Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪: অমৃত নয় গরলের উদযাপন

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 



প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী

 

 

 

প্রথম পিরিয়ডের পর যখন কমনরুমে এলাম তখন টানটান উত্তেজনা। সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ মোবাইলের স্ক্রিনে। কেন্দ্রীয় বাজেট পড়ছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। আজাদির এই অমৃত মহোৎসবে বাজেটের নামেও অমৃতের ছোঁয়া। সরকারি কর্মচারী হোক বা শিক্ষক, বাজেট মানেই আয়কর ছাড়ের গল্প। তাই আয়কর ছাড়ের ঊর্ধ্বসীমা বাড়তেই চাপা উল্লাস সবার চোখমুখ জুড়ে। তবে গণিত শিক্ষকের বিধিবদ্ধ সতর্কবার্তার ফলে সেই উল্লাস দীর্ঘস্থায়ী হল না। কিছুদিন আগে চাকরি পেয়েছেন এমন এক তরুণ শিক্ষক দামি ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোনের দাম অনেকটা কমতে পারে শুনে যারপরনাই পুলকিত হয়েছিল কিন্তু আমাদের মত বুড়ো ঘুঘুদের কাছে সেটা প্রকাশ করা ঠিক হবে কি, না-বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেল। আর এই ধরনের কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া আলোচনায় শেষ হয়ে গেল মধ্যবিত্ত, মাসমাইনের নিরাপত্তায় মোড়া মানুষদের কাহিনি। কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য যদি আমরা জনসংখ্যার সর্বোচ্চ দশ শতাংশের এই কিসসাকে সরিয়ে রেখে বাকি নব্বই শতাংশের ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে দেখি, যেখানে বাস করে কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তাহলে বাজেটের গল্পটা অন্যরকম হতে বাধ্য। এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট কী বার্তা বয়ে এনেছে এই মানুষদের জন্য? বাজেট মানে তো  নিছক আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, তা আসলে সরকারের ভাবনার, তার মতাদর্শের, তার কাজের ইস্তেহার। সেই আলোকে এবারের বাজেটকে দেখে নেওয়ার প্রয়াস এই নিবন্ধ। তবে সেই আলোচনায় প্রবেশের আগে একটা কথা মনে রাখা দরকার। এই চরম মুদ্রাস্ফীতির সময় কোনও একটি খাতে দশ শতাংশের কম বরাদ্দ বৃদ্ধির অর্থ আদতে কোনও বৃদ্ধি না হওয়া। আর বেশ কিছু বছর ধরে দেখা যাচ্ছে বাজেট প্রস্তাবে যে টাকা বরাদ্দ হয়, বছরের শেষে ছাঁটাইয়ের ফলে প্রকৃত ব্যয় হয় তার চেয়ে অনেক কম। বিশেষ করে জনকল্যাণমূলক ক্ষেত্রগুলোতে এই প্রবণতা দিনের পর দিন বাড়ছে।

 

দুই.

এবারের বাজেটে সবচেয়ে বড় আঘাত নেমেছে গ্রামভারতের জীবনরেখা একশো দিনের রোজগার যোজনায়। এই প্রকল্প সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদির বিরাগ সর্বজনবিদিত। ক্ষমতায় আসার পর তিনি এই প্রকল্পকে গর্ত খোঁড়ার প্রকল্প বলে উপহাস করেছিলেন। অথচ অতিমারির সময়ে এই প্রকল্পের কারণে গ্রামভারতে নির্বোধ লকডাউনজনিত আর্থিক বিপর্যয়কে কিছুটা হলেও সামলানো গেছিল। আজ চাহিদা কমের দোহাই দিয়ে এই প্রকল্পকে গুরুত্বহীন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল মোদি সরকার। এই আর্থিক বর্ষে এই প্রকল্পে ৮৯,৪০০ কোটি টাকা খরচ করা হলেও এবারের বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ৬০,০০০ কোটি টাকা, সাধারণ অঙ্কে ৩৩ শতাংশ কম। আশঙ্কা থাকছে বছর শেষে প্রকৃত ব্যয়-বরাদ্দ আরও কমে যাওয়ার। কেউ কেউ চাহিদা কমে যাওয়ার গল্পে বিশ্বাস রাখছেন— তাঁদের জন্য কিছু পরিসংখ্যান দেওয়া যেতে পারে। এবছরও এই প্রকল্পে ৮ কোটি লোক কাজ করেছেন। অতিমারি-পূর্বে (২০১৯-২০) এই প্রকল্পে কাজ করেছিলেন ৭.৯ কোটি মানুষ। আর অতিমারি-সময়ে বিশেষ পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে ১১.২ কোটি এবং ২০২১-২২ আর্থিক বর্ষে ১০.৬ কোটি মানুষ একশো দিনের রোজগার যোজনায় কাজ করেছিলেন। তাই বলা যায় সাধারণ পরিস্থিতিতে এই প্রকল্পে ৮-৯ কোটি মানুষ কাজ করতে পারে। এই প্রকল্পের ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ার অর্থ গরিব মানুষের পেটে লাথি মারা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

 

তিন.

জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের একটা বড় দায় হল তার সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। কিন্তু ক্রমাগত কর্পোরেট ভজনা করতে গিয়ে সরকারকে আজ সেই সমস্ত প্রকল্পগুলোতে সঙ্কোচন করতে হচ্ছে। সরকারের ন্যাশনাল সোশাল অ্যাসিসটেন্স প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা প্রভৃতি। গত বাজেটে এক্ষেত্রে বরাদ্দ ছিল ৯,৬৫২ কোটি টাকা। এবছর তা বাড়ানো তো হলই না বরং কমিয়ে করা হল ৯,৬৩৬ কোটি টাকা অর্থাৎ ০.১৭ শতাংশ হ্রাস। এরকমই এক প্রকল্প হল ‘আজীবিকা’ (ন্যাশনাল লাইভলিহুড মিশন)। সেক্ষেত্রেও ব্যয়বরাদ্দ ০.৭৫ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে।

 

চার.

বিগত অতিমারি দেখিয়েছিল ভারতে স্বাস্থ্যব্যবস্থার অতি ভঙ্গুর অবস্থা। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির সুপারিশ ছিল স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির ৩.৫ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ যা এবারও অধরা থেকে গেল। সরকার দাবি করছে পূর্ববর্তী বাজেট বরাদ্দ ৮৩,০০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮৬,১৭৫ কোটি টাকা করা হয়েছে যার অর্থ ৩.৮২ শতাংশ বৃদ্ধি। কিন্তু ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের ৫.৫ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতিকে হিসেবের মধ্যে ধরি তাহলে বৃদ্ধির স্বরূপ উন্মোচিত হবে। তথ্যের খাতিরে এটাও মনে রাখা দরকার যে স্বাস্থ্যখাতে গত বছর ৮৩,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ৭৬,৩৭০ কোটি টাকা। এবারেও একই আশঙ্কা থাকছে। প্রসূতি, সদ্যোজাত ও শিশুর স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে বয়ঃসন্ধিকালের স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, পরিবার কল্যাণ, টিকাকরণ, কুষ্ঠ ও অন্ধত্ব নিবারণ প্রভৃতি বিষয়গুলিকে এক ছাতার তলায় এনে ২০০৫ সালে পথ চলা শুরু করেছিল রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য মিশন। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার মেরুদণ্ডস্বরূপ এই মিশনের গুরুত্ব ও বরাদ্দ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৩৬,৭৮৫ কোটি টাকা যা পূর্ববর্তী বাজেট থেকে ৩৭৫ কোটি টাকা কম। টাকার অঙ্কে বাজেটবরাদ্দ ১০ শতাংশ কমে গেলেও মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করলে ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১৬ শতাংশ। এছাড়া এইমস ধাঁচের যে প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল, সেই খাতে গত বছরে ৯,৪১১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও এবছর ৬৫ শতাংশ কমিয়ে তা করা হয়েছে ৩,৩৬৫ কোটি টাকা মাত্র।

 

পাঁচ.

আজ এই ২০২৩ সালেও একথাটা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে এদেশের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত। আর সেই কৃষকদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম মোদি সরকারকে বাধ্য করেছিল কর্পোরেটবান্ধব কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে। নরেন্দ্র মোদি কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু বিগত অভিজ্ঞতা আমাদের এই সরকারের কৃষকবিরোধী চরিত্রকে বারবার উন্মোচিত করেছে। এবারের বাজেটকে এককথায় বলা যায় কৃষকবিরোধী এক ইস্তেহার। ২০২২-২৩ আর্থিক বর্ষে সরকারের কৃষিবাজেট ছিল ১,২৪,০০০ কোটি টাকা যা এই বছর কমিয়ে করা হয়েছে ১,১৫,৫৩১ কোটি টাকা। বিষয়টা একটু ক্ষেত্রভিত্তিক বুঝে নেওয়া দরকার।

ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের প্রতিবছর কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এককালীন ছয় হাজার টাকা অনুদান দেওয়ার কথা (কিষান সম্মান নিধি)। সরকারের দাবি এই টাকাতে ১২ কোটি কৃষক উপকৃত হন। এ বাবদ গত বাজেটে ব্যয়বরাদ্দ ছিল ৬৮,০০০ কোটি টাকা যা এবছর কমিয়ে করা হল ৬০,০০০ কোটি (১২ শতাংশ হ্রাস)। কিষান সিচাই যোজনায় ব্যয়বরাদ্দ ১২,৯৫৪ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ১০,৭৮৭ কোটি টাকা (১৭ শতাংশ হ্রাস)। বহুবিজ্ঞাপিত প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার বরাদ্দ ১৫,৫০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ১৩,৬২৫ কোটি টাকা। সারের ভর্তুকিও ভয়ঙ্করভাবে কমানো হয়েছে যার ফলে কৃষকদের চাষের খরচ আরও বাড়বে। ইউরিয়া সারের ক্ষেত্রে ভর্তুকি গত বাজেটে ছিল ১,৫৪,০৯৪ কোটি টাকা যা এবছর কমে হয়েছে ১,৩১,১০০ কোটি টাকা (১৫ শতাংশ হ্রাস)। পোষকভিত্তিক সারের ক্ষেত্রে ৭১,১২২ কোটি টাকা কমে হয়েছে ৪৪,০০০ কোটি টাকা (৩৮ শতাংশ হ্রাস)। কর্পোরেট লবির চাপে ও নীতি আয়োগের সুপারিশ মেনে গণবন্টন ব্যবস্থাকে দুর্বল করার জন্য ফসল সংগ্রহ ও পরিবহনের খরচ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ২.১৫ লক্ষ কোটি থেকে ১.৩৭ লক্ষ কোটি টাকায় (৩৮ শতাংশ হ্রাস)। রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনার ব্যয়বরাদ্দ ১০,৪৩৩ কোটি টাকা থেকে কমে ৭,১৫০ কোটি টাকা হয়েছে। আর সারা দেশে সবুজ বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে সরকারপক্ষের আর কোনও উচ্চবাচ্য নেই।

 

ছয়.

আমাদের দেশের শিশুদের পুষ্টিহীনতা এক উদ্বেগের বিষয়। সেই অপুষ্টি রোধে গণ আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকারকর্মীরা সরকারকে বাধ্য করেছিলেন মিড ডে মিল চালু করতে যার উপকারিতা সর্বজনস্বীকৃত। প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের মিড ডে মিল খাতে ২০২২-২৩ আর্থিক বর্ষে বরাদ্দ ছিল ১০,২৩৩ কোটি টাকা। এই খাতে গত বছর অক্টোবরে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকে পড়ুয়া পিছু যথাক্রমে ৪৮ ও ৭০ পয়সা বাড়ানো হয়। ফলে সংশোধিত বাজেটে মিড ডে মিলে বরাদ্দ বেড়ে হয় ১২,৮০০ কোটি টাকা। নতুন আর্থিক বর্ষে তা কমে হল ১১,৬০০ কোটি টাকা। আবার দেশের অন্যতম শিশু কল্যাণ প্রকল্প আইসিডিএসের (সুসংহত শিশু উন্নয়ন প্রকল্প) ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ ২০,২৬৩ কোটি টাকা থেকে ২০,৫৫৪ কোটি টাকা করা হয়েছে যা মুদ্রাস্ফীতির হিসাবে ঋণাত্মক বৃদ্ধির উদাহরণ।

 

সাত.

এ কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বাজেট এক ইস্তেহার যা শাসকদলের মতাদর্শ, ভাবনা ও লক্ষ্যকে নির্দিষ্ট করে। এই বাজেটের প্রধান লক্ষ্য কর্পোরেট স্বার্থকে নিশ্চিত করা। তাই ধনীদের উপর কর বসানো, কর্পোরেট কর বৃদ্ধির মতো দাবিগুলোর মান্যতা নেই, যেমন নেই আর্থিক ঘাটতি মেটানোর কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। এই অবস্থায় সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থরক্ষা করে এক জনমুখী বাজেট তৈরি করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এইজন্য সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের স্বার্থরক্ষা মোদি সরকারের জরুরি কর্তব্য নয়। জনবিরোধী বাজেট তৈরি করে নির্মলা সীতারামন সেই সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করলেন।