Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ASER-2022— অতিমারির সময়ে শিক্ষা: যে ক্ষতি পূরণের নয়

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 



শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী

 

 

 

ভারতবর্ষের শিক্ষার হাল-হকিকত নিরূপণে অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট (ASER) এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে দীর্ঘকাল ধরে চিহ্নিত। প্রথম ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক রিপোর্টও (ASER-2022) তার ব্যতিক্রম নয়। এবারের রিপোর্ট তুলনামূলক বিচারে বরং আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ অতিমারিপর্বে লকডাউন একমাত্র ভারতেই এত দীর্ঘ সময় ধরে স্কুলের পঠনপাঠনকে বন্ধ করে রেখেছিল। করোনা অতিমারি স্কুলশিক্ষায় কী ধরনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে, শিক্ষায় বৈষম্যকে কীভাবে আরও ত্বরান্বিত করেছে তা নিয়ে ইতিমধ্যে কিছু কিছু আলোচনা হয়েছে। তবে প্রথমের সমীক্ষা এক সর্বভারতীয় চিত্র আমাদের সামনে উপস্থিত করে। এক্ষেত্রে প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল যে এই সমীক্ষা পুরোটাই গ্রামভারতের স্কুলগুলোকে নিয়ে করা। একথা অনস্বীকার্য যে আজকের সরকারি স্কুলশিক্ষার বেশিটাই গ্রামনির্ভর, কারণ তুলনামূলক আর্থিক স্বচ্ছলতা এবং সুযোগের কারণে শহরাঞ্চলের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নবিত্তদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আজ বেসরকারি স্কুলে তাদের বাচ্চাদের পড়ানোর ব্যবস্থা করছে। প্রথম ফাউন্ডেশনের সমীক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে নজরকাড়ার মতো বিষয় হল তার নমুনার সংখ্যা ও বিস্তৃতি। ভারতের ৬১৬টি জেলার ১৯০৬০টি স্কুলের ৭ লক্ষ শিক্ষার্থীর উপর এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বয়স সীমা ১-১৬ বছর। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে কী শিখছে তা বোঝার জন্য বই পড়া (reading skill), সাধারণ পাটিগণিত ও ইংরেজি শব্দের মানে বোঝার মতো সাধারণ মানদণ্ডগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। এই রিপোর্ট প্রতিবছরই প্রকাশিত হয়, কিন্তু অতিমারির জন্য চার বছর এই মাত্রায় ফিল্ড সার্ভে করা সম্ভব হয়নি। তাই এইবারের প্রাপ্ত ফলের সঙ্গে তুলনামূলক বিচার টানা হয়েছে ২০১৮ সালের সমীক্ষালব্ধ ফলাফলের সঙ্গে, যেটা ছিল এক পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা।

প্রথম সমীক্ষা সারা দেশের খতিয়ান তুলে ধরলেও বর্তমান নিবন্ধে আমরা সারা ভারতের গড় চিত্রটা যেমন দেখব তেমনই বাস্তব পরিস্থিতিটা বিচারের জন্য পাঁচটি রাজ্যের তৃণমূল স্তরের পরিসংখ্যানটিকেও আলোচনার জন্য উপস্থিত করব। এই রাজ্যগুলি হল শিক্ষায় অগ্রণী কেরল, পিছিয়ে পড়া রাজ্য বিহার, বহুবিজ্ঞাপিত উন্নয়ন মডেল গুজরাট, আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ মহারাষ্ট্র এবং অবশ্যই আমাদের নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। মাতৃভাষা, ইংরেজি ভাষা ও সাধারণ গণিতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্যগুলিকে বিচারের জন্য আমরা সব ক্ষেত্রেই একই শ্রেণিকে বেছে নিচ্ছি। ইংরেজি ও গণিতের ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়েছিল মূল্যায়ণের জন্য তাও উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রথম ফাউন্ডেশনের সমীক্ষার প্রথম বিষয় ছিল মাতৃভাষা। এক্ষেত্রে বর্ণ, শব্দ, সরল বাক্য পড়া, কোনও অনুচ্ছেদ পড়াকে মানদণ্ড স্থির করা হয়েছিল। বাংলার ক্ষেত্রে যেমন হ/চ/ট/ল/ন প্রভৃতি বর্ণ; ভুল, আতা, ভোজ, পূজা প্রভৃতি শব্দ; এবং কিছু সাধারণ বাক্য যেমন রাজাদাদা খুব ভাল খেলে/ব্যাট বল নিয়ে মাঠে যায় ইত্যাদি পড়তে বলা হয়েছিল। তৃতীয় শ্রেণির ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় সমীক্ষার পরিসংখ্যান নিচের সারণীতে দেওয়া হল।

রাজ্য

কোনও বর্ণ চেনে না (%) শুধু বর্ণ চেনে (%) বর্ণ ও শব্দ চেনে (%) প্রথম শ্রেণির পাঠ পড়তে পারে (%) দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ পড়তে পারে (২০১৮) (%) দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ পড়তে পারে (%)

তৃতীয় শ্রেণির পাঠ পড়তে পারে (%)

মহারাষ্ট্র ১১.৫ ১৮.৪ ২২.২ ২১.৩ ৩৩.৬ ২৯.৫ ২৬.৬
বিহার ২৩.১ ৩০.২ ১৬.৩ ১০.৭ ২৩.৭ ১৯.৮ ১৯.৮
গুজরাট ৭.১ ১৯.০ ২৫.১ ২৪.৬ ৩৩.৩ ২৩.৮ ২৩.৯
পশ্চিমবঙ্গ ৮.০ ১৮.১ ২২.০ ১৮.৯ ৩৬.৬ ৩২.৬ ৩৩.০
কেরল ৫.৪ ১২.৯ ২০.৮ ২২.৮ ৪৩.৪ ৩১.৬ ৩৮.৮

 

ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্রে ছিল ক্যাপিটেল লেটার চেনা (B/H/R/L); স্মল লেটার চেনা (a/g/c/f); সাধারণ শব্দের উচ্চারণ ও তার মানে বোঝা (cow/hat/big/pen); সাধারণ বাক্য পড়া ও তার অর্থ বলা (i like to play/this is a long wall) প্রভৃতি। তৃতীয় শ্রেণির ক্ষেত্রে সেই সমীক্ষার ফল রইল নিচের সারণীতে।

রাজ্য

ক্যাপিটাল লেটার চেনে না (%) শুধু ক্যাপিটাল লেটার চেনে (%) ক্যাপিটাল ও স্মল লেটার চেনে (%) বর্ণ ও শব্দ চেনে (%) সাধারণ বাক্য পড়তে পারে (%) শব্দ পড়তে পারে, কিন্তু বাক্য পড়তে পারে না (ষষ্ঠ শ্রেণি) (%)

বাক্য পড়তে পারে, কিন্তু তার অর্থ বলতে পারে না (ষষ্ঠ শ্রেণি) (%)

মহারাষ্ট্র ২২.৭ ১৯.৮ ৩১.৭ ১৯.৮ ৬.১ ৫৩.৯ ৬২.২
বিহার ২৬.৪ ১৫.৫ ২৮.৩ ১৫.৫ ১১.৪ ৫২.৬ ৫৯.৪
গুজরাট ৩০.৮ ৩০.৪ ২৮.২ ৮.৩ ২.৩ ৪৭.৭ ৫০.৪
পশ্চিমবঙ্গ ১০.৫ ১৩.৪ ৩৫.৩ ২৬.৩ ১৪.৫ ৬৩.৬ ৬৬.৬
কেরল ৩.৫ ৫.২ ২৪.২ ২২.৯ ৪৪.৪ ৮০.২ ৮৬.৯

 

গণিতের ক্ষেত্রে মানদণ্ড রাখা হয়েছিল এক ও দুই অঙ্কের সংখ্যা চেনা (২, ৭, ৫, ৩, ৭৬, ৫৮); বিয়োগ (৭৪- ৫৭, ৬৩-২৭); ভাগ (৯৯৩÷৮, ৭৫৮÷৬) ইত্যাদি। সেই সমীক্ষার ফল:

রাজ্য

সংখ্যা চিনতেই পারে না (%) সংখ্যা চিনতে পারে (%) বিয়োগ পারে (%) ভাগ পারে (%) ভাগ করতে পারে (পঞ্চম শ্রেণি) (২০১৮) (%)

ভাগ করতে পারে (পঞ্চম শ্রেণি) (%)

মহারাষ্ট্র ৮.৬ ৪৩.৬ ১৬.১ ২.০ ৩০.২ ১৯.৬
বিহার ১৪.২ ২৮.৭ ১৪.৩ ১৪.৪ ২৯.৯ ৩৫.৬
গুজরাট ৯.৮ ৩৭.৫ ১৮.৫ ৪.৬ ২০.২ ১৪.৭
পশ্চিমবঙ্গ ৫.৬ ৩৪.৫ ১৮.৮ ১৫.৫ ২৯.৭ ২৭.৭
কেরল ১.৪ ৫৩.৬ ৩৬.৬ ২.৩ ৪৩.০ ২৬.৬

 

পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে সারা দেশ জুড়ে শিক্ষার্থীদের এই হতমান অবস্থা দীর্ঘকালের। কিন্তু একই সঙ্গে একথাও বলা দরকার লকডাউনের কারণে স্কুল দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে। এই পরিস্থিতির অনিবার্য পরিণতি হিসাবে টিউশনির উপর নির্ভরতা আরও বেড়েছে। ২০১৮ সালে প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক স্তরে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী টিউশন নিত, ২০২১ সালে অতিমারিজনিত কারণে টিউশনির উপর নির্ভরতা বেড়ে হয় ৪০ শতাংশ। ২০২২ সালে স্কুল খুললেও টিউশনির উপর নির্ভর করছে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী। রাজ্যওয়াড়ি দেখলে সবচেয়ে বেশি টিউশনির প্রকোপ বিহার (৭০ শতাংশ) ও ঝাড়খণ্ড (৪৫ শতাংশ)। একই সঙ্গে আরেকটি সমস্যা হল একই শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন শ্রেণিকে বসিয়ে পড়ানো হচ্ছে (মাল্টিগ্রেড ক্লাসরুম)। এই ধরনের শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা ২০১৮ সালে ছিল ৬২.৪ শতাংশ যা ২০২২ সালে উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে হয়েছে ৬৫.৫ শতাংশ।

এই করোনা অতিমারির সময়ে একটু হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে পড়াশোনার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ। গ্রামভারতে ৬-১৪ বছর বয়সিদের ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে এনরোলমেন্টের পরিমাণ ছিল ৯৭.২ শতাংশ যা ২০২২ সালে বেড়ে হয়েছে ৯৮.৪ শতাংশ। মেয়েদের ক্ষেত্রে পরিমাণ ৯৮ শতাংশ যা আশাপ্রদ। এই নিবন্ধকারের মতে মিড ডে মিল এক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে। আর করোনা অতিমারি যেহেতু এক ব্যাপক সংখ্যক মানুষের জীবনে আর্থিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে তাই বেসরকারি বিদ্যালয় থেকে সরকারি স্কুলে ফেরত আসার ঘটনা বেড়েছে। এক্ষেত্রে অন্য কোনও কারণ খোঁজা সমীচীন নয়।

এবার সারা দেশে শিক্ষার আবশ্যিক পরিকাঠামো কেমন হয়েছে তা এই সমীক্ষার ফলাফলের আলোকে দেখে নেওয়া যেতে পারে। আর একটি সারণী দেওয়া হল।

 

২০১৮ (স্কুল শতাংশ)

২০২২ (স্কুল শতাংশ)

পানীয় জলের ব্যবস্থা ৭৪.৮ ৭৬.৪
শৌচালয় ৭৪.২ ৭৬.২
মেয়েদের জন্য পৃথক শৌচালয় ৬৬.৪ ৬৮.৪
লাইব্রেরি ৩৬.৯ ৪৪.০
বিদ্যুৎ সংযোগ ৭৫.০ ৯৩.০
কম্পিউটার ২১.৩ ২২.৩

 

অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অব এডুকেশনের রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তা নতুন কোনও কথা নয়। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত মানুষজন অতিমারির সময় থেকেই আশঙ্কা করছিলেন কোনও পঠন-পাঠন, মূল্যায়ণ ছাড়াই লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষাজগতে অপূরণীয় ক্ষতি করবে। ডেটা, মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারনির্ভর ‘জুম ক্লাস’ শুধুমাত্র আর্থিকভাবে সবল ও উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার অধিকারী পরিবারগুলোর জন্য শিক্ষার সুযোগ এনে দেবে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থী প্রায় কোনও কিছু না শিখেই শংসাপত্র পাবে। এই পরিস্থিতি ভারতের মতো অসম বিকাশের দেশে অতিমারিকালের ডিজিটাল শিক্ষা ধনী-দরিদ্রের ফারাককে আরও তীব্র করবে। অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট-২০২২ সেই আশঙ্কাকেই সত্যি প্রমাণ করল।