Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সকার ইন দ্য সান অফ মে

সকার ইন দ্য সান অফ মে | অনির্বাণ ভট্টাচার্য

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 



কবি, গদ্যকার

 

 

 

ম্যাচের বয়স ৩৯ মিনিট। জুলিয়ান আলভারেজ তখন দৌড়চ্ছিলেন। লিও মেসির অসম্পূর্ণ, হতে হতেও না হওয়া একটা সোলো রানের ব্যাটন তখন জুলিওর পায়ে। পিটার ড্রুরির ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েসের ব্যারিটোন জুলিওর দ্রুতিতে কাঁপছে। ড্রুরি দেখছেন লিভাকোভিচের বাঁ দিক দিয়ে বলটা জালে। ড্রুরির কণ্ঠ, ‘জুলিয়ান আলভারেজ’ বলে একটু থমকাল, তারপর তুমুল ড্রুরিয়ানা— ‘সেনসেশনাল… সোলো…’। যাই হোক, বিষয়টা ঠিক ড্রুরিকে নিয়ে নয়, বিষয়টা জুলিওকে নিয়েও নয়, বিষয়টা, ওই যে বললাম, সকার ইন দ্য সান অফ মে। লা মেসিয়ার গ্ল্যামার আর লেগ্যাসির বাইরে ইতালীয় এবং স্পানিশ ইমিগ্র্যান্টে ছেয়ে যাওয়া একটা মিশ্রিত জাতির সামগ্রিক ফুটবল প্রতিষ্ঠান নিয়ে।

জুলিও নিয়েই শুরু করেছিলাম। জুলিওর ডাকনাম ‘স্পাইডার’ বা ‘লা অ্যারেনা’। ওর মাকড়সার মতো নিষ্ঠুর জাপটে ধরার আগের গল্পটা কেমন? উঠে আসাটা কেমন? আর্জেন্টিনার উত্তর-পূর্বে কর্ডোবা প্রভিন্সের মাত্র ৩০০০ জনের ছোট্ট গ্রাম ‘ক্যালচিন’, স্প্যানিশ থেকে বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘লবণাক্ত জায়গা’। এই নুন সেখানকার মানুষগুলোর ঘামে, রক্তে। ক্যালচিনের রিভেরা ইনডেন্টে প্রাইমারি স্কুলের জুলিও আলভারেজ অ্যাথলেটিকো ক্যালচিন থেকে রিভারপ্লেটের ইয়ুথ টিম হয়ে ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে আসেন। অ্যাথলেটিকো ক্যালচিনের নিজস্ব ক্লাবের গ্যালারিতে দর্শক আসন সংখ্যা কত? ১৫০। আই রিপিট। দেড়শো। সেখান থেকে ১৮ ডিসেম্বর কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামের ৮৯,০০০ আর্জেন্টাইন ফ্যানবেসের সামনে খেলা। মাঝের সময়টা? অদ্ভুত নির্লিপ্ত, স্মিত হাসির জুলিওকে মনে রেখে গ্রামের ভেতর গ্রিডের চেহারার একতলা ছোট ছোট বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে স্প্যানিশে যা লেখা আছে তার ইংরেজি করলে দাঁড়ায়— ‘জুলিয়ান, দ্য প্রাইড অফ ক্যালচিন’। মেয়র নিজেই বলছেন, জুলিয়ান তাঁর গ্রামের ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডর। রিভেরা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক প্যাট্রিসিও ম্যাগনিনো, গ্যাব্রিয়েল ডি বারবারির কথায়, স্মৃতিতে জুলিওর মতো আরও অনেক তরুণ প্রতিভা। ব্রিটিশ ক্লাবের জৌলুসে ভাসার পরেও প্রথম কোচ রাফায়েল ভারাসকে ভোলেননি জুলিয়ান। বর্তমানে পেশায় ডেলিভারিম্যান ভারাসের আর্থিক অনটন জেনে তাঁর কাজের সুবিধের জন্য গ্রামে একদিন একটি বিশাল ট্রাক নিয়ে ঢুকলেন জুলিও। রেখে দিলেন স্যারের কাছে। স্যারের চোখে জল…

ক্যালচিনে জুলিও অ্যালভারেজের নামে হোর্ডিং

বাকি গল্পে আসার আগে, জুলিওর বন্ধুদের কথায় ঢোকার আগে একটু আর্জেন্টাইন ফুটবল নিয়ে র‍্যাপিড ফায়ার হয়ে যাক। কবে তৈরি হয় এএফএ বা আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন? উত্তর— ১৮৯৩। এএফএ-র নিজেদের ঘোষণা অনুযায়ী লাতিন আমেরিকায় সবচেয়ে পুরনো ফুটবল সংস্থা এবং গোটা পৃথিবীর নিরিখে তা অষ্টম। দেশে ফুটবল শুরু হয় কীভাবে? নেপথ্যে কারা? উত্তর— ব্রিটিশ ইমিগ্র্যান্টরা। মূলত এঁরা ছিলেন রেইলরোড ওয়ার্কার। কাজের ব্রেকে রবারের বলে পা চালাতেন। এঁরাই পরবর্তীকালে ক্লাবগুলির গোড়াপত্তন করেন। ওই সময়ের বেশ কিছু ক্লাব এখনও আর্জেন্টাইন লিগ খেলছে, যেমন লিও মেসির উত্থানখ্যাত এবং নাপোলি পরবর্তী সময়ের (১৯৯৩-১৯৯৪) দিয়েগোর রোজারিওর সেই বিখ্যাত নিউয়েলস ওল্ড বয়েজ অথবা বুয়েন্স আয়ারসের ক্লাব ব্যানফিল্ড। এবং এই প্রসঙ্গেই এসে যায় ব্রিটিশ ঘরানার ফুটবল এবং স্থানীয় Creole বা Criollo স্টাইলের মধ্যে চিরকালীন বিরোধ। মূলত ইতালীয় ও স্পেনীয় ইমিগ্র্যান্টদের আধিপত্যে বুয়েন্স আয়ারস সংলগ্ন পটরেরো অঞ্চলে এই ক্রেওল স্টাইলের জন্ম, যা পরবর্তীকালের দৃষ্টিনন্দন প্যাটার্ন উইভিং আর্জেন্টাইন ফুটবলের জন্ম দেয়। মূলত পটরেরো-র বিক্ষিপ্ত রাস্তায় বা এবড়োখেবড়ো মাঠে এই ধরনের স্টাইল অফ প্লে শুরু হয়। কারা জন্ম দিয়েছিল? ব্রিটিশ ঝকঝকে ডিসেন্ট ওয়ার্কাররা না, হেরে যাওয়া অপ্রেসড গরিব লোকালের একটা অংশের একদল লোক। এরাই ট্যাঙ্গো নাচে, এরাই সারারাত স্থানীয় আর্জেন্টাইন বিয়ার নিয়ে পড়ে থাকে। যে ট্যাঙ্গোকে মার্টিনেজ এস্ট্রাদা বলেছিলেন— ‘the dance of pessimism, of everyone’s sorrow’ এবং যে ক্রেওল স্টাইলকে এডোয়ার্ডো গ্যালিয়ানো বলেছেন— ‘On the feet of first criollo virtuosos, el toque, the touch, was born: the ball was strummed as if it were a guitar, a source of music.’ যাই হোক, এই প্রসঙ্গ থেকে আবার একটু পরের ইতিহাসে আসি। শুরুর দিকটা তো জানলাম। ব্রিটিশ থেকে ইতালীয় বা স্পেনীয় ঘরানার মিশেলের কথাও বলা হল। তাহলে ফাদার অফ আর্জেন্টাইন ফুটবল? এই নামে তেমন কেউ আছেন? তারও উত্তর আছে। এএফএ-র প্রথম ফাউন্ডার-প্রেসিডেন্ট এবং ১৯১১ সাল পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে সফল ক্লাব দল ‘অ্যালুমনি’-র প্রতিষ্ঠাতা স্কটিশ জেন্টলম্যান অ্যালেকজান্ডার ওয়াটসন হাটন। বুয়েন্স আয়ারস ইংলিশ হাইস্কুলের টিফিন টাইমে ছাত্রদের নিয়ে ফুটবল খেলানো এই হাটনের হাত ধরে বিগস্ক্রিন পর্যায়ে ফুটবল শুরু করা আর্জেন্টিনাকে প্রথমদিকে বারবার পড়শি উরুগুয়ের কাছে হেরে যেতে হচ্ছিল। ১৯১৬ সালের প্রথম ক্যাম্পিওনাটো সুদামেরিকানো (পরে যা কোপা আমেরিকার রূপ নেয়), ১৯২৮ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক এবং ১৯৩০-এর প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনাল— সবেতেই উরুগুয়ের কাছে হার। ১৯৩৪ সালে তারকা লুইস মন্টি, ভিনেস্তে জিটো, ম্যাটিলিও পিনেট্টি, ফ্রান্সিনকো ভ্যারেল্লে সহ ইতালীয় বংশোদ্ভূত অধিকাংশ খেলোয়াড়ই চলে গেলেন ইতালিতে। এবং এতকালের আর্জেন্টাইন ডমিনেন্সের ডার্ক পিরিয়ড শুরু হল। তবে তার আগে এই সময়েই দেশের ক্লাব ফুটবলে উল্লেখযোগ্য ছিল রিভারপ্লেটের ড্রিমটিম ‘দ্য মেশিন’ বা ‘লা ম্যাকিনা’-র দাপট। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই লা ম্যাকিনায় কারা ছিলেন? সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিছু নাম, যাঁরা আন্তর্জাতিক জার্সিতে একেবারেই না আসায় বাকি পৃথিবীর কাছে সেভাবে আলো পেলেন না। অ্যাডোলফো পেডেরনারা, জোসে মরেনো, জুয়ান মুনোজ, অ্যাঞ্জেল লাব্রুনা, ফেলিক্স লস্টাও। এবং পেডেরনারার ক্লাব ছাড়ার পরে এই ড্রিম টিমেই ডাক পাওয়া তরুণ লেজেন্ড ‘ব্লন্ড অ্যারো’ ডি স্টিফানো। পরবর্তীকালে স্যার রাইনাস মিশেলের টোটাল ফুটবলের প্রথম সার্থক রূপায়ণ আসলে এই লা ম্যাকিনার হাত ধরেই।

লা ম্যাকিনার ফরোয়ার্ড লাইন: মুনোজ, মোরেনো, পেডেরনারা, লাব্রুনা, লস্টাও

অন্যদিকে, দেশ হিসেবে এই সময়েই শুরু হওয়া সেই অন্ধকার অ্যালবিসেলেস্তের গল্প। দেশের রাজনৈতিক সমস্যা, ফিফার সঙ্গে মতবিরোধ— যার পরিণাম ১৯৩৪-এর পর থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত মাঝের সময়টা বিশ্বকাপ থেকে আর্জেন্টিনার দল সরিয়ে রাখা। ১৯৭৮ পর্যন্ত পরের কুড়ি বছর খুব সাধারণ মানের একটি ফুটবল পেটানো দেশ এবং বড়জোর দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত ওঠা একটা ফুটবল লেগ্যাসি। এবং সেই ১৯৭৮। ইসাবেল পেরনকে সরিয়ে জর্জে রাফায়েল ভিদেলার কুখ্যাত ডিক্টেটরশিপ এবং বিশ্বকাপ আয়োজন। প্রায় ৩০,০০০ আর্জেন্টাইনের হত্যা বা রহস্যজনক নিরুদ্দেশের ব্যাকড্রপের ভেতর বিউটিফুল গেম অফ দ্য আর্থ। মেনোত্তির নির্দেশে ভ্যালেন্সিয়ার মারিও কেম্পেস ছাড়া বাকি সবাই দেশীয় ফুটবলার। ২১ জুনের কুখ্যাত পেরু ম্যাচের ৬-১ পেরিয়ে গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে লুকা-কেম্পেস ডুয়োর দাপট এবং নেদারল্যান্ডকে ফাইনালে হারিয়ে রাজধানী শহরের স্টেডিয়ামে কাগজের ফুল ওড়ানো সেই প্রথম নীল সাদা-অ্যালবিসেলেস্তের আকাশ ফাটানো চিৎকার— বিজয়োল্লাসের সেই প্রথমবারে যার সাক্ষী বুয়েন্স আয়ারসের সেই ৬৭.৫ মিটার উঁচু ওবেলিস্ক।

২০২২-এর ১৯ ডিসেম্বরের সম্ভবত সর্বকালের বৃহত্তম ফুটবল-কেন্দ্রিক জনমিছিলের সেন্টার পয়েন্ট এই ওবেলিস্ক সম্পর্কে একটু বলে নিই। ১৯৩৬ সালে রোজারিওর পারানা নদীর ধারে (যেখানে এখন ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল আছে) বসানো, মডার্নিস্ট স্থপতি অ্যালবার্তো প্রেবিস্কের স্বপ্নের এই ওবেলিঙ্ক পরে সে বছরই চলে আসে বুয়েন্স আয়ারসের কেন্দ্রে, ঠিক সেই জায়গায় যেখানে ১৮১২ সালের আগস্টে প্রথম আর্জেন্টাইন পতাকা ওড়ে। ১৯৭৮ সালে বিজয়োল্লাসের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল এই ওবেলিস্ককেই।

২০২২ বিশ্বকাপ জেতার পরের দিন ওবেলিস্কের সামনে জনসমুদ্র

একটু ইতিহাস হল। খেলার ধরন হল। স্থাপত্য হল। শুরু থেকে প্রথম দলগত সাফল্যের ক্রনোলজি হল। ১৯৮৬, দিয়েগো-যুগ এবং পরের ৩৬ বছরের বিটার-সুইট গল্প আমাদের প্রায় সবারই কম বেশি দেখা, জানা। জুলিওর কথা বলছিলাম শুরুতে। এবার বাকি টিমমেটদের কথায় আসি। কীভাবে, কখন, কোথায় শুরু তাঁদের সেইভাবে আলোর বাইরে থাকা ফুটবল লেগ্যাসির? ফিফা ২০২২-র বেস্ট ইয়ং প্লেয়ার বছর একুশের এনজো ফার্নান্ডেজ ক্লাব লা রেকোভায় কেরিয়ার শুরু করে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে রিভারপ্লেটের কিশোর দলে চলে আসেন। পরে রিভার থেকে লোনে ডিফেন্সা ইয়ুস্টি সিয়া দলে রিক্রুটেড এনজোর মতো জুয়েলকে কে চেনেন শুরুতে? ডিফেন্সা ক্লাবের কোচ। কে তিনি? ক্রেসপো। হ্যাঁ, হার্নান ক্রেসপো। এনজো ফার্নান্ডেজের তারপরের গল্পটা বেনফিকায়। ২০২২-এর ইতিহাসের পর এনজোকে নিয়ে টানাটানির খবরগুলো সংবাদপত্রের হুজুগে থাকুক, এখানে জরুরি না। অ্যালেক্সিস ম্যাকঅ্যালিস্টার। পোল্যান্ড ম্যাচে ওই স্বপ্নের গোলটুকু না করলেও গোটা টুর্নামেন্ট এবং ফাইনালের ওই ড্রিমি পারফর্মেন্সের জন্য অনন্ত এক স্মৃতিতে থাকবেন ম্যাকঅ্যালিস্টার। বছর তেইশের এই প্রাণখোলা ছেলেটি তাঁর দুই ভাইয়ের সঙ্গে ফুটবল কেরিয়ার আজেন্টিনা জুনিয়রস ক্লাবে শুরু করে একলাফে চলে আসেন ইংল্যান্ডের ব্রাইটন অ্যান্ড হোভ অ্যালবিওনে, যা এখনও অব্যহত। ২০২২-এর পর সম্ভবত কিছু বিগ জাম্প হচ্ছে। আর বাকিরা? গোল্ডেন গ্লাভস-জয়ী, দেশের প্রায় সেভিয়ার এমিলিয়ানো মার্টিনেজ? এমির ডাকনাম ‘দিবুজা’ বা ‘দিবু’ এসেছিল একটি অ্যানিমেটেড কার্টুন চরিত্র থেকে, স্প্যানিশে যার অর্থ ‘আঁকা’। তিরিশ পেরোনো এমি আর্জেন্টিনার ইন্ডিপেন্ডিয়েন্টেতে কেরিয়ার শুরু করে ১৭ বছরের জন্মদিনের মুহূর্তে আর্সেনাল থেকে ডাক পান, ২০২২-এর সোনালি মুহূর্তে তিনি সেদেশেরই অ্যাস্টন ভিলায়। আর নীরবে আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডকে শক্তি দেওয়া লিও মেসির প্রায় প্রাণের বান্ধব কঠোরতম এক পরিশ্রমী বছর আটাশের রড্রিগো ডি পল? ৮ বছর বয়সে রেসিং ক্লাবে যোগ দিয়ে পরে ভ্যালেন্সিয়া এবং ইতালির উদিনেজ হয়ে বর্তমানে আর্জেন্টাইন দিয়েগো সিমিওনের অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদে আছেন পল। অথবা নেদারল্যান্ড ম্যাচে লিওর স্বপ্নের পাস থেকে ওই অবিস্মরণীয় গোলের নায়ক চব্বিশ পেরনো সুদর্শন নেহুয়েল মলিনা? বোকা জুনিয়রস থেকে ডিফেন্সা এবং রোজারিও সেন্ট্রাল হয়ে ইতালির উদিনেজ এবং সেই সিমিওনের অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ। প্রাক্তন আর্জেন্টাইন এই দিয়েগো সিমিওনে তরুণ প্রতিভাকে চিনে নেওয়ার এক দুর্লভ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন। একের পর এক ম্যাজিক টাচ, আড়ালে সিমিওনে।

এবং এসবের মাঝে আরেকটি দিকও আড়ালে থেকে যাচ্ছে, তা হল ইউরোপীয় ফুটবলে একের পর এক নক্ষত্র সরবরাহ করে নিজের আকাশকে রিক্ত করে দেওয়া আর্জেন্টিনার ফুটবল। অবশ্য বিশ্বায়নের প্রবল আধিপত্যে এক্ষেত্রে ফুটবলারদেরও পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না বোধহয়। যদিও, খেদ থেকে যায়। প্রসঙ্গত মনে পড়ে, আর্জেন্টাইন ফুটবল নিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত বই ব্রিটিশ লেখক-সাংবাদিক জোনাথন উইলসনের ‘Angels With Dirty Faces: The Footballing History of Argentina’-র কথা। জোনাথন বইটি শেষ করছেন এই খেদ থেকেই—

Argentina is a nation founded on immigration and the immigrant vision of a better world, and football has played a central role in the creation of its image and its identity, yet now its best players— even its quite good players— are emigrants, forced to abandon the land of silver for the old world. Football is another Argentinian dream that has slipped away. For Argentinians to see the best their country can produce, they must look either to the past or abroad. Argentinian football has become something that is played elsewhere.

আর্জেন্টাইন ক্লাব ডার্বি বোকা জুনিয়রস ও রিভারপ্লেট ম্যাচের দৃশ্য

এটা মনে রাখা দরকার লো সেলসো বা দিবালা এখনও এই দলে সেইভাবে দাপট দেখাননি। ২০২২-এর ফিনিলিসিমায় ইতালি ম্যাচে বা লুসেইল স্টেডিয়ামে ওই অসম্ভব ক্রিটিকাল মোমেন্টে যেটুকু পেরেছেন, পাওলো দিবালা দেখিয়ে দিয়েছেন হি ইজ আ বিগ ম্যাচ প্লেয়ার। স্প্যানিশ ভাষায় তিনি ‘দ্য জুয়েল’ বা ‘লা জোয়া’।  চোটের থাবা ২০২২-এর গ্র্যান্ড সেলিব্রেশন থেকে রোজারিও সেন্ট্রাল থেকে উঠে আসা মাঝমাঠের ক্রিয়েটিভ বিস্ময় লো সেলসোকে আলাদা করে রেখেছে। এবং এদেরই মাঝে ঝকঝক করছে আরও কয়েকটা মুখ। বছর আঠারোর রাইট ব্যাক ভ্যালেন্টিনো বারকো। সান্টা ফে ইউথ ক্লাব থেকে বোকায় আসা বারকা দেশের হয়ে আন্ডার ফিফটিন এবং আন্ডার টোয়েন্টি খেলেছেন। ফ্রিকিক স্পেশালিস্ট এবং নিখুঁত ট্যাকলিং-এর দক্ষতার জন্য ক্লাবগুলোর চোখ পড়ছে বারকার ওপর। মেক্সিকো-জাত রাইট উইং বছর আঠারোর লুকা রোমেরো স্পেনে বড় হয়ে আর্জেন্টিনার হয়ে আন্ডার টোয়েন্টি খেলেছেন। মায়োরকার হয়ে দাপট দেখিয়ে খেলে কনিষ্ঠতম লা লিগা খেলোয়াড়ের গারল্যান্ড ছুঁয়ে এখন ইতালির লাজিওতে। পাশাপাশি চোখে পড়ছে রিয়েল মাদ্রিদ অ্যাকাডেমি থেকে বেড়ে ওঠা আঠারো পেরনো নিকো পাজ বা আলভেরো রড্রিগেজদের। এবং বলা হচ্ছে, ২০২৬-এ লিও মেসির অবস্থান নিতে চলেছেন যে নামটি, তাকে ইতিমধ্যেই কিছুটা অবৈধভাবে কব্জা করে রেখেছে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড। বছর আঠারোর লেফট উইঙ্গার এই তরুণ বিস্ময় আলেজান্দ্রো গারনাচো অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের ইয়ুথ টিম পেরিয়ে এক্কেবারে ম্যাঞ্চেস্টারে চলে গেছেন, খেলেছেন আরেক লেজেন্ড জেভিয়ার মাসচেরানোর কোচিং-এ নীল সাদার হয়ে আন্ডার টোয়েন্টি ম্যাচে। বড় ম্যাচে না নামলেও সুযোগ পেয়েছেন স্কালোনির সিনিয়র দলেও। উঠে আসছে এমি মার্টিনেজের সেই ইন্ডিপেন্ডিয়ান্টের আরেক তরুণ বিস্ময় সতেরো পেরনো স্ট্রাইকার সান্টিয়াগো হিডালগোর নাম। অর্থাৎ, মোটের ওপর, তৃতীয় কাপের জন্য ৩৬ বছরের বিশাল ফাঁক যে ভবিষ্যতে রিপিট হবে না, একথা কিন্তু এখনই দাবি রেখে বলা যায়।

এ আলোচনার প্রসঙ্গেই প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে গত ২০১৮ সালে বেরনো একটি বিখ্যাত লেখার কথা মনে আসে। ২০১৪-র শেষ সময়ের ব্যর্থতার পরে যে লেখাটি সবার আগে আসতে পারত, তা শেষমেশ আলোয় এল আট বছর পর, এক অবিশ্বাস্য সাফল্যের রাতে। কারণ সিজনাল পাঠক শুধু সাফল্যটুকু দেখেন। হেরে যাওয়াগুলো না। না বললেও চলবে, লেখাটি অ্যাঞ্জেল দি মারিয়ার। রোজারিও সেন্ট্রাল ক্লাব থেকে বেনফিকায় যাওয়ার মাঝের লড়াই, সময়। রোজারিওর কয়লাখনিতে কাজ করা তাঁর বাবার লড়াই, টিনের ছাদের ঘর, কালো দেওয়াল, ছেলের ফুটবলের জন্য সাইকেলে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে আপহিল যাওয়া তাঁর মা, এবং রিয়েল মাদ্রিদের বিশ্বাসঘাতকতার এক অবিশ্বাস্য, নির্মম এপিটোম ডিমারিয়ার এই লেখা, ২০১৪-র হারের পর যা অসম্ভব এক কান্নার জন্ম দেয়—

They watch the World Cup Final, and all they see is a result. 0-1. But they don’t see how hard so many of us fought to get to the moment. They don’t know about my father working under a little tin roof. They don’t know about my mother riding Graciela through the rain and the cold, for her children …

রোজারিও সেন্ট্রাল ক্লাবের দেওয়ালে ডি মারিয়ার ছবির সামনে কিশোর ফুটবলার

এসব কথা থেকে বেরিয়ে যেতে ভাল লাগে না। কারণ মারিয়া যেটুকু লিখলেন, তা অনেক, যেটুকু লিখলেন না, তার কিছু গল্পও তো অনেকের চেনা, জানা। গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সিতে ধরা পড়ার আগে রোজারিওর নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে লিওর ৫০০ গোল এবং সেই ক্লাবের ড্রিম টিম ‘মেশিন অফ এইটি সেভেন’-এর রূপকথার দিনগুলো। ওষুধের খরচ জোগাতে না পেরে নিউওয়েলস ছেড়ে যাওয়ার সময় শেষ ম্যাচে লিওর চোখ, বাবা জর্জের হাত ধরে এক ম্যাজিকাল ‘ডোয়ার্ফ’-এর ক্লান্ত হেঁটে যাওয়া, এবং ট্রফি হাতে বাইশ বছর পরে যার সামগ্রিক প্রত্যাবর্তন। এই স্মৃতির ভেতরে আরও অনেক রাষ্ট্রীয় ডার্ক মেমোরি। দারিদ্র্য। রাজনীতি। হুলিগ্যানিজম। যেমন উল্লেখ্য, কুখ্যাত ‘বারাস ব্রাভাস’ হুলিগ্যান গ্যাং এবং কাতারে আসার আগে আর্জেন্টিনার পক্ষ থেকে কাতার সরকারের কাছে ব্ল্যাকলিস্ট করে দেওয়া ৬৫০০ জন কুখ্যাত সেই গ্যাং-এর সমর্থক। অথবা দীর্ঘ ৩৬ বছরের কিছু না পাওয়া। দলগতভাবে সেমিফাইনালের আলো পর্যন্ত না দেখা কোথায় যেন হারিয়ে যাওয়া ২০০৬-এর ছাব্বিশ পাসের টিম বা জুয়ান রোমান রিকলমের মুখ। আর্থ-সামাজিকভাবে এই সময়ই আরও এক অন্ধকারের সময়। গত নভেম্বরে বিশ্বকাপ শুরুর মুখে আর্জেন্টিনার মূল্যবৃদ্ধি ছিল ঠিক আগের বছরের নভেম্বরের তুলনায় ৯২ শতাংশ বেশি। বলা হয়, ঠিক বিশ্বকাপ জেতার বছরেই এই মূল্যবৃদ্ধি কাকতালীয়ভাবে রেকর্ড ছোঁয়। ১৯৭৮ এবং ১৯৮৬-তে এই হার ছিল যথাক্রমে ১৭৬ ও ১১৬ শতাংশ। সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের ডেটা বলছে দেশের বর্তমান সুদের হার ৭৫ শতাংশ। সরকার থেকে রপ্তানি দ্রব্যে নিয়ন্ত্রণ জারি করছে একের পর এক। ঠিক এমন সময়, একটা ৩৬ বছরের খরা মেটানো ট্রফি। ঠিক কী বলা যায় একে?

নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজের ‘দ্য মেশিন অফ এইটি সেভেন টিম’ (নিচের সারিতে ঠিক মাঝখানে লিওনেল মেসি)

আর্জেন্টাইন লেখক-অধ্যাপক অ্যারিয়েল স্কারের কথাগুলো সব শেষে উত্তর হিসেবে থাকুক—

There is no guarantee that it (football) mask or make you forget problems… but it’s a place where you look for things you cannot find elsewhere…