Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সুবিমল মিশ্র: হওয়া না-হওয়ার আলো-অন্ধকার

কিন্নর রায়

 



কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

সুবিমল মিশ্র বাংলা তথা ভারতীয় ভাষার একজন ব্যতিক্রমী গদ্যকার— এ-বিষয়ে অন্তত আমার কোনও সংশয় নেই। আমি তাঁর গদ্যরীতি পছন্দ করি বা না করি, তাঁকে অস্বীকার কোনও প্রশ্ন নেই। বাংলা সাহিত্যে তথাকথিত এস্টাবলিশমেন্ট বা প্রতিষ্ঠান তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকেনি, বরং উল্টোটাই ঘটেছে, সুবিমল মিশ্রই তথাকথিত প্রতিষ্ঠানের দিক থেকে আজীবন মুখ ঘুরিয়ে থেকেছেন, প্রতিষ্ঠানকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছেন, এবং তারপরেও তিনি আপন অবস্থানে স্থির, জিব্রাল্টার রক, আল্পস পর্বতমালা অথবা হিমালয়ের মতোই অনড় ও অটুট রয়ে গেলেন।

সুবিমল মিশ্রের লেখালেখির সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ষাটের দশকের শেষ লগ্নে। তবে তাঁর সঙ্গে আরও বেশি করে পরিচিত হই সত্তরের দশকে। উনিশশো সাতাত্তর সালে জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর জেল থেকে বেরিয়ে ব্যাপকভাবে প্রায় সবকিছুই পড়তে আরম্ভ করি। পড়তে পড়তে সুবিমল পড়ে ফেলি। পাঠক হিসেবে আমি অজপ্রতিম, যা পাই তাই খেয়ে ফেলি। আমি কোনও বই ফেলে রাখি না, দেরি করি না, কারণ আমি জানি টেবিলে একটা বই পড়ে থাকলে তার ওপর নতুন বই এসে পড়বে এবং প্রথম বইটা আর পড়া হবে না।

সুবিমল মিশ্র আহিরীটোলা বঙ্গ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। সেই একই স্কুলে পড়াতেন কবি গৌরাঙ্গ ভৌমিক। গৌরাঙ্গদা খুব বড় কবি এবং চমৎকার মানুষ। তিনি ‘যুগান্তর’-এ আমার সহকর্মী ছিলেন, অথবা উলটো করে বললে বলতে হয়, যুগান্তর পত্রিকার রবিবাসরীয় দপ্তরে আমি-ই কবি, প্রাবন্ধিক, শিল্পবিশেষজ্ঞ ও শিল্পবিশ্লেষক গৌরাঙ্গ ভৌমিকের সহকর্মী ছিলাম। আহিরীটোলা বঙ্গ বিদ্যালয়ে একসময় গৌরাঙ্গদাও শিক্ষকতা করেছেন। গৌরাঙ্গ ভৌমিকের কাছ থেকে সুবিমল মিশ্রের সম্বন্ধে শুনতে পাই। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার যে ষাটের দশকে সুবিমল মিশ্রকে আবিষ্কার করেছিলেন কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়। পবিত্রদা বাংলাভাষার অন্যতম প্রধান কবি, ষাটের দশকের অন্যতম শক্তিশালী কবি তো বটেই, যিনি ‘শবযাত্রা’ বা ‘ইবলিশের আত্মদর্শন’-এর মতো কাব্যগ্রন্থ লিখতে পারেন, সেই পবিত্র মুখোপাধ্যায় আবিষ্কার করেছিলেন সুবিমল মিশ্রকে। পরবর্তী সময়ে, সাহিত্যে, শিল্পে, সিনেমায় যেমন হয়, সুবিমল-পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের জোটবন্দি খানিকটা ভেঙে যায় বটে, কিন্তু এই কথাটি না বললে সুবিমল মিশ্রের ইতিহাসকে অস্বীকার করা হবে।

 

সুবিমল মূলত লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। আমার মনে আছে আমি তখন প্রতিক্ষণ-এ চাকরি করি। আমাকে প্রতিক্ষণ সম্পাদক স্বপ্না দেব বললেন, আমরা সুবিমল মিশ্রের একটা গল্পের বই করতে চাই… সেই সময় একেকজন লেখকের গল্প নিয়ে একটা পেপারব্যাক সিরিজ প্রতিক্ষণ থেকে বেরোচ্ছে… প্রতিক্ষণ সেই সিরিজেই সুবিমল মিশ্রের একটা বই করতে চাইল। এছাড়াও বলা হল, তিনি যদি অন্য কোনও লেখা দেন, উপন্যাস বা অ্যান্টি-উপন্যাস ওই রকম কিছু, সেই বইও প্রতিক্ষণ আলাদাভাবে ছাপতে পারে। ততদিনে ‘বাব্বি’, ‘পাইপগান ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে’ এসব বই বেরিয়ে গেছে, সুবিমলের অ্যান্টি-উপন্যাস ‘আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো’-ও বেরিয়ে গেছে। সুবিমল মিশ্রের সঙ্গে আমার তখন সামান্যই সখ্য ছিল। আমি কোনওদিনই তাঁর ভাবনাবৃত্তের লোক ছিলাম না বা স্তাবকবৃত্তের লোকও ছিলাম না। আমি প্রায় সবাইকেই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি অথবা আমাকেই সবাই এড়িয়ে চলেন। সে যাই হোক, কফি হাউসে শুধু একটু হাসি বিনিময় হত তাঁর সঙ্গে, আমি কফি হাউজ যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছি আজ প্রায় তিরিশ বছর হল। এছাড়া যখন সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল বা বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের উল্টোদিকে বইমেলা হত, সেখানেও সুবিমল মিশ্র কিন্তু তাঁবু খাটিয়ে নিজের মতো করে উপস্থিত থাকতেন। সে যাই হোক, তাঁর কাছে প্রস্তাবটা নিয়ে যাওয়া হল, ওঁর কাছে গল্পও চাওয়া হয়েছিল, আবার বলা হল, ওঁর মতো করে লেখা কোনও নভেলাও অর্থাৎ ছোট নভেল যদি উনি ছাপতে দেন। উনি অত্যন্ত সবিনয়ে, কোনওরকম শ্লাঘা বা অহঙ্কার কিছুই না দেখিয়ে বললেন, দেখুন, আনন্দবাজার যেমন বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠান, প্রতিক্ষণ-ও বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠান, আমি আনন্দবাজার, যুগান্তর, অমৃত, দেশ… কিছুতেই লিখি না। লিখব না। ফলে আমি প্রতিক্ষণেও লিখব না। উনি সবিনয়ে জানালেন, আপনার সম্পাদককে বলবেন, আমি এটা করতে পারব না। কেননা প্রতিক্ষণ একটা এস্টাব্লিশমেন্ট, সেখান থেকে আমার কোনও বই বেরোক, আমি চাই না। আমার কোনও লেখা বেরোক, তাও আমি চাই না।

পূর্ণেন্দু পত্রী পরে আবার আমাকে সুবিমল মিশ্রের কাছে পাঠান। আমি ওঁকে বলি যে পূর্ণেন্দুদার খুব আগ্রহ আপনার একটা বই প্রতিক্ষণ থেকে প্রকাশিত হোক৷ উনি হাতজোড় করে ঘাড় নুইয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন যে, পূর্ণেন্দুদা আমার খুব প্রিয় মানুষ, শ্রদ্ধেয় মানুষ, কিন্তু ওঁকে বলবেন যে আমি লেখা দিতে পারব না। আমি অপারগ। প্রতিক্ষণও একটি প্রতিষ্ঠান এবং আমি প্রতিষ্ঠানকে স্বীকার করি না। তখন আমি প্রশ্ন করি, তাহলে কি আপনি নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে চান? উনি হেসে বললেন, সে আপনি যা মনে করেন!

ধীমান দাশগুপ্ত অত্যন্ত ভালো লেখক, চলচ্চিত্র সমালোচক, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রের ইতিহাসকার এবং সাহিত্যবোদ্ধা। তিনি সুবিমল মিশ্রের কয়েকটা লেখার সঙ্কলন বাণীশিল্প থেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন, এবং সেই বইটা বেরোয়। কিন্তু সেই কাজটাও যে খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে, তা নয়। পরে, গাঙচিল প্রকাশনা থেকে তাঁর লেখাসংগ্রহ পাঁচ খণ্ডে বেরিয়েছে, আমি যতদূর জানি। আমার মনে পড়ছে, বইমেলায় সুবিমল নিজের বইয়ের একটা অদ্ভুত বিজ্ঞাপন দিতেন। বইয়ের দাম এই, সুবিমল মিশ্রের পাঠক হলে আপনি যা খুশি দিতে পারেন— এইরকম একটা পোস্টার নিয়ে উনি বসতেন।

লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গেও যে সুবিমলের সখ্য চিরস্থায়ী হয়েছে এমন তো নয়। বিজ্ঞাপনপর্ব-এর সঙ্গে একটা সময় তাঁর খুব যোগাযোগ ছিল। জারি বোবাযুদ্ধ-এর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, ওখানে লেখালেখি করেছেন। কিন্তু সেটাও যে খুব ঘন সখ্য এমন নয়। আসলে সুবিমল মিশ্র এমন একজন ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর লেখার ব্যক্তিত্বটাই এমন— আসলে একজন লেখক, নাট্যকার বা ফিল্মমেকারের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয় তাঁর লেখার বা সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে— সুবিমল এমন এক লিখন ব্যক্তিত্বের লোক, যেখানে তাঁকে কোথাও বেশিদিন বেঁধে রাখা খুব শক্ত৷ আমি তাঁর লেখা খুব খুঁটিয়ে পড়েছি। তাঁর প্রায় সমস্ত লেখা পড়েছি। এটা বলে রাখা দরকার, সুবিমল মিশ্র প্রচুর সিনেমা দেখতেন, সিনেমা অর্থাৎ বিশ্বচলচ্চিত্র। জঁ লুক গোদারের ছবি তাঁর পছন্দের তালিকায় ছিল। এছাড়াও ঋত্বিক ঘটকের ছবিও তিনি খুব পছন্দ করতেন। এঁদের দুজনকে তিনি অসম্ভব গুরুত্ব দিতেন এবং খানিকটা অনুসরণ করারও চেষ্টা করতেন। সেকারণে তাঁর লেখার মধ্যে আশ্চর্য সব জাম্প কাট আছে যা একেবারে ফিল্ম শটের প্রতিস্পর্ধী। অর্থাৎ ফিল্ম স্ক্রিপ্টকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন সব লেখা সুবিমল মিশ্র লিখতে পারতেন। সঙ্গীত বিষয়েও তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। ভারতীয় রাগসঙ্গীত এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীত সম্বন্ধে বিশেষত বেঠোভেন, চাইকোভস্কি (Pyotr Ilyich Tchaikovsk), মোজার্ট, শুবার্ট… এঁদের কাজের প্রতি তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। ভারতীয় রাগসঙ্গীত সম্বন্ধে বিশেষত তারের বাজনা অর্থাৎ সেতার, সরোদ, বীণা— এগুলি নিয়েও সুবিমল মিশ্রের গভীর চর্চা ছিল। কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথকে একদম পছন্দ করতেন না। একদম পছন্দ করতেন না রবীন্দ্রনাথের গদ্য, তাঁর জীবনযাপন, রবীন্দ্রনাথের দর্শনকে। বলতে গেলে, রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণই করতেন। এমনকি সেই সময় তথাকথিত প্রতিষ্ঠান-বিরোধী বলে যারা প্রচলিত ছিলেন, যেমন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, অসীম রায়, দেবেশ রায়— এঁদের সকলকেই মুখে তুলোধোনা করেছেন তিনি। সন্দীপন ও অসীম রায়, এঁদের অবস্থানের বিরুদ্ধে তো লিখিতভাবেও বলেছেন। তাঁর সব মতামত, বিশেষ করে অসীম রায় সম্বন্ধে তাঁর মতামত যে আমি মেনে নিয়েছি এমন নয়। তর্ক হয়েছে। কিন্তু সুবিমল মিশ্র ওঁর নিজের মত নিয়ে নিজের মতো করেই শ্লাঘাবান জীবন কাটিয়ে গেছেন।

 

প্রকৃতপক্ষে, বাংলা সাহিত্যে সুবিমল মিশ্রের সুনির্দিষ্টভাবে কোনও পূর্বসূরি, যাকে তিনি অনুসরণ করতে চেয়েছেন, এমনটা আমি দেখিনি। খানিকটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও খানিকটা জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ছাপ হয়তো তাঁর মধ্যে ছিল। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর কথা তিনি বিশেষ বলতেন না। কিন্তু আমার বারবার মনে হয় জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর লেখার সেই মরবিডিটি, সেই তীব্র বিষাদ, এবং তার সঙ্গে প্রবল যৌনতা সুবিমলের লেখাতেও এসেছিল। এই যে যৌনতার অস্ত্র দিয়ে সমাজকে আক্রমণ করা, প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করার প্রবণতা ভীষণভাবেই সুবিমল মিশ্রের লেখার মধ্যে ছিল। তাঁর ‘হারান মাঝির বিধবা বউয়ের মরা অথবা সোনার গান্ধীমূর্তি’ এইসব লেখা বা ‘বাব্বি’ অথবা ‘পাইপগান ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে’, এমনকি অ্যান্টি-উপন্যাস ‘আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো’— প্রত্যেকটি লেখায় সুবিমল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এক অন্তর্ঘাত ঘটিয়েছেন। এর আগে আমরা অ্যান্টি পোয়েট্রির কথা আমরা শুনেছি। নিকানোর পাররা-র অ্যান্টি-পোয়েট্রি বাংলাভাষায় চমৎকার অনুবাদ করেছিলেন বিশিষ্ট অনুবাদক, কবি, ভাবুক ও প্রবল গুণীজন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তেমনি অ্যান্টি-উপন্যাসের ধারণাও ইউরোপের শিল্প সাহিত্য বা ফিল্ম থেকেই এসেছে। সুবিমল তাঁর লেখায় অবশ্য ভারতীয় আখ্যানের গোড়াপত্তনের সময় অর্থাৎ তুলসীদাস ইত্যাদির কাছে গেছেন, দেখতে পাই ‘রামায়ণ চামার…’ লেখাটির মধ্যে তিনি প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও তখনকার জীবনযাপনের সঙ্গে খানিকটা সম্পৃক্ত হয়েছেন। অবশ্য এই সম্পৃক্তি সহজে ধরা যায় না, কারণ তা প্রকাশ্য নয়। যেমন সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এ আমরা খুব সহজেই দেখতে পাই যে তাতে কীভাবে ‘রামচরিত মানস’ সরাসরি ছায়া ফেলেছে। ভারতীয় সমাজকে রামচরিত মানসের আদলেই দেখছেন সতীনাথ… ঢোঁড়াই, রামিয়া এদের দৃষ্টিকোণ থেকে। সতীনাথের লেখায় যে আশ্চর্য সমাপতনগুলো এসেছে সুবিমল মিশ্রে তা প্রকাশ্যে আসেনি বা সেগুলো সুবিমল কোথাও স্বীকারও করেননি। কিন্তু আমার কোথাও কোথাও মনে হয়েছে যে তিনি হয়তো ‘রামায়ণ চামার’ লেখার সময় ভারতীয় প্রাচীন আখ্যানের কলা ও কৌশল, কাব্য ও গদ্যের যে আশ্চর্য সমাহার, তাকে নিজের বোধে মিশিয়ে নিয়েছেন।

 

সুবিমল পারিবারিকভাবে খুব একা এবং নিঃসঙ্গ ছিলেন। তাঁর একমাত্র কন্যা দূরে দিল্লিতে থাকতেন। একজন নার্সের হাতেই তাঁর যা কিছু সেবাশুশ্রূষা ও পরিচর্যা হত। কিডনির অসুখে বহুদিন ধরেই ভুগছিলেন। একটা বুকের কষ্টও ছিল। আস্তে আস্তে তাঁর লেখাও কমে গেছিল। যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল তিনি কোনওদিন নতজানু হয়ে লিখতে রাজি ছিলেন না। শুধু বড় প্রতিষ্ঠান-ই নয়, লিটল ম্যাগাজিনেও লিখতে গেলে কাউকে কাউকে নতজানু হতে হয়। সুবিমল মিশ্র কোনওদিনই সে ধাতের ‘পাবলিক’ ছিলেন না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁকে তাঁর মতো করেই রাস্তা খুঁড়ে যেতে হবে। একটা কোদাল নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন এবং তা দিয়েই আজীবন নিজস্ব রাস্তা খুঁড়ে গেছেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর কোনও উত্তরসূরি আমি এখনও খুঁজে পাইনি। পূর্বসূরির কথাও আগেই বলেছি। বাংলাভাষায় শুধুমাত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে সুবিমলের পূর্বসূরি বলা যেতে পারে। বিশ্বসাহিত্যে অবশ্য অনেকেই আছেন। এই মুহূর্তে কাফকার কথা মনে পড়ছে। এমনকি মার্কেজ সুবিমলের পূর্বসূরি হলেও হতে পারেন। লাতিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সাহিত্যের ধারাবাহিকতার প্রতি সুবিমলের পক্ষপাত থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু সুবিমলের প্রেরণার প্রধানতম উৎস ছিল বিশ্বসিনেমা। বিশ্বসিনেমার নানা অলিগলি অন্ধিসন্ধি তিনি জানতেন। ভারতীয় সিনেমার খবরও রাখতেন। বিশ্বসিনেমার নানা বাঁকগুলিকে তিনি তাঁর লিখনমালার মধ্যে এনেছেন, এই কথাটা আমার বারবার ও বিশেষভাবে মনে হয়েছে। গোদারের প্রথমদিকের ছবি ‘ব্রেথলেস’ বা ‘গুডবাই ভিয়েতনাম’ ছবির উচ্ছসিত প্রশংসা শুনেছি সুবিমলের মুখে। ফরাসির সিনেমার এই নতুন ধারা বা ন্যুভেল ভাগ জঁরটি মৃণাল সেনের মতো সুবিমল মিশ্রকেও অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিল। মৃণালদা গোদারকে কিছুটা অনুসরণও করেছিলেন, তাঁর ‘কোরাস’ বা ‘চালচিত্র’ ছবিগুলিতে গোদারের ছোঁয়া আছে। ঠিক তেমনি সুবিমল মিশ্রের গদ্যনির্মাণেও কোথাও যেন জঁ লুক গোদার আছেন বলেই আমার মনে হয়। অতি সম্প্রতি গোদারও প্রয়াত হলেন। সেই রূপবান ফরাসি চিত্রপরিচালক যিনি জীবনের শেষেরদিকে একা ও নিঃসঙ্গ হয়ে গেছিলেন, সুবিমল মিশ্রও একইভাবে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছিলেন, আর সেই গোদারের ভূমিস্পর্শী ও আকাশনন্দিত যে ছায়া, তা-ই হয়ত সুবিমল মিশ্রের গদ্যকে খানিকটা মথিত করেছিল।