Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সন্দীপ দত্তের সফলতা ও নিষ্ফলতা

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

 



প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, চলচ্চিত্রবেত্তা

 

 

 

একা চলার গৌরব সন্দীপের ছিল। আমরা যারা ধীরে ধীরে সত্তর পার হয়ে গেলাম, তারা বুঝতে পারছি এই গৌরব সত্তর দশকের। সত্তর দশক বাঙালির শেষ দশক যা কিছু প্রশ্ন তুলেছিল এবং উদাসীনতার সঙ্গে দামি শাল ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছিল। আজ সন্দীপ চলে যাওয়ার পরে দেখছি যে আমাদের জন্য ম্যানিকুইন, শপিং মল আর অনুপ্রেরণা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না

 

সন্দীপ, আমাদের বন্ধু সত্তরোর্ধ্ব সন্দীপ, উত্তর কলকাতার বনেদি গন্ধবণিক, সন্দীপ দত্ত চলে গেলেন। তাঁর এই চলে যাওয়াতে একটি প্রচ্ছন্ন ঠাট্টা আছে। যেন সন্দীপ আমাদের বলে গেল— দত্ত কারও ভৃত্য নয়। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের সারস্বত সমাজে একটি আকস্মিক প্রভা দেখা যাচ্ছে এবং মনে হচ্ছে সকলেই সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে ‘যব তক সুরজ চাঁদ রহেগা, সন্দীপ তেরা নাম রহেগা’। এসব উচ্ছ্বাসে আমার মুখে এখন সামান্য হাসির ঝিলিক খেলে যায়। তার কারণ এই নয় যে আমি নাস্তিক বা অবিশ্বাসী। আমি সন্দীপের চেয়ে মাস ছয়েক অথবা বড়জোর বছরখানেকের ছোট। আসলে এখন পশ্চিমবঙ্গের বিদ্বৎসমাজ বা সাহিত্যসমাজ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাকে এক সম্প্রসারিত দাসবংশ বলা যায়। এই যে সন্দীপ চলে গেল, বা খানিক আগে সুবিমল মিশ্র বা আরও বেশ কয়েক বছর আগে নবারুণ ভট্টাচার্য, এই শোকমিছিল শুরু হয়েছিল অনন্য রায়কে দিয়ে। আমরা প্রায় সকলেই জানতাম যে আমাদের কাজ অর্থাৎ লেখকের কাজ ঘাড় নুয়ে থাকা নয়, বরং সন্দীপ তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেল যে সে কোলকুঁজো নয়। বরং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সে তাঁর কাজের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সারাজীবনে সে কারও কাছে হাত পাতেনি। সন্দীপ সামাজিক জীব ছিল, তাঁরও আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, তবু বঙ্গরত্ন হিসেবে না ঘোষিত হওয়ায়, কোনও পুরস্কার না পাওয়ায় সন্দীপের কোনও অনুশোচনা দেখিনি৷ বরং দেখা গেল সন্দীপ আজীবন এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারল এবং লিটল ম্যাগাজিনের অধিকার রক্ষার আন্দোলনগুলোতে হাসিমুখে যোগ দিতে পারল।

 

কলকাতা বইমেলা এবং অন্যান্য পুস্তকমেলায় লিটল ম্যাগাজিনের জন্য যেন প্রয়োজনীয় স্থান সংরক্ষণ করা হয়, তার জন্য সে বিস্তর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাঁর মধ্যে রামকানাই ছিল, সে স্বেচ্ছায় নির্বুদ্ধিতার শিকার হল। সেই নির্বুদ্ধিতা হল, সন্দীপ নিজের জন্য কোনওদিন কিছুই চায়নি। অর্থাৎ এমন নয় যে বইমেলায় তাঁর জন্য আলাদা স্টল থাকত। সে লিটল ম্যাগাজিনের তাঁবুতে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে হইহল্লা করেই খুশি। এমন নয় যে, সন্দীপ যখন লিটল ম্যাগাজিনের জন্য কোনও ডেপুটেশন জমা দিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে গেছে, তখন সে নিজের জন্য আলাদা করে কোনও সুবিধে চাইত। সিদ্ধার্থ রায় থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— চারজন মুখ্যমন্ত্রীকে পার করে সে ওপারে চলে গেল, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীরা যে আত্মীয় হন না, তাঁদের দাদা-দিদি বলার দরকার নেই, এই সহজ সত্যটা স্কুলমাস্টার সন্দীপ দত্ত জেনে গেছিল। আসলে সন্দীপ প্রথম থেকেই জানত যে নিজের জন্য কোনও কিছু চাওয়ার দরকার নেই। এই জানার মধ্যে কিছু ভুল ছিল। কারণ লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র যদি আরও উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ করতে চাইত, তাহলে কিছু পরিমাণ লক্ষ্মীর প্রসাদের দরকার ছিল। আইএফএ তাঁকে একসময় কিছু অর্থ দিতেও চেয়েছিল, এবং আমাদের বন্ধুরা সেসব আলোচনার সাক্ষী ছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, যে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েও সে খুব স্বস্তি বোধ করছে না। ডিজিটাল পাঠক্রমের সঙ্গে সে খুব একটা পরিচিত নয় এবং তাঁর সবসময় ভয় থাকছে যে তাঁর স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হবে। এই স্বাধীনতার বোধই সন্দীপ দত্তকে আলাদা করে রেখেছে।

সন্দীপ নিজের জন্য স্বদেশ এবং বিদেশের কোনও ঠিকানা চায়নি, সে এইটুকুতেই খুশি ছিল যে উইলিয়াম র‍্যাডিচে বা অন্য কেউ তাঁর গ্রন্থাগারে আসে, টেমার লেনের সেই ছোট্ট প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে, এবং গবেষণা করে। সন্দীপ কোনও একসময় আমাকে বলেছিল, পরে হয়তো লিখেওছে, যে সত্তর দশক না থাকলে এসব কিছুই হত না। আমরা কেউই কিছু হতাম না। এই যে স্বাধীনতার বোধ যা অনন্য রায় থেকে সন্দীপ দত্ত পর্যন্ত সবাইকে স্পর্শ করে গেল, সেটা আজকের যুগে বসে অনুমান করা কঠিন। কেননা আজকের যুগে রাজনীতির ছোঁয়া না থাকলে অমরতার স্বাদ পাওয়া যাবে, এমনটা ভাবতেও বাঙালি ভুলে গেছে। এবং আমি জানি না, সন্দীপ এরকম অসমসাহসী একটি কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন কেন? নিশ্চয়ই ছোট পত্রিকা যাতে সংরক্ষিত হয় তা দেখাটা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু বুদ্ধিজীবিতার দিক থেকে দেখলে সে অঁরি লংলোয়া-র মতো নয়, এমনকি সে ঋত্বিক ঘটকের প্রিয়পাত্র পি কে নায়ারও নয়। তাঁর সরকারি অর্থানুকুল্য ছিল না, এমনকি সে শিবেন্দু দুঙ্গারপুরও নয়, যে সেলুলয়েড-ম্যানকে চিরায়ত করে রাখবে। সন্দীপ আমাদেরই সন্দীপ, উত্তর কলকাতার সন্দীপ, এবং সভ্যতার গভীর অসুখ জেনেও সন্দীপ সাধারণ একটি ফতুয়া ও একটি প্যান্ট সম্বল করে ত্রিপুরা পর্যন্ত তাই নিয়ে চলে যেত। এমনকি এই যে সেমিনার, সিম্পোসিয়াম, বা বইমেলা, এসব জায়গায় যাওয়ার জন্য সন্দীপ কারও কাছে বিমানভাড়া বা ট্রেনভাড়া কোনওদিন আশা করেনি। সে তাঁর নিজের আনন্দেই মত্ত ছিল। যদি ইতিহাসের ধুলোবালির মধ্যে লিটল ম্যাগাজিন সামান্য স্থান পায়, সেটাই তাঁর পক্ষে অসামান্য গৌরবের ছিল।

সন্দীপকে রাজনীতিমুক্ত বলাটা ঠিক হবে না, সে যৌবনে একটি বড় মিডিয়া দপ্তরের কাছ থেকে অপমানিত হয়, এবং একটি সরকার বিভাগের কাছ থেকে লাঞ্ছিত হয়ে বোঝে স্বাবলম্বন দরকার। এবং এইজন্যই সে পঞ্চাশ দশকের বিখ্যাত অগ্রজদের এড়িয়ে চলত। বরং ডেকে নিত জেলা বা মহকুমা শহরের অখ্যাত লেখক ও গবেষকদের। পরবর্তীকালে সন্দীপের প্রচুর নাম-টাম হয়েছে, কিন্তু আমরা যারা আশির দশকের সময় থেকে সন্দীপকে দেখছি, তখন তো সন্দীপ নিতান্ত একজন সাহিত্যকর্মী, যাকে হেসে বলা যায় ‘বাংলা সাহিত্যের কুলি’। আমরা এই কুলিটিকে সারাজীবন ধরে নির্বিচারে শোষণ করে গেছি, বঞ্চনা করে গেছি। আজ যাঁরা তাঁর মৃত্যুর পরে বড় বড় বিবৃতি দিচ্ছেন, তারা সন্দীপ দত্তের জীবিতকালে তাঁর ঋণ কতটা স্বীকার করেছেন তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, বাঙালির কোনও ইতিহাস নেই। বাঙালির ইতিহাস যারা তৈরি করতে সক্রিয় হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রামচন্দ্রের সেতুবন্ধনের মতো একটি কাঠবিড়ালি হলেও সন্দীপ দত্তের ভূমিকা ছিল। সন্দীপ নিজের অমরতার কথা না ভেবে লিটল ম্যাগাজিন গ্রন্থাগারের অনশ্বরতার কথা ভেবেছে। এবং এই গ্রন্থাগারটিকে যাতে বড় প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে রক্ষা করা যায় সেকথাও ভেবেছে।

আজ হয়তো সন্দীপ চলে যাওয়ার পরে আমরা দেখব যে এই প্রতিষ্ঠান অধিগৃহীত হয়েছে। সেখানে সন্দীপের একটি স্ট্যাম্প সাইজের ছবি মূল হোর্ডিংটির তলায় থাকবে। ওপরে থাকবে হাস্যরত কোনও দেশনেতা বা দেশনায়িকার ছবি। কিন্তু এই হাসির আড়ালে সন্দীপ যে অমোঘ ইঁদুর হয়ে আমাদের বিবেকের জটিলতাকে কামড়ে দিল এবং আমাদের নেটওয়ার্কিং কিছুটা ধ্বংস করল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমরা কোনও বড় পত্রিকার এক কোণাতেও কোনও লেখা ছাপা হলেও সেই পত্রিকার সম্পাদককে ধন্যবাদ দিই। সন্দীপ কিন্তু এই ধরনের কোনও ধন্যবাদের প্রত্যাশা না করেই এই লাইব্রেরিটা গড়ে তুলেছিল। আজ আমরা যাঁরা তাঁর জন্য শোক জানাচ্ছি, তাঁদের মনে রাখা দরকার সন্দীপ জীবিত অবস্থায় কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে হাত পাততে চায়নি। অথচ তাঁর সে সুযোগ ছিল। অনেকেই তাঁকে প্ররোচিত করেছিল। হয়তো হাত বাড়ালে উপকারও হত। জাতীয় গ্রন্থাগার কী মর্যাদা দিত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার কী মর্যাদা দিত, অথবা আইএফএ কী মর্যাদা দিত— তা নিয়ে সন্দীপ চিন্তিত ছিল না। সন্দীপ চিন্তিত ছিল যে এইসব জায়গায় গিয়েও সে দেখেছে অসামান্য ও দামি পাণ্ডুলিপিগুলি কি অসম্মানে ভূলুণ্ঠিত হয়ে রয়েছে। সন্দীপ ভেবেছিল, জাতীয় গ্রন্থাগার যদি অবজ্ঞা করতে পারে, তাহলে টেমার লেনেই না হয় দারিদ্র্যের গৌরব জুটুক।

 

এই যে একা চলার গৌরব তা সন্দীপের ছিল। এই যে আপাতভাবে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গা-ঘেষাঘেষি করে অনশ্বরতার দোলনায় দোলার এক অলীক স্বপ্ন তা সন্দীপ কখনও দেখেনি। এবং সে তা দেখেনি বলেই আমরা যারা ধীরে ধীরে সত্তর পার হয়ে গেলাম, তারা বুঝতে পারছি এই গৌরব সত্তর দশকের। সত্তর দশক বাঙালির শেষ দশক যা কিছু প্রশ্ন তুলেছিল এবং উদাসীনতার সঙ্গে দামি শাল ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছিল। আজ সন্দীপ চলে যাওয়ার পরে দেখছি যে আমাদের জন্য ম্যানিকুইন, শপিং মল আর অনুপ্রেরণা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না। এমন নির্বোধ ছিল সন্দীপ যে আমাকেও কয়েকবার মঞ্চাসীন করেছিল, সম্বর্ধনায় বা প্রধান আতিথ্য দানে। সন্দীপ সারাজীবনে বুঝতেই পারল না যে কোথায় বিনিয়োগ করতে পারলে কোথায় পুরস্কার জুটতে পারে। আজ হয়ত সে আবারও মৃদু মৃদু হাসছে যে মৃত্যুর পরে আজ এত ফুল, যা সন্দীপ জীবনেও ভাবতে পারেনি! সন্দীপ অন্যের জন্মদিনে শুভেচ্ছার পোস্টকার্ড দিত। কিন্তু মৃত্যুর পর যে সে এত শুভেচ্ছা পাবে, সে ভাবতেও পারেনি। হয়তো গোপনে জানত, কিন্তু প্রকাশ্যে সে আমাদের এসব কিছুই জানায়নি। বাঙালিরা সাধারণত ব্যক্তিগত উৎকর্ষে বিশ্বাস করে, রবীন্দ্রনাথ হতে চায়, ঐতিহাসিক বা বিজ্ঞানী হতে চায়, কিন্তু সন্দীপ তাঁর নিজের ধরনে সমষ্টির জন্য একটি সংগঠন গড়ে তুলতে চেয়েছিল। তাঁর এই সংগঠন প্রতিভাও তো কম গৌরবের কথা নয়।

এবার শেষ তোপধ্বনি। বিদায় সন্দীপ।