শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
মহারাষ্ট্রের ইয়াবতমল। কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা যেখানে চমকে দেওয়ার মতো। জীবন ও জীবিকার চরম অনিশ্চয়তার সেই মৃত্যুভূমি থেকে যন্ত্রণা ও জীবননাশের আরও কিছু কথা…
জীবিকা ও ঋণের সম্পর্কটা ইয়াবতমলে ক্রমশই জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।সরকারী জেলা রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলের ইয়াবতমল জেলায় ৩০০০-এরও বেশী কৃষক আত্মহত্যা করেছেন।কলাপুর, ঘাতঞ্জি, রলেগাঁও, কালম্ব সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল।
উপর্যুপরি শস্য ফলনের ব্যর্থতা গত দশকে ইয়াবতমলের কৃষকদের মৃত্যুর কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। রোপনের পর সময়োপযোগী বৃষ্টিপাতের অভাব, রোপনের পর অত্যধিক বৃষ্টিপাত, কিংবা ফসল ঘরে তোলার আগে ঝোড়ো হাওয়া বিটি তুলোর চাষের জন্য বিপজ্জনক। ছোট জমির ওপর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে খরার ফসল চাষ সবসময়ই অত্যন্ত ঝুঁকির ব্যাপার।বিটি তুলোর চাষ যেহেতু একান্তভাবেই সময়োপযোগী ও পরিমিত বৃষ্টিপাতের উপযুক্ত সমতার ওপর নির্ভরশীল, তাই সেচের অন্য কোনও উৎস না থাকার দরুণ এই ফলন চরম দুর্দশার সম্মুখীন হচ্ছে। যেখানে কোনও অঞ্চলের কৃষি-জলবায়ুর সাথে শস্য নির্বাচনের আদৌ কোনও সমন্বয় নেই, সেখানে অস্থিতিশীল কৃষিব্যবস্থা দেশের জন্য একটি যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে উত্তরোত্তর খরচ বৃদ্ধি, অন্য জীবিকার অভাব, ফসল সংরক্ষন ও শস্য সুরক্ষার উপযুক্ত পদ্ধতি ও পরিকল্পনার অভাব কৃষিব্যবস্থায় ঋণাত্মক ফল সৃষ্টি করে। একজন বিটি তুলো চাষী কোনওক্রমে চাষের খরচটুকু তুলতে সক্ষম হয় মাত্র, গৃহস্থালির ব্যয়ভার মেটানোর মতো যথেষ্ট লাভ করা তো দূর অস্ত। অশোধিত ঋণের বোঝা বৃদ্ধি, ঋণ শোধের অক্ষমতা অথবা পরবর্তী ঋণগ্রহণের বাধ্যতা, মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের জীবনের কিনারায় এনে দাঁড় করায়।
এই ঋণচক্র অমর ও অনিষ্ক্রমনীয়। একে তো কৃষিকাজে লাভ নেই। ফলে এরপরেও যাদের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণগ্রহণের যোগ্যতা থাকে তারা সেই ঋণের টাকা দিয়ে অকৃষিজ ব্যয় করতে বাধ্য হয়। যদিও প্রায় ৮০-৯০% কৃষক গত কয়েকবছরে ব্যাঙ্ক ঋণ পেতে অক্ষম হয়েছেন।কৃষি ঋণ কিস্তিতে শোধ করার কোনও সুযোগ নেই। যে সমস্ত কৃষকরা একবার ব্যাঙ্ক-ঋণ শোধ দিতে অসমর্থ হন, তাদের ‘অযোগ্য’ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক ঋণব্যবস্থা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। ঋণশোধের ক্ষেত্রে চাষীদের বিশ্বাসযোগ্যতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ঋণদাতারা ১০-১২% এর মতো উচ্চহারেও ঋণ দিতে অস্বীকার করছেন।
বর্তমান ঋণমকুবের ফলে এই অবস্থার কোনও প্রতিকার হয় নাকি সেটাই দেখার। যদিও ২০০৭-এ ৬০,০০০ হাজার কোটি টাকার ঋণমকুব এই অবস্থার খুব সামান্যই প্রতিকার করতে পেরেছে বা এই দুর্দশার খুব স্বল্পই মোচন করতে পেরেছে।পক্ষান্তরে, স্থানীয় ব্যাঙ্ককর্মীদের কথা অনুযায়ী, এটা পরিবর্তে ইচ্ছাকৃত অক্ষম চাষীদের সংখ্যা বাড়িয়েছে।
জলতলও নেমে যায়। জলকষ্ট দেখা দেয়। চাষীরা মরিয়া হয়ে প্রথম বৃষ্টিপাতের জন্য অপেক্ষা করে যাতে তারা চাষ আবাদ শুরু করতে পারে।বীজ রোপনের পরই বৃষ্টিপাতের অভাব দ্বিতীয় বা তৃতীয় দফায় বীজ বপন করতে বাধ্য করায় যা বীজের খরচও বাড়িয়ে দেয়। বপনের আগে ঋণ করা পছন্দের বিষয় নয়, বাধ্যতার বিষয়। ব্যাঙ্কের থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ঋণের জন্য পরিবারের ওপর ভরসার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আত্মীয়দের সময়মতো ঋণ পরিশোধ করার দায়বদ্ধতা অনেক বেশী, এবং পরিবারের কারও থেকে ঋণ নিলে ঋণ শোধ করতে না পারলে তার লজ্জাও অনেক বেশী। এক স্থানীয় ব্যাঙ্ক কর্মচারী এই দুরবস্থার শ্রেণীবিন্যাসকে নির্দেশ করে বলেন, “ওরা এই ব্যবস্থার জন্য আরও নীচে নেমে যাচ্ছে। তুমি ব্যাঙ্ক দিয়ে শুরু কর, তারপর তুমি ব্যাঙ্কের থেকে প্রত্যাখ্যাত হও। তুমি ঋণদাতার কাছে যাও, তুমি তাদের থেকেও প্রত্যাখ্যাত হও। শেষপর্যন্ত তুমি পরিবারের কারও থেকেই ঋণ নিতে বাধ্য হও।”
রোপনের মরশুমের আগে বিটি তুলোর বীজের বিজ্ঞাপন খুব বেশী চোখে পড়ে। বীজ ব্যবসায়ীরা অনেকসময়ই বীজ ও অন্যান্য জিনিস বিনামূল্যে দিয়ে ঋণদাতার ভূমিকা পালন করে এবং ফসল তোলার পর প্রথম ফলনের অংশ দাবী করে। ইয়াবতমলে ঋণপ্রদানের ধরনটাও বদলে যাচ্ছে, কারণ ঋণদানে একটি নতুন শ্রেণীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে, এবং ঋণদাতারাও অপেক্ষা করা বা তাগাদা দেওয়ার পরিবর্তে এককালীন নিশ্চিত লেনদেন পছন্দ করে।
চাষীরা সবসময়ই সমবায় ব্যবস্থায় কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের গুরুত্বের কথা বলে। বর্তমানে, একজনকে পুনরায় ঋণগ্রহণের যোগ্য হতে হলে তাকে একবছরের মধ্যে ব্যাঙ্কের পুরো ঋণ শোধ করতে হয়। আংশিক ঋণ পরিশোধের জন্য আংশিক ঋণপ্রাপ্তির কোনও ব্যবস্থা নেই। সেজন্যই অর্ধেক ঋণ পরিশোধের জন্য কোনও ছাড় নেই, এবং কেউ অর্ধেক ঋণ শোধ করতে পারলেও তাকে অযোগ্য হিসেবেই গণ্য করা হয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত সে সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করছে।
এটা ভাবা ভুল যে আত্মহত্যা স্বস্তি নিয়ে আসে বা দেয় ঋণ মোকাবিলা করার এটি একটি সমাধান, কারণ আত্মহত্যার পরও ঋণ মকুব হয় না; বরং, চাষীর আত্মহত্যার পর পরিবারের পক্ষে ঋণ শোধ করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আত্মহত্যার পর সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে, কারণ তখন সেই চাষীর পরিবারের ওপর ঋণের বোঝা থাকলেও কোনও উপার্জনক্ষম ব্যক্তি থাকে না।
(এই গবেষণা প্রকল্পটি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া দ্বারা অনুমোদিত (২০১৪-২০১৬) এবং শিভ নাদার বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা পরিচালিত। আর বি আই এর কাছে প্রদত্ত বিবৃতিটি অধ্যাপক অজয় দান্ডেকর ও ডঃ শ্রীদীপ ভট্টাচার্য লিখিত।)