Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কেন্দ্রীয় বাজেট: কতটা জনকল্যাণ, কতটা রাজনীতি

কৌশিক ভট্টাচার্য

 



অর্থনীতির অধ্যাপক, আইআইএম, লখনৌ

 

 

 

প্রতি বছরের মতন এবছরেও ফেব্রুয়ারির শুরুতে কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভাতে দেশের বাজেট পেশ করবে। এই বাজেট জিনিসটি সাধারণ লোকের কাছে এক রহস্যের চাঁদোয়ায় মোড়া থাকলেও আসলে এটি সরকারি জমা-খরচের এক খতিয়ান মাত্র। সরকারি বাজেট আমাদের জানায় কোন খাতে কত টাকা সরকারের ঘরে ঢুকবে আর কোন খাতে কত টাকা সামনের বছরটিতে সরকার খরচ করবে। বলা বাহুল্য, এই পরিকল্পনা করতে গেলে শুধু ভবিষ্যতের ছক-ই নয়, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও হিসেবের মধ্যে আনতে হয়। ভারতবর্ষে এই অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করা হয় ইকনমিক সার্ভের মাধ্যমে। ইকনমিক সার্ভে আকারে একটি ছোটখাট বইয়ের মতন। প্রতি বছর নতুন নতুন করে প্রকাশিত এই বইটি সরকারের দিক থেকে দেশের লোককে শুধু বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধেই ওয়াকিবহাল করে না, এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন ভাবনাচিন্তারও আভাস পাওয়া যায়।

ভারতবর্ষে সাধারণভাবে সরকার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করে। আপনার-আমার ব্যয় আয়ের চেয়ে বেশি হলে, যেহেতু চট করে আয় বাড়ানোর উপায় নেই, তাই  লোকের থেকে ধার নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আমরা সকলেই জানি যে বেশি ধার যে কোনও ব্যক্তির জীবনে গভীর সমস্যা ডেকে আনতে পারে। একজন সাধারণ লোকের মতন সরকারও রাজস্বের ঘাটতি মেটাতে পারে দেশের বা বিদেশের লোকের থেকে ধার করে। সরকার বেশি ধার করলে প্রতি বছর এই টাকার উপর দেশের বা বিদেশের লোককে সুদ দিতে হয়, তাতে ঠিক আমার আপনার মতোই ভবিষ্যতে সরকারের খরচ আরও বেড়ে যায়। আর এছাড়াও সরকার নিজেই ধার চাইলে দেশে শিল্পস্থাপনের জন্য আরো পয়সা জোগাড় করা মুশকিল হতে পারে। সরকার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধার করলে তাই দেশের লোকের সমস্যা বাড়ে বই কমে না।

আপনার বা আমার থেকে সরকারের হাতে কিন্তু ক্ষমতা অনেক, অনেক বেশি। তাই তার সামনে আরও অনেক পথ খোলা। আপনি বা আমি টাকা ছাপাতে পারি না, কিন্তু সরকার তা পারে। বাজেটে ঘাটতি হলে সরকার তাই টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি মেটাতে পারে। কিন্তু এতেও আবার সমস্যা এই যে দেশে জিনিস না বেড়ে যদি শুধু টাকা বেড়ে চলে, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে জিনিসপত্তরের মূল্যবৃদ্ধি প্রায় অনিবার্য।

টাকা ছাপানো ছাড়াও সরকার রাজস্বের হার বাড়িয়ে দিয়ে মেটাতে পারে বাজেটের ঘাটতি। কিন্তু রাজস্বের হার বাড়লে কোনও দেশের লোকই  খুশি হয় না। শুধু গণতন্ত্র কেন, এমনকি স্বৈরতন্ত্রেও সরকারকে তাই এই সাধারণ লোকের অতিরিক্ত রাজস্ব সম্বন্ধে বীতরাগটিকে অবহেলা করলে চলে না। এই সব কারণেই অর্থনীতিবিদরা বারংবার বছরের পর বছর ক্রমাগত  বেশি বেশি করে ঘাটতি বাজেট করার থেকে সরকারকে বিরত থাকার উপদেশ দেন।

সরকারের বাজেট মানে যেহেতু আয়ব্যয়ের ছক, তাই সেটি কখনওই রাজনীতিবর্জিত ভাবে করা সম্ভব নয়। প্রথম কথা, কার থেকে কতটা সরকার রাজস্ব নেবে? গরিব আর ধনীর ঘাড়ে কি আলাদা আলাদা হারে রাজস্ব চাপানো হবে? হলে কতটা আলাদা? কোন খাতে সরকার কতটা খরচ করবে? মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অথবা দেশের শিল্পগুলিকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাবার জন্য কোন কোন খাতে দেশে ভর্তুকি দেওয়া হবে? যে কোনও দেশের বাজেট নিয়েই এরকম অসংখ্য প্রশ্ন করা যায়।

আসলে যে খাতেই সরকার আয় করুক বা যে খাতেই সরকার ব্যয় করুক, তাতে দেশের কারুর লাভ, কারুর ক্ষতি। সরকারি বাজেট তাই সর্বদেশে সর্বকালে এক আদ্যোপান্ত বিতর্কের বিষয়। বাজেট নিয়ে তাই একটা জরুরি কথা মনে রাখা দরকার: অনেক সময়েই আমরা সরকারের সমালোচনা করি যে যার নিজের নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে। আমরা যখন দেশের মঙ্গলের জন্য “অমুক করা উচিত” বা “তমুক করা উচিত নয়” বলে চিল্লোই, আমাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোই তখন আমাদের কাছে অতিরিক্ত গুরুত্ব পায়, অন্যদের সমস্যাগুলো নয়! আসলে আমরা অনেক সময় নিজেদের অজান্তেই মনে করি যে দেশের সকলের অবস্থা আমাদের মতন। গণতন্ত্রে তাই সরকার যে বাজেটই করুক, কেউ না কেউ তার সমালোচনা করবেই। কোনও বাজেটেরই সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা সম্ভব নয়। আলোচক কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এই আয়-ব্যয়ের দিকটি দেখছেন তার উপর তাই নির্ভর করে বাজেটটি নিন্দিত না প্রশংসিত হবে।

সরকারি বাজেটের এই রাজনৈতিক দিকটি নিয়ে অর্থনীতিতে অসংখ্য লেখা রয়েছে, আলোচনা হয়েছে। ফলে আমরা জানি যে যারা রাজনৈতিক দিক থেকে প্রভাবশালী অথবা অর্থনৈতিক দিক থেকে বলীয়ান, তারা সরকারকে কাজে লাগিয়ে বাজেট থেকে নিজেদের সুযোগসুবিধা বেশি বেশি করে আদায় করে নেবেন। যেমন, আমাদের দেশে স্বাধীনতার সময় রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল জোতদার ও জমিদার শ্রেণি। সেই সময়ের সরকারকে কাজে লাগিয়ে তারা চাষিদের থেকে আয়কর আদায় বন্ধ করে। ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সারে সরকারকে বছরের পর বছর প্রচুর ভর্তুকি দিয়ে যেতে হয় কারণ সরকারি মন্ত্রী এবং পার্লামেন্টের সদস্যদের অনেকেই ছিলেন জমিদার বা বড় চাষিদের মুখপাত্র। দেশের শিল্পপতিরাও নিজেদের ব্যাপারটি দিব্যি গুছিয়ে নিয়েছিলেন বড় শিল্পে লাইসেন্স-পারমিট রাজ এনে। দেশে বড় শিল্প আনতে গেলে যদি সরকারের অনুমতি পেতে হয়  আর সেই সরকারকেই যদি নিয়ন্ত্রণ করেন বড় শিল্পপতিরা, তাহলে বলা বাহুল্য নতুন যাঁরা এই শিল্পপতিদের প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলতে চাইবেন, লাইসেন্স-পারমিট রাজ কাজে লাগিয়ে তাদের বাজারে প্রবেশের ব্যাপারটাই বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে অনায়াসে!

একটি গণতন্ত্রে সরকার অবশ্য সব সময়ে শুধু দেশের ধনীদের সুযোগসুবিধা দিয়ে ক্ষমতায় টিঁকে থাকতে পারে না। গণতন্ত্রে যেহেতু নিয়মিত নির্বাচন হয়, দেশের সাধারণ লোকের জন্য কিছুই না করলে ক্ষমতায় থাকা সরকারকে দেশের মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে হঠিয়ে দিতে পারে। তাই সাধারণত দেখা যায় নির্বাচনের সময় এগিয়ে এলে সরকারের বেশি বেশি করে খরচ করবার প্রবণতা। এই খরচ অনেক সময় করা হয় সম্পূর্ণ আইনসঙ্গত উপায়ে লোকের ভোটকে প্রভাবিত করতে। ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতারা এই সময় বিভিন্ন প্রজেক্টের শিলান্যাস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই প্রজেক্টগুলি ফলদায়ী না হলে অতিরিক্ত খরচের জন্য ভবিষ্যতের সরকারের নানানরকমের সমস্যা হতে পারে, কিন্তু ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক নেতার তো দরকার আগে নির্বাচনটাতে উতরে যাওয়া!

পৃথিবীর যে কোনও গণতন্ত্রেই বাজেট ব্যাপারটি এই ধরনের নানান রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে চলে। আমাদের দেশেও তাই। আমাদের দেশে, কোনও সন্দেহ নেই যে বিগত তিরিশ বছর ধরে অনেক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এই উন্নয়নের সুফল কতখানি গরিবদের কাছে পৌঁছেছে, সে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। ধনীদের আয়বৃদ্ধির হার অনেক সময়েই আকাশছোঁয়া হলেও, দেশে গরিবের সংখ্যা কমেনি আশানুরূপ। দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে সামান্যই। স্বাস্থ্যব্যবস্থাতে ভারত এখনও পৃথিবীর ধনী কেন, বহু গরিব দেশের থেকেও পিছিয়ে। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ও জলের পরিষেবা ও যাতায়ত ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে প্রয়োজনের চেয়ে কম।

গত দু বছরে কোভিড এসে এই বিপর্যয়কে ভয়ঙ্করভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। কোভিড রুখতে গিয়ে সরকারকে যে অতিরিক্ত খরচ করতে হয়েছে তাতে দেশের ধার দেশের জিডিপির সঙ্গে তুলনা করলে এখন— বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেবমতন— বিপদসীমার উপরে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে তাই অবিলম্বে দেশের রাজস্ব বাড়ানো দরকার। ভারতে রাজস্বের হার এই মুহূর্তে দেশের জিডিপির বারো শতাংশের মতন। পৃথিবীর বহু দেশে এই হার পনেরো শতাংশের উপরে। এই হারকে অন্তত পনেরো শতাংশে নিয়ে যেতে গেলে দরকার আয়কর (বিশেষ করে ধনীদের উপর আয়কর), অথবা  দেশের কোম্পানিগুলির রাজস্ব দেওয়ার হার বাড়ানো। তৃতীয় আর একটি উপায় দেশের করদাতার সংখ্যা বাড়ানো। এই কাজগুলি, বিশেষ করে প্রথম দুটি, যেহেতু দেশের অর্থবান গোষ্ঠীদের পছন্দ নয়, তাই অনেক সময়ই দেখা যায় সরকারের ঝোঁকটি পরে ব্যয়সঙ্কোচের দিকে। গরিবদের জন্য নানান সুযোগসুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয় ব্যয়সঙ্কোচের নাম করে। এগুলিকে তাই নাম দেওয়া হয় বাজে খরচ বলে!

গণতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রভাব অনেক তফাত করে দিতে পারে রাষ্ট্রের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা আদায়ের। দেশের গরিব রাজনীতিবর্জিত জীবনযাপন করলে সবচেয়ে বেশি সুবিধে দেশের ধনীদের। দেশের ধনীদের কাছে যেহেতু অনেক টাকা রয়েছে, সেই টাকা দিয়ে তারা সহজেই কোনও না কোনও রাজনৈতিক নেতাকে বা সেরকম দরকার হলে কখনও পুরো একটি রাজনৈতিক দলকেই কিনে নিতে পারে। গরিবের সেই সুবিধে নেই। সরকারের থেকে সুযোগসুবিধে পেতে গেলে গরিবের তাই একমাত্র উপায়, সেটি হল দল বাঁধা। বাজার অর্থনীতির আত্মার মধ্যেই আসলে এই প্রভাব বা জোর ফলানোর দিকটি রয়ে গেছে। চাহিদা এবং জোগানের লড়াইয়ে দরকষাকষির এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই দরকষাকষিতে অর্থবল বা লোকবল অনায়াসে একদিকের পাল্লা ভারী করে দিতে পারে। দেশের সরকার যেহেতু মানুষেরই তৈরি একটি প্রতিষ্ঠান, এরও যে কোনও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের পিছনে তাই সেই দরকষাকষি আর জোর ফলানোর খেলা। উন্নত দেশগুলিতে এই জোর ফলানোর খেলাটিও তাই একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। সেখানে সরকারের থেকে অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা আদায় করতে অনেক সময় কিছু বিশেষ লোক বা কোম্পানির সুযোগ নিতে হয়। এই লোকেরা বা কোম্পানিরা তাদের নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে মন্ত্রী বা অন্যান্য নেতাদের কাছে দরবার করে সেইসব সুযোগসুবিধার জন্য। বলা বাহুল্য, পেশাগতভাবে দরবারকারীদের এই “সেবা” বিনামূল্যে পাওয়া যায় না।

গরিবের অর্থবল নেই, নেই পেশাগত দরবারকারীদের নিজেদের হয়ে নিযুক্ত করবার ক্ষমতা। তার একমাত্র ভরসা লোকবল। পৃথিবীর যে সমস্ত দেশে গরিবেরা নিজেরা একজোট হতে পেরেছে, সেই সব দেশের সরকারি বাজেটও তাই রাজনৈতিক প্রয়োজনেই জনমুখী হয়ে উঠেছে, শিল্পপতিমুখী নয়।

নিজেদের ভাল চাইলে যে কোনও বাজেটের আগে তাই দেশের গরিবদের একসঙ্গে বলা দরকার, “জোট বাঁধো, তৈরি হও, সামনে ফের বড় লড়াই!”