সুমন গুণ
কবি, গদ্যকার
আমাদের তরুণ বয়সে বইমেলা ছিল প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠান যেহেতু পরিহারযোগ্য, তাই একটি অস্পষ্ট বা প্রচ্ছন্ন প্রতিরোধ ছিল বইমেলার প্রতি। এটা ওই বয়সের বাধ্যতামূলক স্বভাব। আবার ছোট পত্রিকা কিংবা এক বা দুই ফর্মার বই হাতে নিয়ে বইমেলায় ঘোরার মধ্যেও ছিল তারুণ্যের উদ্বোধন। সুতরাং বইমেলা ছিল স্পর্শের মধ্যে। অধিকারের মধ্যে। আর তখন তো ছোট পত্রিকা আর ছোট বইয়ের সুবর্ণ দশক। আমি আগেও বলেছি যে, কবিতার বই ৬৪ পাতারই করতেই হবে এই অশ্লীল ধারণাটি বাংলা বাজারের কিছু অসাধু আর কুশলী প্রকাশকের লোভ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে প্রচার পেয়েছে। বাংলা কবিতা, অন্তত গত প্রায় অর্ধশতাব্দীকালে, ৬৪ নয়, ১৬ পাতার আশেপাশে ভর রেখে মাথা তুলেছে।
প্রতিবারের বইমেলা-ফেরত অভিজ্ঞতায় এই ধারণা আরও ধারালো হত।
বইমেলার প্রথম পর্বে আমি কিছুদিন ছিলাম নৈহাটিতে। তরুণ বন্ধুদের নিয়ে, অনতিঅগ্রজদের সান্নিধ্যে দল বেঁধে বইমেলা ঘোরার অভিজ্ঞতার মধ্যে হারানো সুসময়ের গন্ধ আছে। তখন ময়দানে বইমেলা হত। অপ্রাতিষ্ঠানিকতার আদর তখনকার বইমেলায় ছিল আরও বেশি। ছোট পত্রিকার জন্য, ছোট পত্রিকা নিয়ে উন্মাদনার একটা প্রকাশ্য আশ্রয় ছিল বইমেলা। আর তখন তো বাংলার প্রতাপশালী লেখকেরা অনেকেই বেঁচে ছিলেন। বইমেলায় দেখা হত কারও কারও সঙ্গে। তাঁদের অনেকের সঙ্গে সখ্য বইমেলাতেই শুরু হয়েছিল বলেই মনে পড়ে। আশির দশকের শেষে আমি একটা ছোট পত্রিকা শুরু করেছিলাম, একটা বা দুটো সংখ্যা বেরিয়েছিল, ‘অন্যজন্ম’ নাম দিয়ে। কাগজটা তেমন কিছু ছিল না, কিন্তু পত্রিকাটি নিয়ে প.ব. আনন্দবাজারে দুলাইন লিখেও দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠানবিরোধী মন গোপনে দুলে উঠেছিল। ১৯৯৪-এর বইমেলা ছিল আমার কাছে প্রেম ও প্রত্যাখ্যানের বইমেলা। দুটোরই তুঙ্গ পর্ব একেবারে। গোটা বইমেলা আমি ও আমার নবীন প্রেমিকা দুই শরীর এক করে প্রায় বইমেলা ঘুরেছিলাম প্রথম কদিন। তারপর বইমেলাতেই একদিন তুমুল বিস্ফোরণ। প্রেমিকা প্রাক্তন হয়ে গেল। মেলার শেষ দিনগুলো সে একই ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াল আমারই আত্মজের সঙ্গে। ১৯৯৪! মনে আছে। মনে আছে বইমেলার জায়গা বদলের আগে-পরের দিনগুলো। বিক্ষোভ। আন্দোলন। বিষণ্ণতা। তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত কৃত্তিবাস পুরস্কার দেওয়া হত বইমেলাতেই। এটা একটা ঘটনা ছিল। তবে আমি যেবার পেলাম, ২০০৭ সালে, পুরস্কার অর্পণের অনুষ্ঠান হয়েছিল বাংলা অ্যাকাডেমিতে। মধ্যমণি অবশ্যই সুনীলদা। আমার প্রায় সব বইও বেরিয়েছে বইমেলা উপলক্ষেই। এ তো শুধু আমার নয়, সব লেখকেরই আন্দোলনময় অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতায় মিশে আছে আনন্দ, আহ্লাদ, বিস্ময়, শ্রম, স্বেদ, হতাশা, উল্লাস, তৃপ্তি ও আরও অনেক কিছু। মনে পড়ছে ‘প্রমা’ পত্রিকার কথা। সুরজিৎ ঘোষ প্রবল বিক্রমে পত্রিকা সম্পাদনা করছেন, বইমেলার অন্যতম কর্মকর্তাও ছিলেন তিনি দুই-এক বছর। একবার ‘প্রমা’র স্টল সামলানোর দায়িত্বও উত্তেজনার সঙ্গে পালন করেছিলাম মনে আছে। বড় বর্ণময় মানুষ ছিলেন সুরজিৎদা। বলতেন, ‘প্রমা’র স্টলে যারা একবার বসে, পরের বছর তার বই বেরোয়। সত্যিই আমার বই বেরিয়েছিল ‘প্রমা’ থেকে। ‘সোমবার, আত্মীয়স্বজন’ ‘প্রমা’রই বই। আমার প্রথম প্রবন্ধের বইটিও বইমেলায় বের করে দিয়েছিলেন সুরজিৎদা। ‘মেধাবী সান্নিধ্য: বুদ্ধদেব বসু’। বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে আমার ধারাবাহিক চর্চার প্রথম গ্রন্থবদ্ধ ফসল এই বইটি। পরে এর আরও অনেক সংস্করণ হয়েছে। এখন এটি ‘প্রতিভাস’-এর।
এই মুহূর্তে বইমেলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মধুরতর একটি বিশেষ কারণে। জীবনে বিভিন্ন ছোট কাগজের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে ছিলাম, নিজে কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনাও করেছি। যেমন ‘অন্যজন্ম’, ‘বব্বল’, ‘পুণ্যিপুকুর’ ও সম্ভবত আরও দুয়েকটি। বইমেলার নানা মঞ্চ ভাড়া করে কবিতাপড়া ইত্যাদির আয়োজনও করেছি প্রায় প্রতিবারই। কিন্তু কোনওদিনই বইমেলায় টেবিল নিয়ে প্রতিদিন এসে গুছিয়ে হল্লা করার সামর্থ্য হয়নি। এবারে ‘বান্ধবনগর’ পত্রিকার বইমেলা সংখ্যা নিয়ে যে থাকতে পারছি, তার কারণ আমার চেয়ে অনেক ছোট কয়েকজন তরুণের উদ্যমী ও মেধাবী সান্নিধ্য। শুধু পত্রিকা নয়, ‘বান্ধবনগর’ থেকে প্রকাশিত এক ফর্মার অনেকগুলো কবিতার বই নিয়ে বসে, রশিদ কেটে বিক্রি করা, মুদ্রা দেওয়া-নেওয়া, খুচরো জোগাড়, টেবিলের জায়গা নিয়ে, পরিসর নিয়ে ছুটোছুটি, রাগ-বিরাগের তরুণ অভিজ্ঞতার মধ্যে যুক্ত থাকা সম্ভব হল সব্যসাচী মজুমদার, সুদীপ চট্টোপাধ্যায়, শাম্ব, ধৃতিরূপা দাস, মাসুদ শাওন, অরিত্র দ্বিবেদী, অভিষেক মুখোপাধ্যায়, শৌর্যদীপ গুপ্ত সহ আরও অনেক নবীনের মুখর সৌজন্যে। এবার মনে হচ্ছে আমিও বইমেলার অংশ। আরও একটি রক্তিম কারণও আছে। আমার ‘ত্রাণ’ নামে যে বইটি বান্ধবনগর থেকে বেরোল মেলায়, আমি সেটি উৎসর্গ করেছি সুদীপ্তাকে। ‘শব্দ’-র সুদীপ্তা, আমার তরুণ বন্ধু মেলায় আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে। এবারের বইমেলা থেকে আমার প্রাপ্তি খুব কম নয়!