Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রাষ্ট্র বনাম জনতা

নন্দন রায়

 



প্রাক্তন প্রশাসক, প্রাবন্ধিক, লিটল ম্যাগের সঙ্গে যুক্ত

 

 

 

বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ‘শাস্তি’ কেন পেলেন? যেটুকু অনিয়ম হয়েছে তার জন্য একটা সতর্কীকরণই কি যথেষ্ট ছিল না? বিচারালয়ের গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের দিকে তাকিয়ে?

 

সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস থেকে স্কুলের চাকরিতে নিয়োগ সংক্রান্ত দুটি মামলা অন্য বিচারপতির এজলাসে স্থানান্তরিত হয়েছে এই খবরটা পুরনো হয়ে গিয়েছে। টাকার বিনিময়ে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি দেওয়া নিয়ে যে অজস্র মামলা হয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি মামলার অন্যতম ধুরন্ধর অভিযুক্ত কুন্তল ঘোষ অভিযোগ করেছিল তদন্তকারী সংস্থা এই কেলেঙ্কারীর মূল মাথা হিসাবে বঙ্গের যুবরাজের নাম বলার জন্য তার ওপরে নাকি চাপ সৃষ্টি করেছিল। এই অভিযোগ করার ঠিক আগেই স্বয়ং যুবরাজ এক জনসভায় হুবহু এমনই অভিযোগ করেছিলেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যা্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ হল তিনি তার নির্দেশনামায় কুন্তলের সঙ্গে প্রয়োজন হলে যুবরাজকে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। চাকরি বিক্রি করার থেকেও বিচারপতির ‘অপরাধ’ আরও বেশি এই কারণে যে এই নির্দেশ দেওয়ার বেশ কিছুদিন আগে একটি সংবাদ চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকার দিয়ে তিনি নিয়োগ সংক্রান্ত মামলার বিষয়ে নানা কথা বলার পাশাপাশি ‘যত বড় মাপের নেতাই হোক অপরাধ করলে কাউকেই ছাড়া হবে না’ বলে হুমকি নাকি দিয়েছিলেন। মামলা চলাকালীন ওই বিষয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়াটা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী, নাকি অন্য কোনও কারণে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাত দিনের ফাঁসি ও একদিনের জেল’-এর সাজা হল সেটা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়।

নিয়োগ কেলেঙ্কারির ঘটনা যত বেশি বে-আব্রু হয়েছে তত বেশি জনমনে তা আলোড়ন তুলেছে। মোদি-দিদির রাজত্বে দুর্নীতি ও প্রশাসনিক কেলেঙ্কারির ঘটনা বড় কম ঘটেনি। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে সারা দেশ, বিশেষত দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর ভারত যখন উত্তাল, সেদিন এ বঙ্গদেশ জাগেনি স্বপনে। তারপরে মাত্র এক ঘন্টার নোটিসে দেশ জুড়ে যখন লকডাউন ঘোষিত হল, তখনও তেভাগার আন্দোলনে সমৃদ্ধ বঙ্গদেশ, জোতদারের সিলিং বহির্ভূত জমি দখলে রক্তাক্ত বঙ্গদেশ উদাসীন থেকেছে। সারদা-নারদ কেলেঙ্কারির সময়ে একের পর এক নেতার জেলে যাওয়া এবং শতাধিক আত্মহননের ঘটনা ঘটার সময়েও মধ্যবিত্ত বাঙালির তেমন চিত্তচাঞ্চল্য ঘটেনি। মধ্যবিত্ত রাজনীতিই যেহেতু বাংলাকে চিরদিন চালিত করেছে, তাই নকশালপন্থী আন্দোলন যতটা বাংলার রাজনীতিকে ঝাঁকুনি দিতে পেরেছিল, বৎসরাধিক কাল ব্যাপী দিল্লি ঘেরাও করে থাকা স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বড় কৃষকদের গণআন্দোলন, লকডাউনের জেরে লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবীর দুর্দশাক্লিষ্ট হাজার মাইল পথ হেঁটে নিজের গ্রামে ফেরার বিপন্নতা, কোনও কিছুই বাংলার রাজনীতিকে নাড়া দিতে পারেনি। দিদির দাক্ষিণ্যপ্রার্থী হয়ে ভোটের ডালি উজাড় করে দিয়েছে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েতে যখন দিদি বাংলাকে বিরোধীশূন্য শ্মশানে পরিণত করার মতলব করেছিলেন, তখন মাত্র একবারই লোকসভা ভোটে দিদির প্রতি বাঙালির ক্রোধ মোদির পায়ে অঞ্জলি হয়ে ঝরে পড়েছিল।

এসবের পেছনে একটা কারণ যদি হয় খেটেখাওয়া শ্রেণিগুলির প্রতি মধ্যবিত্তের উন্নাসিকতা, দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে বাংলার শক্তিশালী ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সাফল্য সম্ভব হয়েছিল রাম-বামের তৃণমূলবিরোধী ঐকতানে। কিন্তু স্কুলশিক্ষকের চাকরি বিক্রির ঘটনায় সরাসরি আঘাত এসেছে শহুরে ও গ্রামীণ মধ্যবিত্তের সংসারে। ফলে দিদির বিরুদ্ধে শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত একযোগে ক্ষেপে উঠেছে।

 

দুই.

ভাবতে আশ্চর্য লাগে ৩৪ বছরের বামশাসন বুর্জোয়াব্যবস্থার সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে বুর্জোয়া মতাদর্শে চালিত আমলা ও পুলিশি বাতাবরণের মধ্যে থেকে একটি ন্যায়পরায়ণ সরকার চালানোর চেষ্টায় কেবল সময় অতিবাহিত করেছে। বামপন্থীরা একদিকে এর সীমাবদ্ধতার বিষয়ে যেমন নিরন্তরভাবে মানুষকে সচেতন করেননি, অন্যদিকে প্রশাসনিক বাধ্যবাধকতার প্রতি বেশি নজর দিতে গিয়ে জনতার থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন। অথচ আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যের মূল শিক্ষাই হল শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের সঙ্গে সোচ্চার-কণ্ঠ মধ্যবিত্তের স্বার্থের মেলবন্ধন। অর্থাৎ বামপন্থীদের লক্ষ্য হল মুষ্টিমেয় নিপীড়কদের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী জনতা এবং মধ্যবিত্তদের ঐক্য সাধন করা। শাসকশ্রেণিগুলির সঙ্গে শ্রমজীবী শ্রেণিগুলির বৈরিতার সম্পর্ক নিয়ে সকলেই একমত। এই দুই যুযুধান পক্ষের মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকা মধ্যবিত্তদের দোলাচলতা নিয়ে যত গোলমালই থাকুক না কেন, এদের বেশিরভাগকে নিজেদের পক্ষে টেনে নিতেই হবে। ‘দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে’। এখানেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়দের মত মানুষদের ভূমিকা।

প্রথমত, ‘বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান’, ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’, এবং ‘বুর্জোয়া অধিকার’ রক্ষা করার বিষয়টি একটি অন্তর্বর্তীকালীন ন্যায়সঙ্গত ও কল্যাণকামী সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং শেষ বিচারে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের সঙ্গে দ্বান্দ্বিকভাবে সম্পর্কিত কারণ এই বুর্জোয়া ধারণাগুলিকে রক্ষা করার অর্থই হচ্ছে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা। দ্বিতীয়ত, ‘বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান’, ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ এবং ‘বুর্জোয়া অধিকার’ রক্ষা করা প্রকৃত প্রস্তাবে শ্রেণিসংগ্রামেরই অংশ। ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ অর্জন করার মধ্যে দিয়ে শ্রেণিসংগ্রামে অগ্রসর হওয়া সূচিত করে। বুর্জোয়া বিচারব্যবস্থা বুর্জোয়া গণতন্ত্রেরই অঙ্গ। উভয়ই উভয়কে প্রভাবিত করে। তাই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এবং অন্যান্য বিচারপতিরা নিয়োগ কেলেঙ্কারির অভিযুক্তদের প্রতি অনড় মনোভাব দেখাচ্ছেন বলেই গণতন্ত্রের পরিসর প্রসারিত হচ্ছে, যে গণতন্ত্রের দিদির কর্মকুশলতায় গঙ্গাযাত্রার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে এখানেও মনে রাখতে হবে যে সামগ্রিক বুর্জোয়া মতাদর্শের ব্যবস্থার মধ্যে সরকার চালনার কাজে যে ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করার কথা একটু আগেই আমরা আলোচনা করেছি, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হওয়া চলবে না। একাদিক্রমে ৩৪ বছর শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও যখন বামপন্থীরা মমতাময়ী প্রতিবিপ্লবের কাছে পরাজিত হয়ে এখন অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রামে যুঝছেন, তারা নিশ্চয়ই সেই সতর্কতা শিথিল হতে দেবেন না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে— once bitten twice shy।

আরও একটি বিষয়ও সকলেই লক্ষ করেছেন। যে বিচারব্যবস্থা তার দীর্ঘসূত্রিতার লজ্জাজনক ঐতিহ্যের জন্য জনমানসে বৈধতা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিল, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ও তার সহযোগীদের তৎপরতা এবং সময় বেঁধে তদন্তের গতিশীলতা মোটামুটি বজায় রাখতে উদ্যোগী হওয়ার দরুণ সেই আস্থা আবার ফিরে আসছে। শুধু তাই নয়, আবাস যোজনার দলবাজি, রেগার কাজের দুর্নীতি সহ পঞ্চায়েতের হাজারো দুর্নীতি, সরকারের সঙ্গে জনসাধারণের সংযোগের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পয়সা খাওয়ার সম্ভব-অসম্ভব নানা ফিকির নিয়ে কেবল ভুক্তভোগীরাই নয়, সাধারণ মানুষের এতদিনের ক্ষোভের অর্গল যেন খুলে গিয়েছে— দিকে দিকে রব উঠেছে ‘চোর চোর’। এসবই গণতন্ত্রের প্রসারণের ফলে সম্ভব হয়েছে। ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’। এসব ঘটার ক্ষেত্রে বিচারপতিদের ‘নো ননসেন্স’ নতুন ধরনের বিচারের ভূমিকাকে কি অস্বীকার করা যায়?

 

তিন.

প্রবন্ধের গোড়ায় যে প্রশ্নটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সে প্রশ্নটার উত্তর কিন্তু এখনও মেলেনি— বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তবে ‘শাস্তি’ কেন পেলেন? যেটুকু অনিয়ম হয়েছে তার জন্য একটা সতর্কীকরণই কি যথেষ্ট ছিল না? বিচারালয়ের গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের দিকে তাকিয়ে?

এখানেই যাকে বলে ‘ডিপ স্টেট’ (deep state)-এর ভূমিকা। রাষ্ট্র বলতে আমরা চোখের সামনে যেটা প্রত্যক্ষ করি তার পেছনে লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছে রাষ্ট্রের আসল চালকদের ভূমিকা। সেটা কোনও সংগঠিত গোষ্ঠী নয়, একটি মতাদর্শ— বুর্জোয়া মতাদর্শ। যে মতাদর্শ অনুযায়ী সরকারের থিঙ্কট্যাঙ্ক— উচ্চতম পদে আসীন আমলারা, বিচারব্যবস্থার কোর গ্রুপ, সশস্ত্র বাহিনির নীতিনির্ধারকরা, যারা নিজেদের বিশ্বাস (conviction) থেকে কখনও এককভাবে, কখনও বা যৌথভাবে ব্যবস্থাটি টিকিয়ে রাখার জন্য নির্ধারিত পদক্ষেপ করে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস থেকে মামলা সরিয়ে দেওয়া শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বিচারপতিকে সবক শেখানো নয়, সবাইকে এই চেতাবনি দেওয়া যে ‘দিজ ফার অ্যান্ড নো ফারদার’; এমন কাজ কোরো না যাতে ব্যাবস্থাটিই বিপন্ন হয়ে পড়ে।

১৯১৪ সালে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত এঙ্গেলস-এর Principles of Communism পুস্তিকাটির ইংরেজি সংস্করণের ‘পরিশিষ্ট’ অংশ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে নিবন্ধটির উপসংহার টানা যাক।

শিক্ষার প্রসার, সংবাদপত্রের জনপ্রিয়তা এবং চার্চকে নিজেদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলার কাজ সম্পন্ন করে পুঁজিবাদ অবশেষে জনসাধারণকে ভোট দানের অধিকার দিয়েছে। নির্বাচকদের নিয়ন্ত্রণহীন মেজাজের দরুণ শাসক গোষ্ঠীগুলির হিসাবনিকাশে যখনই কোনও হস্তক্ষেপ ঘটে, তখনই এই গোষ্ঠী ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলে নেয়। [ভোটের মাধ্যমে] হঠাৎ রাজনৈতিক পরিবর্তনের মত অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যাওয়ার প্রতিষেধক হিসেবে checks and balances-এর ব্যবস্থা প্রবর্তিত হল। এবং কোনও সিরিয়াস রাজনৈতিক বিদ্রোহ ঘটে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবসময়ই লেলিয়ে দেওয়া যায় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা পুলিশ এবং সামরিক বাহিনিকে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে ভোটদানের অধিকার সীমায়িত করে রাখার মধ্য দিয়ে নয়, তাদের অনিয়ন্ত্রিত এবং নিঃশর্ত রাজনৈতিক প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্য বুর্জোয়াশ্রেণির তুণীরে আরও অনেক অস্ত্র মজুত রয়েছে।

 


*মতামত লেখকের নিজস্ব। এর জন্য সম্পাদকমণ্ডলী দায়ী নয়