমান্য করতে শুরু করেছে। গণতন্ত্রের পক্ষে এর চেয়ে অশুভ বার্তা আর কী-ই বা হতে পারে! এইভাবেই গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর মধ্যে আমাদের দেশে যেসব ‘ওয়াচডগ’ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, বিজেপি সরকার এক এক করে তার সবগুলোকেই পঙ্গু করে দিতে বদ্ধপরিকর। প্রথমে চেষ্টা করা হচ্ছে, নানা গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে নিজেদের পছন্দসই লোকজনকে বসানো, এবং সেই পছন্দসই লোকেরা সেইসব চেয়ারে বসে অন্ধভাবে শাসকদলের নির্দেশ পালন করে চলেছেন। এর ফলে যে সংস্থাগুলি গণতন্ত্রকে সচল রাখার জন্য জরুরি, যেমন নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, সিবিআই, জুডিশিয়ারি— সেগুলিকে নির্লজ্জভাবে কব্জা করা হচ্ছে।
আমাদের দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে এই অবনমন আমাদের রুখতেই হবে। কারণ গণতন্ত্র মানে শুধু পাঁচ বছর পর পর ভোট দেওয়া নয়, গণতন্ত্র কথাটার অর্থ ভিন্নমতকে লালন-পালন করা। ভিন্নমত যিনি রাখছেন, তাঁকে সম্মান করা ও তাঁর কথা শোনা-ই গণতন্ত্রের চরিত্রলক্ষ্মণ। কিন্তু ভিন্নমত মানেই আরবান নকশাল— এইরকম একটা অদ্ভুত স্লোগান ওরা চালু করেছে। ঠিক একই কারণে যেসব বিচারপতিরা তাঁদের রায়ে সংবিধানের মর্মবস্তুকে প্রতিফলিত করছেন, তাঁদেরকে এরা পছন্দ করছে না। এরা পছন্দ করে সেইসব বিচারপতিদের যাঁরা ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার পথে গোপনে বা প্রকাশ্যে শাসকের পাশে দাঁড়াবেন৷ এরকম কিছু বিচারপতির কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাচ্ছি যা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং সংবিধান-বিরোধী। এই ধরনের লোকেদেরই শাসকের পছন্দ, তারা এই সমস্ত লোকজনদেরই পদে নিয়ে আসতে চায়। এদের রুখতে হলে ব্যাপক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ প্রয়োজন।
আর এই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে সাধারণ মানুষদেরই। গণতন্ত্রকে রক্ষার আন্দোলন তো আমজনতারই আন্দোলন। কারণ বিচারপ্রার্থী হচ্ছেন আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ। যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, তাঁরা অর্থের জোরে বিচার কিনে নেন। তাঁরা ভয় দেখিয়ে অথবা পয়সা দিয়ে বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেন। যাঁদের ধনদৈলত বা ক্ষমতা কিছুই নেই, ন্যায়বিচার তো তাঁদেরই দরকার। বিচার যাঁদের দরকার, অর্থাৎ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের, তাঁদের কাছে ন্যায়বিচার পৌঁছে দেওয়ার লড়াই আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে।