বিষাণ বসু
গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, পেশায় চিকিৎসক
বইয়ের সঙ্গে যোগাযোগের প্রথম স্মৃতি আর মনে পড়ে না। স্মৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে যতদূর মনে পড়ে, বাড়ির দেওয়ালের রং, জানালার বাইরে গাছ, ছাদের উপরে আকাশ এইসব, আর ঘরের মধ্যে তাক-বিছানা-টেবিল-মেঝে সর্বত্র বই ছড়িয়ে আছে, এটুকুই দেখতে পাই। গৃহিণীর লাঞ্ছনা-গঞ্জনা অগ্রাহ্য করে বাস্তবটা এখনও তাই। অতএব, ঘর থেকে আলাদা করে বইয়ের মেলা নিয়ে লেখার আমার আর কী-ই বা আছে!
ছেলেবেলা বলতে, কলকাতা থেকে দূরে মফস্বল শহরে বাস। অতএব, বইমেলা বলতে যাঁরা শুধুই কলকাতা বইমেলা বোঝেন, তাঁদের প্রতি দূর থেকে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম জানানোর বেশি একাত্মতা দেখাতে পারা মুশকিল। আমার প্রথম বইমেলা আমাদের সেই নিস্তরঙ্গ শহরেই। বাঁকুড়া জেলার প্রথম বইমেলাটি আয়োজিত হয়েছিল সেখানেই। পরে যিনি সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতিমান হবেন, সেই ভগীরথ মিশ্র তখন ওখানে সরকারি আধিকারিক। আমাদের বিষ্ণুপুরে বইমেলা আয়োজনের ব্যাপারে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। আমার বাবাও জড়িত ছিল সঙ্গে। বইমেলার কদিন তাঁর সঙ্গে বাবাও সারারাত মেলার মাঠে কাটাত, বই পাহারা দিতে৷ আমার স্মৃতি বলতে, আমাদের ইশকুলের মাঠে বইয়ের মেলা। সে এক আশ্চর্য ব্যাপার! কখানাই বা দোকান ছিল! কিন্তু ওই কদিন, বিকেল থেকে রাত্তির অবধি বইয়ের মধ্যে ঘুরেফিরে কেটে যেত।
পরের বছর থেকেই, সম্ভবত, মেলা সরে গেল জেলাশহর বাঁকুড়ায়। নিয়ম করে সে মেলায় যাওয়া হত অবশ্যই। প্রতি বছরই। বই তো কেনা হতই, কিন্তু মেলার চাইতে বেশি করে মনে আছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা। সলিল চৌধুরী। অংশুমান রায়৷ মফস্বলে তখন বড় শিল্পীদের শোনার সুযোগ হত কতটুকুই বা! ডেভিড কপারফিল্ড-এর বাংলা অনুবাদের পাতায় সলিল চৌধুরীর সই নিয়েছিলাম। বইটা, দুর্ভাগ্য আমার, হারিয়ে গিয়েছে। একবার মেলার উদ্বোধন করতে এসেছিলেন ফুটবলার বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরও সই নিয়েছিলাম। ইয়াকভ পেরেলম্যানের অঙ্কের খেলা বইতে। সইয়ের আগে তিনি লিখে দিয়েছিলেন, Play Soccer and See the World. বইটা হারিয়ে গিয়েছে, কিন্তু কথাগুলো ভুলিনি। ভুলিনি, কেননা, আমার ক্ষেত্রে ‘সকার’ খেলে বিশ্বদর্শনের সম্ভাবনা অ্যাকাউন্টে মোদিজির পনেরো লাখ ঢোকার চাইতে কম ছিল, চিরকালই। আর, সকার ব্যাপারটা কী, তখন তার মানেটাও বুঝতে পারিনি। বাবার কাছে শব্দের অর্থ জেনে নিয়ে ভেবেছিলাম, বড় খেলোয়াড়রা তাহলে ফুটবল খেলাকে সকার বলে!
বাঁকুড়া বইমেলার স্মৃতি সেই ছেলেবেলাতেই শেষ, এমন নয়। মেডিকেল পড়তে এসে বইমেলায় ঘোরা আবার অন্যরকম। বন্ধুরা মিলে, হইহই করে। ছোটবেলা থেকেই বই পড়তাম অঢেল। মোটামুটি তথাকথিত খ্যাতিমান লেখকদের বই-ই মূলত। গল্প-উপন্যাস-কবিতা সবই। মেডিকেল জীবনে আমার বাংলা বই পড়ার দুই নতুন গুরু জুটল। তমোজিৎদা আর অনিন্দ্যদা। তথাকথিত খ্যাতিমানদের বাইরে বাংলাভাষায় যে কত অসামান্য লেখক ও কবি ছড়িয়ে রয়েছেন, তাঁদের চেনাল এরা দুজনই। উদয়ন ঘোষের গদ্য। ভাস্কর চক্রবর্তী, উৎপলকুমার বসুর কবিতা। এবং আরও কত। বইমেলায় ঘুরেফিরে এমন অনেক অচেনা সম্পদ সংগ্রহ করতাম। আর একটা বাড়তি মজা, জুনিয়র ভাইবোনদের কাছে আবদার করে বই উপহার চাওয়া৷ একপ্রকার আদায়ই, তবে সেই জোরাজুরির মধ্যে দাদাগিরির চাইতে স্নেহভাজনের প্রতি অধিকারবোধই মিশে থাকত বেশি।
আর একটা স্মৃতি। বাঁকুড়া বইমেলায়ই সুবর্ণরেখার স্টলে পুরনো বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে ধূসর পাণ্ডুলিপি-র একটা ধূসরতর সিগনেট সংস্করণ হাতে পেয়ে গিয়েছিলাম। উপরে লেখা ছিল, সেই পরিচিত হস্তাক্ষরে— বন্ধুবর পরিতোষ সেনকে, সত্যজিৎ রায়। কুড়ি টাকা দিয়ে কিনেছিলাম, এখনও মনে আছে৷ তবে আরও বছর কুড়ি পরে, বইটি পোকার আক্রমণে দেহরক্ষা করে৷ বাঁচাতে পারিনি, সে দুঃখ এখনও যায়নি।
তবে ছোটবেলায় কলকাতা বইমেলাতেও এসেছি। বাবা নিয়ে আসত কিশোর ছেলেকে বইমেলা দেখাতে। মাঝে, বছরকয়েক সম্ভবত, দুটো বইমেলা হত। একটা বইমেলা, আরেকটা পুস্তকমেলা। দুটোই সেই অর্থে বইমেলা-ই। একটা পাবলিশার্স গিল্ড-এর, আরেকটা রাজ্য সরকারের। বলাই বাহুল্য, সরকারি দলের কর্মী হিসেবে বাবা সরকারি বইমেলাতেই নিয়ে আসত, থুড়ি পুস্তকমেলায়। একদিনের জন্যই। ময়দানের বিপুল বিস্তৃতির মধ্যে দিশেহারা হয়ে ঘোরাঘুরি করে কেটে যেত দিনটা। বই কিনতাম অবশ্যই, কিন্তু মূলত যে বই চোখে পড়ত ও তা-ও সাধ্যায়ত্ত দামের মধ্যে, তার ভিত্তিতে। পরিকল্পনা করে কেনা যেত না, কেননা স্টল খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার।
একান্ত আত্মকেন্দ্রিক সুখস্মৃতিও রয়েছে বইকি! সদ্যযৌবনে, মেডিকেল পড়ার সময়, যৌবনের বদভ্যাস-বশতই, কবিতা লিখেছিলাম কিছুদিন। কবিতা লেখা নয়, অপপ্রয়াস মূলত। ওই তমোজিৎদা আর অনিন্দ্যদার প্ররোচনায়। সে কবিতার কিছু প্রকাশিত হয়েছিল, একবার, কবিতা ক্যাম্পাস পত্রিকায়। কবিতা ক্যাম্পাস তখন খুব ছোট কাগজ নয়, বইমেলায় নিজস্ব স্টল হয় তাদের। সেই পত্রিকার বইমেলা সংখ্যায় আমার কবিতা ছাপা হবে!! অবিশ্বাস্য সেই ঘটনার প্রমাণ রাখতে লেখক-কপি নিতে এসেছিলাম কলকাতা বইমেলায়ই। এবং বইমেলা সংখ্যা শুরু হচ্ছে আমার কবিতা দিয়ে, দেখে বাকরহিত হয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক যেমন অবাক হয়েছিলাম, গতবছর বইমেলায়, ধানসিড়ি-র স্টলে অনুজপ্রতিম প্রকাশক শুভ-র সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখে পড়ল, আমার বইদুটি সম্পূর্ণ অপরিচিত দুজন মানুষ পয়সা দিয়ে কিনে বসলেন— এই দৃশ্য দেখে। পয়সা দিয়ে অপরিচিত কেউ কখনও আমার বই কিনতে পারে, এ একেবারেই আমার ধারণার বাইরে ছিল! কিন্তু কথায় কথায় বড্ড আত্মপ্রচারের দিকে চলে যাচ্ছি।
তো কথাটা হল, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বইমেলার প্রতি দৃষ্টি বদলে গিয়েছে। গত আড়াই দশক তো কমবেশি কলকাতারই বাসিন্দা হয়ে গিয়েছি। শুরুর বিস্ময় কাটিয়ে এখন পদচারণা পরিচিত মাটিতেই। ময়দান থেকে সল্টলেক স্টেডিয়াম বা সায়েন্স সিটি থেকে সেন্ট্রাল পার্ক, বইমেলার চরিত্র কতখানি বদলে গিয়েছে জানি না, বদলেছি তো আমিও। এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো থেকে বইয়ের তালিকা ধরে খুঁজে চলা, কখনও বা লিটল ম্যাগাজিনের প্যাভিলিয়নেই পরপর তিনদিন সারাটা সময় কাটানোর দিন থেকে কখনও বা পেঙ্গুইনের স্টলে ঘুরে বইয়ের গন্ধ ও স্পর্শের সুখ অনুভব করা আর দীর্ঘশ্বাস ফেলা, অথবা শুরুতেই বুকলাইন দোকানে গিয়ে (সত্যিই কম দামে দুর্দান্ত বিদেশি বইয়ের স্টক থাকে) পকেট খালি করে ফেলে বাকি দিনটা উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো— সেসব দিন পার হয়ে মধ্যবয়সী থেকে ধীর ও নিশ্চিতভাবে প্রৌঢ়ত্বের দিকে হেঁটে চলা এই আমি, প্রতিবারের মতো এবারেও ঠিক করেছি, বইমেলায় যাওয়ার মানে হয় না আর। তবু…
তবু এরই মধ্যে কোনও একদিন, অন্যবারের মতোই মেলার মাঠে পৌঁছে যাওয়া হবে, হয়ত। ছেলের হাত ধরে, কিংবা দূরের কোনও বন্ধুর কপট তিরস্কার-সহ আন্তরিক আহ্বানে…
পৌঁছে যদি যাই-ই, ধুলোয় আর ভিড়ের ধাক্কায় বিরক্ত হতে হতে, আবারও, মনে পড়ে যাবে, আপাত-উদ্দেশ্যহীন যে যুবক-যুবতীর দল মেলার মাঠে ভিড় করে আছে, যে ভিড়ের ঠেলায় আমি আজ তিতিবিরক্ত হয়ে পড়ছি, তারা আর কেউ নয়, আমারই কৈশোর, আমারই তারুণ্য, আমারই যৌবন… মেলে মে বিছড়ে হুয়ে ইত্যাদি প্রভৃতি।
বইমেলা বলতে আর কী-ই বা ভাবতে পারি!