Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সুবিমল মিশ্র: বাংলা সাহিত্যে এক সার্বিক অন্তর্ঘাত

শৌভ চট্টোপাধ্যায়

 



কবি, গদ্যকার

 

 

 

সুবিমল মিশ্র একজন পরীক্ষামূলক গদ্যকার ছিলেন— এই বাক্যের মাধ্যমে, বাংলাসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে সুবিমলের অনন্যতার একটি খণ্ডচিত্রই শুধু আভাসিত হয় বলে আমার বিশ্বাস। মননশীল পাঠকমাত্রেই জানেন, বাংলাসাহিত্যে পরীক্ষামূলক গদ্যকারের তালিকাটি, সুবিমলের আগে বা পরে, ঈর্ষা-জাগানোর মতো অফুরন্ত হয়তো নয়, কিন্তু এক-হাতের আঙুলে গুনে ফুরিয়ে ফেলা যাবে, এমন অতিসংক্ষিপ্তও নয় তা-বলে। জগদীশ-ধূর্জটিপ্রসাদ-জীবনানন্দ-মানিক থেকে আরম্ভ করে, কমলকুমার-অমিয়ভূষণ-লোকনাথ-উদয়ন-সন্দীপন-দেবেশ-আদি আরও ঢের নাম এই বক্তব্যের সপক্ষে অনায়াসে দাখিল করা যেতে পারে। বিষয়বস্তু, ভাষা ও আঙ্গিক নিয়ে তাঁদের হরেকরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা আখেরে বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, এবং ধীরে-ধীরে প্রসারিত হয়েছে তার সম্ভাবনার দিগন্তটি, এ-ব্যাপারে দ্বিমতপোষণের কোনও অবকাশ আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু, সুবিমল মিশ্রের নিরীক্ষা শুধু লেখার বিষয়বস্তু, ভাষা বা আঙ্গিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং, লেখক-প্রকাশক-বিক্রেতা-পাঠকের সমন্বয়ে তৈরি এই গোটা ব্যবস্থাটাই— লেখার, প্রকাশের, বিপণনের এবং পাঠের— ম্যানেজমেন্টের ভাষায় যাকে সাহিত্যের ‘ভ্যালু চেন’ বলে অভিহিত করা যেতে পারে, তাঁর যাবতীয় নিরীক্ষা ও আক্রমণের আসল লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। অর্থাৎ, সুবিমলের লেখার প্রকরণগত চমৎকারিত্ব যেমন আমাদের প্রথাগত পাঠের অভ্যাসকে ব্যাহত করে, তেমনই তাঁর বইগুলির অভিনব সজ্জা ও গড়ন, এবং তাদের বিপণনের ব্যতিক্রমী ধাঁচা, গ্রন্থ-সংক্রান্ত যাবতীয় পূর্বানুমিতিকেও ধারাবাহিকভাবে তছনছ করে দিতে থাকে। এইখানেই সুবিমলের স্বাতন্ত্র্য। বাংলায় তো বটেই, এমনকী হয়তো বিশ্বসাহিত্যেও, এমন সার্বিক অন্তর্ঘাতের নজির বস্তুত দুর্লভ।

 

সুবিমলের প্রকরণ, অথবা, প্রকরণের বিরুদ্ধে সুবিমল

যদি শুধু প্রকরণের দিক থেকেই বিচার করি, তাহলেও দেখব, সুবিমলের লেখালিখিকে, তাদের বিচিত্রমুখিনতার কারণেই, চট করে কোনও একশিলা ধারণার খোপে আঁটিয়ে ফেলা যাচ্ছে না, বরং তাদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে নানারঙের প্যাটিনা, বিভিন্ন স্তরীভূত নকশা ও শিরার কারুকাজ। সুবিমলের একেবারে প্রথম গল্প ‘হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া অথবা সোনার গান্ধীমূর্তি’ থেকে আরম্ভ করে শেষদিকের গল্প ‘মাটি নড়ে’ অবধি, কালানুক্রম মেনে পড়লে, একটি ধারাবাহিক বিবর্তনের ছবি ফুটে ওঠে। ফুটে ওঠে গল্প থেকে না-গল্পের দিকে, অথবা ন্যারেটিভ থেকে অ্যান্টি-ন্যারেটিভের দিকে যাত্রার একটি স্পষ্ট অভিমুখও। কিন্তু, মনে রাখা দরকার, সেই অভিমুখটিও সর্বদা সরলরৈখিক নয়— বারবার আগুপিছু গিয়ে, গোঁৎ খেয়ে, ফের দিক পালটে নতুন রাস্তার খোঁজে বেরিয়ে পড়তে চান সুবিমল। কোনও একটি স্বরের নিজস্বতায় সুস্থিত হওয়ার পরিবর্তে, আঙ্গিকের প্রথাবিরুদ্ধতাকেও তিনি বাজিয়ে দেখতে চান নানাভাবে, নানান দিক থেকে।

সুবিমলের প্রথম গল্পসঙ্কলন ‘হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া অথবা সোনার গান্ধীমূর্তি’ অধুনা প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের জুন মাসে। তার অব্যবহিত আগেই, হাংরি জেনারেশনের গেরিলা-আক্রমণে বাংলা-সাহিত্যের বনেদি ইমারতে রীতিমতো কাঁপন ধরেছে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, কোনও গোষ্ঠী বা জেনারেশনের খাতায় নাম না-লিখিয়ে, একজন আনকোরা নিরীক্ষামূলক লেখকের পক্ষে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার কাজটা খুব একটা সহজ ছিল না। তবুও যে এই বইটি কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ, অসীম রায়ের মতো ব্যতিক্রমী লেখকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল, সেটা নিশ্চিতভাবেই সুবিমলের শৈল্পিক সাফল্যের প্রমাণ। অথচ, এই বইয়ের অধিকাংশ গল্পই কিন্তু, আঙ্গিকের বিচারে, ঠিক ততখানি আক্রমণাত্মক ছিল না। ন্যারেটিভকে দুমড়ে-মুচড়ে অবশেষে একেবারে নাকচ করে দেওয়ার যে-পণ আমরা সুবিমলের পরবর্তীকালের লেখালিখির মধ্যে দেখতে পাই, এই বইয়ে শুধু তার ইঙ্গিতটুকু চোখে পড়েছিল মাত্র। ন্যারেটিভকে নাকচ করে দেওয়ার পরিবর্তে, এই গল্পগুলি যাচাই করে নিতে চাইছিল তার সম্ভাবনাকে, মেপে দেখতে চাইছিল ঠিক কতদূর সম্প্রসারিত হতে পারে তার সীমা, এবং কীভাবে ন্যারেটিভের প্রচল ফর্মের মধ্যেই ভরে দেওয়া যায় অন্তর্ঘাতের বারুদ।

বইয়ের নামগল্পটির কথাই ধরা যাক। গ্রামের ভূমিহীন ভাগচাষি হারাণ মাঝিকে, ভূমিসংস্কারের পর, জমিদার আর জমি চষতে দেয় না। এই-সংক্রান্ত বিবাদের জেরে, অল্পদিনের মধ্যেই হারাণ খুন হয়। অভাবের তাড়নায়, তার বাইশবছরের বিধবা বৌ লোকের বাড়ি কাজ করে, ধান ভেনে, কোনওরকমে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে। এবং তার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে, তার শরীরের দিকে হাত বাড়ায় গ্রামের উচ্চবর্ণের জমিদার ও মুরুব্বিরা। তবু, অভাব মেটে না। শোষণ চলতেই থাকে, এবং বিধবা বৌটির বেঁচে থাকা ক্রমশ একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে কার্যত বাধ্য হয়। কিন্তু, এ সবই অনতি-অতীতের কথা। গল্প যখন শুরু হয়, তখন হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া আদিগঙ্গার খাল বেয়ে ভেসে আসছে কলকাতার দিকে। এই ভেসে আসার যাত্রাপথটিকে ছোট-ছোট দৃশ্য বা ভিশ্যুয়ালের মাধ্যমে, চলচ্চিত্রের মন্তাজের মতো করে উপস্থাপিত করেন সুবিমল। এবং তার সঙ্গে, কতকটা ইন্টারকাটের কৌশলে, ফ্ল্যাশব্যাকে দেখাতে থাকেন হারাণ মাঝি ও তার বৌয়ের মৃত্যুর কার্যকারণ-পরম্পরাটিকে—

দেড় বছরের কালো রোগা পেটের পিলে বিশ্রীভাবে উঁচু হয়ে-থাকা ছেলেটা ককিয়ে কঁকিয়ে এখন হাঁফিয়ে উঠেছে, ধুঁকছে। শ্যাওড়াবেড়ার ধারে একটা গরু ঘাস চিবোচ্ছে। দুজন বুড়ো দুঃখ করছে ছেলেটার দুর্ভাগ্যের জন্য, এরপর বৌটার চরিত্রহীনতা নিয়ে আলোচনা করবে। বৌটার বাইশবছরী তাজা শরীর, অনেক সাধ-আহ্লাদ মনে ছিল গো, কিছুই পূর্ণ হয়নি। হারাণ মাঝি পশু ছিল একটা, বামুনপাড়া থেকে মুড়ি বেচে ফিরতে দেরি করলে পিটতো, পিটিয়ে আধমরা করে ফেলত মানুষটাকে। মড়াটা ভেসে ভেসে কালিঘাটের দিকে চলে যাচ্ছে। কাকেরা পিছু নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। খালের দুদিক বড় সুদৃশ্য, মানুষেরা পায়খানা করে রেখেছে জলের কাছাকাছি, দুনিয়ার আবর্জনা স্তুপাকার করে ফেলা, বস্তা ঘাড়ে করে একটা কাগজ-কুডুনি কাগজ কুড়াচ্ছে, তিনটে মোষ ঘোলা জলে শরীর ডুবিয়ে স্থির হয়ে আছে, একটা মরে যাওয়া গলে যাওয়া কুকুর বেড়াল বা এ রকম কিছু ভেসে যাচ্ছে, তার ওপরেও একটা কাক। কালিঘাটে এসে লোকে এই জলে চান করে পাপ ধুয়ে ফ্যালে।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরও দুটি ঘটনা, হারাণ মাঝির বৌয়ের মৃত্যু ও তার শবদেহ ভেসে আসার ঘটনার সঙ্গে-সঙ্গে, হয়তো-বা তার সমান্তরালেই, ঘটে যেতে থাকে। বৌটির অর্ধগলিত শব, কোনও এক অব্যাখ্যাত উপায়ে, যত্রতত্র গিয়ে পৌঁছয়— কখনও রাইটার্স বিল্ডিঙের দরজায়, কখনও বা গ্রামের বামুন জমিদারের দরজার চৌকাঠে, কখনও শহরের মেয়রের খাবার টেবিলে— আর ভাষাহীন প্রহরীর মতো শুয়ে বা দাঁড়িয়ে থাকে সকলের পথরোধ করে। আবার, এরই পাশাপাশি, রাজনৈতিক মিছিলের হাঙ্গামায় পার্ক স্ট্রিটের গান্ধিমূর্তি ভেঙে যাওয়ার দরুণ, আমেরিকা থেকে বিমানযোগে কলকাতায় নিয়ে আসা হয় একটি নতুন, ঝাঁ-চকচকে, সোনার গান্ধিমূর্তি, এবং তাকে ঘিরে বেশ একটা উৎসবের আবহে সেজে ওঠে শহর। এইভাবে, চারটি ঘটনাস্রোতের ক্রমিক জাক্সটাপোজিশনে ক্রমশ গুলিয়ে যেতে থাকে দেশকালের পারম্পর্য, ঠিক যেমনটা ঘটে সিনেমায় জাম্পকাটের প্রয়োগে। এবং আমরা বুঝতে পারি, সিনেমার ভাষার সঙ্গে সাহিত্যের ভাষার ধারাবাহিক লেনদেনের প্রক্রিয়াটি, সুবিমল তাঁর প্রথম লেখা থেকেই আত্মস্থ করতে শুরু করেছিলেন। গল্পের শেষে, এই চারটি ঘটনাস্রোত একবিন্দুতে এসে মিলিত হয়, প্রায় যেন ধ্রুপদী সঙ্গীতের ঝালা অথবা ক্রেসেন্ডোর মতো, যখন গান্ধিমূর্তির বাক্সের ডালা খোলার পর দেখা যায়, মূর্তির ওপর শুয়ে আছে হারাণমাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া—

এক সময় বাক্সটার ডালা খোলা হল, এবং সংগে সংগে সমস্ত উপস্থিত জনবর্গ সবিস্ময়ে দেখলেন: বাক্সটার ওপরে হারাণ মাঝির বৌয়ের গলিত মড়াটি শোয়ানো রয়েছে। সকলে সমবেত চমকালেন, নাকে রুমাল দিলেন এবং বুঝতে পারলেন হারাণ মাঝির বৌয়ের মড়া না সরালে সোনার গান্ধীমূর্তির নাগাল পাওয়া যাবে না।

সমাজ ও রাজনীতিসচেতনতা, এবং মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের প্রতি আপাদমস্তক অনাস্থাই যে সুবিমলের লেখার অন্যতম চারিত্র্যলক্ষণ হয়ে উঠবে, সে-কথা এই গল্পের পাঠক সহজেই অনুমান করে নিতে পারবেন। কিন্তু এই গল্পে সুবিমলের আরেকটি প্রবণতা আমরা লক্ষ করতে পারি, যা পরবর্তীকালেও তাঁর গল্পে এবং উপন্যাসে ঘুরে-ফিরে আসবে। সেটা হল, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও তার ক্ষমতার বয়ানের বিরুদ্ধে তাঁর আপসহীন প্রতিবাদ। আমরা লক্ষ করব, সামন্ততান্ত্রিক সমাজের শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়েও, হারাণ মাঝি শেষ অবধি পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ। সে বৌ-কে সন্দেহ করে, এবং হয়তো তাকে নিগ্রহ করে সমাজের বিরুদ্ধে তার অবদমিত ক্রোধের ক্যাথারসিস ঘটাতে চায়। ফলে, হারাণের মৃত্যুর পর, আদিগঙ্গার স্রোত বেয়ে তার বৌয়ের ভেসে আসার সঙ্গে, গাঙুড়ের জলে বেহুলার ভেলা ভাসানোর একটা দৃশ্যগত সাদৃশ্য থাকলেও, আমরা বুঝি, নিজেকে পণ্যে পরিণত করে প্রলুব্ধ পুরুষ-চোখের করুণাভিক্ষা করা আদপেই তার উদ্দেশ্য নয়। বরং, অর্থনৈতিক ও জাতিবর্ণগত বঞ্চনার পাশাপাশি, ওই পচা-গলা মৃতদেহটি আমাদের কাছে লিঙ্গগত বৈষম্যের জবাবদিহিও চেয়ে বসতে পারে, এই ভয়ে, কাহিনির চরিত্রগুলির মত, আমরাও আশিরনখ কেঁপে-কেঁপে উঠি। এখানে আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, আদিগঙ্গা বেয়ে, হারাণমাঝির বিধবা বৌয়ের শবদেহটি ভেসে আসে শক্তিপীঠ কালীঘাটের দিকে। একে নিছকই এক সমাপতন বলে ভেবে নিলে, হয়তো কাহিনির বহুমাত্রিক সম্ভাবনার প্রতি খানিকটা অবিচার করা হবে। তন্ত্র এবং তন্ত্রোল্লিখিত শক্তি-উপাসনাকে, সুবিমল যে পুরুষতন্ত্রের বিপরীতে নারীর ক্ষমতায়নের বয়ান-হিসেবে দেখেছেন, তার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে পরবর্তীকালের গল্পে, এবং ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’, বা ‘পোঁদের গু তিন জায়গায় লাগে’-র মতো উপন্যাসেও। এই গল্পের মধ্যেই হয়তো আমরা খুঁজে পেতে পারি তার সূচনাবিন্দুটি।

প্রসঙ্গত, আরেকটি কথাও এখানে উল্লেখ করা দরকার বলে মনে হয়। সুবিমলের সমসাময়িক অনেক লেখকই মধ্যবিত্ত রক্ষণশীলতা ও ট্যাবুকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে, যৌনতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু, অনেকক্ষেত্রেই, তাঁরা নিজেদের এবং তাঁদের লেখালিখিকে পুরুষ-চাউনির সর্বব্যাপী কবল থেকে মুক্ত করতে পারেননি, যার ফলে তাঁদের অস্ত্রের ধার-ভার দুই-ই কমেছে, এবং তাঁদের লেখা শেষমেশ এক পুরুষ-লেখকের শিল্পিত যৌন-ফ্যান্টাসিতে পর্যবসিত হয়েছে। সুবিমলও তাঁর লেখাতে যৌনতা ব্যবহার করেছেন। বিশেষত, ‘চেটে-চুষে-চিবিয়ে-গিলে’ এবং ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’ উপন্যাসে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে যৌনতার প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু, সুবিমল সর্বদাই সচেষ্ট থেকেছেন, যাতে সেই যৌনতা পাঠককে তৃপ্তি দেওয়ার পরিবর্তে, খুঁচিয়ে তোলে তার অস্বস্তির সূচিমুখ, অথবা তাঁর ভাষায়, “এই উপদংশসর্বস্ব সভ্যতার” দগদগে ক্ষত।

ওই একই বইয়ের দ্বিতীয় গল্প, ‘বাগানের ঘোড়ানিমের গাছে দেখনচাচা থাকতেন’ আরও প্রকটভাবে কাহিনি-প্রধান। সমাজের প্রচলিত নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে, আধ-পাগলা দেখনচাচা ঘোড়ানিম-গাছের মগডালে উঠে বাসা বাঁধেন। মানুষের তথাকথিত সভ্যতার বিপরীতে, এক আবহমান আদিমতার প্রতিভূ তিনি—

বাঁশবাগানে সোনার জ্যোৎস্না উঠলে তিনি ঘোড়ানিম থেকে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, জিভ দিয়ে চেটে সেই সোনার পাতের ঠাণ্ডা নিতেন। বাঁশবাগানের গায়ে একটা ডোবা ছিল, তাতে ব্যাঙেরা ভেসে থাকত। দু হাত-দুপা দিয়ে হেঁটে দেখনচাচা সেই জলে নেমে পড়তেন। তারপর যখন তিনি উঠে আসতেন— জল-পাঁক-মাখা তাঁর শরীর— বুকে ভর দিয়ে হাটতে থাকলে তাঁকে অতিকায় এক আদিম সরীসৃপের মত মনে হত।

লোকে বলে, তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে, চাইলে তিনি লোককে দিব্যদৃষ্টি দিতে পারেন আর তখন সে দেখতে পায় সভ্যতার মুখোশের আড়ালে মানুষের আসল রূপ—

দেখনচাচা বলতেন সব শালারই ফুটো-ফাটার ধান্দা। বলে থপথপ করে উরত বাজালে লোকে হাসত। বলত: ফুটোটা বুঝলুম ফুটোপয়সা কিন্তু ফাটাটা কি… হি-হি-হি। দেখনচাচা খেপে গিয়ে “বিশ্বাস করলি না হতভাগারা” বলে বসতেন, তারপর একজনের গর্দান ধরে “ওঁ ক্লিং ক্লিং বৌটায় ফট্‌ সাহা” মন্ত্র পড়লে তার চোখে দিব্য-দৃষ্টি হয়ে যেত, সে দেখত নায়েবমশাই পা টিপে টিপে তার বিধবা শালীর ঘরে ঢুকছে, হাজার একর জমির মালিক চৌধুরীমশাইয়ের গোলায় বেওয়ারিশ ইদুরেরা ধান খেয়ে যাচ্ছে চুপিচুপি, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় জলপানি-পাওয়া ছেলে আসন্ন পরীক্ষার পড়া তৈরি করতে ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে রামপ্রসাদী গাইছে, আমায় দে মা তবিলদারী… তারপর গর্দান ছেড়ে দিয়ে বলতেন: দে শালা দে, দুটো পয়সা দিয়ে যা… অনেক দেখেছিস…

দেখনচাচার চরিত্রটি, আমাদের মনে হয়, যেন টেম্পেস্টের ক্যালিবান এবং কিং লিয়রের ভাঁড়ের এক অনাসৃষ্টি যোগফল। গ্রামের লোকেরা স্বভাবতই তাঁকে সমঝে চলত। একদিন, গ্রামে কলেরার মড়ক দেখা দেওয়ায়, দলে-দলে লোক গ্রাম ছেড়ে পালাতে শুরু করে। গ্রামের একটি বৌয়ের কলেরা হলে, তার স্বামী-সহ পরিবারের অন্যরা তাকে ফেলে পালিয়ে যায়। দেখনচাচা মেয়েটিকে শুশ্রূষা করে বাঁচিয়ে তোলেন। এবং, তারপর, সে সুস্থ হলে, তার সঙ্গে সহবাসের অনুমতি প্রার্থনা করে বলেন— “জননী জায়ার মাঝে ভেদাভেদ নাই/একজন স্তন্যদাত্রী, অন্যজন মাই”। এই ঘটনায়, গ্রামের মানুষের নৈতিকতা বিশেষ আঘাত পায়, এবং তারা দল-বেঁধে দেখনচাচাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। কিন্তু এর পরেই ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা—

পরের দিন গ্রামের সমস্ত চরিত্রবান লোক দেখল যেখানে যেখানে দেখনচাচার রক্ত পড়েছিল সেখানে সেখানে এক-একটা ঘোড়ানিমের গাছ জন্মে গেছে। সকালবেলার সতেজ আলোবাতাসে সেই সব নিমগাছের কচি পাতায় কাঁপ ধরেছে।

প্যারাবল-ধর্মী এই গল্পে আমরা লক্ষ করব, সুবিমল ব্যবহার করেছেন লোককথার ভাষা ও কাহিনিকথনের কৌশল। চাইলে, আমরা একে জাদুবাস্তব বলেও হয়তো আখ্যাত করতে পারি। আমরা এ-ও লক্ষ করব, ‘হারাণ মাঝি’-র সঙ্গে ‘দেখনচাচা’-র আঙ্গিকের পার্থক্য যেমন রয়েছে, তেমনই মিলও রয়েছে তার শ্লেষমিশ্রিত ভাষার চাবুকে, যা আমাদের সভ্যতা ও তার অন্তর্নিহিত ভণ্ডামির মুখোশটিকে পরতে পরতে উন্মোচিত করতে থাকে। কাহিনিকথন বা ন্যারেটিভের মধ্যে সচেতন অন্তর্ঘাত চারিয়ে দেওয়ার এই প্রয়াস সুবিমল জারি রাখেন এই সঙ্কলনের অধিকাংশ গল্পেই, পাঠককে তার নিষ্ক্রিয় নিস্পৃহতা থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনতে চান, আঘাত করতে চান তাদের শিল্প ও সৌন্দর্যবোধের গোড়ায়— ‘পরীজাতক’ গল্পে একদল বন্ধু সমুদ্রতীরে বেড়াতে যায় তাদের রক্ষিতাকে নিয়ে, এবং সে মারা গেলে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে-কুটে নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নেয়; ‘সময়-দুঃসময়’ গল্পে অদ্রি তার প্রেমিকাকে উপহার দিতে চায় নিজের শরীর থেকে বের করে আনা একবোতল রক্ত; ‘ছুরি’ গল্পে সুদাস তার পকেটে-রাখা ছুরি নিয়ে পেরিয়ে যায় একের পর এক দুঃস্বপ্ন, যৌথ-নরকের একেকটি স্তর। এইভাবে, কখনও পরাবাস্তব, কখনও লোককথা, আবার কখনও অস্তিত্ববাদী অ্যাবসার্ডিটির মধ্যে দিয়ে সুবিমল নিজের রাস্তা তৈরি করে নিতে থাকেন; সামাজিক অবিচার, সভ্যতার অন্তর্নিহিত হিংসাকে অনুবাদ করেন ভাষার ভায়োলেন্সে, বীভৎস-রসের উদযাপনের মধ্যে দিয়ে।

সুবিমলের পরবর্তী গল্পসঙ্কলন, ‘নাঙা হাড় জেগে উঠছে’-তে এসে আমরা দেখব তাঁর লেখালিখি ক্রমশ বাঁক নিতে শুরু করেছে, কাহিনির আবরণ পরিত্যাগ করে তা হয়ে উঠতে চাইছে আরও নগ্ন, আরও রিপোর্টাজ-ধর্মী ও প্ররোচনামূলক। এই বইয়ের ‘নুয়ে-গুয়ে দুই ভাই’ বা ‘পাখি’ গল্পের প্যারাবল-ধর্মিতার মধ্যে, ‘হারাণ মাঝি’-র সুবিলমলকে চিনে নেওয়া কঠিন না-হলেও, অন্তিম দুটি গল্পে— ‘আপনি যখন স্বপ্নে বিভোর কোল্ড-ক্রিম তখন আপনার ত্বকের গভীরে কাজ করে’ এবং ‘মূলত সংবাদই কাব্য’— প্রথাগত কাহিনির লেশমাত্রও আর অবশিষ্ট থাকে না। প্রথম গল্পটিতে, খবরের কাগজ থেকে তুলে-আনা বিজ্ঞাপনের আকাঁড়া বয়ানকে পরপর সাজিয়ে দেওয়া হয় পাঠকের সামনে, আর তাদের বিচিত্র সংস্থাপন ও সন্নিধির মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে পণ্যনির্ভর সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতা। দ্বিতীয় গল্পটিতে, একইভাবে, খবরের কাগজের হেডিং ও প্রতিবেদনের অংশ পরপর রেখে, হরফের সাইজ বাড়িয়ে-কমিয়ে, দিগভ্রান্ত সমকালের এক আশ্চর্য তথ্যচিত্র রচনা করেন সুবিমল। এই গল্পগুলিতে লেখকের ভূমিকা যেন এক মনোসমীক্ষকের, যিনি আমাদের অবদমিত বাসনাগুলিকে, লুকিয়ে রাখা হিংসা ও ঘৃণার চালচিত্রকে আমাদের চোখের সামনে সরাসরি উন্মোচিত করে আসলে সারিয়ে তুলতে চাইছেন আমাদের মনোবিকলন, বের করে আনতে চাইছেন ক্ষমতার প্রগাঢ় সম্মোহন থেকে। এই রিপোর্টাজ-ধর্মিতা, জ্বলজ্যান্ত বাস্তবকে একেবারে বেআব্রু করে বইয়ের পাতায় উপস্থাপিত করার প্রবণতা, ক্রমশ সুবিমলের ব্যক্তিগত স্বাক্ষরে পরিণত হবে। কখনও-সখনও, তার মধ্যে থেকেও উঁকি দেবে কাহিনির আদল, ‘দু-তিনটে উদোম বাচ্চা ছুটোছুটি করছে লেবেল-ক্রসিং বরাবর’ গল্পগ্রন্থের ‘মানুষ রতন’ গল্পটি যেমন। কিন্তু, লেখালিখির প্রধান প্রকরণ-হিসেবে, সুবিমল আরও বেশি করে ব্যবহার করবেন উইলিয়াম বারোজের কাট-আপ পদ্ধতি, যেখানে বিভিন্ন আপাত-অসংলগ্ন পংক্তি, শহরের রাস্তা থেকে তুলে-আনা দুয়েকটি দৃশ্য, টুকরো সংলাপ, অন্য টেক্সটের অংশবিশেষ, খবরের কাগজের প্রতিবেদন কিংবা বিজ্ঞাপন, বিভিন্ন বিচিত্র উপায়ে একে অন্যের পাশাপাশি বসে, তৈরি করবে বিচিত্র কোলাজ, সিনেমায় যেমনটা করা হয় মন্তাজের মাধ্যমে।

আমার মনে হয়, সুবিমল বিশ্বাস করতেন, আমাদের সময়ের বাস্তবতা এতটাই ভয়াবহ, এবং এত বিচিত্র স্বরের টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত, যে তাকে কাহিনির একমুখিনতায়, সে-কাহিনি যতোই নিরীক্ষামূলক হোক না কেন, বেঁধে ফেলা কার্যত অসম্ভব। ঠিক এই ব্যাপারটাই আমরা লক্ষ করি ‘আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারত’ উপন্যাসে। এই উপন্যাস এক দিক থেকে সুবিমলের স্বীকারোক্তিই যেন বা, অথবা তাঁর সাহিত্যদর্শনের এক শিল্পিত ভাষ্য। উপন্যাসের কথক— একজন এক্সপেরিমেন্টাল লেখক, হয়তো সুবিমল নিজেই— শ্রমিক-ইউনিয়নের কর্মী রামায়ণ চামারকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে চায়। কিন্তু সেই উপন্যাস লিখতে গিয়ে তার মাথায় বারবার ভিড় করে আসে আরও নানান অনুষঙ্গ, লেখার গতিকে ক্রমাগত ব্যাহত করে সমসাময়িক ঘটনার স্রোত—

চরিত্রটির অনেক কিছুই অজানা থেকে গিয়েছিল আমার, পড়তে পড়তে, আপনাদের সংগে, ক্রমাগত আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকি আমি, অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু কিছুই নিয়ম মত ঘটে না, শুধু খালি গা, ঘর্মাক্ত মুখ— এমন কি সংলাপগুলো পর্যন্ত গুলিয়ে ওঠে জিভ বরাবর, আলগা, নিষ্ক্রিয়… সামাজিক উপসর্গগুলো, ফ্রেমটা, প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে, অনুসন্ধানী, তার, চরিত্রটির আর তখনই অনেক অংশ, যা লেখার সময় নিজের কাছেই অস্পষ্ট ছিল একদা ক্রমশ ছায়া কাটিয়ে উঠতে থাকে। কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য হই আমি, প্রতিশ্রুতিগুলো…

ক্রমশ সে বুঝতে পারে, পচে-গলে যাওয়া একটা সমাজ, তার মধ্যবিত্ত ভণ্ডামি আর দিকশূন্য রাজনীতি, এই সমস্তটাকে একসঙ্গে ধরতে না-পারলে, রামায়ণ চামারের হয়ে ওঠার পটভূমি এবং তার ঐতিহাসিকতাকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করা কিছুতেই সম্ভব নয়, কেননা “এখনো পর্যন্ত এমন বন্দুক মানুষ বানাতে পারেনি/যা কেবল একদিকেই গুলি ছোঁড়ে/এবং অন্যদিকগুলো/এড়িয়ে যায়”। ফলে, সমস্ত দিকের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান করতে গিয়ে হিমসিম, উপন্যাস আর তার লেখা হয়ে ওঠে না কিছুতেই, বরং পাতার পর পাতা জুড়ে, আমরা দেখি, উপন্যাস লেখার যাবতীয় কাঁচামাল— লেখকের ভাষায়, “গত ২/৩ বছরের খবরের কাগজ, চিঠি, লেখা, ইনটারভ্যূর অংশ, রিপোর্টাজ, যখন যখন যা যা ভেবেছি”— অগোছালোভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। সুবিমলের লেখালিখি, সামগ্রিকভাবে, ওই অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপির মতো, যা একটা সময়ের সমাজবাস্তবতাকে, রাজনীতিকে, তার সমস্তটা নিয়ে ধরে ফেলার এক অসম্ভব প্রকল্পে নিয়োজিত।

এবং এইখানেই, সুবিমলের জোর এবং দুর্বলতার জায়গাগুলি, তাঁর যাবতীয় সাফল্য এবং সম্ভাব্য বিফলতাও, একইসঙ্গে আভাসিত হয়। কাহিনির মধ্যস্থতা ছাড়াই প্রত্যক্ষ বাস্তবকে শিল্পে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। এর ফলে, তাঁর লেখালিখি, এক সুনির্দিষ্ট দেশকালের অত্যন্ত গভীরে তাদের শিকড় চারিয়ে দিতে থাকে। ভিন্ন পরিস্থিতিতে, ভিন্ন সময়ে, তাঁর গল্পগুলির গুরুত্ব একইরকম থাকবে কি না, সেই প্রশ্ন, অতএব, পাঠকের মনে জেগে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। দ্বিতীয়ত, আঙ্গিকের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও, একটি পর্যায়ের পর, বিষয়বস্তুর দিক থেকে তাঁর লেখালিখিকে খানিকটা সঙ্কীর্ণ ও সীমাবদ্ধ বলে মনে হতে পারে, যেন সামাজিক সম্পর্ক, তার রাজনীতি ও ক্ষমতাতন্ত্রের বাইরে ব্যক্তিমানুষের আর কোনও অস্তিত্ব নেই, দার্শনিক সঙ্কট নেই, অর্জন নেই। আবার, এ-ও মনে হতে পারে যে, সামাজিক অসুখগুলিকে চিহ্নিত করতে গিয়ে, আরও প্রত্যক্ষভাবে আক্রমণাত্মক ও পোলেমিক্যাল হতে গিয়ে, সুবিমল যেন বড় বেশি ডাইড্যাক্টিক হয়ে পড়ছেন। এগুলোকে তাঁর লেখার সীমাবদ্ধতা বলেই মনে হয় আমার। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা, হতে পারে, সুবিমলের স্বেচ্ছা-আরোপিত। হয়তো এই অসম্পূর্ণতা, এবং তজ্জনিত অতৃপ্তিই তাঁর শিল্পদর্শনের সারাৎসার। আমাদের মনে পড়বে, তিনি নিজেই একদিন বলেছিলেন, “তোমার লেখা যেন কোনোভাবেই মহৎ না হয়ে যায়, তোমাকে যেন কোনো কায়দাতেই ওল্ড মাস্টারদের দলে পেড়ে ফেলতে না পারে, কিচ্ছু হয়নি… কিচ্ছু হচ্ছে না— এই ব্যবস্থায় এমন একটা বিশেষণ পাওয়া কি কম কথা?”

 

Auteur সুবিমল— বই-নির্মাতা

ফিল্মের পরিভাষা-হিসেবে auteur কথাটি সম্ভবত ফরাসি নিউ ওয়েভ আন্দোলনের পর থেকেই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। Auteur-অর্থে এমন একজন চলচ্চিত্র-পরিচালক যিনি তাঁর ছবির প্রত্যেকটি উপাদান— চিত্রনাট্য, ক্যামেরা, সঙ্গীত, অভিনয় ইত্যাদি— আগাগোড়া নিয়ন্ত্রণ করেন, যার ফলে সমগ্র চলচ্চিত্রটি তাঁর নিজস্ব শিল্পদর্শনের অবিকল প্রতিফলন হয়ে দাঁড়ায়। বাণিজ্যিক ছবির নির্মাণপদ্ধতি, বিশেষত হলিউডি স্টুডিও-র ‘অ্যাসেম্বলি লাইন’ নির্মাণের বিপরীতে, auteurship প্রাধান্য দিয়েছিল শিল্পীর স্বাধীনতাকে, তাঁর যা-খুশি করার খামখেয়ালকে।

বাংলাসাহিত্যে যদি সত্যিই কোনও auteur থেকে থাকেন, তবে তিনি সুবিমল মিশ্র। শুধু পরীক্ষামূলক গল্প লেখা নয়, সেই গল্প কোথায় প্রকাশিত হবে, গল্পসঙ্কলন এবং উপন্যাসের গড়ন বা গেট-আপ কেমন হবে, কেমন হবে তাদের প্রচ্ছদ কিংবা টাইপসেটিং, এমনকী কোথায় ও কীভাবে বিক্রি হবে তাঁর বই, কতখানি আর্থিক মূল্য ধার্য করা হবে বইয়ের দাম হিসেবে— এই সমস্তকিছুই সুবিমলের সামগ্রিক শিল্পদর্শনের অংশ হয়ে উঠতে থাকে। স্বভাবতই, বাণিজ্যিক পত্রিকা ও প্রকাশনার ছত্রছায়ায় দাঁড়িয়ে, এমন বেপরোয়া স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বাতুলতামাত্র। ফলে, গোড়া থেকেই সুবিমলের আশ্রয় হয়ে ওঠে লিটল ম্যাগাজিন এবং তাদের অবাণিজ্যিক, ক্ষুদ্র প্রকাশনাগুলি। বাংলাসাহিত্যে এমন নিরীক্ষামূলক লেখকের সংখ্যা একেবারেই হাতে-গোনা, যাঁরা সদম্ভে দাবি করতে পারেন কোনও বাণিজ্যিক পত্রিকায় জীবনেও একটি অক্ষর না-লেখার সঙ্কল্পের কথা। এমনকী, লিটল ম্যাগাজিনের মধ্যেও যেগুলি অপেক্ষাকৃত কুলীন, অথবা বামপন্থী সাহিত্যপত্রিকাগুলি, যেখানে প্রকাশিত হচ্ছিল সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় কিংবা দেবেশ রায়ের লেখালিখি, সুবিমল তাদেরকেও সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়, সুবিমল আমাকে বলেছিলেন, “কখনও একলাইনও লিখিনি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাগজে। একবার ‘আজকাল’ থেকে আমার লেখা চেয়েছিল। সন্দীপনকে দিয়ে বলিয়েছিল লেখা দেওয়ার জন্য। আমি বলেছিলাম— যদি প্রতিষ্ঠানে লিখতেই হয়, তাহলে ‘আজকালে’ লিখব কেন? ‘আনন্দবাজারে’ লিখব… ‘আনন্দবাজার’ একটা লেখার জন্যে ‘আজকালে’র দশগুণ টাকা দেবে। সেই কথা শুনে অনেকেই বিরূপ হয়েছিল।” অর্থাৎ, সুবিমলের কাছে প্রতিষ্ঠানের কোনও প্রকারভেদ ছিল না, আনন্দবাজার তাঁর কাছে যতখানি প্রাতিষ্ঠানিক, আজকাল, প্রতিক্ষণ বা অনুষ্টুপও ততটাই। কেননা প্রত্যেকেই, নিজের মতো করে, একটি পেটোয়া লেখকগোষ্ঠী তৈরি করতে চায়, একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ-অনুযায়ী গড়ে তুলতে চায় নিজস্ব বাজার। অথচ, এমন কোনও ছকবন্দি মতাদর্শের কাছে বাঁধা পড়ায় সুবিমলের আন্তরিক বিতৃষ্ণা। ফলে, ‘বোবাযুদ্ধ’, ‘বিজ্ঞাপনপর্ব’, ‘কবিতীর্থ’ বা ‘কৌরবে’র মতো হাতে-গোনা কিছু পত্রিকাকেই তাঁর লেখালিখির জায়গা-হিসেবে বেছে নেন তিনি।

একই কথা তাঁর গল্পসঙ্কলন বা উপন্যাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাঁর বেশিরভাগ বইয়ের প্রকাশক ছিলেন তিনি নিজেই। ‘হারাণমাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তি’ বইয়ের প্রকাশক-হিসেবে ‘একাল’ পত্রিকার সম্পাদকদ্বয়ের নাম লেখা হলেও, বইয়ের আসল নির্মাতা ও প্রকাশক ছিলেন সুবিমল। বইসংগ্রহ ১-এর গ্রন্থপরিচয় থেকে জানতে পারছি, বইটি প্রকাশের জন্য ১০০ টাকা দিয়েছিলেন সুবিমলের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ও ‘বিজ্ঞাপনপর্বে’র সম্পাদক রবিন ঘোষ। আবার, দ্বিতীয় গল্পসঙ্কলন প্রকাশের সময়ে, সুবিমল আরেক অভিনব পদ্ধতির আশ্রয় নেন। আজকের দিনে যাকে ক্রাউড ফান্ডিং বলা হয়, ঠিক সেইভাবে, সহ-লেখক ও তাঁর সীমিতসংখ্যক পাঠকদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে, সেই টাকায়, ‘পাঠক সমবায়’ নামক এক প্রকাশনা থেকে, বইটি প্রকাশিত হয়। সমবায়-ভিত্তিতে নিরীক্ষামূলক সাহিত্যের প্রকাশ ও প্রসারের চিন্তা তাঁর আগে কেউ করেছেন কি? দুর্ভাগ্যবশত, এই উদ্যোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অনেক পরে, ২০০৭ সাল নাগাদ, বর্তমান লেখকের কাছে আক্ষেপ করে সুবিমল বলেন, “আমি যেগুলো করতে চেয়েছিলাম সেগুলোর সবকটাই ফেলিওর হল। তোমাদের মতো নতুন লেখকদের জন্যেও কিছু করতে পারিনি। চেষ্টা করেছিলাম। জানো, আমার ‘নাঙা হাড় জেগে উঠছে’ বইটা সমবায় প্রথায় বের করেছিলাম। গ্রাহক হওয়ার জন্যে আবেদন জানিয়েছিলাম। প্রায় ৭০-৮০ জন, না প্রায় ৮৩ জন হবে, গ্রাহক হয়েছিল। সেই টাকায় বইটা ছাপা হয়। তাদের সবাইকে আমি বইটা উৎসর্গ করেছিলাম। কিন্তু এটাও চালানো গেল না। কার বই আগে বেরোবে সেই নিয়ে দলাদলি, খেয়োখেয়ি শুরু হল। ওটা চালাতে পারলে আজ বোধহয় নতুন লেখকদের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠতে পারত।” পরবর্তীকালে, সুবিমলের গল্প-উপন্যাসগুলি, অতনু পালের উদ্যোগে, তাঁর ‘বিতর্ক’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। এর মধ্যে অবিশ্যি, ‘বাণীশিল্প’ থেকে তাঁর গল্পসংগ্রহ এবং অ্যান্টি-উপন্যাস সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে। অ্যান্টি-উপন্যাস সংগ্রহে গ্রন্থিত হয়েছিল তিনটি উপন্যাস— ‘আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারত’, ‘রঙ যখন সতর্কীকরণের চিহ্ন’ এবং ‘কণ্ঠ পালক-ওড়া, সবকিছুই’। তথাকথিত বাণিজ্যিক প্রকাশনা থেকে সুবিমলের বইপ্রকাশের ঘটনা সেই প্রথম এবং শেষ। আমার ধারণা, ধীমান দাশগুপ্ত এবং বীতশোক ভট্টাচার্যের উদ্যোগই এই অসম্ভব ঘটনাটিকে সম্ভব করে তুলেছিল।

এমনকী, জীবনের উপান্তে, যখন হার্পার কলিন্স তাঁর গল্পের ইংরিজি অনুবাদ প্রকাশ করতে চাইছে, তখনও তিনি দ্বিধান্বিত। তিনি চিন্তিত, পাছে তাঁর এতদিনের অবস্থান, এতদিনের শিল্পদর্শনের সঙ্গে কোথাও, কোনওভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেলেন তিনি নিজেই। অথচ, প্রায় চল্লিশবছর ধরে, ভিনধারায় অক্লান্ত লেখালিখি চালিয়ে যাওয়ার পর, সত্যিই কি তাঁর দায় ছিল নতুন করে কিছু প্রমাণ করার?

যেহেতু সুবিমল নিজেই তাঁর বইয়ের প্রকাশক, ফলে বইয়ের প্রচ্ছদ এবং তার অঙ্গসজ্জা নিয়ে যথেচ্ছ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে কিছুমাত্র অসুবিধা হয়নি তাঁর। এবং সেখানেও, ক্রমশ তিনি আরও বেশি নিরীক্ষামূলক হয়ে উঠতে থাকেন, আরও সাহসী ও আক্রমণাত্মক। ‘হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া’-র প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছিল কলকাতা শহরের ম্যাপ, যাতে পার্ক স্ট্রিটের গান্ধীমূর্তির অবস্থানটি একটা লাল বৃত্ত দিয়ে চিহ্নিত। ‘নাঙা হাড় জেগে উঠছে’-র মলাটে আবার কোনও ছবিই রইল না। শুধু লাল-কালিতে লেখা বইয়ের নাম, আর তার চারদিকে, নীলরঙের হরফে লেখা একটি শ্লোগান— ‘যে-ডাঁশটি আপনার রক্ত খেয়ে তেলালো/ বইটির শক্ত পাটাতন দিয়ে তাকে আঘাত করুন/ সে তার হাড় মাস আর রক্তের ছিটকিনিসুদ্ধু/ তার অবস্থানেই পিষে যাক’। ছবিহীন, ক্যালিগ্রাফিহীন, শুধুমাত্র হরফবিন্যাস দিয়ে তৈরি এই প্রচ্ছদটি ছাপা হয়েছিল ঠোঙার কাগজে। বইসংক্রান্ত আমাদের সযত্নলালিত ধারণাগুলিকে, আমাদের নান্দনিক চেতনাকে, এভাবেই, বইয়ের শক্ত পাটাতন দিয়ে আঘাত করতে উদ্যত হন সুবিমল। এবং, এর পর থেকে, তাঁর বেশিরভাগ প্রচ্ছদই তৈরি হয় হরফ সাজিয়ে, অথবা, হাতে লেখা বইয়ের নাম এবং তার ওপর লাল-নীল ফেল্টপেনে কাটাকুটির দাগ-সমেত। যেমন, ‘আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারত’ উপন্যাসের মলাটটি ব্রাউন পেপারের। তাতে কালো কালিতে লেখা ‘রামায়ণ চামারের গল্প’।  তারপর, সেটিকে লাল রঙের মোটা কালি দিয়ে কেটে, তলায় লেখা হয়েছে ‘আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারত’। আবার, ‘সুবিমলের বিরুদ্ধে সুবিমল’ বইয়ের মলাটে ব্যবহৃত হয় মানুষের শিরদাঁড়ার ছবি। আমরা বুঝতে পারি, এইভাবে, বইয়ের মলাটকেও তাঁর টেক্সটের অংশবিশেষে পরিণত করছেন সুবিমল। তৎসহ, বইয়ের ভিতরে, আমরা লক্ষ করি, হরফের সাইজ বাড়িয়ে কমিয়ে, তাদের সজ্জা পালটে, একটি হরফের সঙ্গে অন্য হরফ মিলিয়ে, তৈরি করা হয় বিচিত্র ভিশ্যুয়াল এফেক্ট। এ-জিনিসও বাংলা গদ্যে সুবিমলের আগে আর কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই। সুবিমলের শেষের দিকের বইগুলিতে, এমনকী, প্রচ্ছদের ওপর নামের উল্লেখও বাহুল্য হয়ে দাঁড়ায়। ‘চেটে-চুষে-চিবিয়ে-গিলে’-র মলাটে ব্যবহৃত হয় শুকিয়ে যাওয়া রক্তের মতো কালচে-খয়েরি রঙের খসখসে হ্যান্ডমেড কাগজ, তাতে বই বা লেখকের নামের উল্লেখমাত্র নেই। ‘কিকা কাট-আউট’-নামক গদ্যসংকলনে, বইটিকে মুড়ে দেওয়া হয় নিকষ কালো কাগজে—আবারও, লেখক ও বইয়ের নাম ছাড়াই। ২০০৭ সালে, তাঁর শেষ উপন্যাস ‘পোঁদের গু তিন জায়গায় লাগে’-র প্রায় ১০০০ পৃষ্ঠার স্বহস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি তিনি ফোটোকপি করে পাঠকের হাতে তুলে দেন—ছাপা বা প্রকাশনার মধ্যস্থতাকে অস্বীকার করে, পাঠকের কাছে সরাসরি পৌঁছে যাওয়ার এ এক অভিনব তরিকা। এবং আমরা বুঝি, সুবিমল তাঁর গল্পের আঙ্গিকের মতো, বইয়ের নির্মাণের ক্ষেত্রেও, সমস্ত খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে, এক চূড়ান্ত নেতির মধ্যে ঢুকে পড়ছেন ক্রমশ।

সুবিমল বিশ্বাস করতেন, লেখক এবং পাঠকের মধ্যে একটি বাধাহীন সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি করাই সাহিত্যের প্রধান লক্ষ্য। ফলে, একটি বইয়ের হয়ে ওঠার ব্যাপারে, পাঠককেও সামিল করে নিতে চেয়েছেন তিনি। আমার মনে পড়ছে, সুবিমলের স্বনির্বাচিত গল্পসঙ্কলন ‘৩৬ বছরের রগড়ারগড়ি’-র শেষে অনেকগুলি পাতা সাদা রেখে দেওয়া হয়েছিল, যাতে পাঠক সেখানে নিজের চিন্তাভাবনা, প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করতে পারেন, এবং তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণে বইটি পূর্ণতা পায়। আবার, ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’-এর প্রচ্ছদে, পাঠকের সামনে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল একাধিক বিকল্প নাম— ‘নীলবসনা সুন্দরী আনকাট’, ‘হাতানিয়া-দোয়ানিয়া’, ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি’, ‘নারীবাদের ২৯ দফা’ ইত্যাদি। প্রত্যেকটি নামের পাশে দাগ দেওয়ার জন্য ছিল একটি করে চৌকো বাক্স। এবং পাঠকের উদ্দেশ্যে লেখা ছিল ‘পছন্দমতো যে কোনো একটি নাম বেছে নিন’।

অবশ্য মনে রাখতে হবে, পাঠক-নির্বাচনের ব্যাপারে সুবিমল ছিলেন সতর্ক ও সাবধানী। তাঁর বইয়ে স্পষ্ট লেখা থাকত, ‘সুবিমল মিশ্র কোনো কারণেই অর্ধমনস্ক মানসিকতা প্রার্থী নয়’। বইবিক্রি ও লাভক্ষতির প্রচলিত অঙ্কটিকে বেসামাল করে দেওয়ার অভিপ্রায়ে তিনি বইয়ের দামের জায়গায় লিখে দিতেন, “সুবিমল মিশ্রের পাঠক হলে যা দেওয়া উচিত মনে করেন”। কিন্তু, যে-কোনও পাঠকের হাতে, যে-কোনও মূল্যে নিজের বইকে তুলে দেওয়ার কোনও অভিপ্রায় যে তাঁর ছিল না, সে-কথা বলাই বাহুল্য। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অন্য অনেকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেও, পাঠক এবং তার রুচি ও পাঠাভ্যাসকে রীতিমতো যাচাই করে নিতেন সুবিমল। পাঠক যদি দীক্ষিত হত, তবে তার সামর্থ্যমাফিক দামে, কখনও বা নামমাত্র মূল্যে, তার হাতে নিজের বই তুলে দিতে আপত্তি করতেন না। আবার, যদি কাউকে অগভীর ও নিছক চমকলোভী বলে মনে হত তাঁর, তবে তাকে পত্রপাঠ বিদায় করে দিতেও দেখেছি। বইনির্মাণ, প্রকাশ ও বিপণনের গোটা পদ্ধতিটাকে সুবিমল এভাবেই, নিজের আদর্শ-অনুযায়ী, এক-তারে বেঁধে ফেলতে পেরেছিলেন, একজন সার্থক auteur-এর ঢঙে।

রবীন্দ্রনাথ ও তলস্তয়কে ‘জীবনশিল্পী’ বলে অভিহিত করেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। তাঁর মতে, এই দুই দানবিক প্রতিভার ক্ষেত্রে, তাঁদের শিল্প আর জীবন একই বিন্দুতে এসে মিলে গিয়েছিল— যেন, তাঁরা আসলে একই বিশ্বদৃষ্টির দ্বিবিধ প্রকাশ, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। রবীন্দ্রনাথের নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে, আমরা জানি, সুবিমলের নান্দনিক অবস্থানের পার্থক্য যোজনপ্রমাণ, এবং সুবিমল নিজেই বহুবার, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ তীব্রতায়, সে-কথা জানাতে ভোলেননি। কিন্তু, আপাতত যদি সে-পার্থক্য সরিয়ে রেখে, শুধু ওই ‘জীবনশিল্পী’ শব্দটির প্রয়োগক্ষেত্রের কথা ভাবি, তবে দেখব, সুবিমল মিশ্র-সম্পর্কেও অনায়াসে তাকে ব্যবহার করা চলে। যে-আপসহীন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা সুবিমল তাঁর গল্পে-উপন্যাসে-প্রবন্ধে লিখেছেন, নিজের জীবনকেও সেই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ছকে সাজিয়ে নিতে এতটুকু দ্বিধা করেননি তিনি। কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে, কোনও পুরস্কার বা অনুদানের তোয়াক্কা না-করে, শম্পা মির্জা নগরের ছোট একটা ফ্ল্যাটে, মেঝে থেকে ছাদ অবধি ঠাসা বই আর কাগজপত্রের মাঝখানে তাঁর যে দমবন্ধ যাপন, সে-ও তো এক শিল্পনিরীক্ষাই। ২০০৭ সালের সেই আলাপচারিতায়, সুবিমল বলেন— “আমি যেটা করতে চেয়েছি, সেটা একটা টোটাল ব্যাপার। শুধু ছোট কাগজে লিখেছি, তাই নয়, গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য ইশকুল-মাস্টারি করেছি। সোনাগাছির কাছে একটা ইশকুলে। সেখানেই বাসা ভাড়া করে থেকেছি। টিউশানি করিনি, বিটি করিনি। নিজের খরচে বই ছেপেছি, বাঁধাই করেছি, ঘাড়ে করে বিক্রিও করেছি। এই যে বাড়িতে আমি আছি, চাদ্দিকে ভূপাকার বই, পা-রাখার জায়গা নেই, দমবন্ধ ব্যাপার, এসবই ওই একটাই কারণে, একটাই জায়গা থেকে। জীবনযাপন সম্বন্ধে মধ্যবিত্ত ধারণাগুলোকে ভাঙতে গিয়ে। যে, এভাবেও একটা লোক বাঁচতে পারে, লিখে যেতে পারে। আর আজ যদি এই ফ্ল্যাটটা হঠাৎ ভূমিকম্পে ভেঙে যায়, তাহলে আমাকে গাছতলায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আর কিছু তো করতে পারিনি। লিখে একটাও পয়সা নিইনি কখনও।”

সুবিমলের লেখালিখি-সম্পর্কে আমাদের প্রশ্ন থাকতে পারে, সমালোচনার সুযোগও থাকতে পারে নিঃসন্দেহে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ক্ষেত্রে তাঁর সততাকে প্রশ্ন করা কিছুতেই আমাদের ধকে কুলিয়ে উঠবে না। বস্তুত, অন্য অনেকের মতো, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা সুবিমলের মুখোশ ছিল না, বরং সেটাই ছিল তাঁর মুখ— এক ও একমাত্র।


এই লেখায় ব্যবহৃত সুবিমল মিশ্রের বইয়ের প্রচ্ছদের ছবিগুলি কবি কমলকুমার দত্তের সূত্রে প্রাপ্ত।