জয়ন্ত ভট্টাচার্য
প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য-কর্মী
রামায়ণের “সুন্দরকাণ্ড”-র অষ্টবিংশতি সর্গের ৬ নম্বর শ্লোকে আছে—
নূনং মমাংগান্যচিরাদনার্যঃ।
শস্ত্রৈঃ শিতৈ ক্ষেৎস্যতি রাক্ষসেন্দ্রঃ।।
তস্মিন্ননাগচ্ছতি লোকনাথে।
গর্ভস্থজন্তোরিব শল্যকৃন্তঃ।।[1]
কলকাতা থেকে ১৮৯২ সালে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুবাদে যে রামায়ণ[2] প্রকাশিত হয় তাতে এর অনুবাদ দেওয়া আছে— “এক্ষণে রাম যদি না আইসেন, তাহা হইলে চিকিৎসক যেমন অস্ত্র দ্বারা গর্ভস্থ জন্তুকে ছেদন করে, সেইরূপ ঐ নীচ, শানিত অস্ত্রে শীঘ্রই আমারে খণ্ড খণ্ড করিবে।” একই বছরে মন্মথনাথ দত্ত রামায়ণের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, “vile lord, of the Rakshasas, mince my limbs with his arrows like unto surgeon cutting of the limbs of an embryo.” এখানে মন্মথ দত্ত একটি নোট যোগ করেছেন, “এই অনুচ্ছেদটি পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করে যখন রামায়ণ লেখা হচ্ছে তখন দক্ষ এবং প্রজ্ঞাবান শল্য চিকিৎসকেরা ছিলেন।”
আমরা কয়েকটি প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্রথম, রামায়ণের পাঠ ও অন্যান্য সূত্র থেকে যতটুকু বুঝি যে সীতা যথেষ্ট শিক্ষিত কোনও মহিলা ছিলেন না। কিন্তু শল্য চিকিৎসকেরা গর্ভস্থ ভ্রূণ কাটাছেঁড়া করে এরকম এক ধারণা তাঁর আছে। তাহলে কি সত্যিই সেসময়ে এরকম প্র্যাকটিস বাস্তবে ছিল? দ্বিতীয়, রামায়ণের বাংলা এবং ইংরেজি অনুবাদের সময়কাল জুড়ে জাতীয়তাবাদী ধারণা সমাজে শেকড় বিস্তার করছে। এজন্য ইংরেজি অনুবাদককে একটি নোট যোগ করতে হচ্ছে প্রাচীন ভারতের উল্লেখযোগ্য সম্ভারের অস্তিত্ব বোঝানোর জন্য। তৃতীয়, সীতার বয়ানকে আমরা তথ্য হিসেবে কতটা ভরসা করতে পারি? সীতার প্রাথমিক স্তরের যে ধারণা বা লোকশ্রুতি সম্পর্কে জ্ঞান তাকে এম্পিরিকাল নলেজ বলে বুঝতে হবে। এ পরিস্থিতিতে বিমলকৃষ্ণ মতিলাল থাকলে হয়তো বৈয়াকরণ ভর্তৃহরিকে উদ্ধৃত করে বলতেন— he recognized quite clearly the very significant role of language in the structure of empirical knowledge.[3]
প্রশ্নগুলো আরেকটু ভাল করে পরপর সাজালে এরকম হতে পারে— তথ্য কী? কী এর চরিত্র (ontology)? কীভাবে জন্ম নেয় তথ্য? কোন ঐতিহাসিক, আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে একটি নির্দিষ্ট তথ্যের বা তথ্যসমূহের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে? কীভাবে বিভিন্ন টুকরো টুকরো তথ্য একটি জ্ঞান কাঠামোর জন্ম দেয়? রামায়ণের এই নির্দিষ্ট তথ্যের যাথার্থ্য কতদূর? একে কি আমরা তথ্য না বলে proto-information বা প্রাক্-তথ্য বলতে পারি?[4] তথ্য কি শুধুই তথ্য হিসেবে থেকে যায়? কিংবা একটি বিশেষ যুক্তি ও জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemological) প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে জ্ঞান হিসেবে সঞ্চিত হয় এবং স্বীকৃতি লাভ করে? জ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি লাভের এই ধরন ও প্রক্রিয়া কি সর্বজনীন? কিংবা, ভারতীয় ও পাশ্চাত্যের ধরনের মাঝে ভিন্নতা আছে? ভারতীয় দর্শনে যেভাবে ধাপে ধাপে জ্ঞানার্জনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় অপরিমেয় তথ্য থেকে গড়ে ওঠা পাশ্চাত্যের দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ধারণা কি একইভাবে গড়ে উঠেছে?
এখানে ভারি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন এ কে রামানুজন। তাঁর “Is there an Indian Way of Thinking? An Informal Essay”-তে একাধিক প্রশ্নকে এভাবে সাজিয়েছেন—
Is there an Indian way of thinking?
Is there an Indian way of thinking?
Is there an Indian way of thinking?
Is there an Indian way of thinking?
উত্থাপিত জিজ্ঞাসাগুলোকে বিভিন্নভাবে দেখা যেতে পারে। কোথায় জোর পড়ছে তার ওপরে নির্ভর করছে জিজ্ঞাসাটিকে কীভাবে দেখছি। অর্থাৎ, যে দেখছে (যাকে আমরা বিষয়ী বলব) তার ওপরে নির্ভর করছে প্রশ্নটির চারটে আলাদা অংশের গুরুত্ব। একইভাবে যে বিষয়ী তার ওপরে নির্ভর করবে যে বিপুল তথ্যরাজি তার সামনে রয়েছে সেখান থেকে জ্ঞানের এবং ধারণার নির্মাণ কী পদ্ধতিতে একজন করবে। তাহলে প্রসঙ্গ চলে এল পদ্ধতির, জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতির, যাকে দিয়ে তথ্যের অপরিমেয় জগৎ জ্ঞানের বিশেষ জগতে রূপান্তরিত হবে। যখন Is-এ জোর পড়ছে তখন was-ও গুরুত্ব পাচ্ছে, আগে ছিল কিন্তু এখন নেই। যখন an-এ জোর থাকে তখন চিন্তার বহুত্বের প্রসঙ্গ এল, কোনও একটি ধরনে ভারতীয় চিন্তন বাঁধা পড়ে আছে বা নেই। যখন Indian-এ জোর দেওয়া হল তখন মৌলিক যে প্রশ্ন উঠে এল তা হল, আদৌ ভারতীয় চিন্তন বা চিন্তাপদ্ধতি বলে কিছু আছে? নাকি এ চিন্তন প্রাক-শিল্প, প্রাক-ছাপাখানা, গ্রামীন ও তদুপরি নাগরিক ডিসকোর্সবিহীন একটি ফেনমেনোলজিকাল অস্তিত্ব? কিন্তু thinking-এর ওপরে যখন জোর দেওয়া হল তখন গোড়া ধরে মারো টান গোছের এক অবস্থা তৈরি হল— আদৌ ভারতীয়রা কি চিন্তা করতে পারে?
খানিকটা রামানুজনের উত্থাপিত প্রশ্নের বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শেল্ডন পোলক প্রবন্ধ লিখলেন— Is There an Indian Intellectual History? Introduction to “Theory and Method in Indian Intellectual History”। এ প্রবন্ধে পোলক মন্তব্য করছেন, বিশেষ করে প্রাক-আধুনিক মুহূর্তে, “represents a challenging and, in global-historical terms, crucial sphere of study.”
রামায়ণীকথার বহুত্ব বনাম অতিরাষ্ট্রের উপাখ্যান
দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর “দ্য বেঙ্গলি রামায়ণস” গ্রন্থের শুরুতেই দুটি বিষয় পাঠকদের নজরে এনেছেন— প্রথম, বাল্মীকি রামায়ণের মাঝে যে ধারাবাহিক স্থিরতা বিদ্যমান এবং দ্বিতীয়, রামায়ণের টেক্সটের আভ্যন্তরীণ যে সমসত্ত্বতা রক্ষিত হয়েছে সে দুটির প্রতি। তাঁর ধারণানুযায়ী এ কারণে রামায়ণ জাতীয় মহাকাব্য হয়ে উঠতে পেরেছে। আবার পরবর্তীতে ওই গ্রন্থেই পরে আলোচনায় তিনি দেখিয়েছেন বাংলায় এসে রামায়ণের দার্ঢ্য এবং ওজস্বিতা কীভাবে অনেকাংশে খসে গিয়েছে। সীতা, রামায়ণ, এমনকি হনুমানও আমাদের বেশ ঘরের লোক হয়ে উঠেছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাবণের হাসি দেখে সীতার মনে হয়—
কুড়ি পাতি দন্ত মেলি দশানন হাসে।
কেতকীকুসুম যেন ফোটে ভাদ্রমাসে।।
আবার কোথাও—
জানকী কাঁপেন যেন কলার বাগুরি।
রঘুনন্দনের “রাম-রসায়ন”-এ রামের সাথে বৈষ্ণবীয় চৈতন্যদেব যেন মিশে গেলেন—
শ্রীরাম আইলা শুনি যতেক যুবতি।
ভোলে নিজ গৃহকার্য্য গুরুজন পতি।।
কেহ যায় একপদে আলতা মাখিয়া।
আর জন যায় করে নুপূর পরিয়া।।
এক আখি মাত্র কেহ রঞ্জনে রঞ্জিয়া।
ধাইল যুবতী সতী উতোরোল হিয়া।।
তারপরে সুকুমার রায়ের হাতে পড়ে তো আর কথাই নেই— “ওরে বাবা ইকী লাঠি/গেল বুঝি মাথা ফাটি/নিরেট গদা এ কি সর্বনেশে!/কাজ নেইরে খোঁচা খুঁচি/ছেড়ে দে ভাই কেঁদে বাঁচি” ইত্যাদি।
কিংবা, গোটা রামায়ণকে একেবারে শিশুসুলভ লঘুতা, চাপল্য এবং সারল্যের স্তরে এনে—
হনুমান। আমার কান কটকট কচ্ছে—
রাম। আহা, যারে যা, আর গোল করিসনে— নে বকশিশ নে। (কলা প্রদান)
এরকম নানা ধরনের রাম এবং রামায়ণের মাঝে পড়ে আমরা বেশ আতান্তরে আছি— রাষ্ট্রের রামায়ণই কি আমাদের সবার রামায়ণ? ওই যেখানে বিধর্মী মুসলিমরা “রামের মন্দির” ভেঙে বাবরি মসজিদ তৈরি করেছিল সেখানে আবার “যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি” ঘোচানোর জন্য রামমন্দির তৈরি হচ্ছে এবং যে কাজের জন্য খোদ দেশের রাষ্ট্রপতি অনেকগুলো টাকা দিয়েছেন! এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ও এর অনুকূলে গিয়েছে। এরকম পুণ্যের কাজে collateral damage হিসেবে সংখ্যার দিক থেকে কয়েক হাজার মারতে পারলে তবে যে একজন হিরো তথা বীর হয়ে ওঠে এ তো আমরা জানিই। সেই কবে ১৭৫৯ সালে বেইলবি পর্টিয়াস লিখেছিলেন Death: A Poetical Essay। সেখানে কেমন জোর গলায় লন্ডনের এই বিশপ ভদ্রলোক বেমালুম বলে দিলেন—
One murder made a villain,
Millions a hero. Princes were privileged
To kill, and numbers sanctified the crime.
এরপরে আমাদের চ্যাপলিন “মঁসিয়ে ভার্দু”-তে একথাগুলোর সাথে বিচারের সময়ে ভার্দুর বয়ানে বলিয়ে দিলেন—
As for being a mass killer, does not the world encourage it? Is it not building weapons of destruction for the sole purpose of mass killing?
তাহলে ব্যাপারটা বেশ সরল হয়ে গেল, “এখন সবই শান্ত এবং ভাল”। “পেটের কাছে উঁচিয়ে আছ ছুরি” বলেই তো আমরা কেমন সুন্দর “স্বাধীনমতো ঘুরি”! Collateral damage নিয়ে এরপরে আর বিশেষ কোনও সমস্যা রইল না।
কিন্তু বেশ একটা ঘোটালা রয়ে গেল মিথ তথা কল্পকাহিনি, মহাকাব্য তথা এপিক আর ইতিহাসের গতায়াত নিয়ে। কীভাবে এরা তৈরি হয়, কীভাবেই বা ছড়িয়ে পড়ে, জারিয়ে যায়। কীভাবেই বা খোদ রাষ্ট্র এসে বলে “এই লভিনু সঙ্গ তব” তাই আমি সুন্দর কল্পকাহিনি আর ইতিহাসকে মিলিয়ে মিশিয়ে উল্টেপাল্টে দিতে পারি বিলক্ষণ। তারপরেও, রাষ্ট্র হিসেবে, পর্টিয়াস আর চ্যাপলিন যেমনটি বলেছেন আমরা ক্রমাগত “বীর” সন্তানদের জন্ম দিই প্রতি বীরের জন্য হাজার আর লাখ ঝরতি-পড়তি মানুষের মৃত্যুর নিয়ম মেনে।
যেন পর্টিয়াস আর চ্যাপলিনের কথাকে সত্যি করে ভারতসন্ধানী অধ্যাপক শেল্ডন পোলক তাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ “Ramayana and Political Imagination in India” শুরু করছেন মৃত্যুর খতিয়ান দিয়ে, এবং সে সংখ্যা হাজারে। তাঁর প্রবন্ধের প্রথম বাক্যটি হচ্ছে— “ডিসেম্বর ১৯৯২ থেকে ১৯৯৩-এর জানুয়ারি পর্যন্ত ৩০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, সুরাট থেকে কলকাতা, কানপুর থেকে বাঙ্গালোর।”
এরকম অবস্থায় এসে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ একটা আপৎকালীন পরিস্থিতিতে পড়েছেন। একাদশ খণ্ডে প্রকাশিত রচিত তাঁর সুবিশাল বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত-র ২০০৮ সালের সংস্করণে বলছেন (স্মরণে রাখব এর আগেই বীর রাম-সেনানীর দল বিধর্মীর সৃষ্টি মসজিদের স্থাপত্য ভেঙে ইটের টুকরো নিয়ে দাঁড়ানো বিশ্বজয়ীর আত্মপ্রসাদের হাসির ছবি আমরা দেখেছি!)—
ভক্তির সঙ্গে যুক্তির কদাপি সহাবস্থান হতে পারে না। ইতিহাসের সঙ্গে গল্প-আখ্যানের সব সময়ে ঐক্যমত্য হয় না। রামায়ণ নিয়ে যে বিতর্ক ও বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে আছে চিরাভ্যস্ত সংস্কার ও যুক্তিপন্থী সিদ্ধান্তের বিরোধ— প্রায়শই একের সঙ্গে অপরের দ্বৈরথ শুরু হয়ে যায়। একালে এই দ্বন্দ্বসংঘাত যে উগ্র রাজনৈতিক উত্তাপ সৃষ্টি করেছে তার ফলে রাম সমস্যার শীঘ্র সমাধান হওয়া দুরূহ। রবীন্দ্রনাথের “কবি তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো”— একথার উপরে গুরুত্ব দিলে পাড়ায় পাড়ায় শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা আছে।[5]
ভারতে এবং ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে রামায়ণের বিভিন্ন রূপ, ব্যপ্তি এবং সামাজিক প্রভাব থেকে বোঝা যায় কোনও একটি টেক্সট হিসেবে এর তুল্য আর কোনও সাহিত্য ভারত ভূখণ্ডে রচিত হয়নি। এ কে রামানুজন তাঁর “Three Hundred Ramayanas: Five Examples and Three Thoughts on Translation” প্রবন্ধে দেখিয়েছেন প্রতি একজন ভিন্ন রামের জন্য একেকটি রামায়ণ জন্ম নিয়েছে বা রচিত হয়েছে। আন্নামী, বালি ভাষায়, তিব্বতি, থাই, কম্বোডীয়, সংস্কৃত, সাঁওতালি, সিঙ্ঘলি, তামিল, তেলুগু, গুজরাটি ইত্যাদি অনুমানযোগ্য সংখ্যায় অপরিমেয় সংখ্যায় রামের চরিত্রায়ণ এবং চরিত্রবর্ণন হয়েছে। শুধুমাত্র সংস্কৃতেই ২৫টি বা তার বেশি “tellings belonging to various narrative genres (epics, kavyas or ornate poetic compositions, puranas or old mythological stories, and so forth)” রামায়ণের বিভিন্ন চেহারা দেখা যায়। একে রামানুজন telling বলেছেন। কেন? কারণ হিসেবে তিনি জানাচ্ছেন—
I have come to prefer the word tellings to the usual terms versions or variants because the latter terms can and typically do imply that there is an invariant, an original or Ur -text—usually Valmiki’s Sanskrit Ramayana, the earliest and most prestigious of them all. But as we shall see, it is not always Valmiki’s narrative that is carried from one language to another.
রামানুজন দেখিয়েছেন— রামের পদধূলিতে প্রস্তরীভূত অবস্থা থেকে অহল্যার যে শাপমুক্তি সে আখ্যানের ক্ষেত্রে সংস্কৃতে বাল্মীকি এবং তামিলে কম্পণ-এর আখ্যানের মাঝে বেশ কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে, হুবহু একইরকম নয়। শুধু তাই নয়, হিন্দু ধর্মে প্রচলিত রামায়ণী আখ্যানে রাবণকে সবসময়েই দস্যু বা খলনায়ক হিসেবে চিত্রিত ও প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কিন্তু জৈনদের রচিত রামায়ণের শুরুতেই রাবণকে নায়ক করে চিত্রিত ও প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এবং রাবণের মতো জ্ঞানী ও শুদ্ধকাম মানুষ কেন নায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে না এ প্রশ্নও জোরালোভাবে রাখা হয়েছে।
রামানুজন আরও বলেছেন, রামায়ণ সম্ভবত তিনটি রাস্তা ধরে প্রসার ও বিস্তার লাভ করে— (১) স্থলভূমি দিয়ে উত্তরদিকে পাঞ্জাব ও কাশ্মির থেকে চিন, তিব্বত এবং পূর্ব তূর্কিস্থানে পৌঁছয়, (২) সমুদ্রপথে দক্ষিণদিকে গুজরাট এবং দক্ষিণ ভারত থেকে জাভা, সুমাত্রা এবং মালয়ে যায়, এবং (৩) আবার স্থলপথ ধরে বাংলা থেকে ছড়িয়ে পড়ে বার্মা, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়াতে।[6]
কবে রচিত হল বাল্মীকির রামায়ণ? অনুমান করা হয়, যেমনটি রোমিলা থাপার মনে করেন[7], ৭টি কাণ্ডে ২৪,০০০ শ্লোক নিয়ে (প্রধানত অনুষ্টুপ ছন্দে) রামায়ণ কাব্য হিসেবে ছন্দোবদ্ধ হয় খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীর প্রথমভাগে। মধ্য-গাঙ্গেয় সমতলভূমি এবং বিন্ধ্যপর্বতের অরণ্য অঞ্চলকে এই মহাকাব্যের পটভূমি হিসেবে রাখা হয়েছে। থাপারের অনুমান (অন্য অনেক গবেষকেরও একইরকম অনুমান) রামায়ণ বাল্মীকির হাতে সূত্রবদ্ধ হওয়ার কয়েকশো বছর আগে চারণকবিদের গীতিমালার মধ্যে ছিল, তারা এ গান অঞ্চল থেকে অঞ্চলান্তরে গেয়ে বেড়াত। ওয়েন্ডি ডনিগারের ধারণায় রামায়ণ এবং মহাভারত “were probably composed and performed first in the interstices between engagements on a battleground, to an audience that probably consisted largely of Kshatriyas and miscellaneous camp followers. The first bards who recited it were a caste called Charioteers (Sutas), probably but not certainly related to the chariot drivers who appears frequently in narratives…”[8]
এমনকি যাকে মহাভারতের ক্ষেত্রেও— যাকে আমরা সঙ্গত কারণেই মহাকাব্য হিসেবে বিবেচনা করি— এর গড়ে ওঠার মাঝে সমধর্মী উপাদান রয়েছে। ইরাবতী কার্ভে (Irawati Karve) তাঁর Yuganta: The end of an epoch (2008) গ্রন্থে বলছেন—
সূত নামের একশ্রেণির মানুষ, যারা ক্ষত্রিয়দের জারজ বংশধর, রাজদরবারে বিভিন্ন ধরনের কাজ করত। তারা রাজাদের পরামর্শদাতা ও বন্ধু, এবং চারণকবি হিসেবেও ভূমিকা পালন করত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পরিভ্রমণ করে বেড়াত— যেসব স্থানে অনেক মানুষের সমাগম হবে— এবং রাজারাজরার অন্দরের কাহিনি গান গেয়ে, অভিনয় করে বর্ণনা করত… এরকম অভিনয় ও বর্ণনা থেকেই এক নতুন ধরনের সাহিত্য গোত্রের জন্ম হয়… এর মাঝে মহাভারত পড়ে, যার আগের অনেক ছোট আখ্যানটির নাম ছিল জয়… স্কলার এস ভি কেটকার একে সৌত সাহিত্য হিসেবে অভিহিত করেছেন।”[9]
এ সমস্ত চারণকবিদের এবং রথচালক বা সূত সম্প্রদায় যারা সেসময়ে সামাজিকভাবে নিচুতলার মানুষ, গ্রাম-গ্রামান্তরে এধরনের গীতিকাব্য গাওয়া এবং অভিনয় করে দেখানোই পেশা (নেশাও বটে) ছিল। যখন বাল্মীকির মতো সামাজিকভাবে উচ্চবর্গের (বল্মীক সম্প্রদায় থেকে বাল্মিকী। এজন্য অন্ত্যজও ভাবা হয়) মানুষের হাতে নতুন লিখিত চেহারা পেল সমগ্র কাব্যের চরিত্র মূল থেকে বদলে যেতে শুরু করল। প্রসঙ্গত বলার যে মহাকব্যের রচনার সময় বা মাধ্যমের মধ্য দিয়ে বেদের “শ্রুতি” চরিত্র “স্মৃতি”-তে রূপান্তরিত হল। ছন্দোবদ্ধ কবিতা স্মৃতিতে ধরে রাখার পক্ষে সুবিধেজনক যাকে বলে mnemonic verses। কাব্যের মাঝে ব্রাহ্মণ্যত্বের উপাদান প্রাধান্যকারী হয়ে উঠল।
আরও কিছু উপাদান প্রবেশ করল রামায়ণের টেক্সটে:
(১) ব্রাহ্মণের সুউচ্চ অবস্থানের বিপরীতে একটি “অপর”-এর পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবায়ন। এ বিষয়টি মহাভারতে এত সফলভাবে হয়নি। কারণ দুটি সমবংশজাত ও সম-কুলগরিমাসম্পন্ন পরিবারের মাঝে যুদ্ধ বিবৃত হয়েছে কাব্যে। সেখানে হিংসা-প্রতিহিংসার হাজারো উদাহরণ থাকবে, কিন্তু একজন আরেকজনের other বা অপর হিসেবে পাঠকের মনে সফলভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে না। এখানে রাবণ একজন অনার্য, এবং কদাচারী। শুধু তাই নয়, রামায়ণের শুরুতে বাল্মীকি বলেন—
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।
পাদবদ্ধোক্ষরসমস্-তন্ত্রীলয়-সমন্বিতঃ।
শোকার্তস্য প্রবৃত্তো মে শ্লোকো ভবতু নান্যথা।।
এখানে শোক থেকে শ্লোকের উৎপত্তি হলেও নিষাদ বা নিচকুলজাত ব্যাধও হচ্ছে “অপর”, যে নির্দ্বিধায় প্রাণীহত্যা করতে পারে। কাব্যের মূল সুরটি এইক্ষণেই বাঁধা হয়ে গেল।
(২) ব্রাহ্মণের বা ব্রাহ্মণ্যত্বের প্রয়োজনে অপর-কে আত্মীভূত করে নেওয়া যায় এবং সেক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষা হয়ে উঠবে এর একমাত্র মাধ্যম। এক অর্থে ভাষার সংস্কৃতায়ন শুরু হল সফলভাবে। শেল্ডন পোলক তাঁর The Language of the Gods in the World of Men (2006) গ্রন্থে একথাটিই সুনির্দিষ্টভাবে জানাচ্ছেন— It is significant that the richly associative term saṃskṛta as an adjective qualifying speech or language (saṃskṛta vag) occurs for the first time in the Vālmīki Rāmāyāṇa, a work of the last centuries before the Common Era.[10] ভাষা-সংক্রান্ত একটি ভাল উদাহরণ রয়েছে রামায়ণে। সুন্দরকাণ্ডে হনুমান যখন লঙ্কায় প্রথম সীতাকে আবিষ্কার করে তখন তার মনে চিন্তা এল— “আমি যদি ব্রাহ্মণদের মতো সংস্কৃতে কথা বলি তাহলে সীতা আমাকে রাবণ ভেবে ভয় পেয়ে যাবে। কীভাবে একজন বাঁদর এ ভাষা বলতে পারে? আমাকে মনুষ্যভাষায় অর্থপূর্ণ শব্দ বলতে হবে যাতে সীতা বুঝতে পারে।[11] এখানে আমরা নিশ্চয়ই “সংস্কৃত” এবং “মনুষ্যভাষা”-র মধ্যেকার পার্থক্য লক্ষ করব। এটাও লক্ষ করব কোন ধরনের জনসম্প্রদায় কী ধরনের ভাষা ব্যবহার করে।
এখানে সুনীতিকমারের মত অভিধানযোগ্য— “যে-সমস্ত দেশে ভারত-ধর্মের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের প্রচার হইয়াছে, সেই-সমস্ত দেশে রামায়ণ মহাভারত ও নানা পৌরাণিক উপাখ্যানও পঁহুছিয়াছে— তবে ব্রাহ্মণ্যের প্রতিষ্ঠার উপর-ই এই সব দেশে রামায়ণ মহাভারত ও পুরাণের প্রতিষ্ঠা নির্ভর করে।”[12] সুনীতিকুমারের ব্যাখ্যায় স্পষ্টতই রামায়ণের প্রসারের সাথে ব্রাহ্মণ্যের প্রতিষ্ঠার সরল যোগসূত্র অনুধাবন করা গেল। একই লেখায় তিনি বলছেন— “ভারতের হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সহৃদয় সাহিত্য-রসিক ব্যক্তিগণের চেষ্টায় রামায়ণের একাধিক অনুবাদ বা রূপায়ণ ফারসী ভাষাতেও হইয়াছে।”
(৩) রাজধর্মের সঙ্গে গার্হস্থ্য ধর্মের এক সুসমঞ্জস সমতাবিধান করা যায় রামায়ণের ভাষ্যের মধ্য দিয়ে। এখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করা যায়। দীনেশচন্দ্র সেনের “রামায়ণী কথা”-র ভূমিকায় লিখলেন—
গৃহ ও গৃহধর্ম যে ভারতবর্ষের পক্ষে কতখানি, ইহা হইতে তাহা বোঝা যাইবে। আমাদের দেশে গার্হস্থ্য আশ্রমের যে অত্যন্ত উচ্চস্থান ছিল, এই কাব্য তাহা সপ্রমাণ করিতেছে। গৃহাশ্রম আমাদের নিজের সুখের জন্য, সুবিধার জন্য ছিল না; গৃহাশ্রম সমস্ত সমাজকে ধারণ করিয়া রাখিত ও মানুষকে যথার্থভাবে মানুষ করিয়া তুলিত। গৃহাশ্রম ভারতবর্ষীয় আর্যসমাজের ভিত্তি। রামায়ণ সেই গৃহাশ্রমের কাব্য। এই গৃহাশ্রম-ধর্মকেই রামায়ণ বিসদৃশ অবস্থার মধ্যে ফেলিয়া বনবাসদুঃখের মধ্যে বিশেষ গৌরব দান করিয়াছে।
সুনীতিকুমার “সত্যনিষ্ঠা, পিতৃভক্তি, পাতিব্রত্য, পত্নীপ্রেম, সৌভ্রাত্র, প্রভুভক্তি, আশ্রিত-রক্ষা” প্রভৃতি গুণগুলিকে সমাজ ও পরিবারের ভারসাম্যরক্ষাকারী ঊপাদান হিসেবে দেখেছেন। তিনি এ ব্যাপারেও সতর্ক করছেন যে—
অন্যদিকে রামের কতকগুলি আচরণে বা কার্যে আধুনিক মানুষ সহমত হইতে পারিবে না; যেমন বালি-বধ, সীতার বনবাস ও শম্বুক-বধ।[13]
এরপরেও দু-একটি ঘটনা থেকে যায় যা আদর্শ পরিবার বা ন্যায়ের শাসনের ধারণার সাথে ঠিক খাপ খায় না। অযোধ্যাকাণ্ডে ২১তম সর্গে লক্ষণ বলছেন— “কৈকেয়ীর কুপ্ররোচনায় আমাদের বাবা যদি কোনও অসদুদ্দেশ্য থেকে আমাদের সাথে শ্ত্রুর মতো আচরণ করেন তাহলে আমি তাঁকে কারারুদ্ধ করব কিংবা যদি প্রয়োজন পড়ে হত্যা করব।”[14] একথাও বলছেন লক্ষণ— “যদি উদ্ধত হয়ে ওঠে তাহলে একজন শ্রদ্ধাবান পুরুষকেও শাস্তি দিতে হবে।”[15]
এগুলোকে মহাকাব্য হজম করল কী করে? কিংবা মহাকাব্য এর কাব্যিক মহত্বে এগুলো হজম করে নেয়। পরবর্তীতে যে যে যেমনভাবে শাসন করবে, রাষ্ট্র চালাবে সে অনুযায়ী মহাকাব্যের অংশ থেকে ভাগ করে নেবে— কোনটা জনতা/শাসিতের জন্য বরাদ্দ আর কোনটা রাষ্ট্র পরিচালক/নিয়ন্ত্রকের জন্য প্রয়োজনীয়। এই বিভাজন ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে এসে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রবীণ ফরাসি গবেষক Charles Malamoud একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন— “What place then, in the perspective of dharma, does vengeance occupy?” তাঁর ব্যাখ্যায় রাজধর্ম যেকোনও সঙ্কটের মীমাংসা করতে পারে— “When a norm is invoked, it is always that of dharma; and it is a basic principle of dharma to reserve, for the king, the privilege of inflicting punishment.”[16]
এরপরেও রবীন্দ্রনাথই আবার সমাধানসূত্র বাতলে দেন—
যাঁহারা পরিপূর্ণ পরিণামের মধ্যে সমস্ত খণ্ডতার সুষমা— সমস্ত বিরোধের শান্তি— উপলব্ধি করিবার জন্য সাধনা করিয়াছেন, তাঁহাদেরও ঋণ কোনো কালে পরিশোধ হইবার নহে। তাঁহাদের পরিচয় বিলুপ্ত হইলে, তাঁহাদের উপদেশ বিস্মৃত হইল মানবসভ্যতা আপন ধূলিধূমসমাকীর্ণ কারখানাঘরের জনতা-মধ্যে নিশ্বাসকলুষিত বদ্ধ আকাশে পলে পলে পীড়িত হইয়া কৃশ হইয়া মরিতে থাকিবে। রামায়ণ সেই অখণ্ড-অমৃত-পিপাসুদেরই চিরপরিচয় বহন করিতেছে। ইহাতে যে সৌভ্রাত্র, যে সত্যপরতা, যে পাতিব্রত্য, যে প্রভুভক্তি বর্ণিত হইয়াছে, তাহার প্রতি যদি সরল শ্রদ্ধা ও অন্তরের ভক্তি রক্ষা করিতে পারি তবে আমাদের কারখানাঘরের বাতায়ন-মধ্যে মহাসমুদ্রের নির্মল বায়ু প্রবেশের পথ পাইবে।
আধুনিক তত্ত্ব আলোচনার পরিভাষায় সমস্ত ধরনের subversion, irruption বা schitz-কে ভারতীয় কল্পিত রমণীয়তার এবং সৌভ্রাত্রের মেদুরতায় মুড়ে দেওয়া হল। রাজধর্ম, সমাজধর্ম, গার্হস্থ্যধর্ম সমস্ত কিছু একসঙ্গে রক্ষিত হল। সবাই একসঙ্গে সহবাসও করতে পারে। (আলোচনার পরিসর মাথায় রেখে আমি জেন্ডার বা নারীর প্রশ্ন আলোচনায় আনলাম না।)
(৪) ভিন্নধর্মী মতামত যে রয়েছে কাব্যে তার প্রমাণ মিললেও সেসব বিরুদ্ধ ধারণা ও মতকে রামের বিপুল ছায়া দিয়ে গিলে ফেলা হয়েছে। দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। অযোধ্যা কাণ্ড-তে জাবালি বলে এক ব্রাহ্মণের উল্লেখ পাই, যিনি দশরথের মন্ত্রী আবার নাস্তিক ছিলেন। অযোধ্যাকাণ্ডের ১০৮তম সর্গে জাবালি ব্রাহ্মণত্ব ও দৈবমহিমার পর্দা সরিয়ে রামকে বলেন— “পিতা তো কেবলমাত্র একটি অস্তিত্বের বীজ। শুক্রাণু ও ডিম্বাণু সঠিক সময়ে মেশে যাতে এক মানবক জন্ম নেয় এই পৃথিবীতে। রাজা সেখানেই শেষ যাত্রা করেন যেখানে তার যাওয়ার কথা।”[17] এরকম একটি স্বরও রয়ে যায় রামায়ণে। কিন্ত জনসমাজে পৌঁছয় না। এরপরেই জাবালি বলছেন— “এসমস্ত লোকেরা [ব্রাহ্মণরা] বলে থাকে ‘অষ্টম দিনে আমাদের পিতৃপুরুষের আত্মার স্বস্তিবিধানের জন্য দান-ধ্যান করতে হয়।’ খাদ্যের অপচয় দেখ। একজন মৃত মানুষ কীভাবে খাবে?”[18] আরেক জায়গায় রামকে বলছেন— “হে প্রজ্ঞাবান পুরুষ! এজন্য এই সিদ্ধান্তে এসো যে এই বিশ্বের বাইরে আর কিছু নেই। আমাদের চোখ যা দেখে তাকে গুরুত্ব দাও, আমাদের জ্ঞানের সীমার বাইরে যা অবস্থান করে তাকে প্রত্যাখ্যান করো।”[19]
আরেকটি নজরে আসার মতো তথ্য হল প্রাচীন রচনা লঙ্কাবতার-এ রয়েছে, রাবণ স্বয়ং বুদ্ধকে প্রশ্ন করছেন— “আপনি কী করে বলবেন যে আপনার তথাগতগর্ভ নীতি এবং আমাদের আত্মসংক্রান্ত ধারণা একই… কারণ ধর্মদ্রোহীরাও (heretics) আত্মসংক্রান্ত ধারণাকে বিবেচনা করে?”[20] এখানে আমাদের বলার কথা একটাই যে রামায়ণকে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কাব্যে অনেকসময়েই রাবণের চিত্রায়ন হয়েছে একজন প্রজ্ঞাবান, দর্শনচর্চায় লিপ্ত মানুষ হিসেবে। ব্যাশাম জানান যে “থেরাবাদ-অনুগামী বৌদ্ধদের জাতক-কাহিনীতে রামায়ণের ঘটনা যে ভাবে উল্লিখিত আছে তাতে সীতাহরণের ও রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধের কোনও প্রসঙ্গ নেই।”[21] জৈন রামায়ণে সীতাকে রামের বোন বলা হয়েছে।
রাজশেখর বসু তাঁর বাল্মীকি রামায়ণ (সারানুবাদ) গ্রন্থে্র ভূমিকায় বলছেন— “প্রক্ষিপ্ত যতই থাকুক তাও বহুকাল পূর্বে মূলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে এবং সমগ্র রচনাই এখন বাল্মীকির নামে চলে। … ভারতীয় সাহিত্যে রামবিষয়ক কথা অনেক পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলির আখ্যানভাগ সর্বাংশে সমান নয়। … কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে বলে গেছেন, এখন অপর কবিরা বলছেন, আবার ভবিষ্যতে অন্য কবিরাও বলবেন। … পুরাণকথার একটি মোহিনী শক্তি আছে। যদি নিপুণ রচয়িতার মুখ বা লেখনী থেকে নির্গত হয় তবে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সকলকেই মুগ্ধ করতে পারে। … মহাভারতে আছে, দ্রোণবধের পর অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, ‘বালিবধের জন্য রামের যেমন অকীর্তি হয়েছে সেইরূপ দ্রোনবধের জন্য আপনার চিরস্থায়ী অকীর্তি হবে।’”[22] এই যেমন বলছেন “পুরাণকথার একটি মোহিনী শক্তি আছে। যদি নিপুণ রচয়িতার মুখ বা লেখনী থেকে নির্গত হয় তবে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সকলকেই মুগ্ধ করতে পারে”— বর্তমানের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র যদি এই পুরাণকথার নির্মাতা হয় সহস্রমুখ প্রচার দিয়ে, আধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে, প্রতিমুহূর্তে পোস্ট-ট্রুথ উৎপাদন করে? তাহলে এর শক্তি বহুগুণ বেড়ে যায়। আমরা প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করছি। আমরা সে সময়ের মাঝে অস্তিত্ব নির্বাহ করছি।
এতসব ভিন্নতায় সমৃদ্ধ রামায়ণের বৃহত্তর আখ্যান হোমোজেনাইজ বা সবকিছুকে, সমস্ত ভিন্নতার আনাচ-কানাচগুলিকে সমসত্ব করে ফেলেছে। উচ্চাবচ অঞ্চলগুলো চোখের আড়ালে, চিন্তার আড়ালেই রয়ে যায়। এখানেই টেক্সটের শক্তি, Ur-text তথা মেটা টেক্সটের এর শক্তি, শক্তি রাষ্ট্রের।
একটি উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিক। তুলসীদাসের হাতে যখন “শ্রীরামচরিতমানস” রচিত হচ্ছে তখন রামকে এমনভাবে আমাদের ঘরের ছেলে, দামাল শিশু হিসেবে নির্মাণ করা হচ্ছে যে এ রামের পরতে পরতে অন্য কোনও স্তর, ভিন্নতর ব্যঞ্জনা থাকতে পারে সে কথা কখনও মাথাতেই আসে না, যেন আমাদেরই ঘরের ছেলে। বাংলার কৃত্তিবাসী রামায়ণের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। তুলসীদাস লিখছেন—
ভোজন করত বোল জব রাজা।
নহি আবত তজি বাল সমাজা।।
কৌসল্যা জব বোলন জাঈ।
ঠুমুকি ঠুমুকি প্রভু চলহিঁ পরাঈ।।
ধূসর ধুরি ভরে তনু আয়ে।
ভূপতি বিহঁসি গোদ বৈঠায়ে।।
ভোজন করত চপল চিতইত উত অবসরু পাই।
ভাজি চলে কিলকত মুখ
দধি ওদন লপটাই।।
(রাজা যখন রামকে খেতে ডাকেন তখন সঙ্গী ছেলেদের ফেলে সে আসতে চায় না। কৌশল্যা ডাকতে গেলে সে ছেলে থুপ থাপ করে ছুটে পালায়। ধূলায় ধূসর ছেলেকে রাজা হেসে কোলে বসান। চঞ্চল মনে খেতে খেতে একটু অবসর পেলেই খিল খিল করে হেসে সে পালায়— মুখে দইভাত লেপটে থাকে।)
এরকম সব চিত্র যখন আঞ্চলিকভাবে তৈরি হতে থাকে তখন বাল্মীকি রামায়ণের বীররসের হানি হয়, কিন্তু রামের বীরত্ব ও রাজধর্মকে কেন্দ্র করে রামায়ণ তার সামাজিক চিরস্থায়ী চিত্রকল্প তৈরি করতে থাকে। এখানে সামাজিক মানসিকতা কীভাবে ক্রমাগত ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে তার একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা রামানুজন দিয়েছেন—
the cultural area in which Ramayanas are endemic has a pool of signifiers (like a gene pool), signifiers that include plots, characters, names, geography, incidents, and relationships. Oral, written, and performance traditions, phrases, proverbs, and even sneers carry allusions to the Rama story. When someone is carrying on, you say, “What’s this Ramayana now? Enough.[23]
রবীন্দ্রনাথ বলছেন— “রামায়ণ-মহাভারতকে যখন জগতের অন্যান্য কাব্যের সহিত তুলনা করিয়া শ্রেণীবদ্ধ করা হয় নাই তখন তাহাদের নাম ছিল ইতিহাস। এখন বিদেশীয় সাহিত্যভাণ্ডারে যাচাই করিয়া তাহাদের নাম দেওয়া হইয়াছে ‘এপিক’। আমরা এপিক শব্দের বাংলা নামকরণ করিয়াছি মহাকাব্য। এখন আমরা রামায়ণ-মহাভারতকে মহাকাব্যই বলিয়া থাকি।” রামায়ণ কখনও ইতিহাস, কখনও মহাকাব্য হিসেবে বিবেচিত হছে। মনিয়ের-উইলিয়ামসের অভিধানে ইতিহাসের শব্দার্থে অতিকথা, লেজেন্ড এসবও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১৩০৩ বঙ্গাব্দে (১৮৯৬ সাল) রমেশচন্দ্র দত্ত যখন রামায়ণের অনুবাদ প্রকাশ করেন তখন একে “হিন্দুশাস্ত্র”-র গোত্রে ফেলেছিলেন। তাহলে একটা রৈখিক যাত্রা দেখতে পাচ্ছি— শাস্ত্র থেকে ইতিহাস থেকে মহাকাব্য।
শেল্ডন পোলকের পূর্বে উল্লেখিত প্রবন্ধ “Ramayana and Political Imagination of India”-তে এই জটিল যাত্রার এবং ইতিহাসের অনুসন্ধান করা হয়েছে নিবিড়ভাবে। তাঁর কাছে প্রশ্ন হিসেবে এসেছে “Ramayana mytheme” কোন পরিস্থিতিতে, কীভাবে এবং কখন “the Ramayana was first deployed as a central organizing trope in the political imagination of India” খুব সংক্ষেপে বললে একাদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর সময়কাল জুড়ে রামায়ণ পশ্চিম এবং মধ্যভারতবর্ষে public political discourse-এর জগতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। স্মরণে রাখতে হবে এসময় দিয়ে তথাকথিত “বিধর্মী” ম্লেচ্ছদের আক্রমণ ও আগমন শুরু হয়েছে সেসময়ের ভারতে। আল-বিরুনি তাঁর India গ্রন্থে খুব যত্ন নিয়ে ভারতের অধিবাসীদের সঙ্গে তাঁর মতো বিদেশিদের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে বলছেন যে আমরা যা বিশ্বাস করি এরা তার ঠিক উলটোটা বিশ্বাস করে।
They are not allowed to receive anybody who does not belong to them, even if wished it, or was inclined to their religion.[24]
এ বিবরণ বোঝায় একাদশ শতাব্দী পরবর্তী সময়ে বা তারও আগের থেকে বিদেশি আগন্তুকদের বিষয়ে ভারতীয়রা খুব অনুকূল দৃষ্টিকোণ বা মনোভাব পোষণ করত না। পরতে পরতে এ সমস্যা ধরার চেষ্টা করেছেন পোলক একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক বিবরণ বিশ্লেষণ করে। আগ্রহী পাঠকেরা অবশ্যই প্রবন্ধটি পড়বেন। বিস্তারিত সমস্যাগুলোর একটা সাধারণগ্রাহ্য জবাব দিয়েছেন, প্রশ্ন রেখেছেন পোলক—
If the adoption of the Ramayana to process the events of the eleventh to fourteenth centuries suggests a complex interplay of culture and political power, equally complex is the problem of the present with which I started, the reappropriation of this imaginary in contemporary India.[25]
এরপরে পোলক যোগ করছেন—
If the Ramayana has served for 1,000 years as a code in which protocommunalist relations could be activated and theocratic legitimation could be rendered-if it constitutes an imaginary within which the public sphere is not sundered from the religious, and at the same time cannot be conceptualized without a concomitant demonization of some other-it makes sense that it would be through this mytheme par excellence that reactionary politics in India today would find expression in the interests of a theocratization of the state and the creation of an internal enemy as necessary antithesis.[26]
এ অনুসন্ধানের জবাব খুঁজতে হলে আমাদের বোধহয় আরেকটু অন্যভাবে ভাবা দরকার। আমরা রাষ্ট্র নামক যে ভূখণ্ডকে ভেবে নিই সেটি আরেকভাবে ভাবলে কল্পনা করে নেওয়া কিছু কমিউনিটির সমষ্টি। একজন বাঙালি প্রকৃত অর্থে একজন মারাঠি বা তামিল বা উত্তর-পূর্বের জনসম্প্রদায়কে চেনে না। কিন্তু ক্রিকেট বা রামায়ণ নিয়ে ‘গড়ে নেওয়া’ আবেগে তৈরি হয় ভারত নামক দেশটি। সেখানে কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে একইসঙ্গে অরুণাচলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বা যে দলিত মানুষটিকে আমরা প্রান্তিক বলে দৈনন্দিন জীবনে তাচ্ছিল্য করি, অথচ জাতীয় সঙ্গীত গাইবার সময়ে তাদের পরিচয় কল্পনা করে নেওয়া হয় ভারতীয় বলে। যদিও এক্ষেত্রে বলার অপেক্ষা রাখে না যে some are more equals than others. এই কল্পিত যাপনের বস্তুগত চেহারা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে মিডিয়ার শক্তিশালী প্রচার, স্বাস্থ্যঅভিযানের জয়যাত্রা, সেন্সাস সবকিছুর মধ্য দিয়ে ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে। অ্যান্ডারসন যেমন দেখিয়েছেন (Imagined Communities) এখানে অঙ্কের একটা মজার খেলা চলে। তা হল একজন নাগরিকের পরিচয় আঙ্কিকভাবে শূন্য (০) অথবা এক (১)। এক্ষেত্রে ভগ্নাংশের কোনও জায়গা নেই। অর্থাৎ, যে আস্তিক সে সম্পূর্ণত নাস্তিকের থেকে পৃথক। ‘ভারতীয়ত্ব’ এবং ‘অভারতীয়ত্ব’-কে একসঙ্গে রাষ্ট্র অনুমোদন করে না। পরিচয়গুলো আবার নতুন করে নির্ধারিত হয় জাত-জাতি, নিম্নবর্গ-উচ্চবর্গ, হিন্দু-অহিন্দুর মতো বিভিন্ন ক্যাটেগরি দিয়ে।
এরকম এক সন্ধিক্ষণে আমাদের প্রয়োজন পড়ে ঢোঁড়াই-এর। তার একটি “মানস-চরিত”-ও রচনা করেন সতীনাথ ভাদুড়ী।
তারপর সে গানহী বাওয়ার (গান্ধী) গাওয়া ‘মূরত’ বালা কুমড়োটা মাথায় করে ঢোঁড়াই নিয়ে আসে মিলিট্টি ঠাকুরবাড়িতে। পরনে সেই লাল কাপড়খানা। আগে আগে আসে ঢোঁড়াই আর পিছনে সব তাৎমারা। মহতো পর্যন্ত পিছনে। ঠাকুরবাড়িতে পৌঁছে তাদের সব উৎসাহ জল হয়ে যায়। মোহন্তজী বলেন, ‘কী রে ঢোঁড়াই, তোর যে আর দেখাই নেই। যে ঠাকুরবাড়িতে রামসীতার মূরত আছে সেখানে গানহী বাওয়ার ‘মূরত’ রাখা ঠিক নয়। তুলসীদাসজী তাই বলে গিয়েছেন। —চুথিয়া সরকার!….
যা হোক, ঢোঁড়াই বড় মুশকিলে পড়ছিল ওর জীবনটাকে নিয়ে। জীবনের বিভিন্ন পর্বে তাৎমাটুলির ঢোঁড়াই ধীরে ধীরে বুঝেছে, আত্মস্থ করেছে অজানা সব অভিজ্ঞতা— “অদ্ভুত জিনিস এই ‘বোট’। হঠাৎ টাকা পেলে লোকের ইজ্জৎ বাড়ে, এর অভিজ্ঞতা ঢোঁড়াইয়ের জীবনে হয়ে গিয়েছে। বোটও সেই রকম রাতারাতি লোকের ইজ্জৎ বাড়িয়ে দেয়, কেবল যে বোট দেবে তার নয়, সারা গাঁয়ের।” ঢোঁড়াইয়ের ইজ্জৎ সারা গাঁয়ের ইজ্জৎ হয়ে যায়। “বোটের” সুতোয় রাষ্ট্রের সাথে বাঁধা পড়ে একক ঢোঁড়াই, তখনও নাগরিক হয়ে উঠেছে কিনা স্পষ্ট নয়। কিন্তু তার অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকে তার গ্রাম অর্থাৎ ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার এক আখ্যান রয়ে যাচ্ছে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে চলা নতুন ভারতবর্ষের মধ্যে। “বলান্টিয়ারদের” দয়ায় নগণ্য ঢোঁড়াই “রামরাজ্য কায়েম করবার কাজে, কাঠবেড়ালীর কর্তব্যটুকু করবার সুযোগ পেয়ে গেল।” তার মননে বা psyche-তে যোগসূত্র তৈরি হল ঢোঁড়াই আর “মহাৎমাজীর” সঙ্গে— imagined communities। আধুনিকতার নতুন কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক ডিসকোর্সে ঢুকে পড়ছে ঢোঁড়াইয়ের মতো প্রান্তিক মানুষ ও অঞ্চল— নিজস্ব সমাজ ও কৌম বোধ নিয়ে। এটা ব্রিটিশের জগতে জন্ম নেওয়া ইউরোপীয় আধুনিকতার চেহারা নয়, এর অবস্থান আধুনিকতার চেনা ডিসকোর্সের বাইরে।
ঢোঁড়াইয়ের জীবনে এরপরে অন্য এক যাত্রা শুরু হয়। “এই নিঃসীম রিক্ত জগৎটার মধ্যে ‘পাক্কী’ না কী নামের যেন একটা অপরিচিত রাস্তা দিয়ে সে চলছে।” আধুনিক ভারতের “পাক্কী” রাস্তার বাঁকে ঢোঁড়াই— ভারতের উন্নয়নের কুলচিহ্ন (insignia)। কিন্তু তার নাগরিকতার মধ্যে রয়ে যায় ভগ্নাংশের উপাদান, যদিও রাষ্ট্র তাকে গ্রহণ করবে একক integer হিসেবেই। রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই রয়ে গেল অন্তর্লীন বিরোধ। ঢোঁড়াই-এর সময়ে এবং সামাজিক চেতনায় গান্ধির মূর্তির সঙ্গে একইসঙ্গে রামসীতার মূর্তি রাখা যায় না। কিন্তু যদি বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রনায়কই রামসীতার signifier হয়ে ওঠে? তাহলে? সে পরিস্থিতিতে কী ঘটতে পারে? ঢোঁড়াই-এ “বিশেষ” বিশেষণের সরকার তখন ভারতীয় হিন্দু আমজনতার রাজনৈতিক চৈতন্যে রামের metonym হয়ে যেতে পারে। সে নির্মাণই চলছে একটি দীর্ঘসময় ধরে। এজন্য ইতিহাস, উপকথা, অতিকথা, প্রবাদ ইত্যাদি সবকিছু ঘেঁটেঘুঁটে এক করে দিতে হবে। ইতিহাসকে নিজের পর্যবেক্ষণপদ্ধতির এবং উপাদান সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের প্রক্রিয়া থেকে চ্যুত (dislocate) করতে হবে। মার্ক্স বলেছিলেন—
All mythology overcomes and dominates and shapes the forces of nature in the imagination and by the imagination; it therefore vanishes with the advent of real mastery over them.[27]
[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]
[1] সুন্দরকাণ্ড, ৫, ২৮।৬।
[2] মহাকাব্য ও টেক্সট হিসেবে কেউ কেউ এর মূল রচনাকাল মোটামুটিভাবে ৪০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ বলে ধরে নেন। পরবতীতে ভিন্ন ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে।
[3] Matilal. Epistemology, Logic, and Philosophical Analysis.
[4] একদা হিটলারের আউসভিৎস কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি থাকা পোলিশ-ইহুদি চিকিৎসক-বিজ্ঞানী লুডভিগ ফ্লেক তাঁর বিভিন্ন লেখায় যেমন proto-idea-র ধারণা এনেছেন।
[5] ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩৫১।
[6] এ প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য সন্তোষ দেশাই: “Ramayana— An Instrument of Historical Contact and Cultural Transmission between India and Asia”, The Journal of Asian Studies, Vol. 30, No. 1 (Nov., 1970), pp. 5-20.
[7] The Penguin History of Early India: From the Origins to AD 1300, পৃঃ ৯৮।
[8] The Hindus: An Alternative History, 2009, p. 590.
[9] পৃঃ ২।
[10] পৃঃ ৪৪।
[11] সুন্দরকাণ্ড, ৩০.১৮-১৯।
[12] সাংস্কৃতিকী, আনন্দ ২০১৭, পৃঃ ২৪।
[13] সাংস্কৃতিকী, পৃঃ ৩১।
[14] অযোধ্যাকাণ্ড, ২১.১৩।
[15] অযোধ্যাকাণ্ড, ২১.১৪।
[16] Cooking the World: Ritual & Thought in Ancient India, 1998, pp. 159-160.
[17] অযোধ্যাকাণ্ড, ১০৮.১১।
[18] অযোধ্যাকাণ্ড, ১০৮.১৪।
[19] অযোধ্যাকাণ্ড, ১০৮.১৭।
[20] S.N. Dasgupta, A History of Indian Philosophy, vol. 1, 2004, p. 147.
[21] এ এল ব্যাশাম, অতীতের উজ্জ্বল ভারত— The Wonder that was India গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ, ২০১১, পৃঃ ৫৪৯।
[22] নবম মুদ্রণ, ১৩৯০।
[23] Three Hundred Ramayanas.
[24] Al-Biruni, India, ed. Qeyamuddin Ahmad, 1983, pp. 8-12.
[25] “Ramayana and Political Imagination in India”, জার্নাল অফ এশিয়ান স্টাডিজ, ১ মে, ১৯৯৩, পৃঃ ২৮৮।
[26] পূর্বোক্ত।
[27] Grundrisse, Penguin Books, 1993, p. 110.