Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভাইরাস যাত্রা

ভাইরাস যাত্রা | সাত্যকি হালদার

সাত্যকি হালদার

 

বউকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়াটা কঠিন কাজ ছিল বৈকুণ্ঠর।

‌মাস ছয়েক আগে অল্প ক দিনের ছুটি পেয়ে বৈকুণ্ঠ বিয়ে করতে এসেছিল। তখন সে ছিল বেরিলি-তে। সেখানে ঠিকাদারের অধীনে ঘরবাড়ি তৈরির কাজ করত।

তাদের দেশ কুমিরমারি থেকে ক্যানিং-কলকাতা হয়ে বেরিলি, প্রায় দেড়দিনের পথ। গোসাবায় যে দিদি আর জামাইবাবু তারাই মেয়ে দেখে, চেনা কারও মোবাইলে ছবি পাঠিয়ে সব ঠিক করে রেখেছিল। বৈকুণ্ঠর সে সময় আসা এবং বিয়ে করা। বিয়ের যেটুকু যা হৈচৈ, তারপর সেই নতুন-চেনা রোগা মেয়েটির সঙ্গে মন আর শরীর জুড়তে জুড়তেই ছয়দিনের ছুটি শেষ। শুধু যাওয়ার সময় মেয়েটিকে জানিয়ে গিয়েছিল কাজে গিয়ে ও-দিকে সে একখানা ঘর ভাড়া দেখবে।

বৈকুণ্ঠদের গ্রাম আর আশপাশ থেকে বাইরে যাওয়া লোক অনেক। আগে দূরে যাওয়া বলতে ক্যানিং বা হাসনাবাদ থেকে ট্রেন ধরে কলকাতা। কলকাতা ছাড়িয়ে পাশাপাশির গঞ্জেও কাজে যেত সুন্দরবনের মানুষ। খাঁড়িতে মাছ ধরা আর মৌমাছির পেছনে জঙ্গলে ঘোরা যাদের পোষাত না তারা একদিন গ্রাম থেকে বেরিয়ে চলে যেত। চেনা কারও যোগাযোগে পৌঁছত দূরের ঠিকানায়। মেয়েরা ফ্ল্যাটের আর গেরস্থালির কাজ করতে যেত বেহালা আর সোনারপুরে। কিন্তু গত দশ পনেরো বছরে তেমনটা আর নেই। ও-সব দিকের লোক দল ধরে যাচ্ছে ভিন রাজ্যে, আরও দূরে কোথাও। পাকাপাকিও চলে যাচ্ছে অনেকে।

বাপ-মার কাছে ফুল্লরাকে রেখে বৈকুণ্ঠ বেরিলি-তে ফিরল। সেখানে সেই ঢালাই মেশিন ঘোরানো, গাঁথনি আর ইট ভেজানোর কাজ। সে-দেশে বাঘ কুমির আর সন্ধেবেলায় রাম-যাত্রার গল্প নেই। সেখানে সকালে চারটি খাওয়ার পরই সারাদিনের কাজ। দুপুরে আধঘন্টার বিশ্রাম। রাতে ফিরে টিনের লম্বা টানা শেডের ঘরের মেঝেতে সার দেওয়া বিছানায় শুয়ে পড়া। চার-পাঁচজন মিলে স্টোভে রান্না হয় কাজের পর। রাতে শুয়ে নানা কথার ভেতর বাংলা কথাও ঘুরে বেড়ায়। মুর্শিদাবাদের লোক, মালদার চর এলাকার কথা, এমনকী বৈকুণ্ঠদের দক্ষিণের ভাষাও। আর সেখানেই বৈকুণ্ঠর মোবাইলে ক্ষুদে অক্ষরে এক-দু লাইনের চিঠি ফুটে ওঠে। লেখা থাকে, তুমি কবে আসবা?

বৈকুণ্ঠর ছবির মোবাইল নয়। শুধু কথা। সে চোখের ওপর ছোট যন্ত্রটি এনে কুটি কুটি অক্ষরে উত্তর সাজায়। লেখে, ঠিক নেই।

পাঠিয়ে দেওয়ার পর আবার লেখে, এদিকে আমাদের কেউ ঘর ভাড়া দেয় না।

শেষে ঘুম। এক ঘুমে ভোর। সকালে মোবাইল ছুঁয়ে দেখারও সময় হয় না। রাতের অক্ষর বালিশের একপাশে পড়ে থাকে। বৈকুণ্ঠদের বাদাবনের দেশ, সেখানের নদী-জল-মানুষকে সারাদিনের মতো বেরিলির কনস্ট্রাকশান প্রোজেক্ট শুষে নেয়। কাজে আসা সবার শরীরে যেন রড আর ফাইবার এসে ভর করে। কারও মাথায় হেলমেট চাপে। ভরে পাওয়া মানুষের মতোই তারা পিলপিল করে কাজের অলিগলিতে মিশে যায়।

সন্ধেয় ফিরলে আবার কোনওদিন আসে ফুল্লরার ফোন। ক্ষুদে অক্ষরের বাইরে নামানো গলায় কথা। কুমিরমারির চর জেনে গেছে বেরিলি কখন কাজ শেষ করে ঘরে আসে। বৈকুণ্ঠ মোবাইলখানা মুঠোয় চেপে শেড দেওয়া ঘরের বাইরে চলে যায়। ফুল্লরা কথা বলে থেমে থেমে। সেদিন সে বলে, ক্যানিং-এর ওধারে চম্পাহাটিতে নতুন কাজের খোঁজ হয়েছে। এদিকের একজন যায়, সেই এসে বলে গেল। ওখানে ঘরভাড়ারও খোঁজ আছে।

দক্ষিণের এলাকায় এমন উড়ো কাজের খোঁজ মাঝেমাঝে আসেই। যারা আগে গেছে তারা খবর বয়ে আনে। বৈকুণ্ঠর এসব খবরে ভাবান্তর হয় না। তবে ছ-মাস আগে ফুল্লরার শরীর ছুঁয়েই সে বাইরে চলে এসেছে। বেরিলি-তে ভাড়াঘর কোনওদিন হবে কি না সন্দেহ। ফলে খানিক শুনে নিয়ে সে বলে, কীসের কাজ তা কিছু বলেছে?

ফুল্লরা বলে, ততটা শুনিনি, তবে তুমি বাড়ি ফিরলে দেখা করতে বলেছে।

বৈকুণ্ঠ হ্যাঁ না বলে না। বেরিলি বা বাইরের এমন কাজে টাকাপয়সা খানিক বেশি। আবার বাইরে থাকার খরচাও অনেক। ক্যানিং-বারুইপুর এলাকায় কাজের খোঁজ সে-ও কিছু জানে। প্লাস্টিকের গো-ডাউন, বড় কোম্পানির ছাপ মারা সাবান-শ্যাম্পু-ক্রিমের দুনম্বরি কারখানা, আয়লার পর থেকে এসবে তো গোসাবা-মোল্লাখালির কত লোকই খাটতে চলে গেছে।

ফুল্লরা আবারও ফোন করে একদিন। সন্ধের দিকের ফোনে বৈকুণ্ঠ দক্ষিণের জল-বাতাসের গন্ধ পায়। কুড়ি-একুশ বছর বয়সের ফুল্লরা নিচু গলার স্বর, থেমে বলা কথা, বৈকুণ্ঠ বিয়ের তিনদিনের মাথায় রাতে দেখা শরীরটাও দেখতে পায়। শরীরের নিচু ঢালে ম্যানগ্রোভ। ফুল্লরা বলে, সামনের মাস থেকে ওরা কাজে ঢুকতে বলছে। কী বলব?

বৈকুণ্ঠ উশখুশ করে। বলে, এইদিকে শুনছি কী একটা অসুখ এসেছে। একজন থেকে আর একজনে ছড়াচ্ছে। কিছুদিনের জন্য কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাড়ি এলে ভাবছি তার আগেই আসব। তবে দু হপ্তার টাকা হাতে পাওয়া বাকি।

ফুল্লরার নিচু গলায় সামান্য ব্যস্তভাব। সে বলে, টাকার কথা ভাবা যাবে পরে। অসুখের কথা আমরাও কি‌‌ন্তু শুনছি।

টাকা পাওয়ার আগেই অবশ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কোম্পানি। কোথাও চার-পাঁচতলা পর্যন্ত গেঁথে তোলা পিলার, কোথাও অর্ধেক প্লাস্টার হওয়া দেওয়াল, এভাবেই দিন দুয়েক পর হঠাৎই একদিন বিকেলে সবাইকে কাজে না বলে দেওয়া হয়। চারপাশে ছড়িয়ে থাকে লোহা পাথর, বালির আধ-খোলা বস্তা। শহর থেকে বাতি লাগানো গাড়িতে পুলিশ এসে জানায় কোম্পানির বানিয়ে দেওয়া শেডের ভেতরেই আপাতত থাকতে হবে সবাইকে।

ঝাড়খণ্ড থেকে লেবারদের ম্যানেজারি করতে এসেছিল বয়স্ক সবোরিলাল। তাকে হতাশ দেখায়। সে বলে, মেরা ভি পয়সা লেনা বাকি হ্যাঁয়। পুরা দেশ মে বুখার। কেয়া করনা হোগা সমঝ না আয়ে।

সারা দেশ একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছিল আশ্চর্য অসুখে। মানুষে মানুষে সামান্য ছোঁয়াছুঁয়িতেও ভাইরাস। ভোররাতে লিক হওয়া কারখানার গ্যাস যেভাবে কুয়াশার মতো ছড়ায় সেভাবে ঢেকে যাচ্ছে সারা দেশ।

কুমিরমারিতে অপেক্ষায় থাকা ফুল্লরা বলে, সবই শুনছি। তবে আমাদের এখানে এখনও সে রোগ আসেনি। গাঁয়ের সবাই বলছে তুমি চলে আসো।

অন্ধকারে বৈকুণ্ঠ ফোন ধরে চুপ করে থাকে। রাতে সবাই ঘুমোলে ফুল্লরার ফোনেও শরীর সাড়া দিত তার। যেন ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে কথা। কিন্তু এদিন সে অনেকটা নিরুত্তাপ। যেন হঠাৎ জল সরে যাওয়ায় নৌকো আটকা পড়েছে পাড়ের কাদায়। বৈকুণ্ঠ সেই নৌকোর মাঝি। ফুল্লরা ফিসফিস করে বলে, এই বুধবারের পরের বুধবার বনবিবির থানের পাশে ভাইরাস ঠাকুরের পুজো। সজনেখালির বড় গুণিন আসছে দুইজন। তারা দক্ষিণের চারপাশ বেঁধে দিয়ে যাবে। পারলে তার আগে এসো।

বৈকুণ্ঠ শোনে। নির্লিপ্ত স্বরে বলে, দেখছি।

ফুল্লরার স্বরে উৎসাহ। বৈকুণ্ঠর মুঠোর মধ্যে সে গাঢ় গলায় বলে, রোগের থেকেও এখানে সবাই এখন পুজো নিয়ে বেশি বলাবলি করছে। তুমি যেভাবে হোক বুধবারের মধ্যে এসে পৌঁছোও।

বৈকুণ্ঠ বলে, কিন্তু দক্ষিণদেশের মানুষ কি জানে কাল সকাল থেকে ট্রেন বাস সব অচল?

ফুল্লরা হঠাৎই দমে যায়। খানিক থেমে বলে, ওইদিকে কোনও নদীর পথ নেই!

নৌকোর গায়ে জোয়ারের জল লাগার মতো সামান্য যেন শব্দ হয় বৈকুণ্ঠর মুঠোয়। ফুল্লরা বলে চলে, তা হলে পায়ে হেঁটে এসো। কতদিন লাগবে ওখান থেকে আমাদের এই কুমিরমারি গোসাবা?

কোম্পানির শেডের গুমোট ঘরে বৈকুণ্ঠদের দিন আর রাত কাটে। হাতের সামান্য জমা টাকায় টানাটানি। লক-ডাউন শুরু হয়, শেষ কবে কেউ জানে না। তিনদিনের দিন বৈকুণ্ঠরা জানতে পারে ঝাড়খণ্ড বিহারে যাদের ঘর তারা পথে নেমে পড়েছে। দল বেঁধে চলেছে জিটি রোডের দিকে। সেখান থেকে দেশের দিকে হাঁটবে।

ম্যানেজার সবোরিলাল সাসারামের লোক। এতদিন কাজের জায়গায় ধমকধামক করে গেছে। কিন্তু অচল দেশে তারও এক হাল। বৈকুণ্ঠকে সে বলে, দেরি করনে মে ফায়দা কেয়া। চলকে হি যানা হোগা। এক হি রাস্তা সাসারাম আউর কলকাত্তা পৌঁছতা হ্যাঁয়।

ফুল্লরা মুঠোর মধ্যে বলে, এ ছাড়া আর তোমাদের উপায় কী! এখন যেভাবে হোক দেশে ফেরো।

ক মাস ছাড়াছাড়া বৈকুণ্ঠ এতদিন সামান্য টাকা পাঠাত ঘরে। তাতে আর সামান্য চাষে বাপ-মায়ের সংসার টিকে ছিল। এখন সেই সংসারেই ফুল্লরা। বৈকুণ্ঠ বলে, বাবা মাকে বলেছ যে আমি ফিরে আসতে পারি।

ফোনের ওপাশ বলে, তেনারা সব জানেন। তাদেরও চলে আসায় মত। বাবাও বলছেন গাড়ি না পেলে হেঁটে রওনা দিক।

সবোরিলাল ও মুর্শিদাবাদ-মালদার কজনের সঙ্গে পথে নেমে পড়া। তবে প্রথম দিন হেঁটেই বৈকুণ্ঠ বোঝে শূন্যে ঝুলন্ত ঝুঁকির ভেতর ঢুকে পড়েছে তারা। পেছনে তাকানোর সুযোগ নেই। হয় ঘর, নয় তো পথে ক্ষয়। খাবার কম, জল আরও কম। দিনে প্রায় চোদ্দ-পনেরো ঘন্টা হাঁটা। যে পারছে না সে বসে যাচ্ছে কোথাও। কারও জন্য কেউ থামবে না।

তিনদিনের মাথায় সবোরিলাল লোকটা পিছোতে পিছোতে হারিয়ে গেল কোথায়।

প্রথম দিন রাতে বৈকুণ্ঠর যা একটু কথা হতে পেরেছিল বাড়ির সঙ্গে। তখনই মোবাইলের চার্জ প্রায় শেষ। ওরা তখন ফাঁকা এক দিগর বরাবর জিটি রোডে হাঁটছে। ফুল্লরা ফোনে বলেছিল, গত ক-দিন ধরে সুন্দরবন এলাকার সব বড় গাঙের জল হালকা নীল। গা জুড়ানো ঠান্ডা সেই জলে। এইদিকে যাদের অনেক বয়স তারা বলছে বাদাবনের দেশ না কি অনেক কাল আগে এমনটাই ছিল।

চার্জ ফুরিয়ে মোবাইল চুপ। ফুল্লরা আর নীলচে সুন্দরবন চুপ করে যায়। জেগে থাকে অন্ধকারে অজস্র পা চলার শব্দ। যারা হাঁটছে তাদের ভেতরে অল্প কথা, তারপর সে কথাও যেন শেষ হয়। বৈকুণ্ঠ তখন বোঝে নানারকম কাপড়ের ঢাকনা উড়ে আসছে বাতাসে। বসে যাচ্ছে নাক আর মুখের আধখানায়। কালো সাদা আর গাঢ় রঙের মুখোশে একইরকম দেখতে হয়ে যাচ্ছে সারা দেশ। একরকম পথ আর পথের দুপাশ। তেমন এক মুখোশ বৈকুণ্ঠরও মুখে এসে বসে যায়।

পথের পাশে রাতে শুয়ে ঘুম আসতে চায় না। তখনও কেউ না কেউ হাঁটে। অন্ধকারে মেয়েলি গলা বাচ্চার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সামনে মিলিয়ে যায়। ফুল্লরার বলা একটা দুটো কথা মনে আসে। ফুল্লরা বলেছিল গ্রামের ভেতরেই না কি পুজোর জন্য ভাইরাস ঠাকুরের মূর্তি গড়া চলছে। গোসাপের পিঠে বসা ভাইরাস ঠাকুর। পায়ে ছোট জুতো, হাতে-বুকে লাল রোঁয়া। ফুল্লরা আরও বলেছে ভাইরাস ঠাকুরের মুখের আধাআধিও না কি চৌকো কাপড়ে ঢাকা।

বৈকুণ্ঠ জানত বাতাসে-বাতাসে হলেও তার ফেরার খবর পৌঁছেছে। কুমিরমারির অনেকে তার অপেক্ষায়। সে ভাবে, যখন গাঁয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছবে ফুল্লরার মুখটিও তখন মাস্ক-কাপড়ে আধাআধি আড়াল থাকবে না তো!

এত পথ হাঁটার পর যে সন্ধেয় তাকে নিয়ে ঝড়খালি থেকে একলা ডিঙিখানা এল, সেই শেষ বিকেলে সে চিনতে পারল না তার চেনা জেটিঘাট। জন্ম থেকে দেখা ঘাট যেন আর কোনও দেশ।

যাদের সে দেখতে দেখতে এসেছে তাদেরই অনেক মুখ যেন ঘাট আড়াল করে দাঁড়ানো। কাকা দাদা খুড়ো, সবার মুখ এক, কালো মাস্ক-এ ঢাকা। কারও খালি গা, কারও সাদা ফতুয়া। মুখ-ঢাকা এতজন তাকে ঘরে তোলার জন্য এসেছে!

নৌকোঘাটের কাছে আসতে কথা বলে একজন। চেনা গলা, কিন্তু যেন অচেনা ও ভারি। পাড়ের ওপর থেকে বলে ওঠে, ভাইরাসের দেশ থেকে এদিকে আসা চলবে না কো।

কোনও খুড়োর গলা না? না কি গ্রামসম্পর্কের মামা! বৈকুণ্ঠ মুখ তুলে এদিক ওদিক চায়। তখন মাস্কের আড়ালে আর কেউ। বলে, যেখান থেকে আসা সেখানেই ফেরা ভাল। বাইরের মানুষ আমরা নেব না।

বাবার গলা না? শোনার ভুল না তো! গলা কি একটু কাঁপল! বৈকুণ্ঠ ধীর স্বরে এবার বলে, আমি ছদিন ধরে হেঁটেছি। হাতে পায়ে আর বল নেই। যেখানে কাজ করতাম ভাইরাস আসার আগে সে কোম্পানি বন্ধ। খিদে পেলেও পথে আমি কারও খাবার ছুঁইনি।

উল্টোদিকে এবার বাবার-ই গলা। কেঁপে কেঁপে বলে, আমাদেরও তো বাঁচতে হবে বাপ…

সে কথার প্রতিধ্বনি সন্ধের ঘাট জুড়ে। নদীতে নদীতে কথা ছড়ায়। দূরের ঘাট থেকেও আবছা এক স্বর।

আমাদেরও বাঁচতে হবে বাপ। বৈকুণ্ঠ কিছু বলতে যায়, কিন্তু তার গলা বুজে আসে। তার ডিঙি নৌকোখানা অন্ধকারে এলোমেলো ভেসে বেড়ায়।

নদীর ওপর গুমোট বাতাস। পাহারাদাররা আঁধারে মিশে যায়। খানিক দূর দিয়ে ভটভটি গেলে বৈকুণ্ঠ চলমান মানুষের গলা শুনতে পায়। ফুল্লরা একদিন বলেছিল, বাদাবনের গাছ ঘন সবুজ হয়ে গেছে। গাঙের জল নীলচে। ফুল্লরা আরও বলেছে, ভাইরাস ঠাকুরের পুজোর জন্য মানত করছে অনেকে। বৈকুণ্ঠ ভাবে, সবার মনের ভিতর পুজোর আগেই কি ভাইরাস ছড়িয়ে গেল? চেনা মানুষকে অচেনা করে দেওয়ার ভাইরাস!

নদীতে নেমে স্নান করে সে। ঠান্ডা হয়ে আসা নদীর জল। পথের ধুলো ধুয়ে শরীর জুড়ায়। সঙ্গের বাঁধা পোঁটলা খুলে অন্য জামা-কাপড় পরে নেয়। মনে মনে একবার ফুল্লরার সঙ্গে দেখা করার কথাও ভাবে।

মাঝরাতে বেড়ার গায়ে টোকা পড়ে দু বার। ফুল্লরার ঘুম ভাঙে। পাশের ঘরে বাবা আর মা। রাতের দু-একটি পাখি অন্ধকারে ওড়ে। দরজা খুলে দাঁড়ায় ফুল্লরা। আবছা আলোয় বৈকুণ্ঠ দেখে ফুল্লরার মুখের অর্ধেকখানিতে মাস্ক। মাস্কের ওপর ভেসে থাকা সেই দুই চোখ। ফুল্লরা ফিসফিস করে বলে, মুখখানা ঢাকবে না?

বৈকুণ্ঠ দ্বিধায়। ফুল্লরার মন বোঝে না। বলে, ঘরে আসব না বাইরে যাব কোথাও?

ফুল্লরা ভাবে একটু। তারপর বলে, যেতে হয় তো বনবিবির থান। তবে আমাকে ফিরে আসতে হবে।

অন্ধকারে বেরোয় দুজন। হাঁটতে হাঁটতে অল্প কথা হয়। বৈকুণ্ঠ বলে শহর গ্রাম মাঠের পাশ দিয়ে ছ দিনের পথ। একের পর এক পথে হারিয়ে যাওয়া সঙ্গীরা। সবোরিলাল নামে একজন কোনওদিন আর ঘরে পৌঁছতে পারেনি। ফুল্লরা চুপ হয়ে শোনে। আশপাশের ঝোপঝাড়ে খসখস শব্দ হয়।

বনবিবির থানে নদীর ধারে তারা বসে। চম্পাহাটিতে কবে যাওয়া যাবে তার ঠিক নেই। বেরিলির কাজেও আর ফেরা হবে কি না সন্দেহ। আর এ সব কথার মাঝে বৈকুণ্ঠ আলগোছে হাত রাখে ফুল্লরার গায়ে। ফুল্লরা কিছু বলে না।

অনেকদিন পর দেখা। যদিও এ দেখা থাকবে কি না তার ঠিক নেই। বৈকুণ্ঠ ফুল্লরার বুকের ওপর থেকে শাড়ির আঁচল একটুখানি সরায়। ফুল্লরা মাস্কের ওপর থেকে গাঢ় চোখে চেয়ে থাকে। বলে, চম্পাহাটির ঘরখানা কি লক-ডাউন ওঠা পর্যন্ত থাকবে!

অচিরে কথা থাকে না যদিও। দুই দেহের পোশাকও একটু একটু করে সরে যায়। রাতের আকাশের নিচে খোলা গা। সেই দুই গায়ে পাড়ের কাদামাটি মেখে যেতে থাকে। নালিঘাসের টুকরো জড়ায়। তবে পোশাকহীন দেহেও জেগে থাকে দুটি মাস্ক। আধাআধি ঢেকে রাখা দুই মুখ।

একদা লুকানো ম্যানগ্রোভের সন্ধান পেয়েও বৈকুণ্ঠকে কাজে চলে যেতে হয়েছিল। মোবাইলের ভেতর থেকে তার মনে ভিন-দেশে কখনও উঁকি দিয়েছে সেই ডাক। বৈকুণ্ঠ এই রাতে অল্প চেনা সেই ঢালু ম্যানগ্রোভের হদিশ পায়। তার মনে জোয়ারের শব্দ। নিজস্ব পানসিখানা একটু একটু করে সে বাইতে শুরু করে দেয়। ফুল্লরা তাকে নিয়ে যায় আড়ালে থাকা জলাভূমির ভেতর থেকে ভেতরে।

পরদিন সকালে অবশ্য গ্রামে কোনও হদিশ থাকে না তাদের। ছোট্ট ডিঙি নৌকোয় তারা অনন্ত কোয়ারেন্টাইনে ভেসে যায়।