Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আদানি গেলেই বা কী

অয়নেশ দাস

 



গদ্যকার, প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

বাজারে এখন সবচেয়ে হাতেগরম চর্চার বিষয়বস্তুটি হল হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের আদানি রিপোর্ট। আমরাও বা তাতে বাদ যাই কেন! কী বলছে হিন্ডেনবার্গ? ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টটির হেডলাইন— Adani Group: How The World’s 3rd Richest Man Is Pulling The Largest Con In Corporate History। দীর্ঘ ২ বছর ধরে তদন্তের পর হিন্ডেনবার্গের তদন্তমূলক সিদ্ধান্ত হল— ২১৮ বিলিয়ন ডলারের ভারতীয় কনগ্লোমারেটের যে আশ্চর্য দানবীয় উত্থান, তার পেছনে যা আছে তা হল সুদীর্ঘ কয়েক দশকের brazen stock manipulation এবং accounting fraud scheme।

অনেকেই নানারকম মত প্রকাশ করছেন। নানারকম চর্চাও চলছে। বেশিরভাগ চর্চাতেই উঠে আসছে ব্যক্তি আদানির অবিশ্বাস্য রকমের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি এবং কী কী অর্থনৈতিক উপায়ে এই দুর্নীতি সম্ভবপর হল তার খুঁটিনাটি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। স্পেকুলেটিভ ফিন্যান্স বা তার ইনস্ট্রুমেন্টগুলি নিয়ে বলার মতো বিষয়ীগত পড়াশোনা আমার নেই। আমি বরং এক অতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে নৈতিকতার নিরিখে বিষয়টিকে দেখার চেষ্টা করব। একজন ব্যক্তিপুঁজিপতির এই (একক?) দুর্নীতির পরিমাণে যখন সবাই হতবাক, তখন আমি এটাই বলার চেষ্টা করব যে আমরা যে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাস নিই, তাতে দুর্নীতির এই অবিশ্বাস্য মাত্রা অবিশ্বাস্য বা অসম্ভব কিছু তো নয়-ই, বরং এটাই দস্তুর।

আদানি গ্রূপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান গৌতম আদানির সম্পদের নেট ওয়র্থ প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার যোগ হয়েছে শেষ তিন বছরে! এবং দেশবাসীর চোখের সামনে এখনও অশ্লীলভাবে ঘটে চলেছে এই উত্থান। কিন্তু আমরা, মানে আমরা যারা সাধারণ হাঘরে মানুষ, যাদের কাছে এই মিলিয়ন-বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন শব্দগুলোর নাগাল বড়জোর খবরের কাগজের পাতা অবধি, তারা কি কোনওভাবেই নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনে এই প্রবল উত্থানের যাবতীয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি টের পাইনি? পেয়েছি বৈকি! কিন্তু সয়ে নিয়েছি। আর লক্ষ করার বিষয়, আমাদের এই সয়ে নেওয়ার পেছনে আমাদের যেন একরকমের সমর্থন-ও ক্রিয়াশীল। সমর্থন হয়তো কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির প্রতি নয়, সমর্থন এক ধরনের চিন্তার হেজেমনির প্রতি, যা অবশ্যই নয়া-উদারবাদী ব্যবস্থার ওপর আধারিত এবং যা নিরন্তর জনমানসে পাকাপোক্ত করে চলে পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারণাটিকে। সবসময়-ই যেমন নানারকম অর্থনৈতিক কুযুক্তি দিয়ে এই হেজেমনিকে টিঁকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়, তেমনই সময়বিশেষে এতে আরও নানান নির্মিত ন্যারেটিভের পরত পড়ে। এরকম একটি অতি শক্তিশালী ন্যারেটিভ হল পুঁজির জাতীয়তাবাদী ন্যারেটিভ। যেমন নেশন বিল্ডিং ইত্যাদি। এ বিষয়ে আদানি সংক্রান্ত ঘটনাটিতেই আমরা চোখ রাখতে পারি।

গতকালই আদানি গ্রুপ হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ টিমকে ৪১৩ পাতার উত্তর দিয়েছে। সেখানে তারা হিন্ডেনবার্গের তোলা ৮৮টি নিদিষ্ট অভিযোগের ৬২টিরই কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। বরং নিজেদের কুকর্ম ঢাকার জন্য তারা যে ন্যারেটিভটির আমদানি করেছে তা খুবই প্রেডিক্টেবল— হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টটি আসলে ভারতীয় জাতীয়তার ওপর আক্রমণ। যে ন্যারেটিভের মায়ায় আজ আদানি(রা) মানেই ভারতবর্ষ; ভারতবর্ষ মানেই আদানি(রা)। স্বাভাবিক। স্যামুয়েল জনসন সেই কবেই বলে গিয়েছেন— “Patriotism is the last refuge of the scoundrel.”  কিন্তু কেবলমাত্র গৌতম আদানি নামক ব্যক্তিটি অথবা তাঁর ব্যবসায়িক গ্রুপটিকেই স্যামুয়েল জনসন বর্ণিত ওই স্কাউণ্ড্রেল বলে ভিলেনায়িত করলেই কি এই পাহাড়প্রমাণ কর্পোরেট কোরাপশনের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে? একদমই তা নয়।

প্রথমেই আমাদের, মানে আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তাদের স্বীকার করতে হবে যে আমরা আসলে বুঝতেই পারিনি আমাদেরই সমাজচিন্তায় কখন আদানি-রাষ্ট্র-জাতীয়তাবাদ-উন্নয়ন একাকার হয়ে গিয়েছে। কেননা আমরা তো বুঝেছি এ হল ভারতীয় পুঁজির উত্থান। উন্নত দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারত নামক রাষ্ট্রটির উত্থান। হৈ হৈ করে আমরা আকণ্ঠ গিলেছি এক প্রচণ্ড আকর্ষণীয় রূপকথা। পৃথিবীর উন্নত শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির ‘বিগ লিগ’-এ ভারত নামক দরিদ্র, উন্নয়নশীল দেশটির হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ার রূপকথা। ‘ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’— এই দুরাশার বাস্তবায়নের রূপকথা। আর এই প্রচণ্ড হেজেমনির অন্তরালে আমরা ক্রমশ আসল বোঝাটি থেকে আরও কয়েক আলোকবর্ষ দূরে সরে গিয়েছি। আমরা ব্যক্তি আদানির মুণ্ডপাতে ব্যস্ত কিন্তু আমরা ভুলে গিয়েছি এই সর্বৈব অনৈতিক দুর্নীতির শিকড় লুকিয়ে আছে পুঁজিবাদ নামক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটির মধ্যেই। কলোনিয়াল লুন্ঠনের মাধ্যমে আদিম পুঁজি আহরণের চরম অনৈতিকতায় ভর করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্ম। উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে তার পুষ্টি। লুন্ঠনেই পুঁজিবাদের জন্ম এবং লুণ্ঠনই তার প্রধান চালিকাশক্তি। তাই ভয় হয়, ব্যক্তি-লুঠেরার লুন্ঠনের প্রবৃত্তি, প্রকৃতি ও পরিমাণের চাঞ্চল্যকর তথ্যের চর্চায়, ব্যক্তিগত দুর্নীতির সেনসেশনাল চর্চায় আসল বিষয়টাই না পিছনের সারিতে চলে যায়। এ ব্যবস্থা যতদিন থাকবে আদানিরা থেকে যাবে। এবং শুধু থেকে যাবেই না, তারা তাদের এই লুন্ঠনের ব্যবস্থাটির প্রতি আমাদের কনসেন্টও আদায় করে নিতে থাকবে। কেননা অনৈতিক শর্ট সেলিং-ই হোক বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার থেকে অন্যায়ভাবে আহৃত যাবতীয় পুঁজি-ই হোক, তার বেশিরভাগের বিকাশস্থলটি-ই কেন্দ্রীভূত কিন্তু এই আধুনিক উন্নয়নের ধারণাটিকে ঘিরেই। এবং সেটি-ই অধিকাংশ সাধারণ মানুষের একমাত্র দৃশ্যগ্রাহ্য বিষয় হিসেবে সামনে আত্মপ্রকাশ করে।

আগেই বলার চেষ্টা করেছি কী সেই হেজেমনির ভিত্তিভূমি যা একদিকে লুন্ঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে আবার অন্যদিকে আমাদের সমর্থনও আদায় করে নিচ্ছে! পোস্ট কলোনিয়াল তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে এই ভিত্তিভূমিটি হল ‘ডেভেলপমেন্ট’ বা উন্নয়নের পশ্চিমি ধারণাটি। এর মূল কম্পোনেন্টটি হল ব্যাপক পুঁজিবাদী ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন। পুরনো পরম্পরাগত, গ্রামীণ ও এগ্রেরিয়ান সমাজগুলিকে দ্রুত ইন্ডাস্ট্রিয়াল সমাজে পরিবর্তন। নয়া উদারবাদী জমানায় যা আরও মারাত্মক দ্রুততা এবং ধ্বংসাত্মক প্রতীতি নিয়ে ঘটমান। আমরা তাকেই উন্নয়ন বলে মেনে নিয়েছি। হাল আমলে হিন্দি বলয়ে এর আরেকটি গালভরা নাম হয়েছে – ‘বিকাশ’। এবং আমাদের একজন ‘বিকাশ পুরুষ’ও বর্তমান। তাঁর নেতৃত্বে থালা বাজিয়ে, বগল বাজিয়ে আমরা উদ্বাহু হয়ে ছুটে চলেছি দেশের বিকাশের পথে। আমাদের হাতছানি দিচ্ছে এক গালভরা ‘আত্মনির্ভর ভারত’। পৃথিবী শাসন করা বিগ লিগের একজন তো আমাদের হয়ে উঠতেই হবে। কেননা ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। মানে লইতেই হইবে। এবং ভারতের বিকাশ যেখানে জনমানসের সামগ্রিক চাহিদার কেন্দ্রবিন্দু সেখানে এই বিকাশের এক মহাকারিগর তাঁর অবিশ্বাস্য কুকর্ম ধরা পরে যেতেই অনায়াসে তাই আশ্রয় নিতে পারেন জাতীয়তাবাদের নিশ্ছিদ্র পতাকার তলায়।

এই প্রসঙ্গেই আমি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই একটি প্রিন্ট অ্যাডভার্টাইসের দিকে। হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের অব্যবহিত পরেই সারা দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় আদানির পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। দ্য হিন্দু-ও তার ব্যতিক্রম নয়। এতক্ষন যে হেজেমনির নির্মাণ সম্পর্কে বলছিলাম তার একটি বিশেষ নমুনা এই বিজ্ঞাপনটি। আধুনিক উন্নয়নকে যেখানে ধরেই নেওয়া হয়েছে সামাজিক উন্নতির একমাত্র অবলম্বন হিসেবে। তার সঙ্গে অনিবার্য জুড়ে গিয়েছে নেশন বিল্ডিং, আত্মনির্ভর ভারতের জাতীয়তাবাদী সুড়সুড়িটি। ঢাক পিটিয়ে আরেকটি অর্থাৎ ‘সাস্টেনেবল ভ্যালু’-র ন্যারেটিভটিও এর সঙ্গে যোগ করা হয়েছে। আমি বলতে চাই, এর প্রত্যেকটি শুধু ভ্রান্ত-ই নয়, আসলে চরম অনৈতিক। সেটা তলিয়ে দেখতে গেলে আমাদের একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। ‘বিকাশ’-এর রাস্তা ধরে অনুন্নত যে দেশটা থেকে আদানিরা এক উন্নত আধুনিক দেশে আমাদের পৌঁছে দিতে উদ্যত, আমাদের একটু পেছিয়ে সেই অনুন্নত, অনাধুনিক দেশটার দিকে একবার ফিরে তাকাতে হবে। আসুন এই উপমহাদেশের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিম উপান্তের একটি কোণায় আমরা একটু চোখ রাখি।

পৃথিবীতে সর্বমোট মাত্র কুড়িটি ওয়েজ ব্যাঙ্ক (wedge bank) (এর বাংলা তর্জমা আমার পক্ষে সম্ভব হল না) রয়েছে। ওয়েজ ব্যাঙ্ক কী? এ হল মহাসমুদ্রের সেই অঞ্চলগুলি যেখানে এক অতিসমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য এবং একই সঙ্গে পৃথিবীর উর্বরতম মৎস্যক্ষেত্রগুলি বিদ্যমান। এইরকমই  ১২০০০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত একটি ওয়েজ ব্যাঙ্ক রয়েছে কেরলের ওই দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে কন্যাকুমারী জেলার উপকূলভাগ ধরে। শুধু মৎস্যক্ষেত্র হিসেবে নয়, পৃথিবীর উষ্ণায়ন রোধ করার ক্ষেত্রেও এই ওয়েজ ব্যাঙ্কগুলি ভীষণ কার্যকরী। শয়ে শয়ে বছর ধরে এই ওয়েজ ব্যাঙ্কের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থেকেছে উপকূলবর্তী হাজার হাজার পারম্পরিক মৎস্যজীবী পরিবার। ১৯৫৩ সালে এর ওপর প্রথম আঘাতটি নেমে আসে, যখন স্বাধীন ভারত সরকার তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন দেশগুলির রাজনীতি-অর্থনীতিতে জাঁকিয়ে বসা পশ্চিমি উন্নয়নের তত্ত্বটিকে কেরলের পারম্পরিক মৎস্যজীবিকার ওপর কার্যকর করতে চান। উৎপাদনশীলতা ব্যাপকহারে বাড়িয়ে তুলতে নরওয়ে-র প্রযুক্তিগত সাহায্যে সেখানে মেকানাইজড ফিশিং চালু করা হয়। রপ্তানিবাণিজ্যের খিদে মেটাতে মেকানাইজড বোট ও ‘ট্রল নেট’-এর যথেচ্ছ ব্যবহারে বিপন্ন হয়ে ওঠে কেরলের অসামান্য সম্পদশালী ওয়েজ ব্যাঙ্কটি ও তার ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার সামুদ্রিক প্রজাতি এবং হাজার হাজার পারম্পরিক মৎস্যজীবী পরিবার।

এরপর শুরু হয় এক অসম লড়াই। একদিকে পুঁজির শক্তিতে বলীয়ান আধুনিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিশারি, অন্যদিকে একদল তথাকথিত অনুন্নত পারম্পরিক মৎস্যজীবী। কিন্তু কখনও কখনও রূপকথা আমাদের অজান্তেই লেখা হয়ে যায়। পারম্পরিক মৎস্যজীবীদের লড়াইয়ের হাত ধরে টিঁকে যায় কন্যাকুমারী উপকূলের সেই অনুপম জীববৈচিত্র্য। কয়েক দশকের তীব্র লড়াই ও শতাধিক প্রাণের বিনিময়ে জয় আসে যখন ১৯৮১ সালে কেরল সরকার মনসুনের পুরো সময়ে ট্রলিং নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তারপর অনেক বাধাবিপত্তির পরে এই ঘোষণাই সুপ্রিম কোর্টের সিলমোহর পায় ১৯৯৩ সালে।

কিন্তু রূপকথারও অপমৃত্যু ঘটে। ধ্বংসের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। ২০১৫ সালের ১৭ আগস্ট, কেরল সরকার ওই ওয়েজ ব্যাঙ্ক অঞ্চলের গায়ে লাগানো ভিজিঞ্জামে প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ে তুলবার জন্য আদানি ভিজিঞ্জাম পোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে ৭৫২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হয়। ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয় ড্রেজিং। ফলাফল যা হয় তা খুঁটিয়ে লিখতে গেলে আরও একটি লেখা নামাতে হবে। সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে বলতে গেলে সেখানে হাজার হাজার পারম্পরিক মৎস্যজীবী পরিবার আজ একইসঙ্গে জীবিকাচ্যুত ও বাস্তুচ্যুত। পারম্পরিক জ্ঞান থেকে বলপূর্বক বিচ্যুত এই মানুষগুলির ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অন্ধকার। আর ওয়েজ ব্যাঙ্কের এই অংশটিতে, যেখানে বারোটি কোরাল রিফের আশ্রয়ে গুঞ্জরিত হত কোটি কোটি প্রাণের অনাবিল জীবনচক্র, সেখানে এখন শ্মশানের নীরবতা। মেরিন বায়ো-টেকনোলজিস্ট কুমার সহায়রাজুর ভাষায়— এখন ভিজিঞ্জামের সংশ্লিষ্ট সমুদ্রতল যেন ‘আ সেমেটারি অফ ওয়াটার উইথ নো লাইফ’। সন্দেহ নেই ডেভেলপমেন্টের আকাশ ছুঁয়েছে কেরল সরকারের স্বপ্নপ্রকল্প। সঙ্গী সেই গৌতম আদানি। উন্নয়নের মহাকারিগর। প্রথম সারির সংবাদপত্রে পাতাজোড়া দামি বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ রঙিন বিজ্ঞাপন। সকালবেলার অলস চায়ের সঙ্গে পাতাজোড়া আত্মনির্ভর ভারত। কিন্তু আদানির ওই পাতাজোড়া ঝকঝকে বিজ্ঞাপনটির দিকে চোখ রেখে, মস্তিষ্কের দিনগত আলস্য ঝেড়ে ফেলে কেউ কি গলা চড়িয়ে প্রশ্ন করবে— দেশের এ কেমন উন্নয়ন যাতে দেশের মানুষকেই বাস্তুচ্যুত ও জীবিকাচ্যুত হতে হয়? এ কেমন নেশন বিল্ডিং যেখানে প্রান্তিক মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে যায়? এ কেমন আত্মনির্ভর ভারতের স্বপ্ন তুমি বিলি করছ, যেখানে মানুষের হাজার বছরের পারম্পরিক জ্ঞান মুহূর্তে অর্থহীন হয়ে যায়? এ কেমন সাস্টেনেবল ভ্যালুর ন্যারেটিভ তুমি নির্মাণ করছ, যেখানে লক্ষ বছরের বাস্তুতন্ত্র প্রাণহীন শ্মশানে পরিণত হয়? এ শুধু ভ্রান্তই নয়, এ চরম অনৈতিক।

না, কোনও বিশেষ প্রত্যাশা এই মুহূর্তে নেই। ভারতবর্ষের মেনস্ট্রিম রাজনীতির সমস্ত রাজনৈতিক বীক্ষা-ই উন্নয়ন বলতে মোটের ওপর এই-ই বোঝে। তবে আমি বেছে বেছে কেরলের প্রসঙ্গই বা টানলাম কেন? হাতের সামনে তো দেউচা পাঁচামির উদাহরণ ছিলই। তবে কি কেরলের বর্তমান বাম সরকারের থেকে কিছু ব্যতিক্রমী প্রত্যাশায়? একদম-ই নয়। ডেভেলপমেন্টের অনুষঙ্গে মূলধারার বামপন্থী দলগুলির বর্তমান হ্যাঁ-বাচক অবস্থান যে কোনও ডানপন্থী দলকেও অনায়াসে ছাপিয়ে যেতে পারে। তবুও বুকের মধ্যে কিছু একটা খচখচ করে যখন দেখি ১৯৮১ সালে বাণিজ্যিক ট্রলিংকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল ই কে নায়ানারের তদানীন্তন বাম মন্ত্রিসভা। যাক সে কথা!

নৈতিকতা এমন কোনও বস্তু নয় যা আকাশ থেকে টুপ্ করে এসে পড়বে আমাদের রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতির আঙিনায়। তাই কোনও প্রত্যাশার জায়গা থেকে লিখতে বসিনি। শুধুমাত্র এটুকু আলোচনায় আনতে চেয়েছি যে আমাদের পুঁজিবাদী ধ্বংসের সামাজিক-রাজনৈতিক ভ্যালিডেশনটি কীভাবে নির্মিত হয়ে চলেছে। এমনকি জাতীয়তার ন্যারেটিভটিও সেই অনৈতিক ডেভেলপমেন্টের সহায়ক অন্তর্বস্তু হিসেবে নির্মিত হয়ে চলেছে। আর সেইভাবেই রাষ্ট্র ও পুঁজির চরম অনৈতিক যোগসাজশ দেশের তথা পৃথিবীর যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানবসম্পদের অবাধ লুণ্ঠনকে রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতির ক্ষেত্রগুলিতে ভ্যালিডেট করিয়ে নিতে থাকবে। জলবায়ু-বাস্তুতন্ত্র-সংস্কৃতি মুহূর্তে চড়িয়ে দেওয়া যাবে এই বিকাশের হাঁড়িকাঠে। দেশ-মাটি-আকাশ-মানুষ গলিয়ে মুনাফার অশ্লীল পাহাড় জমা হতে থাকবে উন্নয়নের কাণ্ডারীদের পকেটে আর সেই স্ফীত পকেট থেকে ভিক্ষের মতো চুঁইয়ে পড়া সিকি-আধুলি হস্তগত করার প্রাণান্ত লড়াইতে নিজেকে সঁপে দিয়ে আমরা কৃতার্থ হয়ে উঠব। সর্বৈব অনৈতিকতার এই ভ্যালিডেশন প্রতি মুহূর্তে ঘটে যেতে থাকবে আমাদের মননে, প্রাত্যহিক যাপনে। বিনিময়ে আমরা কী হারাচ্ছি, আমাদের সামগ্রিক মায়োপিয়ায় সেটা ধরা পড়ারও কোনও উপায় আর থাকবে না। সেই আত্মঘাতী মায়োপিয়ায় আক্রান্ত একরকম আমরা সবাই— হ্যাঁ, ডান-বাম নির্বিশেষে। হিন্ডেনবার্গ সততার সঙ্গে দুর্নীতিকে আক্রমণ করেছে। হ্যাঁ, সে আক্রমণ অবশ্যই জরুরি। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু এক ব্যক্তিক-দুর্নীতিকে ঘিরেই সীমাবদ্ধ। যাবতীয় প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পদকে ধ্বংস করে মুনাফার পাহাড় বানানোর এই যে অসুস্থ এবং অনৈতিক প্রতিযোগিতা; তাতে একজন আদানি গেলে আরেকজনের সে জায়গা নেওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। করাপশন এখানে একটি অতি স্বাভাবিক বাই-প্রোডাক্ট মাত্র। আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি, কুইন্সল্যান্ডে আদানি অধিকৃত পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ কয়লা খনিটির কাজ, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় যখন আটকে দেওয়া হয়েছিল, তখন আদালতে কাজ আবার চালু করতে চেয়ে আদানি নামক ঘটমান পুঁজিবাদের পক্ষ থেকে যে অকাট্য যুক্তিটি রাখা হয়েছিল, তা হল— If We Don’t Dig It Up, Someone Else Will.