Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জীবনের হিসেব

জীবনের হিসেব | মনীষা মুখোপাধ্যায়

মনীষা মুখোপাধ্যায়

 

আলমারিটা খুলেই হাঁ হয়ে গেলেন সমরেশ।

এমনিতে এসব কাজ সকলের সামনে করা যায় না। গিন্নির ঘুম, ফাঁকা ঘর এসবের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আর এই অপেক্ষাটাই এই বয়সে পৌঁছে আর করতে মন চায় না দেখেছেন সমরেশ। মানে, সবেতেই যেন একটা তাড়া। ধৈর্য টপকে হুড়োহুড়ি। এই সেদিন বুবুনের পৈতে হল, তখনই ভাবছিলেন তিতিরকে বলবেন, নাতির বিয়ে নিয়ে সমরেশে কিছু ভাবনাচিন্তা করে রেখেছেন। যদিও গিন্নির ধাতানিতে অত দূরের ভাবনার কথা আর বলা যায়নি, তবে বললে বোধহয় ভালই হত, ভাবেন সমরেশ। তাঁর মনে হয়, এই সেদিন যে ছেলে জন্মাল, তার পৈতেও হয়ে গেল। তাহলে বিয়েটাই বা আর দেরি কই! বুড়ো বয়সে সময় যেন বল্গাহীন ঘোড়ার মতো ছোটে।

তারপর এই গেল মাসে এলআইসি থেকে থোক টাকাটা হাতে নিয়েই ভাবলেন গিন্নিকে এবার একটা মটরবালা গড়িয়ে দিলে কেমন হয়? যদিও গয়নাগাটি নিয়ে কোনওদিনই খুব একটা বায়না নেই সরলার। তবু সমরেশের অনেকদিনের শখ, গিন্নির হাতে একখানা মটরবালা থাকুক। তা সে থাকায় আরও খানিক দেরি হলেও ক্ষতি নেই। রয়েসয়ে পরেও দেওয়া যেত। তবু ওই যে অপেক্ষা! ওটা একেবারেই আর ধাতে সইছে না সমরেশের। অবশ্য তার একটা জোরালো কারণও আছে বইকি। সেটা মাথায় এলেই তাড়া যেন আরও হু হু বাড়ে। সেইসব তাড়ার কথা আবার সকলকে বলাও যায় না। নিজের মনে মনে হিসেব কষে সচেতন থাকতে হয়। সাবধানে কাজ সারতে হয়। এই সাবধানতার জন্যই আজ বাবার আলমারিটা খোলা।

কিন্তু এ কী দেখছেন! সব সাফসুতরো। পঞ্চাশ বছর ধরে যে জিনিস আলমারির এককোণে মুখ বুজে পড়ে ছিল, তা সরাল কে? গেরস্থের আলমারিতে এমন কিছু জায়গা থাকে, যেখানে খুব একটা হাত পড়ে না। আর তা বাবা-কাকার পুরনো আলমারি হলে তো আরওই। বেছে বেছে তাই বাবার আলমারিতেই খুব গোপনে জিনিসটা রেখেছিলেন সমরেশ। সরলা বরাবরই খুব শান্ত। তবে স্বভাবে একটা আলাদা আভিজাত্য আছে। বিয়ের পর থেকেই ওর নিজের জন্য বরাদ্দ বড় একটা আলমারিতেই গোটা সংসার পুরে রাখতে ও অভ্যস্ত। বাবা মায়ের পুরনো আলমারিতে খুব একটা হাত দেয় না। ছেচল্লিশ বছরের দাম্পত্যেও সরলার স্বভাবে খুব একটা হেরফের হয়নি। তাহলে জিনিসটা গেল কোথায়? আলমারিটা ভাল করে আর একবার হাঁটকাতেই এই মাঝরাতে ঘুমন্ত সরলাকে পেরিয়ে পা টিপে টিপে সিঁড়ির ঘরে পুরনো আসবাবে ঠাসা জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছেন সমরেশ। ঝটিতি আলমারির ডালা খুলে ফেললেন আবারও। জায়গাটায় চাপচাপ অন্ধকার। অনেকটা গেরস্থবাড়ির গোপন কোনও কেচ্ছার মতো কালো। হাতের টর্চেও সে আঁধার বাগে আসার নয়। বহুদিন খোলা হয় না বলে মাকড়সাও সুখে জালটাল বানিয়ে রেখেছে। প্রথমবার হাতড়াতেই সেসব ছিঁড়ে ফর্দাফাই। আবারও হাত গলালেন সমরেশ। নাহ্‌! কিচ্ছু নেই। টর্চের আলোটা একবার এধার-ওধার করে দেখে নিলেন। ধুস, সব শুনশান।

এবার একটা অন্য ভাবনা ঝিলিক মারছে। যা জানতেন, সেটাই ঠিক তো? নাকি এত বছরে দু-একটা সংখ্যা এদিক-ওদিক হয়েছে মাথায়? একবার মিলিয়ে নিতে পারলে হত। কিন্তু পেলে তো মেলাবেন! এখানে দাঁড়িয়ে আর লাভ নেই বুঝলেন সমরেশ। পায়ে পায়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। চাদর টানলেন গলা অবধি। সরলা একটু নড়ে উঠল কি? ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে হয় সরলাকে। মাঝে খুব একটা ওঠে না। কাঁচা ঘুম ভাঙলে সারাদিন মাথা যন্ত্রণায় ভুগবে বেচারা। আর বেশি নড়াচড়া করলেন না সমরেশ। কিন্তু ঘুমও এমন বজ্জাত, আর এলও না। কথাটা যে সরলাকে খুলে বলবেন সে উপায়ও নেই। যা এতকাল চাপা দেওয়া আছে, দাম্পত্যের এই শেষ প্রহরে এসে সেসব বলে ভাবনা বাড়িয়ে আর কী লাভ? সরলা যদিও এসব বিশ্বাস করে না, তবু জীবনের শেষ প্রহরে এসে অনেক অবিশ্বাসের জিনিসও মিহি চিন্তা তৈরি করে। ঘুমন্ত সরলার মুখটা ঘরের নীল আলোয় একবার দেখলেন সমরেশ। বছর পাঁচেক আগে সুগার ধরা পড়েছে সরলার। এই অবস্থায় এসব আলফাল চিন্তা ঢোকানোর কোনও মানেই হয় না। কিন্তু যেটুকু জানেন, তাতে আজকের রাতটুকুই তো শুধু বাকি! চেনা ভয়টা ঝাপটা মারছে। পাশবালিশটা আঁকড়ে পাশ ফিরলেন সমরেশ। পর্দার বাইরে চাপ অন্ধকারেও বাতাবিলেবুর গাছটা চোখে পড়ল। খুব ফুল ধরেছে এবার। একটা মাতাল গন্ধ আসে পাল্লাটা খুলে দিলেই। দেবেন নাকি? আর যদি গন্ধটা টানার সুযোগ না পান! উঠতে গিয়েও উঠলেন না সমরেশ। থাক। কত কিছুই তো আর সুযোগ পাবেন না, অযথা হুটোপাটা করে সরলার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে লাভ নেই। কাল সারাদিন কত কাজ ওর!

সকাল সকাল কলিংবেল। সরলার ব্যস্ততা আজ ন্যাচারালি বেশি। সাতসকালেই তিতিরের আসার কথা ছিল। সঙ্গে জামাই-নাতিও। নাতিটা এলে আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না সমরেশের। তিতির বাবার এই দুর্বলতা জানে বলে মাঝেমাঝেই পাঠিয়ে দেয় ওকে এখানে। তবে এবারের আসাটা বেশ মজাদার। মানে, ওদের কাছে মজার হলেও সমরেশের কাছে খুবই অস্বস্তির। বারবার এসব পাগলামো বন্ধ করতে বললেও কে শোনে কার কথা! জামাই অরিন্দম বেশ ভাল ছেলে। নিজের বাড়ির সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির সকলেরও বেশ খোঁজখবর রাখে। সুবিধা-অসুবিধা বোঝে। মোটের উপর শেষ বয়সটা সমরেশের মন্দ কাটল না। এবারে সব আয়োজন মূলত অরিন্দমের জোরাজুরিতেই। সমরেশের জন্মদিন আজ। চুয়াত্তর পুরে পঁচাত্তরে পা। বুড়ো বয়সে এসব ভাবলে হাসিই পায় আজকাল। নিজেকে কেমন সং সং লাগে। প্রতিটা জন্মদিনই যে মৃত্যুর দিকে একটু একটু করে এগোনো তা আর এ বয়সে এসে নতুন করে কী জানবেন? তবে অরিন্দম এসব শুনলে তো! সঙ্গে নাতিটাও হয়েছে দোসর। বাপ-ছেলেয় মিলে দাদুর জন্মদিন সেলিব্রেশনের প্ল্যান এঁটেছে মনে মনে। এবারের এইসব পালন-টালনে একেবারেই সায় ছিল না সমরেশের। প্রথমেই রুখে দিয়েছিলেন। তিতিরই কায়দা করে ছেলেকে যুদ্ধে ভিড়িয়ে দিল। অগত্যা অস্ত্র নামাতে বাধ্য হলেন সমরেশ। সরলাও ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চাপা একটা আনন্দ পেয়েছে মনে হয়। এমনিতে একটা সরকারি দফতরে চাকরি করে খুব বেশি বিলাসিতা কখনওই সংসারকে দিতে পারেননি সমরেশ। তিতিরের জন্মদিনটা তবু করতেন, সরলা খুশি হত। তিতিরও এই একটা দিন ক্যালেন্ডারে বড় করে গোল করে রাখত। আর একটা কাজ করতেন সমরেশ। সরলার শত বারণ সত্ত্বেও। সরলার জন্মদিনে একসঙ্গে কোথাও বেরিয়ে খেয়ে আসতেন। আর ওইদিনটা আপিস যেতেন না। সহকর্মীরা ঠাট্টা করে ওই পারটিকুলার দিনটায় কেন প্রতিবার ছুটি— তার নিত্যনতুন নানা কারণ বের করলেও আসল সত্যিটা কখনও কাউকে জানাননি সমরেশ। সরলা খুব রেগে যেত শেষের দিকে। তবে সমরেশ বুঝতেন, মেয়েদের এসব রাগের ভিতরে একটা তিরতিরে নদী থাকে। স্বামীসুখ যেখানে ঘাপটি মেরে ডুবে থাকে। এহেন সমরেশের নিজের কখনও জন্মদিন পালন হয়নি। না। কোনওদিনই না। মাও এই দিনটা এলে বাড়তি কিছু পছন্দ করতেন না। পায়েসটুকু করে দিতেন, মা চলে যাওয়ার পর সরলা ওই দায়িত্বটা নিয়েছে বটে, কিন্তু আলাদা করে বাড়তি কিছু করতে দেননি সমরেশ। মেয়ে বড় হলে নিজে হাতে বাবার জন্য কিছু কিনে আনত। সরলাও টুকটাক কিছু দিত। ওই অবধিই। এর বেশি কিছু নয়। তিতির ও সরলার অনেক রাগারাগিতেও সেই নিয়ম পাল্টায়নি। এই শেষবেলায় এসে তাই পঁচাত্তর বছরের জন্মদিন পালনের কথা শুনেই নাকচ করে দিয়েছিলেন। নাকচ করার আরও একটা বড় কারণও আছে বইকি! ভয়টা আবার ঝাপটা মারছে মনে।

তিতির এসেই জড়িয়ে ধরল পিছন থেকে।

—কেমন আছ বাবা? এই নাও এইটা তোমার।

হাসতে হাসতে অরিন্দমও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে— মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্য ডে বাবা। যান, স্নান সেরে এটা পরে ফেলুন। আমি নিজে পছন্দ করে কিনেছি, খারাপ লাগলেও বলতে পারবেন না কিন্তু!

জোরে হেসে উঠলেন সমরেশ। অরিন্দম এমনই। ঝড়ের মতো এসে মাতামাতি করে যায়। নাতি বুবুনের হাতে আবার মিষ্টির বাক্স।

—তোমরা আবার এসব এনেছ কেন দাদুভাই?
—আরে তুমি তো বার্থ ডে বয়। এই এইটুকুন। সবে জন্মেছ, তোমার কোনও আপত্তিই আজ শোনা হবে না। পাত্তাই পাবে না। তুমি শুধু বড়দের কথা শুনবে আজ।

নাতিটাও পেয়েছে বাপের ধারা। সরলার মুখেও সুখের হাসি। নিমেষে টুকরোটাকরা হা হা হি হি-তে ভরে উঠল বাড়িটা। তাড়া খেয়ে বাথরুমে ঢুকলেন সমরেশ। কিন্তু দুশ্চিন্তাটা যাচ্ছে কই?

সাবানের ব্যাপারে বরাবর শৌখিন সমরেশ। চাকরি করতে করতে নানারকম সাবান কিনে আনতেন দোকান উজিয়ে। এক এক দিন এক একটা। সরলা রাগারাগি করত, বলত, এর বেলা বাজে খরচ হয় না? সমরেশ আবার কিছু কিছু বাজে খরচে খুব মজা পেতেন। দিনের স্নানের সঙ্গে সঙ্গে গায়ের গন্ধ বদলে যাওয়ার মজা। আজও সাবানটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। রিটায়ারের পর সাবান কেনার বাড়াবাড়ি একটু কমলেও গন্ধের শখটা আজও যায়নি। দু’হাতে ধরে নাকের কাছে এনে জোরে শ্বাস নিলেন সমরেশ। গন্ধটা অনেকক্ষণ নাকের কাছে ঘুরঘুর করছে। করুক। প্রাণভরে মেখে নিচ্ছেন গন্ধটা। সময় বলতে হিসেবমতো আজ রাতটাই যে! চকিতে ভাবনাটা মনে এসে গেল সমরেশের।

আচ্ছা, শেষটা কীভাবে হবে? শরীর দিব্যি ভালই আছে এখনও। আজ বেরোনোর কথাও নেই। কাজেই রাস্তাঘাটকে বাদ দেওয়া যেতে পারে ভাবনা থেকে। তাহলে কি বাড়িতেই কিছু? মায়ের যেমন হয়েছিল? দু মিনিটও সময় দেননি, তেমনই? আচ্ছা এই যে আজ এত ভাল ভাল খাবার হচ্ছে ওসব গুরুপাক থেকেই কি…? হঠাৎ কান্না পেল সমরেশের। মনে হল, একছুটে সরলা-মেয়ে-জামাই সকলকে ডেকে সব বলে দেন। খানিকক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সংযত করলেন সমরেশ। এই পঁচাত্তরে পৌঁছে জীবন কম দেখেননি তিনি। আর পাওয়ার বাকি আছেটাই বা কী? পেনশন আছে, সরলার কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। তবে হ্যাঁ, খানিকটা অনীহা থেকেই সরলা ব্যাঙ্কে যেতে চায় না। কোথায় কী কাগজপত্র আছে জানেও না। ওগুলো আজ একটু বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কখন? এসব মোচ্ছব মিটতে মিটতেই তো রাত। তার আগেই যদি…! আর ভাবতে পারেন না সমরেশ। খুব দ্রুত সব মেটাতে হবে। স্নান-খাওয়া সেরে দুপুরেই কি বুঝিয়ে রাখবেন সব? কিন্তু বাড়িতে যে মেয়ে-জামাই। বিশ্রামের সময় বলে আজ কি আলাদা করে ঘরে দোর দিতে পারবেন? নাহ্‌! তাহলে উপায়?

এসব ভাবনার মধ্যেই বাথরুমে দুমদুম আওয়াজ!

—বাবা আর কতক্ষণ? এবার তো ঠান্ডা লাগবে!

ভাবনার তার ছিঁড়ে কোনওক্রমে দু-তিন মগ গায়ে ঢেলেই বেরিয়ে এলেন সমরেশ। কিছুতেই মন বসছে না সমরেশের। আজ এত আনন্দ-উচ্ছ্বাস ওঁকে ঘিরেই। অথচ তীব্র একটা ভয় আর অস্বস্তি শ্বাস ফেলছে ঘাড়ে।

খেতে খেতেই ডাইনিংরুমে বিয়ের পর পর তোলা ওঁদের দুজনের ছবিটায় চোখ আটকাল সমরেশের। পুরনো দিনের বাঙালি আর কিছু করুক না করুক, বিয়ের পরের একটা যৌথ ছবি তুলবেই তুলবে। আর সেটা বাঁধাতেও ভুলবে না। তবে সমরেশবাবুদের ছবিটা আর পাঁচটা দাম্পত্যের মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছাপোষা ছবি নয়। পুরীর সমুদ্রের বালিয়াড়ি ভেঙে ছুটে আসছে তরুণী সরলা, সমুদ্রসফেন জীবন সবে শুরু তখন। গোড়ালিভেজা জলে দাঁড়িয়ে বউয়ের চপলতা দেখে হাসছেন সমরেশ। দুজনকেই এক ফ্রেমে রেখে ছবিটা তুলে দিয়েছিল কে? সেটা আর মনে পড়ছে না। বিচের কোনও পেশাদার ফোটোগ্রাফারই কি? কে জানে! হবে হয়তো! ছবিটা দেখেই আবার হু হু কান্না এসে ভিড় করছে সমরেশের। বুড়ো হলে আরও একটা চিন্তা আসে দাম্পত্যে। কে আগে যাবে? এক্ষেত্রে মনে মনে খানিকটা স্বার্থপরই ছিলেন সমরেশ। চাইতেন, সরলা আগে যাক। এই ভাবনার মধ্যেই গুঁড়ি মেরে থাকত তাঁর অভিভাবকত্ব। সরলা যে দলিলপত্র, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিসগুলো একা সামলাতেই পারে না। তার পর আবার সুগারটা ধরার পর থেকে আরও কমজোর হয়ে গিয়েছে শরীরে। মনেও সে ভয় থাবা বসিয়েছে। সমরেশ না থাকলে ওর বেঁচে থাকাটা আরও কঠিন হবে। যতই তিতির থাকুক, তারও তো একটা সংসার আছে, জড়িয়ে পড়া আছে! কিন্তু যা চাইবেন তা-ই যে হবে, জীবন আবার কবে এমন সভ্যভব্য ভদ্রলোক হল!

মুখে একটা কেঠো হাসি রেখে কোনওরকমে দুটো মুখে দিয়ে চেয়ার ছাড়লেন সমরেশ। অরিন্দম খুব বুদ্ধিমান ছেলে। কিছু আঁচ করল কিনা কে জানে! নিজে থেকেই তিতিরকে বলল, ‘বাবাকে বরং এবেলা একটু বিশ্রাম নিতে দাও, তোমাদের যা আড্ডা সন্ধেয় দিও’খন।’ সমরেশও এ কথার কোনও প্রতিবাদ করলেন না দেখেই হয়তো বাকিরা আর জোরাজুরি করল না। ঘরে ঢুকেই হিসেবের খাতা নিয়ে বসলেন সমরেশ। সাধারণত, এসব কাজ তিনি সকালের দিকে কোনও কোনও দিন করেন। যদি সরলার জীবনটা মাস দুয়েকের জন্যও একটু সরল করে দেওয়া যায়। বাকিটা আস্তে আস্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক শিখে যাবে।

বেঁচে যাওয়া খাবার ফ্রিজে তুলে, মেয়ের সঙ্গে টুকিটাকি গপ্পগাছা সেরে ঘরে ঢুকে এমন অবেলায় মাসকাবারির খাতা হাতে বরকে দেখে একটু অবাকই হল সরলা।

—কী ব্যাপার? এত অবেলায় এসব নিয়ে পড়লে? ভাল করে তো খেলেও না দেখলাম। শরীরটরীর খারাপ নাকি?’

ওহ্! বেশি বয়সে পৌঁছে বউদের এই এক দোষ! কোনও দিন দু-এক মুঠো ভাত কম নিলে তো ধরেই নিল শরীর খারাপ।

—আরে না না, সেসব কিছু না। অত গুরুপাক, আজকাল আর সহ্য হয় না, তাই কম খাওয়াই ভাল। তবে রান্নাগুলো কিন্তু খুব ভাল হয়েছিল আজ। চিংড়িটা বুবুন কেমন চেটেপুটে খেল দেখলে!

—সবই দেখলাম। বুবুনের দাদু যে খুব একটা মুখে তুলল না কিছু, তা-ও।

সমরেশ বুঝলেন, সরলার চোখ এড়ায়নি কিছুই। এখুনি প্রসঙ্গ ঘোরাতে না পারলে আসল কথাগুলোই বলা হবে না। মুখে ‘ধুস’ বলে কান এঁটো একটা হাসি ছড়িয়েই বউয়ের দিকে ফিরলেন।

—আচ্ছা সরল, গত মাসে ক্লিন অ্যান্ড ক্লিয়ারে যে তোমার শাড়িগুলো কাচতে পাঠালে, তার ডেট কবে ছিল গো?

ছেচল্লিশ বছর ধরে চেনা মানুষটার মুখে চটুল হিন্দি গানের শিস শুনলেও বোধহয় এতটা চমকাতেন না সরলা।

—তুমি আবার সেসব নিয়ে কবে থেকে ভাবছ! জীবনে তো একবারও এসব সাসংসারিক খোঁজ নাওনি। কী হয়েছে বলো তো তোমার?

এই রে! ভাল স্ট্রাইকার যেমন গোলে পৌঁছনোর আগে কিছুটা ড্রিব্‌লের কেরামতি দেখাতে পছন্দ করে, ভাল উইংব্যাক যেমন বল কাড়ার আগে কিছুটা চুপকি টুকটাক গুঁজে দেয় বিপক্ষের চেনা ছকে, আসল প্রসঙ্গ তুলতে গিয়ে তেমনটাই করতে চেয়েছিলেন সমরেশ। হালকা চালে কথা শুরু করে আসল কথা পাড়তেন। সে আর হল কই? সরলা যে দক্ষ কোচের মতো বিপক্ষের সব কেরামতি বুঝে যাবে সে আর কে জানত!

—আরে না না, কী আবার হবে। আসলে নানা খাতের টাকাপয়সাগুলো ভাগ ভাগ করে রেখে দেব এখনই ভাবছি। ঘুম পাচ্ছে না আজ। শুধু শুধু বসে থেকে কী করব, কাজটা এগোই…। বিষয়টা হালকা করতে চাইলেন সমরেশ— এই তো দ্যাখো না, গিরিনের দোকানে হল গিয়ে তিন হাজার আটশো বাইশ টাকা। মানে, গতমাসের বিল ধরে বলছি। এ-মাসে না হয় পুরো চারই ধরলুম। তারপর হল গিয়ে দুধ। প্রায় আটশো টাকা, যদি একটু পায়েসটায়েস করো, একটু বাড়িয়েই ধরি। আর বাজারহাটের যাবতীয় যা সে তো আলাদা করে তোমার কাছে রাখাই থাকে। ওষুধ আমার পেনশন থেকেই করে নিও। ওসব নিয়ে ভাবছি না। ভাবছি কেবল, তোমার মেডিক্লেমটা। ওটার কাগজপত্র তো কিছুই জানো না। একটু এদিকে এসে বোসো দেখি, চটপট ব্যাঙ্কট্যাঙ্কগুলো বুঝিয়ে দিই।’ সরলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টুকরো শ্বাস গিলে ফের ঢুকলেন সমরেশ— শোনো, দোতলাটা তোলার জন্য যে টাকাটা লোন করেছিলাম আমরা, সেটা আর দু মাস গেলেই শোধ।  বাড়ির দলিলটাও মর্টগেজ করা হয়েছিল তখন, সেটাও ছাড়িয়ে নেওয়া যাবে। দু মাসের টাকা এই খামে ভরে রাখলুম…।

এবার আর কোনও প্রতিরোধ মানলেন না সরলা। চোস্ত শিকারির মতো ঠিক নিশানায় তির ছুড়লেন।

—একটা কথা সত্যি করে বলবে?

কী কথা তা শোনার আগেই বুকটা ধক করে উঠল সমরেশের। সরলা ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন? তাহলে কি ওর গোপন আশঙ্কার কথা সেও জেনে ফেলেছে। ঢোঁক গিললেন সমরেশ।

—কী ছেলেমানুষি করছ সরল, মিথ্যে কী বললাম যে নতুন করে সত্যি বলতে হবে?
—মিথ্যে বলেছ তো বলিনি, সত্যিটাও বলছ না, সেটা বুঝতে পারছি।

মনে মনে অস্থির লাগছে সমরেশের। বাইরের ঝুটঝামেলাগুলো বোঝানোই হল না। বারবার ভেবেছিলেন, সময় থাকতে ব্যাপারগুলো নিয়ে বসবেন। সে আর হল কই? আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু করে করে তো দিনটাই চলে এল। ভূমিকাটাই যে গুছিয়ে করে ওঠা যাচ্ছে না সরলার ঠেলায়। যে কোনও জেরার মুখে চিরকাল সব গুলিয়ে যেত সমরেশের। অফিসের কাজও করতেন খুব সাবধানে, যাতে কোনও জেরার মুখে পড়তে না হয়। তবু সরলার কথাকে শেষ অবধি আটকাতেই হবে। নইলে যা বলতে চাইছেন বলা হবে না।

—আচ্ছা সরলা, তুমি কি আমাকে একটু সময় দেবে আজ দুপুরটা? আমার কিছু জরুরি কথা বোঝানোর আছে।
—কী ব্যাপার বলো তো? টাকাপয়সা গুছিয়ে রাখছ আগে থেকেই, মেডিক্লেম বোঝাচ্ছ, ব্যাঙ্ক দেখাচ্ছ, বলি এই বয়সে সংসারত্যাগী হবে নাকি? তা মহিলাটি কে? কবে আলাপ? মুখটেপা হাসি নিয়ে কথাগুলো ছুড়ল সরলা।

আজও হাসলে সরলার গালে একটা খাঁজ পড়ে, ঠিক টোল নয়, খাঁজ। টোলের মতো রহস্য তাতে নেই, কিন্তু খাঁজের নিজস্ব মাধুরী তাতে রয়েছে। সেদিকে চেয়েই কিছুটা আনমনা হলেন সমরেশ। চেয়ার ছেড়ে উঠে সরলার কাছে গেলেন, স্ত্রীর থুতনি ধরে সোহাগের মতো সুন্দর বোঝাপড়া থাকতে পৃথিবীতে কেন যে এত দাম্পত্যঅসুখ তা বোঝেন না সমরেশ। সরলার চিবুক ছুঁয়ে আজ সেই চেনা সেহাগটুকুই করতে প্রাণ চাইল। মনে মনে সারাক্ষণ একটা টিক টিক টিক টিক চলছে, একটা টিক মানেই এক সেকেন্ড গেল। সময় দ্রুত কমছে, তারপর মোক্ষম সময় যে কখন কোন ফাঁক গলে ঢুকে যাবে কেউ জানে না। সমরেশ দেরি করলেন না। প্রাণের এই ইচ্ছেগুলো আর আটকাবেনই বা কেন? অনেক অনেক দিন পর সরলার চিবুক ছুঁতেই বুকে মাথা রাখল সরলা। দাম্পত্যের শেষবেলায় মধ্যবিত্ত আটপৌড়ে জীবনে এইটুকু সোহাগই তো পড়ে থাকে! যত বয়স বাড়ে নিশিযাপনের তুমুল মুহূর্তরা দূরে সরে এই খুচখাচ ছোঁয়াচগুলোকে জীবনে জায়গা করে দেয়। সরলাকে আজ বেশ কিছুক্ষণ বুকে ধরে রাখলেন সমরেশ। সরলাও বেশ শান্তিতে মাথা দিয়ে থাকল, আগের মতো পালাই পালাই করল না তো! তাহলে আজ এই বাড়তি নৈকট্যটুকুও সমরেশের পাওনা ছিল জীবনের কাছে! চোখটা থেকে থেকেই ঝাপসা লাগছে বড্ড।

সরলাকে কাছে বসিয়ে গুছিয়ে শুরু করলেন, ‘সরল, কথাটা অন্যভাবে নিও না। দেখো আমারও তো বয়স হচ্ছে, আমি চাই, তুমি আজ এগুলো একটু আমার থেকে বুঝে নাও। আগে অনেকবার ভেবেছি বুঝিয়ে রাখব, কিন্তু নানা কারণে হয়ে ওঠেনি আরকি। আরে আমার তো বয়স হচ্ছে, আজ আছি, কাল নেই, আমি না থাকলে তোমার যাতে অসুবিধে না হয়…, শেষ বাক্যটা বলেই সরলার দিকে একবার আড়চোখে তাকালেন সমরেশ। চোখের কোণ দিয়ে যেন গিলে খাচ্ছে সরলা ওঁকে।

—তুমি এসব বলা থামাবে না আমি তিতিরদের ডাকব?
—আহ্! যেন একটু বিরক্তই হলেন সমরেশ— যা বলছি সেটা শোনো সরল। অযথা বাড়াবাড়ি কোরো না।
—বাড়াবাড়ি তুমি করছ, আমি নই। বলেই ঘর থেকে দুমদুম করে বেরিয়ে গেল সরলা।

নাহ্! এভাবে হবে না। আজ রয়েসয়ে রাতেই নাহয় আর একবার চেষ্টা করবেন। কিন্তু রাত যদি না আসে আর! অস্থিরতাটা আবার চাড়াচ্ছে মাথায়। ঘড়িটা দেখলেন সমরেশ। পাঁচটা বাজতে চলল। তার মানে তো দুপুরটাও মেরেই আনলেন। হঠাৎই বুদ্ধিটা মাথায় এল। আজ রাতটা তিতিরদের জোর করে রেখে দিলে কেমন হয়? কাল বুবুনের স্কুলকামাই নিয়ে খুব ঘ্যানঘ্যান করবে কি মেয়েটা? সে করুক। একদিন নাহয় স্কুল না-যাওয়াটা মানিয়েই ছাড়লেন। আর কিছু না, ওরা থাকলে এমন একটা ভাইটাল দিনে সরলাকে আতান্তরে পড়তে হয় না। কথাটা ভাবতে ভাবতেই সদর দরজা পেরিয়ে বাগানে এলেন সমরেশ। একটা নতুন কামিনী কিনেছেন আগের মাসে। তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। একটু বেড়েছে গাছটা। বাগানের শখ ওঁদের দুজনেরই। বরাবার এসব সরলাই সামলেছে, রিটায়ারের পর ওকে একটু হাতে হাতে সাহায্য করেন সমরেশ। এলোমেলা খানিক ঘুরেই ঘরে এলেন। যত প্রহর এগোচ্ছে মনে মন থাকছে না। কাল অবধিও ভেবেছেন, সরলাকে ডেকে সব জানিয়ে দেবেন। বিশ্বাস-অবিশ্বাস তো পরে, আগে ফ্যাক্টটা তো জানুক। তাছাড়া একটু আগে থেকে জানা থাকলে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ারও সময় পাবে। কিন্তু সে আর হল কই? আর সকলে যে ব্যাপারটাকে খুব সিরিয়াসলি নেবে তাও তো নয়। হাসাহাসিও করতে পারে। তবু নিজের বিশ্বাস তো নিজের কাছেই। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ডাইনিংয়ে এসে বসলেন সমরেশ। চা চাইছে গলাটা। সরলা যা রেগে আছে, চাইবে না কি একবার? হাঁক পাড়তে গিয়েই থামতে হল সমরেশকে। হাতের কাছে চায়ের কাপটা নামিয়ে দিয়ে গেল সরলা। কী করে জানল সরলা যে ওর এখনই চা লাগবে? দাম্পত্য কি একেই বলে! জীবনের শেষেও কত কী জানার থাকে ভাবলেন সমরেশ।

সন্ধেটাও নিরুপদ্রেবই কাটল। বুবুনের বায়নায় কেকফেক কাটার মতো ছেলেমানুষিও পোহাতে হল সমরেশকে। তিতিরও নিজেই জানিয়ে দিল ওরা আজ থাকবে। অবাক হয়েছেন সমরেশ। খুশিই হলেন। তাহলে তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ীই হল ব্যাপারটা। যত সময় এগোচ্ছে জীবনটা আরও হালকা লাগছে। ঠিক করলেন আর বাড়তি ভাবনায় যাবেন না। রাতে  কিছুটা সময় হাতে পেলে সরলাকে সব বুঝিয়ে দেবেন, নইলে থাক। কারও জন্যই কিছু আটকায় না। দরকার সামনে এসে দাঁড়ালে সরলা সব শিখে যাবে আপনিই। আর মেয়ে-জামাই তো রইল।

রাতে খেয়ে ওঠার সময় ঘড়িটা দেখলেন সমরেশ। ঠিক দশটা কুড়ি। সাড়ে এগারোটার আগে ঘুমোয় না সরলা। তার মানে হাতে ঘণ্টাখানেক সময় আছে। কিন্তু এখনও কিছু টের পেলেন না তো! তাহলে কি আর একটু পর? হাতের কাছে কিছু ওষুধ রাখবেন না কি? যদিও সমরেশ জানেন, সময় এলে ওসব কাজে আসে না। ইশ্‌! কাগজটা যদি একবার হাতে পেতেন! আর কিছু কি ছিল লেখা ওতে? ঘড়ির কাঁটার টিকটিক যেন বুকের উপর চেপে বসছে। যত এগোচ্ছে সময় তত অসহায় লাগছে নিজেকে। সরলা এখনও থমথমে। দুপুরের মেঘটা কাটেনি। সাড়ে এগারোটা বাজতে চলল। এখনও শুতে এল না তো? উফ্‌! অস্থির লাগছে সমরেশের। বিষয়গুলো বোঝানোর একটা শেষ চেষ্টা করবেন ভেবেছিলেন। ভাবতে ভাবতেই দরজার আওয়াজ পেলেন।

ওই তো, ওই তো সরলা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন সমরেশ।

—শোনো বেশি সময় নেই। প্রশ্ন কোরো না। যা বলছি বলতে দাও।

পাত্তা দিল না সরলা। পাশ ফিরে বালিশ আঁকড়ে শুয়ে বলল— আলোটা নিভিয়ে দাও। যা শোনার কাল শুনব।

—কাল হবে না সরল, কাল আর বলা যাবে না।
—কেন বলা যাবে না? সটান উঠে বসেছে সরলা। সকাল থেকে আজ দেখছি এসব বলেই চলেছ। কাল রাতে কোথায় উঠেছিলে?

শেষ প্রশ্নটা শুনে যারপরনাই চমকেছেন সমরেশ। সরলা জানল কী করে? ঘুমোয়নি তখনও?

হঠাৎ গলার কাছে একটা কান্না এল। কোনওক্রমে তা গিলে ফেললেন সমরেশ। যে কথা চেপে রেখেছিলেন তা এবার নিজেই বুক ফেটে বেরিয়ে আসবে মনে হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটাও থেমে নেই, ভাবনা, কথা, তর্কের সঙ্গেই দ্রুত এগোচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ সরলা উঠে পড়ল পাশ থেকে। মশারি খুলে কোথায় যেন বেরোল। ওর সঙ্গে যাবেন বলে উঠতে গিয়ে সমরেশ টের পেলেন পা আর সরছে না। সর্বনাশ। সময় এল নাকি?

হঠাৎ দরজা খুলে ঘরে এল সরলা। হাতে একরাশ কাগজ।

এ কী! এই তো…, এই তো সেই কাগজটা! যেটা ওর পৈতের সময় মায়ের গুরুদেবকে দিয়ে বানিয়েছিলেন মা। মা এসব খুব মানতেন। বিয়ের সময় ওর আর সরলার কোষ্ঠী মেলানোয় বাবার কোনও মত ছিল না। বাবাকে লুকিয়ে মা তাঁর বিশ্বস্ত গণককে দিয়ে মিলিয়ে এনেছিলেন। সমরেশও বিয়ের আগে বিষয়টা জানতেন না। একদিন রাতে সরলাই বলেছিল মা ওর কোষ্ঠী চাইতে একদিন ওদের বাড়ি গিয়েছিলেন। কথাটা শুনে লজ্জাই পেয়েছিলেন সমরেশ। নতুন বউয়ের যেন এই নিয়ে মনে কোনও ক্ষোভ না থাকে, সেভাবেই বিষয়টা সামলেছিলেন। মা বলতেন, এখানে যা যা লেখা, তার সব হুবহু মিলেছে সমরেশের জীবনে। সমরেশেও পড়ে দেখেছেন মোটের উপর বেশিরভাগই মিলেছে। মা যতটা বলতেন, তত হুবহু না হলেও মূল বিষয়গুলো মিলেই গিয়েছে। কম বয়সে এসব সমরেশ পাত্তা দিতেন না বিশেষ। কিন্তু বয়স যত বেড়েছে, এই কাগজ যত নির্ভুল হয়েছে, ততই এর উপর বিশ্বাস জন্মেছে। মায়ের থেকেই হয়তো বিশ্বাসটা চারিয়ে গিয়েছিল সমরেশের মগজে। এতেই তো লেখা ছিল, পঁচাত্তরের পর আর একটা দিনও নেই সমরেশের হাতে। জন্মদিনই মৃত্যুদিন হবে তার। সেই হিসেবে তো আজই শেষ দিন। কিন্তু এটা সরলা পেল কোথায়? এর কথা জানলই বা কী করে?

আলো জ্বালিয়ে মশারিতে এল সরলা।

—এ সংসার আমার। এখানে আমারই চোখের আড়ালে বছরের পর বছর লুকিয়ে রাখবে কিছু, তা ভাবলে কী করে তুমি! আমি তিতিরদেরও সব বলেছি।

কথা সরছে না সমরেশের।

—ওরা কি তাই আজ…?
—হ্যাঁ। থাকার ব্যাপারটা সেজন্যই। অরিন্দমও খুব চিন্তায় আছে সকাল থেকে। যদিও ওরা এসব কোনওকালেই মানেটানে না। তিতির বলছে এসব তোমাদের কুসংস্কার। তবু আজকাল এসব ভয় আমারও হয়! ওরাও ও ঘরে জেগে আছে। বলতে বলতেই হাউহাউ কেঁদে উঠল সরলা। মায়ায় ভেসে যাচ্ছেন সমরেশ।

হঠাৎই দূরে বারোটার ভোঁ শোনা গেল কারখানার। ঘড়িতেও বারোটার ঘণ্টা বেজে বেজে থেমে গেল। তার মানে সমরেশের বয়স পঁচাত্তর পুরে এক দিন হয়েই গেল! তাহলে কি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভবিতব্যটাই মেলাতে পারল না কাগজটা?

এতক্ষণ পর সরলাকে জড়িয়ে ছেলেমানুষের মতো কেঁদে ফেললেন সমরেশ। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সরলা। বাতাবিফুলের গন্ধটা আবার ঝাপটা মারছে সমরেশের নাকে।

আরও কটা দিন এক্সট্রা বাঁচতে ইচ্ছে করছে সমরেশের।