সোমেন বসু
“কী শাক আন্ধলু গে মাই… জলন…?”
আন্ধে নাই কিছু। সকালবেলা চাট্টি ভাত ফুটায়ে থুইছে, ওইলাই। গতরটা ক্যানং ভারী নাগে এখন জলনের। থসথসায়। এই যে ঘরের পুবমুখো ধাপখানত্ বাঁশের খুঁটিখানে ঠেস দে বসে ছে তো ছেইএ, পুব পাড় দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বয়ে যাওয়া চিকন নদীটার বুক থেকে সুট সুট বাতাস ওর আপাত ভারী গতরখানের আনাচ কানাচ দে সুড়সুড়ায়ে যাছে, এটোই ভালো নাগছে বড়। এনং করেই বসে থাকবা ম্যানাছে। মামীর কথাটার উত্তর দিবারও মন করছে নি।
কিন্তু জবাব দিবা হবে। নদী থেকে যে সরু পায়েচলা দামালখান পচ্চিমমুখে এসে এই ঠিক জলনী-সকালুর বাড়ির পাশ দিয়ে দক্ষিণে ঘুরে টোলাখানত্ যায়ে ঢুকিছে, ঠিক ওই ঘ্যাংটোত্ থাড়ো ছে কালো হিলহিলে শরীরটো। হেঁটুয়ালার নীচ অব্ধি, শাড়ির পাড়খান, ভেজা। নদীত্ উগনাই জল। হাতের রশিত্ কালো খোসিটো। ঝুলুক ঝুলুক পাশে চান্দির ধানক্ষেতে যাবা চাহছে…
“খোসিশাক গে! খাবু?” তারপর হেসে, “কী আর শাক আন্ধিম! ভাত সিজায়ে থুইছি… করিম কিছু একটা সানা টানা…”
“কাঁকড় মিলছে এলায়ও নদীটোত্… যা না… নে আয় ক্যাটা… সানা করে নিস তাহে…”
“ক্যাতো আর কাঁকড় খাম… স্বাদও নাই… মাঘ মাসে কাঁকড়লাত্ স্বাদ হয়…”
“তখন পাবু কেদুর? কুন যে গাঁড়াত্ ঘুষে…”
মামীও বসল ধাপের এক কোণায়। শাড়ির আঁচল দিয়ে একটু মাটি ঝেড়ে নিয়ে। খাসিটাকে বেঁধে দিল একটা বাঁশের খুঁটির সাথে। পাশের কাঁঠাল গাছ থেকে একটা পাতাভরা ডাল ভেঙে দিয়ে দিল সামনে। ব্যস্ত থাকবে। নইলেই এর ওর ধানক্ষেতে ঢোকাঢুকি। বড়লোকদের মুখ ঝামটানি। খোঁয়াড়ে দেওয়ার হুমকি। নজর রাখতে হয় সব সময়….
এই ধাপটা বারোয়ারি গোছের। টোলার শেষ বাড়ি। এ পাশটা ফাঁকা… নদী…। সারাক্ষণই বাতাস আসে। সকালু বাতাস খাবে বলেই বানিয়েছিল ধাপটা বেশ বড় করে। যারাই এ পাশে যায়, জমিটমিতে কাজে, এখানে বসে দু দণ্ড জিরোয়। একটু বিড়ি টিড়ি খাওয়া, দুটো আংবাং গল্পসল্প…। বৃষ্টিবাদল না হলে সকালু-জলন এখানেই ঘুমোত রাতে। সকালু মরে যেতে জলন এখন ঘরেই শোয়।
মামীক্ দেখে অ্যাগনা জলন। গ্রামসম্পর্কে মামী, নইলে বয়স খুব বেশি এদিকওদিক নাহে। গ্রামসম্পর্কেও না, সকালুর সম্পর্কে। ওর আসলে মামীশাশুড়ি। নইলে নিজের কাকী হবে। একই গুতিয়া ওমরা। তিনতালুর বাপের বাপ, আর ওর দাদু ভাই ছিল। তিনতালের মা মরিছিল মেলাই দিন। জলনরা তখন ছোটই। অত ফোম পড়ে না। ওই আগিলা কাকীটোর বেটাবেটির মধ্যে তিনতাল ছোট। আরও তিনজন ছে ওর উপর। তারপর এমরালা ছোট থেকে সব গাবুর হই গেল্, সেই সময়ে হঠাত কাকা একদিন এই মামীটোক বেহা করে আনিল্। কচি বয়স তখন মামীর, তিনতালের বাপের চেয়ে মেলাই ছোট। দুইখান ছোয়া ফুটায়ে কাচুয়া ছোয়া, কাচুয়া গাবুর বউ থুইহানে বুড়া মরিল্। আর তারপর শুরু হল্ তিনতালের সাথে সৎ মা’র নটঘট। কম কাপালকাইচ সে নিয়ে টোলাত্? বাপরে…
কিন্তু ওরও কি হছে এনং? গতর থসথস?
“কাল যাবু ধান কামবা?”
“কেদুর? কালোমাটি?”
“নাঃ… গাঁয়েই… প্রমানন কহছিল সকালে…”
“প্রমানন?”
“হুঁ…”
রাস্তায় আনমনা চলতে চলতে হঠাত কেউ সামনে পড়ে গেলে দুজনেই যেমন একটু থমকে দাঁড়িয়ে আবার নিজের নিজের পথ ধরে, মামী আর জলনীর দৃষ্টিজোড়া তেমনই একটু মুখোমুখি থমকাল, আবার যে যার পথে চলে গেল…
“দেখু… গতরটা ভারী নাগে… ভালো নাগলে যাম কে…”
“কী হইছে তোর গতরে? সকাল মরার পর থেকেই ক্যানং শুতে বসে থাকিস খালি দেখি…! উঠ ঝাড়া দিয়ে…। ধানলা ক্যানং হলে? দেখবা গিছলু?”
“সকালে গোরটোক বাঁধবা যাইহানে দেখে আইছি। ক্যানং আর হবে… ঠিকই ছে… এক বিঘা তো ভুঁই… ও যা হয়, এগারো বারো মণ, একলা মানষির খোরাকি চলে যাবে…”
“পুষা নাগাবুনি?”
“মেলাই খরচা ওটোর…। জল নিতে নিতেই দম শেষ হয়ে যায়!”
“তাও তো তোর একলা পেট… মোক করবা হবে… ছোয়ালা ছে…”
“লা আর কেদুর! একটা ছোয়াক তো দিয়েই দিলু! কহনু দিস না…”
“কী করিম ক! একলা মানষি… ভুঁই দেখিম, না ছোয়া দেখিম, না কামকাজ করিম! স্কুলত্ দিনু, দেখলু তো, গেল্? সারাক্ষণ বান্দরামো! এদিকে খাওয়াদাওয়াও ভালো নাই হামার। তাই ভাবনু থাক দুবছর বড় বাড়ি। এন্নাই তো। অ্যাগনা খাওয়াদাওয়া জামাকাপড় তো মিলবে! কামও শিখবে…”
“এন্না শিখলে হয় নি? চাকরোক্ ভালোমন্দ খিলাবে? তোরও যেনং কথা…”
“ঠিকই কইছি। কান্দছিল ওদিন ছোয়াগনা। বুড়াটো কঠিন হারামী। গাল দেয় নাকি সবসময়… খাটায় বেহিসাব… ছাড়ায়ে নে আসিম…”
এই গ্রামটা এমনিতে, গ্রাম তো নয়, টোলা বা তোমাদের ভাষায় পাড়া, স্বয়ংসম্পূর্ণ। অর্থনীতিতে। খাটনির দিক দিয়ে। গ্রামের গরীবরা গ্রামের বড়লোকদের জমিতেই খেটে দুপক্ষেরই মিটে যায়। গরীবদেরও খুব একটা বাইরে যেতে হয় না, বড়লোকরাও এতটা বড়লোক নয় যে বাইরে থেকেও লোক আনাতে হবে খাটার জন্য। তবে এটা থোক কথা, বাচ্চাদের বইতে লেখা জলে-মাছ-থাকে’র মতো। মাছ কি অবরেসবরে ডাঙায় ওঠে না? প্রথম বর্ষায় কই, শিঙি, ল্যাটাদের মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়াতে গাঁয়ের মানুষ সবাই দেখেছে, জানি না তোমরা দেখেছ কিনা! সে যা হোক, এটাও তেমনই। ওই যে প্রমাননের কথা হচ্ছিল, তার ভাই ভবাননের বাড়িতে যেমন একটা বাচ্চা ছেলে চাকর আছে। সাঁওতাল ছেলে। নদীটা পার করে পুবে আরও দুটো মাঠ পেরিয়ে যে সাঁওতাল পাড়াটা, সেখানকার। বয়স ধরে নাও না আমাদের মামীর ছেলে গণেশের মতোই হবে, দশ-বারো। মামীর ছোট ছেলেটার নাম সবাই ভেবেছিল কার্তিক হবে। কিন্তু হল ঢাকন। ও হওয়ার পর ওর বুড়ো বাপ বলেছিল, ‘নাঃ মেলাই হই গেল্… এবার নলত্ ঢাকনা নাগায়ে থুবা হবে… আর নাহে!’ সেই ওর নাম হল ঢাকন। বাবার নলে ঢাকনা লাগানো ছেলে। বাপটাও আর বাঁচল না বেশিদিন। ঢাকনার জন্যই, নাকি কে জানে! সে যাক গে, যা বলছিলাম, গরীবদেরও পেট বাড়ছে, ফলে এখন টুকটাক এদিকওদিক যেতে হচ্ছে। হয় আঠারো কিলোমিটার দূরের টাউনে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ টাজ, আর নয়তো ওই কালোমাটিয়ায় মাঠে জন খাটবার কাজ। ওখানে বিঘে কে বিঘে খাঁ খাঁ ভুঁই সব। বড় বড় জোতদার। জংলা জলা জমিতে চাষ করছে। মাঠে টিনা জুলুক ভর্তি। টিনা জুলুক তো বুঝলে না বোধহয়? ছোট ছিনেজোঁক হল টিনা। আর জুলুক নর্মাল জোঁক। তা ওখানে জনের দামটা বেশি। এই টোলার প্রায় ডবল। এই আশ্বিন-কাত্তিক আর চোত-বোশেখ, যে মাসগুলোয় গরীবের ঘরে চাল আর মাঠে কাজ, দুইই বেশ বাড়ন্ত, তখন তিন চারটে গ্রামের লোক সক্কাল সক্কাল দল বেঁধে চলে যায় ওখানে। আট কিলোমিটার হেঁটে হাইরোড, সেখান থেকে ফাঁকা ট্রাক-লরিতে সব চলে যায়। দুটাকা করে ভাড়া নেয় লরির ড্রাইভারগুলো, অনেকে ভিড়ের মধ্যে দেয়ও না। কমবয়সী মেয়ে বৌ দেখলে ড্রাইভারগুলো তাদের কেবিনে নিতে চায়। তাদের ভাড়া মাফ। যে যার ধান্দায় আর কী! হ্যাঁ, বিন্দোল তো আবার একটু বেশি সাহস দেখিয়ে ওর ষোল বছরের ছেলেটাকে টাউনের কোন ঠিকাদারের সঙ্গে দিল্লী পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন খুব কাঁদে। বছর দেড়েক হল ছেলেটার আর কোনও খবর আসছে না…
“বাঃ… তোমরা তো এন্না ভালোই গল্প নাগাইছেন…”
বিনোদদা। মুখে হাসিখান নাগাল ছে। জলন পিড়াখান আগায়ে দিবার আগেই থুপ করে বসে পড়িল্ মাটিখানত্ই। এই মানুষটো বেশ হাসিখুশি। নাটাগাটা শরীর, চুলটো এগনা বাবরি করা, বেশ কেষ্ট-কেষ্ট ভাব মুখখানত্। বিনোদদাদের একটা দল ছে। এই টোলার পাঁচ-ছজনকে নিয়েই। গানের দল। টোলাত্ই এর ওর বাড়ি পূজা টুজা হলে গান গীতাবার ডাক পায়। টোলার বাইরেও পায়, তবে সে খুব কম। কিন্তু এমরা বেশ খুশি থাকে ওই নিয়ে। বিনোদদা ওই দলের হারমোনি পিলিয়ার, সাথে ফির কেষ্টও সাজে…
“আর কী করবু! কামকাজ নাই…। তুই কামত্ যাস নাই আজ?” মামী পুছিল্। বয়সে বিনোদদা মেলাই বড় হলেও সম্পর্কে মামী বড় ভাউজি হবে…
“কাহা কাম?” হাত দুখান ঘুরায়ে ফক্কা দেখায় বিনোদদা, “এলায় তো ওই অ্যাগনা ধান কামাকামি… ওইলাত্ তো বেটাছোয়ালাক্ ডাকেই না কেউ…”
“হ্যাঁ, ওমাক্ তো মায়োনোক্লার নাহা কম পয়সা দিলে হবেনি!”
“ওইতানেই তো! তোমরাও কামাবেন, হামরাও কামামো… তোমাক আশি টাকা দিলে হই যাবে, তাও ফির খোরাক দিবা হবেনি, আর হামাক্ একশো বিশ টাকা, সাথে খোরাক… বাল ডাকবে হামাক…!”
“এটোই বিচার… বুঝলু? সমান সমান কাম… কিন্তু তোমরা একশো বিশ, হামরা আশি… তোমার খোরাক ছে, হামার নাই…”
“তোমরা যান যে দেরি করে… হামরা বেটাছোয়ালা আটটার মধ্যে কামে নাগে যাউ… আর তোমরা আন্ধে বাড়ে ছোয়াক্ খিলায়ে ওই বেলাটো যখন ওত্তিনা চলে আসে… তখন দশটা বাজায়ে কামত্ যান…! ওটোও তো দেখবা হবে!”
“তার জন্য তো খোরাক দেছেনি… কিন্তু টাকা কম হবে কিবা?”
“এটো তো ঠিক কইলেন… ছ্যাচাই… দেরির জন্য খোরাক নাই… কিন্তু টাকা কম ক্যানে!”
নিজের মনেই কহিল্ যেন কথাটো। নোকটো সাদা। অত প্যাঁচগোঁচ বোঝে না। কিন্তু ঘুরেফিরে ঢুমকেঢামকে এটোই আসে। এ কথা সে কথা/দে বুড়ি আলাপাতা। কম পাবে মায়োনোকে, দোষ হবে মায়োনোকের। এই যে টোলাত্ অ্যাগনা কান পাতলেই শুনা পাবেন, বাব্বা জলন! ও তো কঠিন জিনিস! কত নোকের যে ভাত খাইছে…! শালোর মরদ!! খাইছে নাহে, খিলাইছে কহো! আন্ধে বাড়ে খিলাইছে, কামায়েও খিলাইছে! কোনও ভাতারই বইসে খিলায়নি…! আবার তার জন্য শাস্তিও পাইছে…! কিন্তু তোমারলার? মরদলা বিচার বসিল্… দশ… কত্ত ঢং… তা সেই দশের মুরুব্বি কায়? ওই চান্দিটো…! এই টোলার দশটা বাড়ির মধ্যে আটটা বাড়ির মেয়ে-বৌয়ের দিকে যে শালো হাত বাড়াইছে! জানে না গাঁয়ের নোক সে সব? এই যে চান্দির মা এলায় মাটির তলায় শুতিয়ে ছে ওমার ইঙ্গনাটোত্… বেটা আবার ভক্তি দেখায়ে মাক্ পোতাইছে ওন্না, পোতাহানে ফির একটা মন্দিরও বানায়ে দিছে তার ওপর… সেই বুড়ি সুষেণের কম হাত পাও ধরিছিল? যখন শুনা গেল্ সুষেণ নাকি কেদুর কেদুরকার গুণ্ডা মিটাইছে চান্দিক মারেহানে গুম কইরে দিবার তানে? সুষেণের বৌটোক্ ধরিছিল জানোয়ারটো পাটাবাড়িত্। দশোক্ জানাল্, বিচারও হল্, কী বিচার? জরিমানা!! সেটোও দিলেনি হারামিটো। পরিষ্কার কহে দিলে ও এইলা করে নাই, তাই এই বিচার ওয় মানবেনি! কী টো করিল্ দশে? হুঁহ্… করবে! একে মরদ, তায় ফির বড়নোক! জানা ছে সব দম….
আর জলন দোষটোও বা কী করিছিল? সকালুর বৌ বেহার ছয় মাস পরেই সেই যে মায়ের ঘর চলি গেল্, আর ফিরাফিরি নাই। তাও তো ও নিজে আসে নাই। সকালুই থাড়ো থাকত পোতদিন ঐ বিলটোত্ সাঁঝবেলায়… যেন্না জলন তখন গোর-ছাগল নিবা আসে… হোত্তিনা। মুই তোক্ ছাড়া অবা পারিম্নি… চ মোর সাথে… জলন কইছিল এইলা? এই যে বিনোদদা, আগিলা বৌটো মরার সাত আট মাস পর একদিন হাটফেরতা এই সহভাউজিক্ নে চলে আসিল্, সাথে আবার অতবড় একটা মাই… বেহাও হল্নি, কিছুই নি… ওই একসাথেই থাকে গেল্… কেউ কলে কিছু? কবার ছে কিছু? কিন্তু জলনের বেলা চলে আসিছিল সব… চুল কাটি দিছিল জলনের… মাথাটা বিনবিন করে ওঠে ওই ঘটনা ফোম আসলে… এই থসথসা গতরও চিড়বিড়ে ওঠে… ঘাড়ে, বগলে, শরীরের আরও নানা খাঁজে খাঁজে বিনবিনে ঘাম জমে ওঠে…
“জলনোক্ দেখিছি বিনোদ? সারাক্ষণ খালি শুতে বসে থাকে… ওর নাকি গতর থসথসায়… ভারী ভারী নাগে…”
দেখিল্ বিনোদ এগনা। জলনোক্। ছোট একটো শ্বাস পড়িল্, নুকালে না ওটো, ওই শ্বাসের টানেই কহিল্…
“কী আর করবে! কাম কাজ নাই… মণ্ডলটো এমন ফুট করে পালাল্…”
জলনীর বাপ ছিল গ্রামের মণ্ডল। মোড়ল যাকে বলে। সে অনেক যুগ আগের কথা। তা ধরে নাও ব্রিটিশ বা প্রথম জমানার কংগ্রেসি আমলের হবে। তখন গ্রামে জলনের বাপ-কাকারাই ছিল বড় ঘর। মেলা জমি। জলনের বাপ ছিল চার ভাইয়ের বড় ভাই। ফলে মোড়ল। তারপর তো সব ছেলেপিলে বড় হল, সংসার হল, জমিজমা ভাগ হল, অনেক বিক্রিবাটা হল… এখন ওই মণ্ডল খালি লোকমুখেই। গুতিয়া-গর্বও। গুতিয়া মানে গুষ্টি। সুজিত, জলনের খুড়তুতো দাদা হবে, হবে মানে হত, সেও মরেছে, তারও আবার দুটো বউ, ভাইগ্য আর সাইগ্য দুই বোন, সে যাই হোক… একবার কি একটা ক্যাচালের সময় বেশ চিৎকার করে বলেছিল, ‘এই টোলাত্ গুতিয়া বলতে তো হামরাই… আর তো সবই ডাঙ্গুয়া নয় ঘরজুয়াই…’, কথাটা ঠিকই। ও হো! ঘরজুয়াই বুঝলেও ডাঙ্গুয়া বোধহয় বুঝলে না! এই যে ধরো সহ। বিনোদের এখনকার বউ। এ বউ কিন্তু বউ নয়। মানে বিয়ে ঠিয়ে হয়নি। চলে এসেছে, থাকছে, গ্রামের লোকও প্রথমে কিছুদিন কানাকানি, উলুকঝুলুক করার পর এখন বউ হিসেবেই মানছে। এখন এটা উল্টোও হয়। মানে পুরুষরাও গিয়ে ঢোকে এরকম কোনও আণ্ডি… মানে বিধবা বা ভাতারছাড়ি মহিলার ঘরে। সেই পুরুষগুলোই ডাঙ্গুয়া। এই রাজবংশী গ্রামীণ সমাজ তাদেরও মেনে নেয়। সেই মহিলার বর হিসেবেই। তা সে যাক, যেটা বলছিলাম…। সকালু ছিল মণ্ডল। কামে নয়, নামে। ডাকে। মণ্ডলের জামাই বলে সবাই সকালকে মণ্ডল মণ্ডল করেই ডাকত। তারাও, যারা এই জামাই হওয়ার পথে বাধা দিয়েছিল, জলনীর চুল কেটে নেওয়ার বিধান দিয়েছিল। কী আর করবে! বাস্তবকে মেনে নেওয়াই জীবন শেখায়। অতীত ভাসতে থাকে ওই শুকনো নদীটার জলে। তারপর কোনও গর্তে ঢুকে যায়, নাকি কোনও মাছে খায়, নাকি সূর্যের তাপে উবে যায়… সে খবর আর পাওয়া যায় না। তা আসল মণ্ডল, মানে জলনের বাপ এসব দেখেনি। সে আগেই মরেছে। জলনীর মারফত পাওয়া প্রথম জামাইটাকেই সে দেখেছিল, নিজেই বিয়ে দিয়েছিল। এই মেয়ের মারফত যে পরে তার আরও তিনটে জামাই হবে, সে খবর সে নিশ্চয়ই জানত না। তা, সেই প্রথম জামাই টোলার হলেও যেহেতু আসল মণ্ডলই তখন বর্তমান, ফলে তাকে কেউ মণ্ডল ডাকেনি। আর মাঝের দুইখান তো আশপাশের গ্রামে। মণ্ডল ডাক শোনার সৌভাগ্যটা তাই সকালুরই হয়েছিল।
“আর এই আশ্বিন-কাত্তিকে এমন অ্যাগনা হয়। একে কামকাজ থাকে না ওনং… ফির পইচ্চা বাতাসও বওবা ধরিছে… গতর ভারী করে এইলা বাতাস খুব…”
“পইচ্চা বাতাস তো বাড়বেই এলায়। পোষ-মাঘলা তো পড়েই ছে…”
“সে বাড়ুক… কিন্তু তখন মাঠে কামও তো শুরু হই যাবে না? এই অঘোনটোই আসবা দেন না… ধান কাটা, মান্ডা… ওদিক পুষা গাড়া, তুরী বুনা…। কামের ধাক্কাতেই গতর ফির টনটন হই যাবে। তখন পইচ্চা বাতাসেও আর কিছু করা পারবে নি। এই প্রথম সময়টোই জ্বালা…”
হবা পারে। নাও হবা পারে। জলন যেন মালুম পাছে এ থসথসানিটো ঠিক ইতু পাল্টানোর তানে নাহে। ইতু তো বছর বছরই পাল্টায়। এই আশ্বিন-কাত্তিকে, যখন ঘরত্ খাবারদাবার নাই, তখন হয় কো এনং। কিন্তু এটো যেন ঠিক ওনং নাহে। ওর বাপ একবার একটো মাছ ধরিছিল নদীর থেকে। জলন ছোট তখন। বোয়াল। সাত-আট কেজি ওজন হবে। জলনের ফোম ছে মাছখানের গতরে হালকা সবুজ ছ্যাতলা পড়ি গিছল। ওদের বড় বাড়ির, তখন বাড়িটো বড়ই ছিল, ইঙ্গনাটোত্ ফেলায়ে থুইছিল মাছটোক্। ওমার কোনও তিড়বিড়ানি নাই। চখুটো ঘুরাছিল খালি হেতি হুতি, ফির মুঞ্জে নিছিল। ওটো ফোম পড়ে এলায়। মাছটো। মাছটোও ঠিক নাহে, ওর গতরখান। ছলছলা চামড়া, আঁশটাঁশ নাই, পিঠের ধারে হালকা সবুজ। ছ্যাতলা। নিজের আবলুশরঙা হাতখানের দিকে তাকায় ও। দেখা যাছে ওনং? সবুজ? হালকা? ছ্যাতলা?
এই গতর তো কম সাতায় নাই ওক্। গতর ওক্ সাতাইছে, আর ওয় জলাইছে ওর পাশের নোক্লাক্। তা ও তো জলাবেই! সেই জন্মানোর থেকেই জলাছে। নইলে ফির জলন নাম থোয় বাপ-মায়ে? বাপরি! এই নাম নিয়েও সে কী ক্যাচাল ভোটের ফটোক তুলবার সময়। টাউনিয়া বাবুলা সব আইছিল, না ওমার কথা বোঝে, না কিছু!
“নাম জলনী?”
“হ্যাঁ…জলনী বর্মন!”
“ঠিক বলছ তো?”
“মানে??! মোর নাম, মুই ঠিক কম না তো তোমরা কবেন??”
“উনি যে জলন বলে ডাকলেন একটু আগে?”
সুজিতদার বাপোক্ দেখালে চ্যাংড়াটো। চ্যাংড়াই হবে, ঝকঝকে টাউনিয়া চ্যাংড়া। জীবনে কখনও মাটিত্ ঠ্যাং ছোঁয়ায় নাই বুঝি এমন ফকফকা অং।
“তা কী বলে ডাকবে? ওটোই তো নাম!!”
“এই তো বললে জলনী!!”
প্রমানন বাঁচাইছিল। টাউনে যাতায়াত করে, ধাওড় নোক। ধাওড় না হলে এত জমিজায়গা করবা পারে দোনো ভাইয়ে। বাপ ঢুকিছিল ডাঙ্গুয়া। আর আজ ব্যাটারা টোলার মাতব্বর। টাঙ্গা, বেতের নাহা চেহারা, মুখখানও নাম্বা, কথা কয় এগনা ঝুঁকে, অস্তে অস্তে, চখুলা ক্যানং ঘুরে তখন। টাউনের এই আমি-তুমি ভাষাটো কবা পারে ওয়। টাউনিয়া নোকলা ওমারলার এই তুই-মুই, তোমরা-হামরা ভাষাটো ঠিক বুঝা পায় না…
“আসলে স্যার, ওর নাম জলনীই। জলন বলে ডাকে সবাই…”
“কেন?”
“আমাদের স্যার ওরকমই। ব্যাটাছোল… মানে ছেলে হলে বৈশাখু, মেয়ে হলে বৈশাখী। কিন্তু দুজনকেই ডাকার সময়ে লোকে বৈশাখ বলে ডাকবে…”
“ও!” অ্যাগনা সন্দেহ নিয়ে তাকাইছিল চ্যাংড়াটো, “আপনার নাম?”
“মোর? মানে আমার? প্রমানন বর্মণ স্যার…”
“কীঃ? প্রমা? না পরমা? পরমানন্দ?”
“না না স্যার… আনন্দ নাহে… প্রমানন! কন্ট্রোলের কার্ডত্ এটোই ছে…”
আনন্দ পচ্চিমটোলার একটো জুয়াখোর বদ চ্যাংড়া! আর প্রমানন আমি-তুমি টানবা পারে!!
হ্যাঁ, জলনের গতরের জ্বলন ছে। বা ছিল। এলায় ঠিক বুঝা পাছে না ওয় জ্বালাটো মিটিয়েই গেল্ নাকি পুরাপুরি। মিটলে ভালোই একতি। হ্যান্ডেলু, ওর প্রথম ভাতার, ওর সাথে নাগিল্ তো এই নিয়েই। গাঁয়েরই চ্যাংড়া, এইনি ভালোই, বাপই দেখেশুনে বেহা দিছিল ওর সঙ্গে। তখন জলনের বয়স কত? ওই তেরো-চোদ্দ হবে। পাঁচ বছর ছিল জলন ওর সাথে। আর এই পাঁচ বছর পোতিটা আতে নোকটো হ্যাপসায়ে মরিছে। সে কী না করত বায়ো! ঝাঁপাঝাঁপি হ্যাপাহেপি ঝসে টসে সারা এগলায়! আর তার পর কুনদিন নিজের চুলিলা টানে, কুনদিন জলনোক্ পিটবা ধরে, কুনদিন কান্দবা ধরে…! ময়াও নাগে, কিন্তু ময়া ওই উগনাই। ময়ায় তো ওর নিজের গতরখানের জ্বালা মেটে না! গাঁ ঘরে এইলা ঘরের গোপন ব্যাপার অত কিছু গোপন থাকে না। হ্যান্ডেলুর মা গিছল সুপেন ডাক্তারের ঠিনা। ওই নদীখান পার হইয়ানে পুবে একখান গাঁও ছাড়ে যে তেমাথিটো ছে, ওন্নাই বসে সুপেন। হাতুড়িয়া, কিন্তু হাতযশ ভালোই। যায়ে কইছিল,
“মোর ব্যাটার ব্যাটাছোয়াটো ঠিক নাই ডাক্তার। বউটোক্ সাতায় খুব। অ্যাগনা ওষুধ দে না…”
“ব্যাটাছোয়াটো ঠিক নাই তো বেহা দিলু ক্যানে? তখন ফোম পড়ে নাই? এইলা ওষুধে ভালো হয়? দ্যাখ এলায় পুতুটো ভাগবে কারও সঙ্গে…”
হ্যান্ডেলুর মাই আসে কহে দিছিল এইলা। নইলে আর জলন জানবে ক্যানং করে! ওয় তো যায় নাই সাথে। তা ভাগেইছিল ওয়। নইলে কী করলে হয়? ঝেললে হয় গোটা জীবন ওই আধামরদটোক্? কায় ঝ্যালে? এনং যদি কোনও বেটিছোয়ার হলে হয়, সে তো দুই দিনে নাথ খাবে। জলনও দিছিল, নাথ। তার আগে বেশ কবার উই পচ্চিমটোলার ইফিউজিটোর সাথে কথা হই গেছে ওর। হাটেই নাগাল। ওদের গাঁয়ের জীবনে ওই হপ্তার হাটখানই তো ছলছলানোর দিন। অ্যাগনা বাইরের মানুষের সঙ্গে দেখাশুনা, আলাপ-পরিচয়, এমনকি প্রেম-ভালোবাসা। কামের চাপ যখন বেশি তখন হাট জলনীই করত। মেলা দিন ধরেই ইফিউজিটো চুলুক ভুলুক করে, তারপর একদিন কথাই কলে। তারপর তো অস্তে অস্তে যা হয়। উদিনই ফাইনাল কথা হই গিছল ওমার। কবে কেদুর আসবে জলন। হ্যান্ডেলু আতে খুব উৎপাত করছিল উদিন। “তুই হাটে নাকি ওই ইফিউজিটোর সঙ্গে খুব ঢলোমলো করিস? ক্যানে তে?” তখনই ওর বুকের ওপর ঝুঁকে পড়া হ্যান্ডেলুর শরীরটোর নীচে পা দুটা গুটায়েহানে জলন ওর বুকত্ জোড়া পায়ে এক নাথ দেয়। হ্যান্ডেলু ছিটকায় পড়ে ঘরের কোণাত্, আর ওয় সাজার পাশে থোয়া কেইচাখান ধরে থাড়ো হয়ে যায় পুরা—
“কাইটেই দিম্ এগলায়! বালের মরদ আইছে মোর! খ্যামতা নাই, ফির সন্দেহ করে! থুঃ…”
ইফিউজি মানে বাংলাদেশি। এইনি কোনও তাড়া ফাড়া খায়ে আসে নাই এমরালা। কামের তালাশে, বা হয়তো কোনও গুতিয়া টুতিয়া ছিল, ওমার ঠিনা বেড়বাই আসে, যায় ফির, এনং যাই আসি করতে করতে ওন্নাকার সব বেচেবুচে চইলেই আসে। কী চাষ জানে এমরা বাপরি! হামরা দেশি-পলিলা বা সাঁতাললা যেসব ভুঁই ফেলায়েই থুইছিনু বছর বছর ধরে, ওমরা সেইলা জলের দরে কিনে এলায় ক্যানং কাঠফসল করে ওইলাত্। পটল, কল্লা, কয়থা, ঢ্যাঁড়স…। পানের বরজ করে অনেকে। এমরাই ইফিউজি। এমারও ভাগ ছে। ইফিউজি আর কাপালি। যেনং হামার দেশিয়া আর পলিয়া। কাপালি নাকি নমশূদ্রলাক্ কহে। ওটো কী জিনিস জানে না জলন। ওমাকই যে কাপালি কয় সেটোও অনেক পরে জানছে। সকালুর ঠিনাই হবে। ওয় এইসব জানত ভালোই। খবর থুত মেলাই। আর ইফিউজিলা ব্যবসা করে। কিছু না কিছু। এই পানটো, শাকটো, আনাজটো, ফুল, গরু, ছাগল… কিছু না কিছু ব্যবসার ধান্দা ওমার ছেইএ। জলনীর মরদটো, দিলীপ, ভাতারের নাম নাকি ফির ধরবা নি, হুঁহ্…, ছিল গরুর দালাল। গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে ওগাভোগা গোরলাক কিনে আনে, আনিহানে সুস্থ করে ওমাক, ফির হাটে হাটে বেচে দেয়। গোটা দিন এই করে, আর রাতে দারু খায় গলা অবধি। প্রথম ছয়-সাত মাস ভালোবাসাবাসি, তারপর শুরু হল তাসির, খেস্তাখিস্তি, সেও ফির জাত তুলে… “শালী পইলানি! আমি ঘরে তুলেছি বলে তো জাতে উঠেছিস! নইলে তো তোরা অসভ্যের জাত! আবার মুখ তুলে কথা ক’স মাগী!!…’ আর বছর দুয়েক পর মারধোর। তিন বছর পুরবার আগেই জলন যে আতে ওই হারামী ইফিউজিটোর ঘর থেকে নিকলাহানে দুইখান মাঠ ফাটায় মায়ের বাড়ি আসি উঠিছিল, সে আতে ওয় ওন্না থুয়ে আসিছিল গোটা গতরে ফোসকার জ্বলায় তিবড়ে বেড়ানো আর চিয়ার কাটা একটো মাতালোক্। উটি ভাজছিল ওয়। ইফিউজিলা উটি খায়। আন্ধোঘরাটার দুয়ারখানের থেকে পিছেমুখে বসে। কখন মাতালটো পিছন থেকে আইছে সুটসুট করে মালুমই পায় নাই। আর আসেহানেই ‘এই স্সালী পইলানি…’ বলে পিঠিত্ এক নাথ। আটক্ হওয়া দমখান ফিরায়ে আনতে আনতেই ওয় হাতের খুন্তিখান ঢুকায়ে দিছিল চুলাত্। দমও ফিরিল্, ওয়ও ঘুরিল্। হাতত্ গনগনে খুন্তিখান। মাতালটো তখনও কি কি যে বকে যাছে, কার আর কানত্ ঢুকিল্ ওইলা! মনের সুখে হাত ঘুরাইছিল ওদিনকা। ও ব্যাটা একে তো দারু খায়ে টাল, ফির জলনীর খাটনিয়ার শক্তপোক্ত সুস্থ গতর। পারে! আর মনের সুখ, হাতের সুখ সব মেটার পরেই একদম সিধা দামাল ধরিছিল বাড়ির মুখে। মায়ের ঠিন আসেহানে অল্প অ্যাগনা কান্দে ভাত খাইছিল বেশ পেট ভরে এক থাল।
এই যে গল্পগুলো বলছি, এ কিন্তু জলনী একটানা ভেবে যাচ্ছে এমন ভেব না। এর মাঝেই মামী আর বিনোদ চলে গেছে। মামী যাওয়ার সময় জলনকে আবার কাঁকড়া আনার জন্য তাড়া দিয়েছে। সেই তাড়া খেয়েই ও ওর ভারী গতরটা টেনে তুলেছে ধাপ থেকে। বেতের ছোট টুকরিটায় কয়েকটা ছোট ছোট আলু ছিল, সেগুলো, আর কটা শুকনা মরিচ চুলার ধিকিধিকি আগুনটার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পুড়ুক, সানা করে নেবে। তারপর দু বালতি জলও ঢেলে নিয়েছে মাথায় ঝপঝপ করে। ইঙ্গনার, মানে উঠোনের এক কোণে টিউবওয়েল। এরা বলে নলকূপ। জলন আসার পর সকালু বসিয়েছিল। ঘরগুলোও ভেঙ্গে তুলেছিল নতুন করে। সেই নলকূপেই স্নান। এবার খেয়ে নেবে পোড়া আলুগুলো একটু পুড়ে মড়মড়ে হয়ে থাকা শুকনো লঙ্কা, নুন আর তেল দিয়ে মেখে ভাতের সাথে। এই এতটা সময় যে কতটা সময় সে যদি জিজ্ঞেস করো ওরা তোমায় সূর্য দেখিয়ে দেবে। তার অতীত এক অবস্থানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বর্তমানের অবস্থান অবধি দেখিয়ে বলবে, ‘বেলাটো উই ওন্না থেকে এন্না চলে আসিল্’। এই পুরো সময়টাতেই জলনের মাথায় এইগুলো চলেছে। ওই যেগুলো বলছিলাম আর কী! কী করবে! মানুষের মাথা তো আর বসে থাকে না। আর স্মৃতিচারণেরও নেশা আছে। আত্মগত হলেও…
…তিন নম্বর মরদটো, নদীর ওপারে, পুবতিনা, ওন্নাই জলন গণ্ডগোল করিছিল অ্যাগনা। দেওরটোর সাথে শুতিছিল ক্যাবার। ঠিক করে নাই কামটো। ওর গোটা জীবনে যদি পাপের কথা কবাই হয়, তাহলে এটোই। হই গিছিল যেন ক্যানং করে… ওই পাটাবাড়িত্… তারপর আরও…। ছোয়াও হইছিল একটো। মরা। জীবনে ওই একবারই পোয়াতি হইছে জলন। ছোয়াটো জিন্দা হলে আজ বেশ হলে হয়। ওক্ শুধাই চলে আসলে হয় সকালুর ঠিনা। জিন্দা হবে ক্যানং করে? যা কাপালকাইচ শুরু হইছিল! একতি ওর ভাতারটো, অন্যতি দেওরটোর মগী! প্রমাণ ছিলনি কিছু। কেউ দেখে নাই। কিন্তু ওই… পাপ কাম ছাপ থাকে না। ছোয়াটো মরা বিয়ানোর পর ওন্না ওই কাপালকাইচে আর অবার কোনও মানেই ছিল নি। সকালুও তখন থেকেই শুরু করিছে প্যালাপেলি। নদীটো পার হইয়ানে ফাঁকা বিলটোত জলন আসে গরুছাগল বান্ধবা, সকালে, ফির বেলা ভাটি নিয়ে যায় ওমাক। সকালুর ভুঁইখানও ছিল হোতিনাই। যে ভুঁইখানত্ এলায় জলনের ধানলা পাকে উঠিছে। ওই ভুঁইবাড়ি, আলিলা, কোণের বড় শিমুলগাছটো, এই ধানলার বাপ-দাদালা, এমরা সব দেখিছে সকালু আর জলনীর ভালোবাসা। মইরেই গেল্ নোকটো…
শ্বাস পড়ে একটা। নদী থেকে সুটসুট হাওয়া আসে। অত জোরে নয় যে শীতগুলো নামতে পারবে না। নিঃশব্দে নেমে আসবে ওরা পাকা ধানের শিষে, আধপাকা ধানের পাতায়, বাবলায়, শিমুলে, কদমে, খড়ের চালে, ঘাসের ডগায়…। এ শীত মানে শিশির, আর কিছুদিন পরে যারা কুয়াশা হবে। তোমাদের শীতকে এরা জার বলে। সূর্য ডোবে। এক অকিঞ্চিৎকর গ্রামের কিছু মানুষের ঠাণ্ডা জীবনে আর একটা সন্ধ্যা নামে। কুপি জ্বলে ঘরে ঘরে। ইলেকট্রিক লাইন ঢোকেনি এ পাড়ায়। নদী যায় এদিকওদিক। ওর কানে আসে উন্নয়ন, ডিজিটাল এসব কিছু শব্দ। এখানে এসে পাড়ের কলমী, কাশদের সঙ্গে সে সব গল্প করে খুব হাসে ও। হাঁটু জলে ছলাত ছলাত শব্দ হয় তখন। গ্রামে ঘরে ঘরে উলুধ্বনি ওঠে সন্ধ্যাবেলার। তুলসী মঞ্চে প্রদীপ জ্বলে একটা করে। বিগ্রহ, ঠাকুরাসন কারও বাড়িতেই নেই। ওই তুলসী। আর চান্দির বাড়ির মন্দিরে মনসা আছে একটা। মনসাকে এরা খুব মানে। ভয়ে ভক্তি। কুপি জ্বলবে না বেশিক্ষণ। কেরোসিন মহার্ঘ্য। কন্ট্রোলে, মানে রেশনে যেটুকু দেয় ওই দিয়ে হপ্তা চালাতে হয়। শুয়ে পড়বে মানুষগুলো। সাতটা-সাড়ে সাতটা-আটটা। এই সময়েই বোঝা যায় ঠাণ্ডা মনে হলেও জীবনগুলো ঠিক ঠাণ্ডা নয়। নিজের মতো করে উষ্ণতা সবারই আছে। জলনের যেমন এই সময়েই সেই গরমটা লাগে আবার। যে গরমে শরীরের খাঁজে খাঁজে বিনবিনে ঘাম জমে। ওর চুল কেটে নেওয়ার কথা মনে হলে যে গরমটা লাগে। এটা সেই গরম…
মাসখানেক হল জলনের ঘরে রাতে লোক আসছে। প্রতিদিন নয়। দু দিন, তিন দিন পর পর।
প্রথম দিন চিয়ার কাটবা যাতেই শক্ত হাতটো ওর মুখ টিপে ধরিছিল। তাও দুদিন ঠেকাবা পারিছে। তারপর আর নাই। কী করবে? নালিশ? দশোক্? জুতার বাড়ি মুখত্। আসলে জলন, শুধু জলন ক্যানে, সব মায়োনোক্লাই হল্ সস্তা। নাহ্… ওইলা ভাবলেই মাথা বিনবিন… শুতু যাইহানে…।
গোয়ালিঘরায় গরুটাকে দেখে এসে ঘরের মেঝেটা সামটে সাজা… মানে বিছানা করে শুয়ে পড়ল জলন। মাথার ধারে রইল নিয়মমাফিক কুপা আর সলাইবাস্কো, সিতানের… উফফ, বালিশের ধারে অভ্যাসমাফিক কাস্তে। শুয়ে এক ফুঁয়ে কুপাটা নিভিয়ে দিল জলনী।
আস্তে আস্তে সব কটা কুপিই নিভল গ্রামের। নদী দেখল সবাই ঘুমোতে গেল। উঠবে একদম সেই ভোর থাকতে। কৃষ্ণপক্ষের রাত। ফালি চাঁদটাও আসবে সেই রাত্তির দুই পোহরে। তখন একটু গল্পগাছা হবে ওর সাথে। হালকা আড়মোড়া ভাঙল নদী।
কিন্তু সে রাতে আর গল্পগাছা হল না। গ্রামের লোকও ভোর অব্ধি ঘুমোতে পারল না।
যখন চাঁদটা উঠল, তার একটু পরেই এক ভয়ানক আর্ত চিৎকারে ধড়ফড় করে ঘুম ভেঙে উঠে টোলার লোক বাইরে বেরিয়ে দেখল প্রমাননের সিড়িঙ্গে শরীরটা উদভ্রান্তের মতো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঝোপঝাড় ফাটিয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছে সকালুদের বাড়ি থেকে ওর বাড়ির দিকে। হাটে নতুন ওঠা সাদা সাদা লেড আলোর দু-একটা টর্চের আলোয় দেখা গেল ওর পরনের সাদা মাঠানটা লাল…
আর তারপর কুপি টুপি জ্বালিয়ে সবাই যখন মামীর পিছুপিছু জলনের বাড়িতে ঢুকল দেখল ওর ইঙ্গনায় তুলসীতলার একটু পাশে অনেকটা কালো রক্তের মধ্যে একটা ছোট্ট লকলকে পুরুষ। ধাপে কাস্তে হাতে বসে তখন জলনী খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলছে…
“শালোর মরদ!! দ্যাখ দ্যাখ… ক্যানং তিড়বিড়াছে…”