প্রদীপ দত্ত
লেখক, পরমাণু শক্তি-বিরোধী কর্মী, পরিবেশবিদ
তিন দশক আগে যখন থেকে রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে পৃথিবীর নিঃসরণ কমিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হয়েছে, নিঃসরণ না কমে দেড়গুণের বেশি বেড়েছে। নানা দেশে চরম আবহাওয়াও বেড়েছে। ১৯৯২ সালে মোট কার্বন নিঃসরণ হয়েছিল ২২৪৮ কোটি টন। তারপর ২০০০ সালে ২৫৫৯ কোটি টন।[1] আর কোভিড অতিমারির আগের বছর, ২০১৯ সালে হয়েছিল ৩৬৭০ কোটি টন।[2] অতিমারির বছর, ২০০০ সালে নিঃসরণ কিছুটা কমেছিল। ২০২১ সালে ফের বেড়ে হয়েছে ৩৬৩০ কোটি টন। কয়লা থেকে হয়েছে ১৫৩০, গ্যাস থেকে ৭৫০, তেল থেকে ১০৭০ কোটি টন। তবে অতিমারির পর আন্তর্জাতিক পরিবহন (বিমান ও জাহাজ) তখনও স্বাভাবিক হয়নি বলে তেল থেকে নিঃসরণ ২০১৯ সালের চেয়ে কম হয়েছে।[3]
২০২১ সালে চিন একাই নিঃসরণ করেছে ১১৪৭ কোটি টন। তবে ২০২২ সালে তা ০.৯ শতাংশ কমেছে।[4] বিশেষজ্ঞরা আশা করেন চিনের নিঃসরণ হয়তো সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যদিও চিন জানিয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে ২০২৬ সালে। বিশ্বের তিনভাগের প্রায় একভাগ নিঃসরণ করে চিন। তাদের বৃদ্ধি থামলে পৃথিবীর নিঃসরণ আর তেমন না বাড়ারই কথা।
২০২২ সালে বিশ্বে কয়লার ব্যাবহার ১.২ শতাংশ বা ৮০০ কোটি টন বেড়েছে। ইউরোপে বেড়েছে পর পর দুবছর। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য জ্বালানি সঙ্কটে গ্যাস দুর্মূল্য বলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যাবহার বেড়েছে। বেশি বেড়েছে চিনে। ভারতেও বেড়েছে, তবে চিনের তুলনায় কম। চিনে গরমের সময় তাপপ্রবাহ এবং খরার জন্য কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। ২০২২ সালে আর্থিক বৃদ্ধিতে মন্দার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা এবং শিল্পোৎপাদন কম হলেও নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন অনেকটা বেড়েছে। আইইএ-র (ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি) মতে পৃথিবী এখন কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যাবহারে শীর্ষের কাছাকাছি রয়েছে। এরপর ব্যবহার কমবে।[5]
গ্রিনহাউস গ্যাসের ৭৫ শতাংশই কার্বন-ডাই অক্সাইড। গ্লোবাল কার্বন বাজেটের হিসেব অনুযায়ী জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ২০২২ সালে কার্বন নিঃসরণ হয়েছে রেকর্ড মাত্রায়— ৪০৬০ কোটি টন। ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের গড়ের চেয়ে এখনই তাপমাত্রা বেড়েছে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অফ ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্ব-উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রিতে বেঁধে রাখতে গেলে ২০২৫ সালের মধ্যে নিঃসরণ সর্বোচ্চ সীমায় এনে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৩ শতাংশ কমিয়ে ফেলতে হবে। মিথেন নিঃসরণ কমাতে হবে তিন ভাগের এক ভাগ। তারপর ২০৪০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হবে।
কিছুদিন আগে আইইএ জানিয়েছিল, তাপমাত্রা ২ ডিগ্রির মধ্যে বেঁধে রাখতে হলে ২০২৫ সালের মধ্যে সৌর ও বায়ুবিদ্যুতে বর্তমান হারের দ্বিগুণ বিনিয়োগ করা দরকার, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে এবং পরিচ্ছন্ন বিদ্যুতের পথে চলতে উন্নয়নশীল দেশকে আন্তর্জাতিক সাহায্যও দিতে হবে।[6] ২০২১ সালে বিশ্বে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন ক্ষমতা হয়েছে ৩০৬৪ গিগাওয়াট। সৌরবিদ্যুৎ ৮৪৯ এবং বায়ুবিদ্যুৎ ৮২৫, জলবিদ্যুৎ ১২৩০ গিগাওয়াট, জৈবশক্তি ১৪৩ এবং ভূতাপ থেকে শক্তি ১৬ গিগাওয়াট। সে বছর প্রথম দুই পরিচ্ছন্ন বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা বেড়েছিল যথাক্রমে ৯৫ এবং ৮২ গিগাওয়াট।[7] এখন পৃথিবীর প্রায় ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে।
সাম্প্রতিক মিশরের শার্ম এল শেখ-এ জলবায়ু বা উষ্ণায়ন নিয়ে ২৭তম শীর্ষ সম্মেলনকে (কনফারেন্স অফ পার্টিস ২৭ বাস সিওপি২৭) এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে। জলবায়ু বদলের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে তাদের লস অ্যান্ড ড্যামেজ দাবি মেনে নেওয়াকে শীর্ষ সম্মেলনের বড় সাফল্য বলা হচ্ছে। অথচ সম্মেলনে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, ব্রিটেন এবং ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর জন্য যে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছিল তা আমল পায়নি। ২০২৫ সালের মধ্যে নিঃসরণ চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এবং যাবতীয় জীবাশ্ম জ্বালানি ফেজ-ডাউন করার কথাও গুরুত্ব পায়নি। মনে রাখতে হবে মালদ্বীপের অবস্থান সমুদ্র থেকে মাত্র এক মিটার উঁচুতে। ফলে সে দেশের ডুবতে বেশি বাকি প্রায় নেই বললেই চলে, পানীয় জলেরও আকাল শুরু হল বলে। আরও কিছু দ্বীপরাষ্ট্র একইরকম সঙ্কটে। তাই এই গ্রহের ভবিষ্যতের কথা ভাবলে সিওপি২৭-এ লস অ্যান্ড ড্যামেজ দাবি মেনে নেওয়ার জন্য হইহই করার মানে হয় না।
ভারতসহ নানা উন্নয়নশীল দেশ প্রায় তিন দশক ধরে বলছিল জলবায়ু পরিবর্তনে তাদের (গ্লোবাল সাউথ) ভূমিকা নগণ্য হলেও যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে তা সামলাতে তারা আর্থিকভাবে অপারগ। তাদের দাবি ছিল, উন্নত দেশ হয়ে ওঠার জন্য ধনী দেশগুলো বিপুল কার্বন নিঃসরণ করেছে, যে কারণে আজ বিশ্বের জলবায়ুর অবস্থা করুণ হয়ে উঠেছে। তাই উন্নয়নশীল দেশকে তারা উন্নয়নের আর্থিক মাসুল দিক। এই শীর্ষ সম্মেলনে (সিওপি২৭) উন্নত দেশগুলো সেই দাবি মেনে নিয়েছে। ঠিক হয়েছে ওই লক্ষ্যে তহবিল গড়া হবে। কে কতটা দেবে, কোন দেশকে কীসের ভিত্তিতে দেবে তা ঠিক হয়নি, পরের শীর্ষ সম্মেলনে (সিওপি২৮) তা চূড়ান্ত হওয়ার কথা। এরপরও কিন্তু সন্দেহ থেকে যায়। কারণ এ ব্যাপারে ধনী দেশের কথা রাখার অতীত ইতিহাস ভাল নয়। সম্মেলনে গরিব ও ধনী দেশের মাপকাঠি কিছুটা বদলেছে, চিন এবং তেল রপ্তানিকারী দেশকে ধনী হিসেবে ধরা হয়েছে।
সিওপি২৭-এর দু সপ্তাহের ওই আলোচনায় মিশরের বিদেশমন্ত্রী সভাপতিত্ব করেছেন। তবে আলোচনা ফলপ্রসূ করার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ ছিল না। তাই আগেরবার গ্লাসগোয় সিওপি২৬-এ আলোচনার মুখ্য বিষয়গুলি এখানে হারিয়ে গেল। সম্মেলন যেন পুরোপুরি ব্যর্থ না হয় সেই কথা ভেবে প্রতিনিধিরা নির্ধারিত সময়ের পর চল্লিশ ঘন্টা আলোচনার শেষে লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাকেই বলা হচ্ছে সম্মেলনের সাফল্য। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০২৫ সালের আগেই কার্বন নিঃসরণ তুঙ্গে তোলা প্রয়োজন, তা নিয়ে আলোচনাই হয়নি। কয়লা এবং যাবতীয় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাবহার বন্ধ করা দূরস্থান, এমনকি কমানোর কথাও নেই। ফাইনাল টেক্সটে ট্রানজিশন টু লো-এমিশন সোর্সেসের কথা বলা হয়েছে। আদতে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের কথা ভেবেই তা করা হয়েছে। সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ছিল দৃষ্টিকটূ। তাদের ব্যাপক উপস্থিতি আলোচনার হাল বদলে দিয়েছে। বড় হাইড্রোকার্বন উৎপাদক সৌদি আরব তেল ও গ্যাস ফেজ আউট করার পরিকল্পনায় জল ঢেলেছে। আলোচনার শেষে এমন ভাষ্য তৈরি হয়েছে যা আসলে তেল, গ্যাস উৎপাদনকারী পেট্রো-স্টেটস এবং জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের স্বার্থরক্ষাকারী।
সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে শার্ম এল শেখ-এর বিলাসবহুল রিসর্টে। নিঃসরণ কমাতে যে ব্যক্তি-জীবনযাপনের কথা বলা হয় এই ব্যাপারটি তার পরিপন্থী। সম্মেলনের জন্য যে কার্বন ফুটপ্রিন্ট হয় তা নিয়েও রাষ্ট্রনেতাদের মাথাব্যথা নেই। পাঁচ-দশ মিনিট অন্তর এক-একটি বিমান তার পেটভর্তি পর্যটক উগরে দিয়েছে এমন দেশে যেখানে সবার জন্য যথেষ্ট পানীয় জল সহজলভ্য নয়, অথচ তেল পাওয়া যায় প্রচুর। এমন জায়গায় সম্মেলন করার চিন্তাও অদ্ভুত। পরের বছর সম্মেলন হবে সৌদি আরবের দুবাইয়ে। সে দেশও তেল রপ্তানিকারী এবং দেশটি অর্গানাজেশন অব দি পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ-এর সদস্য। তাদের সভাপতিত্বে জীবাশ্ম জ্বালানির প্রতি যে ফের নরম মনোভাব দেখানো হবে তা ধরে নেওয়া যায়। কার্বন নিঃসরণ কমানো নিয়ে তেমন কোনও কাজের সিদ্ধান্ত হবে না। ওদিকে আইপিসিসি-র মতে, নিঃসরণ যদি অনেকটা কমে সেক্ষেত্রেও বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব কমতে সময় লাগবে পাঁচ থেকে দশ বছর। আর তাপমাত্রা কমতে সময় লাগবে কুড়ি থেকে তিরিশ বছর। তাই এখনই নিঃসরণ কমিয়ে ফেলা জরুরি। অবধারিত।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঠেকাতে বিজ্ঞানীরা যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলছেন রাজনীতিবিদরা তা করছেন না। মানবসভ্যতার অস্তিত্বের বিনিময়ে তারা ভোটারদের কথা ভাবেন। এটা সর্বত্রই হয়। যেমন আমেরিকার নানা শহরের মেয়রেরা যানবাহনে গ্যাসের বদলে বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে সহযোগিতায় রাজি, তবে ভোট হারানোর ভয়ে গ্যাস স্টোভ বন্ধ করতে চান না।[8]
তবে আমাদের মতো দেশে বায়ুদূষণ অনেকটা কমালেই নিঃসরণ কমে, কিন্তু তাতেও কেন্দ্র কি রাজ্যের হেলদোল নেই (অবশ্য বায়ুদূষণ বেশি হলে সূর্যরশ্মি ভূপৃষ্ঠে কম আপতিত হয়, তাতে উষ্ণায়নও কমে)। তবে দূষণ কমাতে হলে শুধু নির্মাণের কাজ ও যানবাহনের দূষণ কমালেই হবে না, তাপবিদ্যুতের দূষণও কমাতে হবে।
সম্প্রতি আইইএ জানিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে (২০২২-২০২৭) অচিরাচরিত বা পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎপাদনক্ষমতা ২৪ লক্ষ মেগাওয়াট বাড়বে (এই পরিমাণ ২০২২ সালে চিনের মোট উৎপাদনক্ষমতার প্রায় সমান)। গত কুড়ি বছরে পরিচ্ছন্ন শক্তির মোট উৎপাদনক্ষমতা যতটা বেড়েছে, আগামী পাঁচ বছরে সেই পরিমাণ যোগ হবে। তিন-চতুর্থাংশ হবে সৌরশক্তি থেকে। তখন নবায়নযোগ্য শক্তি হবে বিশ্বের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২০ শতাংশ। সিংহভাগ উৎপাদন করবে চিন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আমেরিকা ও ভারত। এই অপরিমেয় বৃদ্ধির কারণ শুধু অনুকূল সরকারি নীতি বা বাজারের সংস্কারই নয়, রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য নানা দেশের শক্তি-নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগও তার কারণ।[9] সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে এই ত্বরণ পৃথিবীকে ধীরে হলেও নিঃসরণ কমানোর পথে নিয়ে চলেছে। শক্তি সঞ্চয় প্রযুক্তির খরচও কমছে। অর্থাৎ আরও উষ্ণায়ন যেন না হয় তার অনুকূল অবস্থা কিছুটা তৈরি হচ্ছে। তারপরও কিন্তু তা আমাদের চরম আবহাওয়াজনিত বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাবে না। কারণ আজ পর্যন্ত নিঃসরণ বেড়ে যে উষ্ণায়ন হয়েছে এবং হচ্ছে তা বদল হবে না।
চিনের উদ্যোগ
২০২২ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে বিশ্বের বাকি দেশগুলো পরিচ্ছন্ন শক্তিতে যতটা বিনিয়োগ করবে চিন একাই করবে তার তিনগুণ। ২০২২ সালের প্রথম এগারো মাসে সে দেশে সৌরশক্তির উৎপাদনক্ষমতা বেড়েছে ৬৫.৭ গিগাওয়াট (১ গিগাওয়াট=১০০০ মেগাওয়াট) এবং বায়ুবিদ্যুৎ ২২.৫ গিগাওয়াট। তাদের পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎপাদনক্ষমতা হয়েছে প্রায় ৯২০ গিগাওয়াট (সৌরবিদ্যুৎ ৪৯০, বায়ুবিদ্যুৎ ৪৩০) এবং জলবিদ্যুৎ ৪২৩ গিগাওয়াট। চিনের ন্যাশনাল এনার্জি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতে, ২০২৩ সালে পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎপাদনক্ষমতা বাড়বে ১৬০ গিগাওয়াট। সে দেশের তিরিশটি প্রদেশের লক্ষ্য ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুবিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা ৩০০ এবং সৌরবিদ্যুতের ৫৫০ গিগাওয়াট বাড়ানো। সেই হিসেবে পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎপাদনক্ষমতা তখন ১৫০০ গিগাওয়াট ছাপিয়ে যাবে।[10] গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা গেছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চিন যে জাতীয় লক্ষ্য ঠিক করে, বাস্তবে প্রতিবারই তার বেশি করে। ২০৩০ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন চিনের লক্ষ্য হলেও, এখনও তাপবিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা বাড়িয়েই চলেছে। গত বছর ব্যাপক বিদ্যুৎঘাটতির পর কয়লার উৎপাদনও বাড়িয়েছে। চিন জানিয়েছে, ২০৬০ সালের মধ্যে সে দেশ কার্বন নিঃসরণশূন্য হবে এবং সেই অনুযায়ী ২০২৬ সালের মধ্যে কয়লা পোড়ানো কমাতে শুরু করবে।
আমেরিকার তৎপরতা
আমেরিকায় বেশ কয়েক বছর ধরে বিদ্যুতের জোগানে কয়লা থেকে উৎপাদিত তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কমতে কমতে শতকরা ৪০ ভাগ থেকে কমে এখন হয়েছে ২১.৮ ভাগ। তার কারণ কিন্তু কোনও সচেতন সরকারি নীতি নয়, বরং বাণিজ্যিক। এই শতকের প্রথম দশকের শেষদিকে ফ্র্যাকিং করে পাওয়া প্রচুর শেল গ্যাস। ওই গ্যাস কয়লার তুলনায় সস্তা। প্রায় এক দশক ধরে বাড়তে বাড়তে গ্যাসবিদ্যুৎ এখন দেশের প্রায় ৩৮.৩ শতাংশ। গ্যাস থেকে নিঃসরণ কয়লার প্রায় অর্ধেক, তাই নিঃসরণও অনেকটা কমেছে। ২০২২ সালে সে দেশের বিদ্যুতের ৬১ শতাংশ এসেছে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে, ২০.১ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি (জলবিদ্যুৎ ৬.৩ শতাংশ, পরিচ্ছন্ন শক্তি ১৩.৮)। এবং ১৮.৯ শতাংশ পরমাণুবিদ্যুৎ। ২০০৫ সালের পর থেকে আমেরিকার নিঃসরণ ক্রমেই কমছে, যার কারণ পরিচ্ছন্ন শক্তি ও গ্যাসবিদ্যুতের বেড়ে ওঠা এবং হালকা গাড়ির ক্ষেত্রে প্রযুক্তির উন্নতিতে কম জ্বালানিতে বেশি পথ অতিক্রম। তবে বাইডেনের লক্ষ্য হল ২০৩০ সালের মধ্যে প্যারিসের অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০০৫ সালের তুলনায় নিঃসরণ শতকরা ৫০-৫২ ভাগ কমিয়ে ফেলা।
২০২২ সালের আগস্ট মাসে পাশ হওয়া ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্টের (আইআরএ) দৌলতে আশা করা হত এ বছর থেকে এক দশক ধরে পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎপাদনক্ষমতা অনেক বাড়বে এবং নিঃসরণ কমবে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই আইনের বলে এই দশকের শেষে আমেরিকার গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ২০০৫ সালের তুলনায় ৪২ শতাংশ কম হবে (অবশ্য ওই সময়ের মধ্যে আমেরিকার ৫০ শতাংশ কম করার কথা ছিল, তবে তার জন্য আরও উদ্যোগ দরকার)। এই প্রথম মার্কিন ফেডারেল সরকার উষ্ণায়ন সামলানোর লক্ষ্যে আইন পাশ করল। কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং শক্তি উৎপাদন কর্মসূচিতে সরকার ৩,৭০,০০০ কোটি ডলার খরচ করবে। মনে করা হয় এতে শুধু আমেরিকার নিঃসরণই কমবে না, সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণায়ন স্তিমিত করতেও সদর্থক প্রভাব ফেলবে।
তবে ওই আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ এখনও শুরুই হয়নি। এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন এজেন্সিতে প্রয়োজনীয় কর্মীর ঘাটতি, কনজারভেটিভ বিচারকদের দখলে থাকা ফেডারেল কোর্ট যে কোনও সময় জলবায়ু নিয়ে কার্যক্রমের বিরুদ্ধে রায় দিতে পারে আশঙ্কায় নিঃসরণ কমানোর ওই লক্ষ্যপূরণ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারী শিল্প এবং ঘরে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতির কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির কথা ছেড়ে দিলেও, এমনকি বাইডেন প্রশাসনের মেয়াদের মধ্যে গাড়ি ও তাপবিদ্যুতের দূষণ কতটা কমাতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।[11]
জার্মানির শিক্ষা
জার্মানির লক্ষ্য ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে মোট ৪৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। নতুন সরকার গত বছর (২০২২) সেই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে করেছে ৮০ শতাংশ, যেন উষ্ণায়ন কমানোর লক্ষ্য ছাড়াও রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানির নির্ভরতা কমে। ওই লক্ষ্যে পৌঁছতে প্রতি বছর ১০ গিগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতা বাড়াবে বলে ঠিক করেছে। কাজটা খুবই কঠিন, কারণ দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সূর্যকিরণ বা বাতাসের প্রবাহ কোনওটাই যথেষ্ট নেই। তবু ২০২২ সালে পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছে প্রায় ১০ গিগাওয়াট। এখন তাদের সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা হয়েছে যথাক্রমে ৬৫ ও ৫৮ গিগাওয়াট। এ থেকে বোঝা যায় নিঃসরণ কমানোর কাজ কঠিন হলেও প্রতিজ্ঞা থাকলে কিন্তু পারা যায়।[12]
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন
২০২২ সালে ইউরোপের সবচেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহকারী রাশিয়া সরবরাহ অনেক কমিয়ে দেওয়ায় তুমুল জ্বালানি সঙ্কটে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা ছিল ২৭টি দেশের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে কয়লার ব্যবহার অনেকটা বাড়বে, তাই নিঃসরণও বেশ বাড়বে। তার সঙ্গে ফ্রান্সের কয়েকটি পরমাণুবিদ্যুৎ কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ ছিল এবং খরা পরিস্থিতিতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনও কম হয়েছে। বায়ু ও সৌরবিদ্যুতের বর্ধিত উৎপাদনক্ষমতা বিদ্যুতের অভাব অনেকটাই মিটিয়েছে। এক বছরে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বেড়েছে ২৪ শতাংশ। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কয়লাচালিত কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৭ শতাংশ, নিঃসরণ বেড়েছে ৪ শতাংশ। তারা জানিয়েছে এই বৃদ্ধি সাময়িক, পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং শক্তি সাশ্রয় করেই তারা রুশ গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির মোকাবিলা করবে। ২০২১ সালে ইউনিয়নের বিদ্যুতের ২২ শতাংশ ছিল পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ। এখন জার্মানি, ডেনমার্ক ও স্পেন তা ৪৫ শতাংশ করতে চায়। হাঙ্গেরি, রোমানিয়ার মত কয়েকটি দেশ করতে চায় ৪০ শতাংশ। সরকারের চাইতে নাগরিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সে ব্যাপারে উৎসাহ বেশি।[13]
বিশ্বের করুণ হাল
২০১০ সালে বিশ্বের বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য শক্তির ভাগ ছিল ১.৭ শতাংশ, ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ৮.৭ শতাংশ। আগেই উল্লেখ করেছি যে, আইইএ জানিয়েছে নবায়নযোগ্য শক্তি গত দুই দশকে যতটা বেড়েছে, মাত্র পাঁচ বছরে ততটাই বাড়বে। জলবায়ুবিজ্ঞানীরা পূর্বাভাস করেছিলেন, এই শতাব্দীর শেষে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ৪/৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যাবে। এখন কোনও কোনও বিজ্ঞানী বলছেন দশ বছরে সৌর ও বায়ুবিদ্যুতের অভাবনীয়ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য অতটা হয়তো বাড়বে না। কম্পিউটার মডেলের ভিত্তিতে উষ্ণায়ন পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন শক্তির অগ্রগতি এবং কয়লার ব্যবহার না বাড়ার হিসেব ধরা হয়নি, ধরলে হয়তো দেখা যাবে এই শতকের শেষে আমরা ৩ ডিগ্রি বৃদ্ধির পথে রয়েছি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, যদি নিঃসরণ অনেকটা কমেও যায় তাহলেও ২০৫০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বাড়বে ২ ডিগ্রি। তার মানে প্যারিস শীর্ষ সম্মেলনের অঙ্গীকার রক্ষা করা যাবে না। ওই সম্মেলনে বলা হয়েছিল ২০৫০ সালের মধ্যে নিঃসরণ এতটাই কমিয়ে ফেলা হবে যেন উষ্ণায়ন অন্তত ২ ডিগ্রির নিচে থাকে, চেষ্টা করা হবে যেন ১.৫ ডিগ্রির নিচেই থাকে। ২ ডিগ্রিকে মনে করা হয় টিপিং পয়েন্ট, অর্থাৎ যে তাপমাত্রায় মেরুর বরফের পাটাতন (আইস শিট) একেবারে গলে যাবে, অথবা বিপুল বনাঞ্চল একেবারে ধবংস হয়ে যাবে, যেমন অ্যামাজন— যার ফল এই গ্রহের জন্য অতি ভয়ানক হবে। তাই তাপমাত্রার অতি সামান্য বৃদ্ধিও চিন্তার কারণ। তার মানে ২০১৫ সালে প্যারিস শীর্ষ সম্মেলনের অঙ্গীকার ব্যর্থ হতে চলেছে।[14]
দিন কয়েক আগে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষণায় জানা গেল যে, শিল্পসভ্যতাপূর্ব সময়ের চেয়ে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির বেশি যেন না বাড়ে— এই লক্ষ্য কাজে লাগতে পারে বরং ২ ডিগ্রি যেন পেরিয়ে না যায় তা সামলাতে। গ্রিনহাউস গ্যাস যতই কমুক তিরিশের দশকের প্রথমভাগেই বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে ১.৫ ডিগ্রি। আগামী দশকগুলিতে নিঃসরণ যতই কমুক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রিতে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ২০৬০ সালের মধ্যে পৃথিবী নিঃসরণশূন্য হয়ে গেলেও তার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশ। এর আগে আইপিসিসি জানিয়েছিল ২০৮০ সালের মধ্যে যদি নিঃসরণ শূন্যতে নিয়ে আসা যায় তাহলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি পেরোবে না।[15]
বিশ্বের উষ্ণতাবৃদ্ধিতে জলবায়ু বদলের প্রভাব আগে যেমন ভাবা হত তার চেয়ে হয়তো অনেক বেশি চরম হবে। এখনই জলবায়ু বদল তীব্র ও ব্যাপক হয়ে বাস্তুতন্ত্র (ইকোসিস্টেম) এবং মানুষের চরম সর্বনাশ ডেকে আনছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ঝড়, বন্যা, দাবানল ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয় তারই সাক্ষ্য। এত কম উষ্ণতা (১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বৃদ্ধিতে কিছুদিন আগেও যে চরম বিপর্যয় অসম্ভব বলে ভাবা হত তাই এখন ঘটছে। পর্বতের চূড়া, আর্কটিক, আন্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের বরফ হারানো, ক্রমাগত অরণ্য ধ্বংসের ফলে আবহাওয়ার চরম ঘটনা বিরামহীনভাবেই চলবে। যদি সার্থকভাবে নিঃসরণ কমিয়ে উষ্ণায়ন সীমাবদ্ধ করা যায় সেক্ষেত্রেও চরম আবহাওয়ার ঘটনা মানবসমাজকে গ্রাস করবে।
গত বছর (২০২২) ছিল চরম জলবায়ুর বছর। তাপমাত্রার তুমুল বৃদ্ধির জন্য বিদ্যুতের চাহিদা তুঙ্গে ওঠায় ক্যালিফোর্নিয়া কোনওক্রমে সর্বাত্মক ব্ল্যাক আউটের হাত থেকে বেঁচেছে। ২০২২ সালের জুন মাসে আমেরিকায় যে তাপপ্রবাহ বয়ে গিয়েছিল তার জন্য আমেরিকার পোর্টল্যান্ড ও সিয়াটেলের তাপমাত্রা বেড়ে হয়েছিল যথাক্রমে ১১৬ ও ১০৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৪৬.৭ ও ৪২.২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড)। কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার তাপমাত্রা পরপর তিনদিন ছিল ১২১ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৪৯.৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড)। যা বছরের সেই সময়ের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি এবং রেকর্ড। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব ছাড়া তা ঘটা অসম্ভব। তাপপ্রবাহ প্রতি বছরই নানা দেশে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ডেকে আনছে। পাকিস্তানে প্রথমে প্রবল তাপপ্রবাহ, পরে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। সরকারি হিসেবে বন্যায় ১৫০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, ৩.৩ কোটি মানুষকে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সেদেশে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। নাইজেরিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতেও চরম ও ব্যাপক বন্যা হয়েছে।
ওদিকে আর্কটিকের সমুদ্রের বরফ এতটাই কমে গিয়েছিল যা আগে কখনও হয়নি। ইউরোপে তাপপ্রবাহ রেকর্ড করেছে। জুলাই মাসে ব্রিটেন সহ ইউরোপের পনেরোটি দেশে তাপমাত্রা এমন বেড়েছিল যে তা একই বছর উত্তর আমেরিকার চরম তাপপ্রবাহের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ব্রিটেনের মেট অফিস জানিয়েছিল, সেদেশে ২০২২ সালই ছিল সবচেয়ে গরম বছর। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পাঁচশো বছরে ব্রিটেনে যে গড় তাপমাত্রা একবার দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তা প্রতি তিন-চার বছর অন্তর দেখা যাবে। ফ্রান্সের জাতীয় আবহাওয়া দপ্তর মেটিও ফ্রান্স জানিয়েছে, ১৯০০ সাল থেকে, দেশে তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে, ২০২২ সালই ছিল সবচেয়ে গরম। এছাড়া দশটি সবচেয়ে গরম বছরের মধ্যে ২০১০ সাল থেকে আটটি বছরই রয়েছে। ওই দপ্তর আরও জানিয়েছে যে, এই শতকের মাঝামাঝি থেকে ওই তাপমাত্রাই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। ইতালি এবং জার্মানিতেও গত বছরই ছিল সবচেয়ে গরম বছর।
২০২২ সাল ছিল পঞ্চম উষ্ণতম বছর। গত আট বছর ছিল দশটি উষ্ণতম বছরের মধ্যে আটটি। তিন বছর ধরে লা নিনার প্রভাব থাকা সত্ত্বেও ২০২২ ছিল অস্বাভাবিক উষ্ণ বছর। বিষয়টা খুবই চিন্তার, কারণ লা নিনার সময় তাপমাত্রা বাড়ার কথা নয়। তাপমাত্রার রেকর্ড, অভাবনীয় তাপপ্রবাহ, খরা, চরম বৃষ্টিপাত এবং বন্যার ঘটনার সঙ্গে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির সামঞ্জস্য রয়েছে। গড় তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তেই পৃথিবী জুড়ে আবহাওয়ার বিপর্যয় বেশি দেখা যাচ্ছে।
এ বছরের (২০২৩) জানুয়ারি মাসের শুরুতেই ইউরোপের কয়েকটি দেশে বসন্তকালের মতো তাপমাত্রা হয়েছে, ইউরোপের ইতিহাসে তা সবচেয়ে চরম ঘটনা। পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, বাইলোরুশিয়া এবং চেক রিপাবলিকে জানুয়ারির তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে। পোল্যান্ডে ছিল ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, জানুয়ারি নয় তা মে মাসের স্বাভাবিক তাপমাত্রা। সে দেশে জানুয়ারির গড় তাপমাত্রা হয় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, অর্থাৎ ১৮ ডিগ্রি বেশি। চেক প্রজাতন্ত্রে ওই সময়ের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হল ৩ ডিগ্রি, হয়েছিল ১৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জার্মানি, দক্ষিণ ফ্রান্স ও স্পেনের তাপমাত্রাও ছিল অনেক বেশি— ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
মানুষ ব্যাপকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো শুরু করার আগে বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইড ছিল ২৮০ পার্টস পার মিলিয়ন। আর ২০২২ সালে বার্ষিক গড় হয়েছে ৪১৭ পার্টস পার মিলিয়ন। অন্তত ২০ লক্ষ বছরে কখনও বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইড এতটা বাড়েনি। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে বেশিরভাগ দেশই শিল্প সভ্যতার আগের চেয়ে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, অন্তত ২ ডিগ্রির কমে বেঁধে রাখতে রাজি হয়েছিল। তার আগে আইপিসিসি জানিয়েছিল, ১.৫ ডিগ্রিই হল চূড়ান্ত সীমা। তার বেশি হলে চরম আবহাওয়ার ঘটনা খুবই বেড়ে যাবে, আবহাওয়ার অপরিবর্তনীয় বদল হবে। বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে বেধে রাখার লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে নিঃসরণ প্রায় অর্ধেক করে ফেলতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে।[16]
লা নিনা, এল নিনোর প্রভাব
পৃথিবীর আবহাওয়ায় লা নিনা ও এল নিনোর প্রভাবের কথা বলতে হয়। তার আগে বলা দরকার এল নিনো ও লা নিনা কী? কোনও কোনও বছর প্রশান্ত মহাসাগরে পেরুর উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠ কিছুটা উষ্ণ হয়ে ওঠে। তখন শুকনো আবহাওয়ার বদলে বর্ষা নামে, বজ্রপাত হয়। উষ্ণ সমুদ্রে মাছ উধাও হয়ে যায়। ক্রিসমাসের সময় এই ঘটনা ঘটে বলে স্প্যানিশ ভাষায় এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির নাম দেওয়া হয়েছে ‘এল নিনো’ (The Child Jesus)। আবার কখনও সমুদ্রপৃষ্ঠ অপেক্ষাকৃত শীতল হয়ে যায়। তখন বাতাস যেন বেশি শুকনো। সাধারণভাবে যতটুকু বৃষ্টি হওয়ার কথা তাও হয় না। এই অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ‘লা নিনা’ (The Girl)। কয়েকটি দেশে আবহাওয়ার এই আচরণের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জলবায়ুবিজ্ঞানীরা বোঝেন যে, এল নিনোর সময় মধ্য ও পূর্ব গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগর অপেক্ষাকৃত উষ্ণ হয়ে ওঠে। একই সময় পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এবং অস্ট্রেলিয়ার উত্তরের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কম হয়। সে সময় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন হয়, নানা দেশে খরা পরিস্থিতি দেখা দেয়। লা নিনার সময় মধ্য ও পূর্ব গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগর অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা হয়, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এবং অস্ট্রেলিয়ার উত্তরের সমুদ্রপৃষ্ঠ উষ্ণ হয়। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাইক্লোনের সংখ্যা বাড়ে, বৃষ্টিপাত বাড়ে। লা নিনার সময় পূর্বদিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রবল আয়নবায়ু বা বাণিজ্য বাতাস (ট্রেড উইন্ড) পশ্চিমে বিষুবরেখার দিকে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রের উপর পৃষ্ঠের উষ্ণ জল ঠেলে পশ্চিমে পাঠায় এবং গভীরের ঠান্ডা জল পূর্বদিকে আসে। আয়নবায়ু দুর্বল হলে প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণ জল ফের যখন পূর্বদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা কিছুটা বাড়ে তা-ই হল এল নিনো। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে তা শুষ্কতা আনে এবং তাপমাত্রা বাড়ে, তাই খরা ও দাবানলের ঘটনা বাড়ে। তবে সম্ভাব্য এল নিনোর মাত্রা কত হবে তা আগে থেকে জানা যায় না। প্রশান্ত মহাসাগরের তাপমাত্রা ও বাতাসপ্রবাহের প্রাকৃতিক দোলন অনুযায়ী এল নিনো বা লা নিনা হয়।
দুই থেকে সাত বছর অন্তর এই ঘটনা ঘটে। বজায় থাকে সাধারণত ন মাস থেকে দু বছর পর্যন্ত। উষ্ণায়ন এবং এল নিনো ও লা নিনাকে এক সঙ্গে ধরলে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বোঝা যায়। তবে নানা বছর এল নিনো বা লা নিনার তীব্রতায় তফাত থাকে। যেমন ১৯৯৫ সালের চেয়ে ১৯৮৮ সালের লা নিনা বেশি তীব্র ছিল। ১৯৯৭ সালের এল নিনো ছিল অতি প্রবল। দেখা গেছে এল নিনোর বছরে ভারত ও তার আশপাশের দেশে বৃষ্টির অভাবে খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়, কৃষি ও মৎস্যশিকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার লা নিনা ভারতের পক্ষে ভাল বৃষ্টির বার্তা বয়ে আনে।
গত তিন বছর ধরে লা নিনা চলেছে। জলবায়ু বদলের প্রভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এখন লা নিনার জন্য কিছুটা কম হচ্ছে, লা নিনা তা আড়াল করছে। তাতেই পৃথিবীর এই করুণ অবস্থা। বিজ্ঞানীরা পূর্বাভাসে বলছেন যে, ২০২৩ সাল হবে আগের বছরের চেয়ে গরম। এও সম্ভব যে এল নিনো শুরু হলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা সাময়িক ভাবে ১.৫ ডিগ্রি পেরিয়ে গেল। উত্তর গোলার্ধে তা শীতকালে শুরু হয়, প্রভাব টের পেতে পেতে কয়েক মাস লেগে যায়। ২০২২ সালে বিশ্বে যে তাপপ্রবাহ রাজ করেছে এল নিনো শুরু হলে তা ম্লান হয়ে যাবে। আজ পর্যন্ত সবচেয়ে উষ্ণ বছর ২০১৬ সাল ছিল বিপুল এল নিনোর বছর। এ বছর শেষের দিকে অথবা ২০২৪ সালে চালু হবে এল নিনো।
কম্পিউটার মডেল পরীক্ষা করে অস্ট্রেলিয়ার ব্যুরো অফ মেটিওরোলজি জানিয়েছে, তিন বছর ধরে গড়ের বেশি বৃষ্টিপাতের বদলে এল নিনোর শুরু হলে দেশটিতে গরম ও শুষ্কতার সঙ্গে চরম তাপপ্রবাহ, খরা ও দাবানল শুরু হবে। আমেরিকার ন্যাশনাল ওসানিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জানিয়েছে ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে এল নিনো শুরু হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৬৬ ভাগ। এল নিনোর সময় ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বৃষ্টি কম হতে পারে। পূর্ব আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকায় (সাম্প্রতিক খরা কবলিত) বৃষ্টি বেশি হয়ে বন্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু অ্যামাজন হবে শুষ্ক।[17]
বরফের রাজ্যে উষ্ণায়নের প্রভাব
ওদিকে আর্কটিক, গ্রিনল্যান্ড, আন্টার্কটিকাও কিন্তু বদলে যাচ্ছে। ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্র উষ্ণ হচ্ছে বলে প্রতি বছর আন্টার্কটিকা গড়ে ১৫ হাজার কোটি টন এবং গ্রিনল্যান্ড ২৮ হাজার কোটি টন বরফ হারাচ্ছে। তা জল হয়ে সমুদ্রে এসে সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু করে তুলছে। পৃথিবীর শতকরা দশভাগ ঢাকা থাকে বরফের হিমবাহে। এখানে বলে রাখি, সমুদ্রের বরফ সমুদ্রেই তৈরি হয় এবং গলে, গ্লেসিয়ার বা হিমবাহ তৈরি হয় ভূমিতে, আইসবার্গ বা হিমশৈল হল হিমবাহ থেকে ভেঙে এসে সমুদ্রে ভাসমান বিশাল বরফখণ্ড। সমুদ্রের বরফ গললে জলের স্তর উঁচু হয় না, তবে ওয়ালরাস বা মেরুভল্লুকদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়।
হিমবাহ, সমুদ্রের বরফ যত বেশি গলবে, উষ্ণ সমুদ্র এবং সমুদ্রস্রোত পৃথিবীর আবহাওয়ার ধরন বদলে দেবে। উপকূল জলে ভাসবে, ঝড় হয়ে উঠবে মারাত্মক। আটলান্টিকে এখন তাই-ই হচ্ছে। তাতে শুধু উপকূলের মানুষই নয়, নিজেদের থাকার জায়গা হারিয়ে, সিন্ধুঘোটক (walrus), পেঙ্গুইনরাও বিপন্ন হচ্ছে।
আর্কটিক
আর্কটিকের তাপমাত্রা বিশ্বের তাপমাত্রার চেয়ে চারগুণ দ্রুত হারে বাড়ছে। সেখানকার ইউরেশিয়ান সেক্টরের তাপমাত্রা বাড়ছে প্রায় সাতগুণ। শীতকালে সূর্যহীন আর্কটিকেও তাপপ্রবাহ দেখা দিচ্ছে, যা ইউরোপে তুষারঝড়ের কারণ। বিজ্ঞানীরা চিন্তিত, কারণ পোলার ভোর্টেক্স (শক্তিশালী বাতাস যা বরফজমাট উত্তরমেরুকে অক্ষুণ্ণ রাখে) ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উত্তরমেরু মার্চ মাস পর্যন্ত সূর্যের আলো পায় না, কিন্তু গরম হাওয়ার অন্তঃপ্রবাহের (influx) জন্য সাইবেরিয়ায় ফেব্রুয়ারি মাসের তাপমাত্রা গড়ের চেয়ে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হয়েছে।
শীতকালে আর্কটিক সমুদ্রের বরফ সাধারণত এক থেকে পাঁচ মিটার পুরু হয়। ঝকঝকে তুষারের পরতে তা ঢাকা থাকে, যেখানে সৌর বিকিরণের ৮৫ শতাংশ প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায়। সমুদ্র ফটফটে সাদা বরফে ঢাকা থাকলে সৌরতাপের শোষণ কম হয়। উল্টোটা ঘটে খোলা সমুদ্রে। বরফের তুলনায় অন্ধকার সমুদ্রপৃষ্ঠে ৯০ শতাংশ সূর্যরশ্মি শোষিত হয়। গরমের সময় সমুদ্রের বরফ গললে শোষণ বাড়ে, যত গলছে তুলনায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে সূর্যরশ্মির শোষণ বাড়ে, জলের তাপমাত্রা বাড়ে, তা আরও বরফ গলিয়ে দেয়, ফলে সমুদ্র আরও উষ্ণ হয়, এইভাবে পজিটিভ ফিডব্যাক চালু হয়। বরফ ঢাকা সাদা অঞ্চল এবং অন্ধকার সমুদ্রপৃষ্ঠে সূর্য রশ্মির দু ধরনের আচরণ আঞ্চলিক এবং বিশ্বের জলবায়ুতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এরই মধ্যে আর্কটিক সমুদ্রের সবচেয়ে পুরনো ও পুরু বরফের ৯৫ শতাংশ গলে হারিয়ে গেছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮৯ সালের চেয়ে ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে আর্কটিকে তুষারপাতের চেয়ে বরফের গলন বেড়েছে শতকরা ১৪ ভাগ। এই গ্রহের বাকি অঞ্চলের চেয়ে আর্কটিক অনেক দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এভাবে সমুদ্র ও বাতাসের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে গ্রীষ্মকালে আর্কটিক পুরোপুরি বরফমুক্ত হয়ে যাবে। আর্কটিকের (এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের) বাতাস ও সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ায় সমুদ্রস্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা পড়ছে। জেট স্ট্রিমের পরিবর্তনে আর্কটিকের বাইরে ইউরোপ ও আমেরিকায় ঘন ঘন পোলার ভোর্টেক্স দেখা দিচ্ছে। আর্কটিকের দুষ্টচক্রে (vicious circle) উষ্ণায়নের প্রভাব বেড়ে যায় বলে ওই অঞ্চলের আবহাওয়াকে বলা হয় বিশ্ব-উষ্ণায়নের নির্দেশক।
আর্কটিকের হিমবাহের বরফও দ্রুত গলছে। ওদিকে অনেক অঞ্চলের ভূমিতে বরফজমাট তুন্দ্রার স্তর বা পার্মাফ্রস্ট রয়েছে। তাপমাত্রা যত বাড়ছে গ্রীষ্মকালে মাটির উপরের স্তর নরম হচ্ছে, সেখানে জৈবিক ক্রিয়া বাড়ছে, তা থেকে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড মিশছে। এর ফলে আর্কটিক আরও উষ্ণ হবে এবং আরও বেশি তুন্দ্রা গলতে থাকবে। সেখানকার তুন্দ্রায় কার্বনের পরিমাণ এতটাই যা এই গ্রহের তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়িয়ে দিতে পারে। অনাদিকাল ধরে মজুত তুন্দ্রা ব্যাপকভাবে নরম বা কাদা হওয়ার ত্বরণ হলে পজিটিভ ফিডব্যাক চালু হয়ে অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে, যাকে পার্মাফ্রস্ট কার্বন টাইম বম্ব বলা হয়। আগে মডেল নির্মান করে বিজ্ঞানীরা যেমন পূর্বাভাস করেছিলেন আর্কটিক তার চেয়ে অনেক দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, আজ যা আর্কটিকে ঘটছে তা কিন্তু শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।[18]
গ্রিনল্যান্ড
পৃথিবীর হিমবাহের আচ্ছাদন ভূমি ও সমুদ্রকে ঠান্ডা রাখার রক্ষাকবচ, তা অতিরিক্ত তাপরশ্মি প্রতিফলিত করে পৃথিবীকে ঠান্ডা রাখে। বিশ্বের ভূমির প্রায় ১০ শতাংশে রয়েছে হিমবাহ। সিংহভাগই রয়েছে আন্টার্কটিকায়, বাকিটা গ্রিনল্যান্ডে। গ্রিনল্যান্ডের বরফের চাদর ২০০৩ সালের চেয়ে এখন চারগুণ বেশি হারে গলছে। নিঃসরণ যদি বাড়তেই থাকে, এই শতকের শেষে তা আরও দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। উত্তর গোলার্ধের মধ্যে সেখানেই সবচেয়ে বেশি বরফ রয়েছে। যদি সবটা গলে যায় সমুদ্র ৭.৪ মিটার (প্রায় ২২ ফুট) উঁচু হবে। শীতকালে সেখানে যে পরিমাণ তুষারপাত হয় বরফ গলার হার যদি তার থেকে বেশি হয় তাহলে ক্রমেই বরফ টুপির (ice cap) পৃষ্ঠদেশ গলে নিচু হয়। এই ঘটনাকে বলা হয় স্মল আইসক্যাপ ইনস্টেবিলিটি।
২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত মধ্য-উত্তর গ্রিনল্যান্ডের বরফের পাটাতনের উপরের (iceself) তাপমাত্রা বিজ্ঞানীরা মেপে দেখেছেন, তা গত এক হাজার বছরের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। তাঁদের মতে, শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তীকালের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। যদি যেমন চলছে সেভাবেই চলে, এই শতকের শেষে গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলনে সমুদ্রের জলস্তর বাড়বে ১৯ ইঞ্চি। এখনই সেখানকার তাপমাত্রা বিংশ শতকের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছে, মধ্য-উত্তর গ্রিনল্যান্ডে দশ বছরের বেশি সময় ধরে ওই তাপমাত্রা বজায় রয়েছে (২০১৫ সালে প্যারিস শীর্ষ সম্মেলনে আগামীদিনে পৃথিবীর তাপমাত্রা তার বেশি বাড়তে দেওয়া হবে না বলে অঙ্গকার করা হয়েছিল)। আগে মনে করা হত তাপমাত্রা বৃদ্ধি ৪.৫ ডিগ্রি পেরোলে স্মল আইসক্যাপ ইনস্টেবিলিটি শুরু হবে। কিন্তু আর্কটিক যেরকম দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠছে তা থেকে মনে হয় গ্রিনল্যান্ডে আরও আগেই হয়তো তা ঘটবে।
২০১৮ সালে, আগে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে যা হয়েছে তার তিনগুণ সময় ধরে (৬১ ঘন্টা) গ্রিনল্যান্ডের তাপমাত্রা ছিল শূন্যের উপরে। বৃষ্টি, তুষারপাত, বরফের গলন ও জমাট বাধার ধরন এবং পরিমাণে তারতম্য হচ্ছে বলে মেরুভল্লুকদের পক্ষে খাদ্য শিকার করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানকার মানুষের বেঁচে থাকাও আগের চেয়ে কঠিন হয়েছে।[19]
আন্টার্কটিকা
২০১২ সাল থেকে আন্টার্কটিকা আগের দুই দশকের তুলনায় তিনগুণ বেশি হারে বরফ হারাচ্ছে। সেখানকার বরফের পাটাতন (iceshelf— হিমবাহের ঝুলন্ত অংশ) থেকে বিশাল বিশাল হিমশৈল (iceburg) ভেঙে পড়ছে। ২০২১-এর নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে পূর্ব আন্টার্কটিকায় অভাবনীয় তাপপ্রবাহে ক্যাসে স্টেশন গলে গিয়েছিল। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে আর্জেন্টিনার এস্পেরেঞ্জা গবেষণাকেন্দ্রের তাপমাত্রা বেড়ে হয়েছিল ১৮.৩ ডিগ্রি। আজ পর্যন্ত এটাই আন্টার্কটিকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
চারপাশের সমুদ্রও উষ্ণ হচ্ছে, দক্ষিণ সমুদ্রের কিছু অংশের তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ ডিগ্রি। উষ্ণ জলের অন্তঃপ্রবাহ (influx) যেখানে বেশি সেখানেই বরফ গলছে বেশি। গবেষকদের মতে, আগে যেমন ভাবা হত বরফের পাটাতনে সমুদ্রের উষ্ণ জলের প্রভাব সম্ভবত তার চেয়েও বেশি, বিশেষত পূর্ব আন্টার্কটিকায়। এছাড়া সেখানে বড় বড় হ্রদ তৈরি হয়েছে। তার ফলে সূর্যরশ্মির প্রতিফলন কমছে, বাড়ছে তাপরশ্মির শোষণ। তাই হিমবাহ গলনের হার বাড়ছে। সম্প্রতি পূর্ব আন্টার্কটিকার নিচে বড় হ্রদের সন্ধান পাওয়া গেছে। বেডরকের বদলে হিমবাহ জলের উপর ভেসে থাকলে বরফ গলে তাড়াতাড়ি। পাটাতনের উপরিপৃষ্ঠের গলনও এখন ব্যাপক। পাটাতন থেকে আবার অনেক হিমবাহ (outlet glacier) তৈরি হয়েছে। সেই হিমবাহ গলা জল দ্রুত সমুদ্রে এসে পড়ে। এই পরিবর্তন জলবায়ুর মডেলে ধরা হয়নি। তাই জলবায়ু বদল যদি চলতেই থাকে তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠ কয়েক মিটার বেড়ে যেতে পারে।
উপগ্রহের রেকর্ড ঘেটে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯০-এর গড়ের চেয়ে বরফের পাটাতন গলে যাওয়া ছ’গুণ বেড়েছে। আগে যা ছিল বছরে চার হাজার কোটি টন, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গড়ে তা হয়েছে পঁচিশ হাজার কোটি টন। রস আইস শেলফের একটি অংশের গলনের হার দশগুণ বেশি, যা গলে গেলে রস পাটাতনের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।
বরফের পাটাতন থেকে বিশাল বিশাল হিমশৈল ভেঙে পড়ছে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিমশৈল ‘এ৬৮’ লারসেন সি পাটাতন থেকে ভেঙে গেছে, যার ওজন এক লক্ষ দশ হাজার কোটি টন, আয়তন আমেরিকার ডেলাওয়ারের প্রায় সমান। ২০২২ সালের মে মাসে পাইন আইল্যান্ড হিমবাহ থেকে ওয়াশিংটনের দ্বিগুণ মাপের হিমশৈল ভেঙে গেছে। ওদিকে গবেষকরা থোয়াইট হিমবাহে আমেরিকার মানহাটানের দুই-তৃতীয়াংশ মাপের বিশাল গহ্বর আবিষ্কার করেছেন। গহ্বরে ১৪০০ কোটি টন বরফ ছিল। সমুদ্রের উষ্ণ জল ঢুকে তার বেশিটাই তিন বছরের মধ্যে গলে গেছে।
আন্টার্কটিকার চারধারে রয়েছে অতি ঠান্ডা ও লবণাক্ত জলের কনভেয়র বেল্ট যা পৃথিবীতে সামুদ্রিক তাপ ছড়িয়ে দেয়। ওদিকে ওই মহাদেশের জোরালো পশ্চিমা বাতাসের জন্য (যার মূল কারণ স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ওজনের স্তর কমে যাওয়া) বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণে দক্ষিণসমুদ্র খুবই কার্যকরী। ওজন হোল এবং উষ্ণায়ন আন্টার্কটিকার আবহাওয়ার ধরন বদলে দিয়েছে। তাই শক্তিশালী পশ্চিমা বাতাস উষ্ণ বাতাসকে আন্টার্কটিক উপদ্বীপের (Antartic peninsula— মূল মহাদেশ থেকে যে লম্বা পর্বতময় অংশ বেরিয়ে এসেছে) ২ হাজার মিটার উঁচু পর্বতমালার দিকে ঠেলে পাঠাচ্ছে। গ্রীষ্মকালে যখন এই ঘটনা ঘটে উপদ্বীপের উত্তরতম অংশের তাপমাত্রা প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়। উত্তরে জোরালো পশ্চিমি বাতাসের জন্যই গ্রীষ্মকালে সেখানে তাপ বেড়েছে এবং লারসেন পাটাতনের উত্তরদিক ছোট হয়েছে। ২০০২ সালে এই কারণেই বরফগলা জল লারসেন পাটাতনের নানা ক্রেভাসে গড়িয়ে পড়েছিল। তাই ২০০৬ সালে ওই পাটাতন ভেঙে পড়ে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে উপদ্বীপের তাপমাত্রা বেড়েছে গড়ে ৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই বৃদ্ধি বিশ্বের গড়ের তিনগুণের বেশি, একমাত্র আর্কটিকের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে তুলনীয়। একই সময়কালে উপদ্বীপের পশ্চিমের কাছের তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রির বেশি। আন্টার্কটিক বৃত্তাকার সমুদ্রস্রোতের জল গড় সমুদ্রের জলের চেয়ে বেশি হারে উষ্ণ হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আন্টার্কটিকার বরফের গলন, সমুদ্রে জলের প্রবাহের ধরন ও ঘন ঘন চরম ঘটনা পরস্পর সম্পর্কিত। এখন গোটা আন্টার্কটিকাতেই যেন জলবায়ু বদলের ছবি আঁকা রয়েছে। তাই নতুন করে আন্টার্কটিকার মানচিত্র আঁকার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
আন্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের বিপুল পরিমাণ অতি ঠান্ডা হিমবাহ ও বরফগলা জল উষ্ণ সমুদ্রে মিশে সমুদ্রস্রোতকে ঠান্ডা করে দিচ্ছে। সমুদ্রের প্রবাহ বদলে যাচ্ছে। পৃথিবীর আবহাওয়া বদলে দিচ্ছে। উপকূলে ঝড় ও বন্যা ঘন ঘন ও তীব্র হচ্ছে। এই বদল পৃথিবীর ভবিষ্যৎ বদলের পূর্বাভাস। ফিশারিতেও বিরাট বদল হচ্ছে। কোথায় ও কখন মাছ বড় হবে তাও বদলে যাচ্ছে। সিন্ধুঘোটক (walrus) তাদের ঘর হারাচ্ছে, মেরুভল্লুক (polar bear) ভূমিতে বেশি সময় থাকছে, মানুষের সঙ্গে সংঘাত বাড়ছে। আন্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ড দ্রুত গলছে বলে হিমবাহ গলা ঠান্ডা জল উষ্ণ সমুদ্রে মিশে সমুদ্রস্রোতকে ধীর করে দিচ্ছে। আন্টার্কটিকার বরফের গলন সমুদ্রের জলস্ফীতি ঘটিয়ে এখনই নানা দেশের নিচু উপকূলের বাসিন্দাদের জীবন কঠিন করে তুলছে।[20]
আমাদের দেশ
কোনও অঞ্চলের উষ্ণায়ন শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সাড়া পৃথিবীকেই প্রভাবিত করে। উষ্ণায়ন থেকে পৃথিবীর কোনও অংশই রেহাই পায়নি। তারপরও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বৃদ্ধিই থামেনি। নিঃসরণশূন্য করার অবস্থা থেকে আমরা বহু দূরে। এরপরও ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের শীর্ষ সম্মেলনে নিঃসরণ কমানো নিয়ে আলোচনা পণ্ড হয়ে গেল। তাই শুধু লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে আহ্লাদিত হওয়া অর্থহীন। আজ থেকেই যদি নিঃসরণ বন্ধ হয় তাহলেও মারাত্মক তাপপ্রবাহ, বন্যা, দাবানল, অতি প্রবল ঝড়, পর্বত ও মেরুপ্রদেশের বরফ গলা, সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে যাওয়া বন্ধ হবে না। যা চলছে তাই কি যথেষ্ট আতঙ্কজনক নয়? অথচ আমরা যেন বসে আছি আরও ভয়ঙ্কর দিনের অপেক্ষায়!
বাংলার মানুষের একটা সুবিধা এই যে, উষ্ণায়নের জেরে জলবায়ুর যেটুকু পরিবর্তন এখানে হয়েছে তা তেমন মারাত্মক নয়। তাই আমরা দৈনন্দিন জীবনে টের পাই না যে পৃথিবী সর্বনাশের দোরগোড়ায় রয়েছে, আমাদের হুঁশ হয় না। যেন বালিতে মুখ গুঁজে বসে আছি। একপ্রান্তে রয়েছে সুন্দরবন। দিনে দিনে জলস্ফীতিতে ডুবছে, অচিরেই তা বিভীষিকা হয়ে দাঁড়াবে। মনে মনে ভাবি, সে তো সেখানকার গরিব মানুষের সমস্যা, তাতে আমাদের কী? অভাগা মানুষগুলো যখন ঘর ছেড়ে এই শহরে এসে মাথা গোঁজবার চেষ্টা করবে আমরা বলব, গেঁয়ো গরিবগুলো শহরটার বারোটা বাজাল।
দেশে কিছু আয়োজন শুরু হয়েছে, ভারতের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ৬০ হাজার মেগাওয়াট পেরোলেও আমাদের রাজ্যে তা ৩০০ মেগাওয়াটের বেশি নয়। অর্থাৎ এ রাজ্যে সৌরবিদ্যুতের আয়োজন তেমন নেই বললেই চলে। কয়লাবিদ্যুতের নিঃসরণের কথা দূরে থাক, বায়ুদূষণে দেশের মধ্যে এই শহর একেবারে উপরের দিকে, তাও পারলে শাসকরা অস্বীকার করে, কী করে কমানো যায় তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
বিপদের কথা ভেবে জীবনযাপন চালচলনের পরিবর্তনের চেষ্টা আমাদের নেই। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করার জন্য আওয়াজ তুলি না, বেপরোয়াভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি, সুযোগ পেলে কিংবা গায়ে পড়ে জানাই এত হাজার টাকার বিল এসেছে। সে তো আমার স্বাচ্ছল্যের পরিচয়, বিদ্যুৎ খরচ করি আমার টাকায়, তাতে রাশ টানব কেন? গাড়ি কিনি, পারলে দুটো কি তিনটে, আমার সামাজিক সম্মান বাড়ে! নিঃসরণ, দূষণের ভাবনা বনের মোষ তাড়ানো পরিবেশবিদদের জন্য তোলা থাক। তারা জলাভূমি ভরাট, নদীর অপমৃত্যু, গাছ কাটা বন্ধ করা, শব্দদূষণ কমানো নিয়ে লোকের মাথা খাচ্ছে। সে নয় হল, কিন্তু আমার মুরোদ আছে যত খুশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করব, যত খুশি পেট্রল পোড়াব, তা নিয়ে লোকের কথা শুনব কেন?
[1] CO2 Emissions by year. Worldometers.
[2] Hausfather, Zeke. Global CO2 emissions have been flat for a decade, new data reveals. Carbon Brief. Nov 4, 2021.
[3] Global CO2 Emissions Rebounded to Their Highest Level in History in 2021. External Press Release, UN Climate Change. Mar 9, 2022.
[4] Stanway, David. China’s CO2 emissions fall but policies still not aligned with long-term goals. Reuters. Nov 21, 2022.
[5] The world’s coal consumption is set to reach a new high in 2022 as the energy crisis shakes markets. IEA. Dec 16, 2022.
[6] Record clean energy spending is set to help global energy investment grow by 8% in 2022. IEA Press Release. Jun 22, 2022.
[7] Renewable Capacity Statistics 2021 & Renewable Capacity Statistics 2022. IRENA.
[8] Lombrana, Laura Millan. COP27 Averts Collapse as Historic Fund Resets Rich-Poor Balance. Bloomberg. Nov 21, 2022.; Kaya, Nuran Erkul. Political will crucial to limit global warming, yet leaders not following science: Scientist. AA. Nov 17, 2022.; Harvey, Fiona. World still ‘on brink of climate catastrophe’ after Cop27 deal. The Guardian. Nov 20, 2022.; Harvey, Fiona. What are the key outcomes of Cop27 climate summit? The Guardian. Nov 20, 2022.
[9] Executive Summary: World Energy Outlook 2022. IEA.
[10] Xue, Yujie. China seen accelerating wind, solar power installation under 5-year plan, reaching 2030 renewable target ahead of time. South China Morning Post. Jan 8, 2023.; Shaw, Vincent. China aims to add 160 GW of wind, solar capacity in 2023. PV Magazine. Jan 3, 2023.
[11] Electricity generation, capacity, and sales in the United States. U.S. Energy Information Administration.; Carbon emissions dropped in 2020. Much of the decrease was due to less driving and fewer flights. USA Facts.; Stokstad, Erik. Surprise climate bill will meet ambitious goal of 40% cut in U.S. emissions, energy models predict. Science. Aug 1, 2022.; Dinneen, James. US action on climate change will start to get serious in 2023. New Scientist. Jan 3, 2023.; Puko, Timothy. Delays plague Biden’s push for rapid action on climate change. The Washington Post. Jan 19, 2023.
[12] Radowitz, Bernd. ‘New dynamic in expansion’, Germany adds nearly 10GW of wind and solar in 2022. Recharge. Jan 3, 2023.
[13] EU coal rebound smaller than feared in 2022 energy crunch. ET EnergyWorld. Jan 31, 2023.
[14] Dance, Scott. A new climate reality: Less warming, but worse impacts on the planet. The Washington Post. Jan 6, 2023.
[15] Garthwaite, Josie. Earth likely to cross critical climate thresholds even if emissions decline, Stanford study finds. Stanford News. Jan 30, 2023.; Diffenbaugh, Noah S. & Barnes, Elizabeth A. Data-driven predictions of the time remaining until critical global warming thresholds are reached. Ed. Mann, Michael. PNAS. Jan 30, 2023.
[16] Kottasová, Ivana. ‘A world rapidly warming’: The past eight years were the eight warmest on record for planet. CNN. Jan 10, 2023.; Hughes, Rebecca Ann. Climate change: Why is Europe experiencing a January heat wave? Euronews. Jan 3, 2023.; Vital signs, Global Climate Change. NASA.
[17] Carrington, Damian. Warning of unprecedented heatwaves as El Niño set to return in 2023. The Guardian. Jan 16, 2023.; Trascasa-Castro, Paloma. Four possible consequences of El Niño returning in 2023. The Conversation. Jan 26, 2023.
[18] Bamber, Jonathan. The Arctic is warming nearly four times faster than the rest of the world. How concerned should we be? World Economic Forum. Aug 15, 2022.; Rantanen, Mika. et al. The Arctic has warmed nearly four times faster than the globe since 1979. Nature. Aug 11, 2022.; Srivastava, Varnika. Why the melting of the Arctic ice matters to India. Business Insider India. Aug 19, 2022.; Vital Signs: Arctic Sea Ice Minimum Extent. NASA.; Melecio-Zambrano, Luis. Melting ice created the perfect storm for a rapidly acidifying Arctic Ocean. Mongabay. Dec 7, 2022.; দত্ত, প্রদীপ। জলবায়ু বদলে যাচ্ছে: পৃথিবী বিপন্ন। কলকাতা: গাংচিল। ২০১৫।
[19] Pulver, Dinah Voyles. Greenland sees hottest temps in 1,000 years. How its melting ice sheet has major impact on sea level. USA Today, Jan 18, 2023.; Hancock, Lorin. Why are the glaciers and sea ice melting? WWF.
[20] Turner, John & Bracegirdle, Thomas. Antarctica and climate change. British Antarctic Survey. Jun 30, 2022.; Levin, Kelly. 5 Visible Signs of Climate Change in Antarctica. World Resources Institute. Apr 10, 2020.