শঙ্কর সান্যাল
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
দ্বন্দ্বটা মায়া এবং বাস্তবতার মধ্যে। যাকে বলা হয় কনট্রাডিকশন বিটুইন ইলিউশন অ্যান্ড রিয়েলিটি। আমার সামনে যে দ্বন্দ্বগুলি ঘটমান, ঘটে চলেছে, তা কি বাস্তব? তার কি কোনও বস্তুগত ভিত্তি রয়েছে? নাকি গোটাটাই মায়া? অনেকটা সিনেমার মতো। সত্যি বলে মনে হচ্ছে, অথচ সত্যি নয়। সমাজের যে অবস্থা বা পরিস্থিতি রয়েছে, নির্দিষ্টভাবে যা সমাজের অবজেক্টিভ রিয়েলিটি, তা সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য প্রয়োজন প্রতিটি নির্দিষ্ট শর্তের নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ— কনক্রিট অ্যানালিসিস অফ কনক্রিট কনডিশনস। অর্থাৎ চোখের সামনে যা দেখছি, তার প্রতিটি শর্ত এবং পূর্বশর্তের নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ করাটা অত্যন্ত জরুরি। কেননা এর ভিত্তিতেই গড়ে তোলা উচিত রণনীতি এবং রণকৌশল। তা নির্বাচনের হোক কিংবা বিপ্লবের। ত্রিপুরায় আদৌ কি বামপন্থীরা রাজ্যের অবজেক্টিভ রিয়েলিটির প্রতিটি শর্ত এবং পূর্বশর্তের নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ করেছিলেন? করেননি। যদি করতেন, তাহলে ফ্যাসিস্ট শক্তির রণকৌশল তাঁদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যেত।
না, ধান ভানতে শিবের গীত নয়, ত্রিপুরার সম্প্রতিকতম বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরে এই নাতিবৃহৎ বিশ্লেষণাত্মক নিবন্ধের মুখবন্ধ হিসাবে এই তত্ত্বের অবতারণা জরুরি ছিল। ভারতের বুকে ভয়ঙ্কর ফ্যাসিবাদী উত্থান এবং সম্প্রসারণের এই সময়কালে ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের জয়লাভ করাটা অত্যন্ত জরুরি ছিল। তাৎপরর্যপূর্ণভাবে ত্রিপুরায় বামপন্থীদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই ছিল ফ্যসিস্ট শক্তির। গোটা ভারতের প্রগতিশীল মানুষ এই লড়াইয়ের দিকে তাকিয়েছিলেন এবং আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কেননা নির্বাচনের প্রচারপর্ব এক গভীর প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু দিনের শেষে ফল প্রকাশের পরে দেখা গেল বামপন্থীদের হাতের পেন্সিলটাও অবশিষ্ট নেই। ২০১৮ সালের থেকেও জনসমর্থন হ্রাস পেয়েছে। অথচ বামপন্থীদের পক্ষ থেকে, নির্দিষ্টভাবে ত্রিপুরা সিপিআই (এম)-এর পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগে এবং পরে আকারে ইঙ্গিতে বারবার বলা হয়েছে যে, জয় কেবল সময়ের অপেক্ষা। তাহলে কি ত্রিপুরার সমাজে যে অবজেক্টিভ রিয়েলিটির কথা বলা হচ্ছিল, তা কি শুধুই ইলিউশন— মায়া? রামপ্রসাদী শ্যামাসঙ্গীতের স্তবক দিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়, “ব্রহ্মাণ্ড যদি ছিলই না, তবে মুণ্ডমালা কোথায় পেলি?”
এবার একটু দেখে নেওয়া যাক ২০১৮ সালে ত্রিপুরায় বামপন্থীদের নির্বাচনী ফলাফল কী ছিল আর ২০২৩ সালে, বিজেপির পাঁচ বছরের রাজ্যশাসনের পরে কী হল। ২০১৮ সালে রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্ট প্রার্থী দিয়েছিল রাজ্য বিধানসভার সবকটি অর্থাৎ ৬০টি আসনেই। প্রবল বিজেপি-ঝড়ের মুখে বামফ্রন্ট জয়লাভ করে ১৬টি আসনে। শতাংশের হিসাবে বামপ্রার্থীরা ভোট পেয়েছিলেন ৪৪.৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে বিজেপি ৫১টি এবং তাদের জোটসঙ্গী আইপিএফটি ৯টি আসনে প্রার্থী দিয়ে পেয়েছিল যথাক্রমে ৩৩টি এবং ৮টি আসন। বিজেপি জোট ভোট পেয়েছিল ৫০.৯৭ শতাংশ। ২০২৩ সালের নির্বাচনে বামফ্রন্ট জোট গঠন করল কংগ্রেসের সঙ্গে। বামফ্রন্ট বিধানসভার ৬০ আসনের মধ্যে ৪৭টি আসনে প্রার্থী দেয় (একজন বামসমর্থিত নির্দলকে ধরে নিয়ে)। কংগ্রেসকে ছেড়ে দেয় ১৩টি আসন। অন্যদিকে বিজেপি-আইপিএফটি জোট প্রর্থী দেয় ৬০টি আসনে। বামফ্রন্টের ঝুলিতে আসে ১১টি আসন এবং জোটসঙ্গী কংগ্রেস পায় ৩টি আসন। শতাংশের হিসাবে বামফ্রন্ট ভোট পেয়েছে ২৬.৮ শতাংশ এবং তাদের জোটসঙ্গী কংগ্রেস পেয়েছে ৮.৫৬ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ বাম-কংগ্রেস জোটের মোট প্রাপ্ত ভোট হল ৩৫.৩৬ শতাংশ। বিজেপি এবং আইপিএফটি মিলিতভাবে পেয়েছে ৪০.২৩ শতাংশ। পাশাপাশি নব্যগঠিত তিপ্রা মোথা ৪২টি আসনে প্রার্থী দিয়ে জয়লাভ করেছে ১৩টি আসনে এবং শতাংশের হিসাবে ভোট পেয়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। তিপ্রা মোথা ত্রিপুরা বিধানসভায় দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টি।
ত্রিপুরার সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্য বামফ্রন্ট কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গঠন করে লড়াই করেছে। ত্রিপুরার রাজনৈতিক ইতিহাসে এটা অভূতপূর্ব। স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্রিপুরায় কমমিউনিস্টদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল, বিশেষ করে দশরথ দেবের নেতৃত্বাধীন মূলত আদিবাসীদের সংগঠন গণমুক্তি পরিষদের সশস্ত্র সংগ্রামের। কমিউনিস্টদের সংগ্রাম ছিল একাদিক্রমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের দোসর দেশীয় সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার আগে এবং পরেও ত্রিপুরার কংগ্রেস ছিল রাজানুগত একটি রাজনৈতিক দল। এতে শ্রেণিগতভাবে কংগ্রেসের কোনও সমস্যা থাকার কথা নয়, ছিলও না। স্বাধীনতার পরে কংগ্রেস দীর্ঘ তিন দশকের নিরবচ্ছিন্ন শাসনকালে বস্তুতপক্ষে পরিচালিত হয়েছে উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদের নির্দেশে এবং কমিউনিস্টদের ওপরে চালিয়ে গিয়েছে নির্বিচারে নির্মম দমন-পীড়ন। ১৯৭৮ সালে বামফ্রন্ট ত্রিপুরার ক্ষমতায় আসে। ত্রিপুরায় বামপন্থীদের মূল সাংগঠনিক ভিত্তিটাই ছিল বঞ্চিত, নিপীড়ত, পদদলিত আদিবাসী সমাজ, যাঁরা কিনা সর্বার্থেই ত্রিপুরার ভূমিপুত্র। দশরথ দেবের নেতৃত্বাধীন গণমুক্তি পরিষদের পতাকার তলার সংগঠিত ছিল এই আদিবাসী সমাজ। কংগ্রেস ছিল মূলত শহরবাসী “ভদ্রলোক”দের রাজনৈতিক দল। শচীন সিং থেকে শুরু করে সুখময় সেনগুপ্ত, সুধীররঞ্জন মজুমদার কিংবা সমীররঞ্জন বর্মণ প্রত্যেক কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীর জমানাতেই কমিউনিস্টরা অত্যাচারিত হয়েছেন। কেননা কংগ্রেস যে শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে, কমিউনিস্টদের সংগ্রাম ছিল তার বিরুদ্ধেই।
জর্জি দিমিত্রভের “কোয়ালিশন ফ্রন্ট” তত্ত্ব কি আজ পর্যন্ত কোনও দেশে কার্যকরী হয়েছে? জার্মানি, ইতালি, স্পেন কিংবা অন্যত্র, যেখানেই ফ্যাসিবাদের বিপদ সামনে এসেছে, সেখানে কি লিবারেল বুর্জোয়াদের খুঁজেপেতে, তাদের সঙ্গে জোট গঠন করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সংগঠিত করা গিয়েছে? ইতিহাস কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও ইতিবাচক সাক্ষ্য দেয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত পুঁজিবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অত্যন্ত প্রকট ছিল। ১৯২৯ সালে মহামন্দার কালে বিশ্বপুঁজিবাদ যে বিপুল সঙ্কটের আবর্তের মধ্যে পড়েছিল, তা থেকে নিষ্ক্রমণের জন্য যুদ্ধ অবশ্যাম্ভাবী হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল বাজার দখলের জন্য পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সবচেয়ে উৎকট রূপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, দেশে দেশে প্রত্যক্ষ উপনিবেশবাদের অবসান এবং ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা ইত্যাদি থেকে শিক্ষা নিয়ে পুঁজিবাদ প্রত্যক্ষ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটাতে চেহারাটিকেই বদলে ফেলে। জাতীয় পুঁজি বদলে যায় আন্তর্জাতিক পুঁজিতে। বিশেষ করে পুঁজিবাদের বিশ্বায়নের যুগে নির্দিষ্টভাবে কোনও জাতীয় পুঁজির অস্তিত্বই নেই। ট্রান্সন্যাশনাল বা মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেট পুঁজিই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কর্পোরেটগুলির মধ্যে যে বাজার দখলের লড়াই নেই, তা নয়। প্রবলতর দ্বন্দ্বই রয়েছে। কিন্তু তার প্রকাশ সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রিক। পুঁজি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করলেও রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কার্যকলাপে বড় একটা হস্তক্ষেপ করতে চায় না। তার মৌলিক লক্ষ্যই হল একটি ত্রিভুজাকৃতি আবর্তন বজায় রাখা— বিনিয়োগ, উদ্বৃত্ত মূল্য লুণ্ঠন এবং সঞ্চয়ন। সঙ্কট পুঁজিবাদের অঙ্গের সঙ্গী। সঙ্কট থেকে বেরোনোর জন্য তখন পুঁজিকে বেছে নিতে হয় আদিম সঞ্চয়নের রাস্তা, প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রীয় পাহারাদারের। পুঁজির প্রয়োজনেই আমেরিকার ক্ষমতায় আসে কখনও রিপাবলিকান আবার কখনও ডেমোক্রাট। ব্রিটেনের ক্ষেত্রেও কখনও লেবার পার্টি আবার কখনও কনজারভেটিভ (টোরি)। একইভাবে ভারতের ক্ষেত্রেও কখনও জাতীয় কংগ্রেস, আবার কখনও ভারতীয় জনতা পার্টি। তাই বুর্জোয়াদের মধ্যে “লিবারেল” খোঁজা অনর্থক। দিমিত্রভের কোয়ালিশন ফ্রন্ট তত্ত্ব একটি তাত্ত্বিক হাইপোথিসিস হতে পারে, কিন্তু তার কোনও ঐতিহাসিক বাস্তবতা নেই।
ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার পরে এই ভূখণ্ডে পুঁজির সবচেয়ে বড় পাহারাদার ছিল জাতীয় কংগ্রেস। পুঁজির প্রয়োজনেই ভারতে গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বৃহৎ এবং ভারি শিল্প। আবার পুঁজির প্রয়োজনেই সেই কংগ্রেসের হাত ধরেই সূচনা হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের অন্তর্জলী যাত্রা— বেসরকারিকরণ, বিলগ্নিকরণ। কংগ্রেসের হাত ধরেই এদেশে প্রবেশ করছে নয়া-উদার অর্থনীতি। ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতীয় জনতা পার্টির পদচারণা কংগ্রেসের ফেলে যাওয়া জুতো পরেই। ভারতের বামপন্থী শক্তি, বিশেষত সিপিআইএম, তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গঠন করে “ফ্যাসিস্ট” বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করার স্বপ্ন দেখছে। সিপিআইএমের যুক্তি, বিজেপির ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক এবং ঘৃণার রাজনীতিকে প্রতিরোধ করতে গেলে কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়েই লড়াই করতে হবে। কিন্তু কংগ্রেস নিজে কি আদৌ একটি আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল? সিপিআইএমও সম্ভবত তা মনে করে না। যদি সাম্প্রতিক ইতিহাসের কথাই ধরি, ১৯৮৪ সালে দিল্লির শিখ গণনিধন, বিতর্কিত বাবরি মসজিদের দরজা খুলে দিয়ে সেখানে রামলালা স্থাপন করার সুযোগ দেওয়া, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়ে নরসিমা রাও সরকারের নীরব রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় কি তথাকথিত হিন্দু মৌলবাদকে পরিতুষ্ট করা নয়? অন্যদিকে আবার শাহবানু মামলা কি মুসলিম মৌলবাদকে প্রশ্রয় নয়? আসলে কংগ্রেস চূড়ান্ত সংসদীয় সুবিধাবাদের জায়গা থেকে প্রয়োজনমতো কখনও হিন্দু আবার কখনও মুসলিম সাম্প্রতিকতার তাস খেলে গিয়েছে। তবে বিজেপি ফ্যাসিস্ট শক্তি। কিন্তু কংগ্রেস গণতান্ত্রিক। গত শতকের সাতের দশক এবং কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা বাদ দিলে কংগ্রেস গণতান্ত্রিক। কিন্তু বিজেপি তথা তার আদর্শগত মেন্টর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ গণতন্ত্রে আদৌ বিশ্বাস করে না। সংঘ পরিবারের গোপন অ্যজেন্ডা আর গোপন নেই। ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো বাতিল করে পায়ে পায়ে হিন্দুত্ববাদী একনায়কতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাওয়াই তাদের মূল লক্ষ্য। তার প্রক্রিয়াও বিজেপি ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছ। কিন্তু কংগ্রেস মুখে বিজেপি-বিরোধিতার কথা বললেও ভোটবাক্সের বাইরের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এখনও তারা অনুপস্থিত। এই দোলাচল এবং দ্বিচারিতা বুর্জোয়া শক্তির মজ্জাগত।
এবার আবার ফেরা যাক ত্রিপুরার নির্বাচনী ফলাফলের পর্যালোনায়। ত্রিপুরায় বামপন্থীরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গঠন করে (তথা আসন সমঝোতা করে) নির্বাচনে লড়াই করেছে। ফলত কী হল? ২০১৮ সালে ত্রিপুরায় কংগ্রেস যেখানে ভোট পেয়েছিল ১.৭৯ শতাংশ, ২০২৩ সালে বামপন্থীদের সঙ্গে জোট করে সেই কংগ্রেস পেল ৮.৫৬ শতাংশ। ২০১৮ সালে কংগ্রের ঝুলিতে একটি আসনও ছিল না, ২০২৩ সালে তারা পেল তিনটি আসন। সবচেয়ে বড় কথা ২০১৮ সালে ত্রিপুরা কংগ্রেসের প্রায় পুরোটা চলে গিয়েছিল বিজেপিতে। ক্ষমতার দরাদরিতে হালে পানি না পাওয়ায় তার একটা বড় অংশ আবার কংগ্রেস ফিরে এসেছে। অন্যদিকে ২০১৮ সালে বামপন্থীরা ত্রিপুরায় ভোট পেয়েছিলেন ৪৪.০৫ শতাংশ এবং আসন পেয়েছিলেন ১৬টি। ২০২৩ সালে বামপন্থীরা ভোট পেয়েছেন ২৬.৮ শতাংশ। আসন পেয়েছেন ১১টি। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় বামপন্থীরা হারিয়েছেন ৪টি আসন এবং জনসমর্থন হারিয়েছেন ১৭.২৫ শতাংশ। তাহলে জোট করে লাভবান হল কে? সহজ হিসাব অনুযায়ী কংগ্রেস। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে। এবার ত্রিপুরায় তার ঐতিহাসিক প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আসলে বামপন্থীদের এটা বুঝতে হবে যে, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার মতো রাজ্যে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকার ফলে কংগ্রেসের ঝুলিতে কোনও ভাসমান ভোট নেই। কংগ্রেস যে ভোটটা পায়, সেটা তাদের কমিটড ভোট। এই ভোটের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিচরিত্র রয়েছে। এই ভোট কোনওদিনই বামপন্থীদের বাক্সে যাবে না। পক্ষান্তরে “বৃহত্তর স্বার্থে” (!) বাম ভোট চলে যায় কংগ্রেসের বাক্সে। লাভের গুড় খেয়ে যায় কংগ্রেস এবং হাতের পেন্সিলটাও হারিয়ে ফেলেন বামপন্থীরা। ভোটরাজনীতির যে পাটিগণিতের অঙ্ক মাথায় রেখে বামপন্থীরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেন, তার গোড়াতেই বিস্তর গলদ। পাটিগণিতের অঙ্ক মিলিয়ে বিভিন্ন বিপরীতমুখী স্রোতকে একটি নির্দিষ্ট অভিমুখে পরিচালনা করা যায় না। ভারতের মতো একটি দেশ, যেখানে সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত, সেখানে ভোট হয় নির্দিষ্ট সাধারণ পারসেপশনের ভিত্তিতে। যে রাজনৈতিক দল এই পারসেপশন তৈরি করতে পারে, ভোটবাক্সে তারাই সিকান্দার।
ত্রিপুরার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের ভুল বা ত্রুটি, যা-ই বলা যাক না কেন, সেটা ত্রিমুখী। প্রথমত, নির্বাচনের আগে ত্রিপুরার গ্রাউন্ড জিরোতে কোন অবজেক্টিভ রিয়েলিটি বিরাজমান, তা অনুধাবন করতে বামপন্থীরা ব্যর্থ হয়েছেন। মিটিং-মিছিলে জনসমাগম মানেই যে ভোটবাক্সে তার প্রতিফলন ঘটবে এমনটা ভাবার কোনও যথার্থ কারণ ছিল না। ভারতের সংসদীয় নির্বাচনে এমন অনেক সমীকরণ কাজ করে, যা কখনওই আপাত দৃশ্যমান হয় না। কিন্তু ওই সমীকরণগুলিই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হয়, এটা ঐতিহাসিক সত্য। দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরার বুকে যাবতীয় শ্রেণিবৈরিতার নির্মোক ছিন্ন করে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গঠন। এর ফল ঠিক কী হয়েছে, তা ইতিপূর্বেই অণুপুঙ্খ আলোচিত হয়েছে। তৃতীয়ত, ভারতীয় জনতা পার্টির কৌশলটিই বামপন্থীরা অনুধাবন করতে পারেননি। এই বিষয়টি নিয়ে একটু গভীর আলোচনা প্রয়োজন।
ঔপনিবেশিক ভারতে ত্রিপুরা ছিল একটি করদ রাজ্য। উত্তরপূর্ব ভারতে পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা এই রাজ্যে প্রথম ব্রিটিশ সামাজ্যবাদ বিরোধী এবং তার দোসর রাজার বিরুদ্ধে তিপ্রাসা জনজাতিকে গণমুক্তি পরিষদের পতাকার নিচে সংগঠিত করেন দশরথ দেব। তিনি নিজে তিপ্রাসা জনজাতির মানুষ হলেও তাঁর সঙ্গে ছিলেন এক বাঙালি কমিউনিস্ট বীরেন দত্ত। ব্রিটিশ এবং রাজার বিরুদ্ধে শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। স্বাধীনতার পরে ১৯৪৯ সালে গণমুক্তি পরিষদ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বিটি রণদিভের হাত ধরে গণমুক্তি পরিষদের নেতারা পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৫১-৫২ সালে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ত্রিপুরার দুটি আসন থেকেই জয়ী হন কমিউনিস্টরা। সংসদে যান দশরথ দেব এবং বীরেন দত্ত। গত শতকের আটের দশক পর্যন্ত গণমুক্তি পরিষদই ছিল ত্রিপুরার জনজাতিদের একমাত্র সংগঠন। ১৯৭৮ সালে বামফ্রন্ট ত্রিপুরার ক্ষমতায় আসে। ওই বছরই খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে বিজয় রাঙ্খলের নেতৃত্বে গঠিত হয় টিএনভি। শুরু হয় নাশকতার অধ্যায়। বিনন্দ জামাতিয়ার নেতৃত্বে টিএনভি দ্বিখণ্ডিত হয় এবং ১৯৮৩ সালে বিনন্দ এবং তাঁর গোষ্ঠী গণমুক্তি পরিষদে যোগ দেয়। ১৯৮৮ সালে বিজয় রাঙ্খল আত্মসমর্পণ করে মূলস্রোতের রাজনীতিতে চলে আসেন। এর পরেও কিছুদিন অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স নামে একটি সংগঠন কিছুদিন নাশকতা চালিয়ে যায়। কিন্তু এতৎসত্ত্বও দশরথ দেবের জীবৎকালে গণমুক্তি পরিষদের জনভিত্তি অটুটই ছিল। সংগঠনের সংবিধান অনুযায়ী কোনও অনুপজাতি ব্যক্তি গণমুক্তি পরিষদের সদস্য হতে পারেন না। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও দেখা যায় জনজাতি এলাকায় গণমুক্তি পরিষদ তথা সিপিআই-এমের জনসমর্থন হ্রাস পেলেও তা তলানিতে পৌঁছে যায়নি। ২০২১ সালে ত্রিপুরার অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল নির্বাচনে সিপিআইএম শূন্য হয়ে গেল। এর আগে ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এনসি দেববর্মার নেতৃত্বাধীন আইপিএফটি ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে জোট করে আদিবাসী এলাকার ৮টি আসন ছিনিয়ে নেয়। এবার এডিসি নির্বাচনে উত্থান ঘটাল এবং ক্ষমতায় এল তিপ্রা মোথা। আক্ষরিক অর্থেই রকেটগতিতে উত্থান।
তিপ্রা মোথার জনক ত্রিপুরা রাজপরিবারের সদস্য প্রদ্যোৎকিশোর মাণিক্য দেববর্মণ। আগে ছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে। শ্রেণিচরিত্র অনুযায়ী সেটাই তাঁর স্বাভাবিক রাজনীতি ছিল। যে আদিবাসীদের ঘামরক্ত শোষণ করেই ত্রিপুরা রাজপরিবার সম্পদের পাহাড়ে বসে আছে, হঠাৎ কী এমন ঘটল যাতে করে বঞ্চিত শোষিত আদিবাসীদের প্রতি সহমর্মিতায় প্রদ্যোৎকে রাস্তায় নেম নতুন রাজনৈতিক দলের খাতা খুলতে হল? এই সহমর্মিতা অবাস্তব, অন্তত প্রদ্যোতের শ্রেণিচরিত্র অনুযায়ী। তার চেয়েও অবাস্তব যে দাবির ভিত্তি থেকে তিনি তিপ্রা মোথা গড়ে তুলেছেন। দাবিটা গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড রাজ্যের। যার মানচিত্রটাই অবান্তর, যদি ওই মানচিত্রটি ভারত সরকারকে মেনে নিতে হয়, তাহলে যুদ্ধ করতে হবে বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের সঙ্গে এবং কেড়ে নিতে হবে তাদের সার্বভৌম ভূখণ্ডের খণ্ডাংশ। যেটা অসম্ভব। প্রদ্যোৎ সাংবিধানিক সামাধানের কথা বলছেন। সেটাই বা ঠিক কী? একটি অসম্ভব দাবি এবং তার ভিত্তিতে অসম্ভব নির্বাচনী সাফল্য। এটা প্রদ্যোতের নিজস্ব রণকৌশল নয়। প্রদ্যোৎকিশোর আসলে ভারতীয় জনতা পার্টি তথা সংঘপরিবারের “বাফার পলিটিক্স”-এর অস্ত্র। যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস এবং অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি। পশ্চিমবঙ্গ এবং পাঞ্জাবে বিজেপি ক্ষমতায় আসার জায়গায় নেই। তাই বামপন্থী এবং কংগ্রেসকে প্রতিহত করতে এই “বাফার পলিটিক্স”-এর আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৮ সালে আইপিএফটিরসঙ্গে জোট করে ভোটে জিতলেও বিজেপি নেতৃত্ব এটা অনুধাবন করে যে, আইপিএফটিকে দিয়ে ত্রিপুরার আদিবাসীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখা বেশিদিন সম্ভব নয়। সিপিআইএম আবার পুরনো দূর্গ অধিকার করে নেবে। ত্রিপুরায় কেবল তিপ্রাসা নয়, ১৯টি জনজাতির বাস। বিজেপির এই দূরদর্শী রাজনৈতিক কৌশলটি বুঝতেই পারেননি জিতেন্দ্র চৌধুরি, পবিত্র কর, বাদল চৌধুরি, ভানুলাল সাহারা। তিপ্রা মোথা যে তৃতীয় কোনও শক্তি নয়, বিজেপিরই সহযোদ্ধা, এটা বামপন্থীরা বুঝতেই পারেননি। বুঝতে পারলে ২ মার্চ ভোট গণনার দিন দুপুরেও প্রদ্যোতের সঙ্গে বৈঠকের জন্য ব্যাকুল হতেন না জিতেন্দ্র চৌধুরি।
আসলে গল্পটা পুরনো। দশরথ দেব এবং অঘোর দেববর্মার প্রয়াণের পরে ত্রিপুরার আদিবাসী সমাজ এবং গণমুক্তি পরিষদের মধ্যে একটি বিপুল শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এই শূন্যতাকে ভরাট করা যায়নি। তাকে কাজে লাগিয়েই পরিচিতি সত্তার রাজনীতি আমাদানি করে ফ্যাসিস্ট শক্তি। ২০২১ সালে গড়ে তোলে তিপ্রা মোথা। বামফ্রন্টের হাত থেকে চলে যায় এডিসির ক্ষমতা। ফাঁকতালে আদিবাসীদের মধ্যে বিজেপিও নিজেদের সংগঠন কিছুটা বাড়িয়ে নেয়। বহু যুদ্ধের নায়ক ত্রিপুরার বাম নেতারা তাঁদের যাবতীয় রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা সত্ত্বেও বিজেপির এই রণকৌশলটি কেন বুঝতে পারলেন না? এই বুঝতে না-পারা অথবা না-চাওয়ার পিছনে সিপিআইএম-এর নিজস্ব একটি রাজনৈতিক বোঝাপড়া কাজ করছে। এই বোঝাপড়াটি হল ভোটরাজনীতির পাটিগণিতের ভিত্তিতে সহজে সংসদীয় ক্ষমতায় পৌঁছে যাওয়া। কিন্তু বাস্তবটা হল ভোটে জেতার আগে রাস্তায় জিততে হয়। তবেই জনগণের মধ্যে একটা পারসেপশন তৈরি হয়। যা একমাত্র সম্ভব বৃহত্তর বাম ঐক্য গড়ে শাসকের প্রতিটি অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম গড়ে তোলা। নচেৎ বাংলা এবং ত্রিপুরার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।