Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শিক্ষক দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়

দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় | নাট্যব্যক্তিত্ব

শুভঙ্কর রায়

 

শুভঙ্কর রায়সংস্তবনাট্যদলের সদস্য, অভিনেতা পেশা অধ্যাপনা, সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির; আমন্ত্রিত অধ্যাপক, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

একজন নাট্যশিল্পী অত্যন্ত কুণ্ঠার সঙ্গে, দ্বিধা সহযোগে আমতা আমতা স্বরে আর্জি রাখল তাঁর কাছে– “আপনার কাছে আমি থিয়েটার-এর কাজ শিখতে চাই। দয়া করে সুযোগ দেবেন।” তিনি তাকালেন সেই প্রশ্নকারীর দিকে যে তাঁর সম্মতির অপেক্ষায় অধীরভাবে উৎসুক। তাঁর মুখে সহজ হাসি, চশমার পুরু লেন্সের ওপারে উজ্জ্বল দিঘল চোখে কৌতুকের ছোঁয়া। ঘনিষ্ঠ স্বরে তিনি সেই প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্যে একটি প্রতিপ্রশ্ন উচ্চারণ করলেন– “কী থিয়েটার করতে চাও?” নাজেহাল অবস্থা তখন সেই নাট্যশিক্ষার্থীর; সে দীর্ঘ বয়ানে থিয়েটার, স্বপ্ন, মানুষ ইত্যাদি সংক্রান্ত স্পষ্ট ও অস্পষ্ট যা যা জানা ছিল তা উগরে দিল। ধৈর্য ধরে সবটাই শুনলেন তিনি, তারপর তাঁর সিদ্ধান্ত জানালেন– সমাজবিজ্ঞানের বইপত্র না পড়লে তো থিয়েটার শেখা যাবে না আমার কাছে। আমি যা বলব তা তুমি বুঝবে কীভাবে? সেই নাট্যের ছাত্রটির তখনও পড়া হয়নি সম্মুখবর্তী শ্রদ্ধেয় নাট্যব্যক্তিত্বের ‘থিয়েটার নির্মাণ’ শীর্ষক প্রবন্ধ, যেখানে তিনি লিখেছেন– “অভিনয়রীতি নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অভিনেতার মানসিক গঠন। তার সঙ্গে মঞ্চাভিনয়ের আঙ্গিকগত দক্ষতা অর্জন করা দরকার।” যে অভিনেতা এবং নির্দেশকের কাছে নাট্যের ছাত্রটি হাজির হয়েছিল; যাঁর অভিনয় দেখেন মঞ্চ, চলচ্চিত্র এবং দূরদর্শন ধারাবাহিকের দর্শকরা চমৎকৃত হবার প্রত্যাশা সহ– সেই তিনি জাদুবিস্তারী অভিনেতা অভিনয়শিক্ষার ভিত্তিতে প্রথম রাখেন ‘অভিনেতার মানসিক গঠন’-এর শিক্ষাকে, তারপর ‘আঙ্গিকগত দক্ষতা অর্জন’ স্থান পায় তাঁর কাছে। তিনি– দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়। একজন সচেতন নাট্য শিক্ষার্থীর কাছে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় নেহাত অভিনয় বা নাট্যশিক্ষক রয়ে যাননি, হয়ে উঠেছেন তিনি– শিক্ষক, জীবনবোধের এবং নাট্যের।

দ্বিজেনদা ছিলেন শিক্ষার্থীদের বন্ধুশিক্ষক। শিক্ষার্থী-শিক্ষকের অন্তর্বর্তী দূরত্বকে প্রথমেই তিনি হটিয়ে দিতেন সহমর্মী আলাপে। তবে সহৃদয় আলাপের মধ্যেও তাঁর ব্যক্তিত্বের ভার ও আকর্ষণ উভয়ই টের পাওয়া যেত। কথাবার্তার সাধারণ আড্ডাতেও দ্বিজেনদা যেন শিখিয়ে দিতেন বাচনভঙ্গি কাকে বলে, বক্তব্য গুরুত্ব সহকারে কীভাবে উপস্থিত করতে হয়, শব্দচয়নের তাৎপর্য। ধরা যাক সম্পর্কের অবনতি বিষয়ে আলোচনা চলছে। সাধারণভাবে এক্ষেত্রে এ ধরণের জিজ্ঞাসাই উঠে আসে– “সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে?” কিন্তু লক্ষ করা গেছিল দ্বিজেনদা প্রশ্নটা রেখেছিলেন এভাবে “সম্পর্কটা মলিন হল কেন?”– লক্ষণীয় মলিন শব্দটি। মানুষে-মানুষে সম্পর্কের মূল্য স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে শব্দটির মধ্যে, আবার একটি মূল্যবান সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবার বেদনাও নিহিত থাকছে ‘মলিন’-এর মধ্যে। সম্পর্কের ভাঙ্গনে আক্রান্ত মানুষটির প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করে দ্বিজেনদা জিজ্ঞেস করছেন সম্পর্কটি ভেঙ্গে যাবার কারণ। সঠিক সময়ে সঠিক শব্দ ব্যবহারের বোধ, শব্দের প্রাসঙ্গিকতা এবং রুচি– এতগুলো বিষয় উদাহরণের মতো স্পষ্ট হয়ে গেল শিক্ষার্থীর কাছে। এসবের চেয়েও বড় একটা শিক্ষা শিক্ষার্থীর সামনে রাখলেন দ্বিজেনদা– ভাষা ব্যবহারের মানবিকতা বোধ, যা সামাজিক ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টান্তস্বরূপ। এমনই ছিল দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষাদান পদ্ধতি। ‘শেখাচ্ছি’ ‘শিখে নাও’ এরকম আরোহণ পদ্ধতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি নিজের চিন্তা-ভাবনা প্রয়োগে মেলে ধরতেন, যে সুযোগ্য এবং সমর্থ সে খুঁজে বুঝে নেবে– এমনই ছিল তাঁর শেখানোর পদ্ধতি।

নাট্য নির্দেশক হিসেবে তিনি অভিনেতাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দিতেন না। প্রথমে নাটকের বিষয়টির গুরুত্ব, সেই বিষয় সম্বন্ধে জনসাধারণের মনোভাব, বিষয়ের ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক নিয়ে অভিনেতাদের সঙ্গে মহলায় সাধারণ আলোচনার আসর বসাতেন। অত্যন্ত ধৈর্যশীল এবং সহৃদয় শ্রোতা ছিলেন দ্বিজেনদা, একইসঙ্গে মত বিনিময়ের আসরে কঠোরভাবে গণতান্ত্রিক। প্রত্যেকের মত প্রকাশের পরিসর তিনি তৈরি করে দিতেন। ভুল বা ঠিক উভয় বক্তব্যই তিনি শুনতেন। যারা বলতে কুণ্ঠা বোধ করে, তাদের নিজস্ব মত প্রকাশ করতে তিনি বাধ্য করতেন। আসলে স্থবির মনস্কদের চিন্তার আলস্যের বেড়ি ভেঙ্গে দিতেন তিনি। নইলে তাঁরা থিয়েটার করবে কী করে?

অভিনেতার শক্তি ও দুর্বলতার ক্ষেত্রগুলো নির্দেশক হিসেবে তিনি জরিপ করে নিতেন। চরিত্রের রূপায়ণের পরিকল্পনা তিনি এমনভাবে বিন্যস্ত করতেন যার ফলে অভিনেতার দুর্বল জায়গাগুলো দর্শকের অলক্ষে থেকে যায়, আর শক্তি বা দক্ষতার ক্ষেত্রগুলো দর্শকের চোখে প্রাধান্য পায়। অভিনয় বা চিন্তাভাবনা যে কোনও ক্ষেত্রেই দ্বিজেনদার কোনও ব্যক্তির ত্রুটি বা দুর্বলতাগুলি ধরিয়ে দেওয়ার সুচিন্তিত কতগুলি কৌশল ছিল। কারও ত্রুটি বা খামতির জায়গা নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে কোনও কথাই বলতেন না। যেন কোনওভাবেই সেই ব্যক্তি সতীর্থ বা পরিচিতদের সমালোচনা বা বিদ্রূপের লক্ষ্য না হয়ে ওঠে– সেদিকে সতর্ক থাকতেন তিনি। উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে কাছে ডেকে নিতেন, এমনভাবে তাঁর দুর্বলতাকে চিহ্নিত করতেন না যাতে সে আঘাত পায় বা হীনমন্যতায় ভোগে। বরং সঠিক ভাবনাটি দ্বিজেনদা সেই ব্যক্তির সামনে এমন ভাবে হাজির করতেন যার ফলে ব্যক্তিটির ধারণা হত যে দ্বিজেনদা তাঁকে এমন একটি বিকল্প পথের সন্ধান দিচ্ছেন যেটি ব্যবহার করলে সে আরও উন্নত হতে পারবে বা আরও সাফল্যের অধিকারী হবে। শিক্ষক দ্বিজেনদা ছাত্রের আস্থা অর্জন করে বাড়িয়ে তুলতেন ছাত্রের আত্মবিশ্বাস।

এমনই সময়সজাগ, বোধিদীপ্ত, মনোবিশ্লেষণ-কৌশলী শিক্ষক ছিলেন দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর শিক্ষণরীতি ছিল তাঁর জাদুবিস্তারী অভিনয়শৈলীর মতোই বিস্ময়প্রদ, অননুকরণীয়।