Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সন্দীপ দত্ত: গভীরতর ক্ষতের অপেক্ষা

সুস্নাত চৌধুরী

 



সম্পাদক, বোধশব্দ

 

 

 

 

লাইব্রেরির স্থানাভাবের সমস্যা মেটেনি। আঙুল কামড়ানো সবে শুরু হয়েছে আমাদের। এখন কি তবে গভীরতর ক্ষতের জন্য অপেক্ষা? সক্রিয় সরকারি উদ্যোগ, বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা কিংবা কোনও সমষ্টিগত প্রয়াসে হয়তো এখনও লাইব্রেরিটি রক্ষা করা সম্ভব। যদিও এই দেশে সে-আশা কত দূর বাস্তবোচিত?

 

সন্দীপ দত্তর মৃত্যু নিয়ে যাঁর সঙ্গে আমার অতীতে কিছু কথা অন্তত হয়েছিল, তিনি সন্দীপ দত্ত স্বয়ং। বিগত বছর কয়েকে, বার দুয়েক। দুঃখজনক হলেও অস্বীকারের উপায় নেই যে মানুষের জীবনে একমাত্র অবশ্যম্ভাবী ঘটনা হল মৃত্যু। কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠ এই বয়ান কাছের মানুষের জন্য, কাজের মানুষের জন্য মেনে নিতে আমাদের মন সায় দেয় না। সেই চরম মুহূর্তটি শিয়রে উপস্থিত হলে বিপর্যস্ত লাগে; অগত্যা তখন আমরা সত্যের নাম দিই ভবিতব্য।

মরে গেলে মানুষ নাকি ‘বডি’ হয়ে যায়। ছায়াছবির গান বলে, চিতাতেই সব শেষ। ‘তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে।’ যেকোনও সমাজ বা সংস্কৃতিতে এমন মানুষ খুব কমই থাকেন, যাঁদের অনুপস্থিতি কোনও একটি ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণত থমকে দেয়। ছোট, বড়, মাঝারি— যেমনই হোক-না-কেন, সামগ্রিক একটা কার্যক্রম যেন আকস্মিক ধসের সম্মুখীন হয়। এমনকী, অনেক গুণী মানুষ, ‘সেলেব’ মানুষ, কাজের মানুষ চলে গেলেও সমাজে এক সাময়িক শূন্যতা তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু সবসময় তা এমন সর্বস্ব খুইয়ে ফেলার বোধ তৈরি করে না। রুটিন হেডলাইনের ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ কিংবা মিছিল-মিটিঙের ‘তোমায় আমরা ভুলছি না, ভুলব না’ গোছের মুখস্থ স্লোগান নয়— প্রকৃত প্রস্তাবেই সেই না থাকা ‘শো মাস্ট গো অন’-এর আপ্তবাক্যটিকে প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সন্দীপ দত্তর সঙ্গে কথা হয়েছিল এইসব নিয়েই। তাঁর না-থাকার অবশ্যম্ভাবী দিনগুলি নিয়ে।

 

কে ছিলেন সন্দীপ দত্ত? কী ছিল তাঁর অবদান? যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন। যাঁরা জানতেন না, তাঁদের অনেকেও গত এক মাসে মোটামুটি জেনে গিয়েছেন— বাংলা ও ইংরেজি খবরের কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর। এমনকী তাঁকে নিয়ে উইকিপিডিয়ার পাতাটিও তৈরি হয়েছে ১৫ মার্চ, তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে। অর্থাৎ জীবৎকালে তিনি যতটা ‘খবর’ হতে পেরেছিলেন, তার চেয়ে বেশি তাঁর কথা বলা হচ্ছে এখন। এর প্রধানতম কারণ, একদা সন্দীপ দত্ত সময়ের থেকে ঢের এগিয়ে ভেবেছিলেন। সমকালের চেয়ে ভাবনায় এই এগিয়ে থাকতে পারাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান। নিজ উদ্যোগে তিনি শুরু করেন লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণের কাজ— ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র। যে-সমাজে বিয়ের মেনুকার্ড থেকে নির্বাচনী জনসভা— যত্র তত্র উৎকট অন্ত্যমিলে আর ভুল মাত্রায় কাঁচা পদ্য আওড়ানো হয় অথচ লিটল ম্যাগাজিন বস্তুটির প্রাসঙ্গিকতা মানুষের মগজে ঠাঁই পায় না, সেখানে সন্দীপ দত্তর অবদান বুঝতে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা কী আর এমন বড় সময়!

সন্দীপ দত্ত আর তাঁর সমার্থক হয়ে ওঠা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির কথা যে কেউ জানতেন না, এমন নয়। অতীতে আল জাজিরা-র মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে কাজ করেছে, ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ফর দি আর্টস-এর মতো সংস্থা অনুদানের হাত বাড়িয়েছে, দুই বঙ্গের লিটল ম্যাগাজিনের সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষও এ-ব্যাপারে নিশ্চিত ওয়াকিবহাল ছিলেন— কিন্তু সমগ্রের নিরিখে আমরা কতজন আদৌ বুঝতে চেয়েছিলাম এই লাইব্রেরির গুরুত্বের দিকটি? সন্দীপ দত্ত না থাকলে তাঁর লাইব্রেরির কী গতি হবে, সেটি পুরোদস্তুর কার্যকর রাখা যাবে না কি কালক্রমে গোটা সংগ্রহের ঠিকানা হবে কলুটোলার ফুটপাথ— সেইসব আশঙ্কার মেঘ অতীতে বড়-একটা ঘনিয়ে উঠেছিল কি? এখন কারও কারও কথার ফাঁকে হয়তো বেরিয়ে আসছে সেই দীর্ঘশ্বাস।

অথচ আজ নয়, একপ্রকার অশনিসঙ্কেত কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরেই উঁকি দিচ্ছিল। স্থানাভাব হয়ে উঠেছিল সংস্থাটির প্রধান অন্তরায়। সন্দীপ দত্ত নিজেও বারবার সে-কথা জনসমক্ষে বলেছেন। জায়গার জন্য বর্তমান রাজ্য সরকারের সঙ্গে একাধিকবার কথাবার্তা চালানো হলেও তা শেষপর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। ক্রাউড ফান্ডিং-এর চেষ্টা করে সাময়িক কিছু সাড়া মেলে। কিন্তু তাতেও পৌঁছোনো যায়নি বিশেষ সুবিধেজনক অবস্থায়। কারণ, এ কি আর দু-চার লক্ষ টাকায় মিটে যাওয়ার মতো সমস্যা! অথচ বাংলা ভাষা ও বাঙালির বিদ্যাচর্চার স্বার্থেই প্রতিষ্ঠানটির সযত্ন দেখভাল জরুরি ছিল; এমন একটি প্রতিষ্ঠান যে বাঙালির আছে, সে-বিষয়ে গর্বিত হয়ে ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে আরও বৃহৎরূপে যে জাতিগত উদ্যোগ কাম্য ছিল, তার বিন্দুমাত্রও দেখা যায়নি।

শুধু স্থানাভাব মেটানো নয়, লাইব্রেরিতে থাকা পত্রিকাগুলির যথাযথভাবে পুরোদস্তুর ক্যাটালগিং হওয়া দরকার ছিল। দরকার ছিল বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে রক্ষণাবেক্ষণের। ডিজিটাইজেশনের কাজও হতে পারত আরও ব্যাপক হারে। বছর খানেক আগের হিসেব বলছে, মোটামুটিভাবে নব্বই হাজার পত্রপত্রিকার সংখ্যা রয়েছে এই লাইব্রেরিতে। অদ্যাবধি কম-বেশি দেড় হাজার পত্রিকার সংখ্যা ডিজিটাইজ করা গিয়েছে; অর্থাৎ যা মোট সংগ্রহের ১.৭ শতাংশ মাত্র। হয়তো সন্দীপ দত্তর ব্যক্তিগত কিছু সীমাবদ্ধতাও এর পিছনে কাজ করেছে। তবে কি না, তা বিচার বা বিশ্লেষণের যোগ্যতা ও অধিকার এই অধমের নেই। এটুকু বলতে পারি, সন্দীপ দত্ত নিজের ভাবনা ও উদ্যমে প্রায় চুয়াল্লিশ বছর ধরে যা করে গিয়েছেন, তা যথেষ্ট বললে কম বলা হয়। বাকি যা ছিল, কিংবা রয়েছে, অন্তত এখনও, তার সুষ্ঠু সমাধা নিশ্চিতভাবেই একটি জাতির কর্তব্য; কারও ব্যক্তিগত দায় তা সেদিনও ছিল না, আজও নয়।

কলেজ স্কোয়ারে শায়িত সন্দীপ দত্তর মরদেহের উপরে শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্যের স্বনামাঙ্কিত এ-ফোর প্রিন্টআউট তাঁরাও রেখেছেন, যিনি বা যাঁরা অতীতে চাইলে অনায়াসে না-হোক, অত্যল্প আয়াসেই হয়তো লাইব্রেরির স্থানাভাবের সমস্যাটি মিটতে পারত। অন্য কাজগুলিও তাতে ত্বরান্বিত হত। হয়নি যে, তা বাঙালির দুর্ভাগ্য। আঙুল কামড়ানো সবে শুরু হয়েছে আমাদের। এখন কি তবে গভীরতর ক্ষতের জন্য অপেক্ষা? সক্রিয় সরকারি উদ্যোগ, বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা কিংবা কোনও সমষ্টিগত প্রয়াসে হয়তো এখনও লাইব্রেরিটি রক্ষা করা সম্ভব। যদিও এই দেশে সে-আশা কত দূর বাস্তবোচিত, বলতে পারি না। কারণ, শুধু টিকিয়ে রাখাই তো যথেষ্ট নয়— লাইব্রেরিটি পুরোদস্তুর কার্যকর রাখা এবং তার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য হওয়া উচিত। সে-কাজ খুব সহজ নয় ঠিকই; আবার একেবারে অসম্ভবও না। আজ যখন সুশোভন রায়চৌধুরীর মতো কোনও তরুণকে দেখি নাগাড়ে একের পর এক লিটল ম্যাগাজিন ডিজিটাইজ করার পরিশ্রমসাধ্য কাজটি সামলে চলেছেন নিজস্ব তাগিদে, দুষ্প্রাপ্য কোনও একটি সংখ্যার খোঁজে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ ছুটে বেড়াচ্ছেন পৃথ্বী বসু, বিন্দুমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়াই লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির তত্ত্বাবধানের উদ্দেশ্যে ঘণ্টা খানেকের পথ পেরিয়ে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন প্রসূন মজুমদার— তখন ভরসা লাগে। মনে হয়, একটা চা-সিগারেট খেয়ে বিরতির পর ফের কাজ শুরু হবে।