চার্বাক মিত্র
রাজনৈতিক ভাষ্যকার
১৮০টি দেশের মধ্যে মিডিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারত ১৬১তম অবস্থানে। ভেবে দেখতে হবে, ভারতের এই অবস্থার প্রেক্ষাপট কীভাবে নির্মাণ করা হল
তখন জনমেজয় কহিলেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ে এক্ষণে সমুদয় বলুন মহোদয়। অমাত্যগণ শুনিতে উৎসুক।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, দ্বিজোত্তম, ভারতে এই বিষয়ে এক বিষম বিপদ উপস্থিত হইয়াছে। সম্প্রতি আরএসএফ, এস নয়, স্মরণ করিবেন, এফ, অর্থাৎ ‘রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস’ নামক একটি বৈশ্বিক নজরদার সংস্থা, যাহারা কিনা মিডিয়ার উপর যাবতীয় অত্যাচারের খতিয়ান দাখিল করিয়া থাকে, তাহারা জানাইয়াছেন, ১৮০টি দেশের মধ্যে মিডিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারত দাঁড়াইয়া রহিয়াছে ১৬১তম অবস্থানে।
জনমেজয়ের অমাত্যগণ ব্যস্তসমস্ত হইয়া কহিলেন, সে কী! পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে নিশ্চয়ই?
বৈশম্পায়ন চুক চুক ধ্বনিতে খেদ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, নাহ্! পাকিস্তান ১৫০তম স্থানের আশপাশে রহিয়াছে। এমনকি, আফগানিস্তানের অবস্থানও এর চাইতে উন্নত।
সকলেই মুষড়াইয়া পড়িল।
গাছের উপর হইতে কা কা ধ্বনি ও স্লেট বাজানোর তীব্র শব্দ পাইয়া সকলেই মুখ তুলিয়া চাহিলেন। কাকেশ্বর তাহার মুণ্ডু বাড়াইয়া বলিল, হিসেব পরিষ্কার। নর্থ কোরিয়া একশো আশিতে, অর্থাৎ ডাহা ফেল। চিন প্রায় লাস্ট, একশো আটাত্তর। এমনকী, ভিয়েতনাম, বাপের নাম ভুলে বামপন্থীরা যাকে স্মরণ করবে বলেছিল, তারাও একশো সত্তরের পর। ভারত একশো একষট্টি। সুতরাং, চিন, ভিয়েতনাম, নর্থ কোরিয়া আর ভারতের মধ্যে ভারত ফার্স্ট।
একজন অমাত্য হাত তুলিয়া বলিলেন, কমিউনিস্ট স্টেটের কথা এখানে থাক। উহাদের কোনও সংবাদই সঠিকভাবে প্রথম বিশ্বে আসে নাই। আর এই যাহারা প্রতিবেদনটি দিয়াছে, তাহারাও নিশ্চিতরূপে প্রথম বিশ্বের, এর মধ্যে দীর্ঘকালীন সমাজতন্ত্রবিরোধী চক্রান্ত রহিয়াছে।
বৈশম্পায়ন বলিলেন, ভারতের সরকারও এইরূপ একটি কথা বলিয়াছে।
কী বলিয়াছে? জানিতে চাহিলেন জনমেজয়।
ভারত সরকারের তথ্য দফতরের পক্ষ হইতে বলা হইয়াছে, এই পরিসংখ্যান বেঠিক। উত্তর করলেন বৈশম্পায়ন।
একজন অমাত্য সজোরে হাসিয়া কহিল, ভারত সরকারের নিজস্ব সংবাদসংস্থা এখন আর পিটিআই নহে, আরএসএস-পুষ্ট সংবাদমাধ্যম, একথা সম্পর্কে আপনারা অবহিত আছেন নিশ্চয়ই, সেই সরকারি বয়ান কি ধোপে টিকিবে?
বৈশম্পায়ন বলিলেন, রানা আইয়ুব কী বলিয়াছেন, এক্ষণে সেকথা আপনাদিগকে জানাই। ইউনেস্কো-র সম্মেলনে তিনি বলিয়াছেন, ভারতে মহিলা সাংবাদিকদের দুরবস্থা ক্রমবর্ধমান। তাহাদের ধর্ষণের ত্রাসে রাখিয়াছে গেরুয়াবাহিনি। মাথায় রাখিবার বিষয়, রানা আইয়ুবের ‘গুজরাত ফাইলস’ ইদানীন্তন সরকারের নিকট স্বস্তিদায়ক নহে, তাহার উপর বিবিসি ওই মর্মেই তথ্যচিত্র বানাইয়া গৈরিক সরকারের পশ্চাদ্দেশে বংশদণ্ড দিবার প্রচেষ্টা করিয়াছিল। অতএব ইহা হইতে কী সিদ্ধান্ত আহরণ করা সম্ভবপর হইবে?
এরপর অমাত্যগণ কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা পরবর্তী বিষয়। কিন্তু ভেবে দেখতে হবে, ভারতের এই অবস্থার প্রেক্ষাপট কীভাবে নির্মাণ করা হল। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে নরেন্দ্র মোদির বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন করণ থাপার। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, ভারতের রাজনীতিতে সম্ভাবনাময় নরেন্দ্র মোদির ঘাম ঝরিয়ে, তাকে দিয়ে জল খাইয়ে যে করণ থাপার সেদিন জাতীয় সাংবাদিকতার প্রতিস্পর্ধী নায়ক হয়েছিলেন— তিনি মোদি আমলে কী করলেন? তিনি এবং আরেক অসমসাহসী বিজেপি-বিরোধী সাংবাদিক বরখা দত্ত মিলে ‘তিরঙ্গা টিভি’ নামে একটি চ্যানেল খুললেন। সেই চ্যানেলে কাজের জন্য অর্ণব-বহুল মিডিয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা সাংবাদিকরা এগিয়ে এলেন। তারপর সেই চ্যানেল গেল উঠে। এখন সত্যপাল মালিকের সাক্ষাৎকার তিনি নিলেও তা নিয়ে তথাকথিত গোদি মিডিয়া জেনেশুনেই তেমন শোরগোল করবে না। কারণ সাংবাদিকতার মূল শর্তের প্রশ্নে করণ থাপার গুরুত্ব হারিয়েছেন। এনডিটিভি নিয়ে অকারণ দেয়ালা না করলে, প্রণয় রায়-রাধিকা রায়ের হাতছাড়া হয়ে তা কি আদানির হস্তগত হত? এখন এই প্রশ্ন উঠে আসছে। ক্যারাভানের মতো বিপ্লবী মিডিয়া পারিশ্রমিক দেওয়ার ব্যাপারে হাত কচলাতে থাকে। বলে, সত্যই তোমার পারিশ্রমিক।
এবার এর উল্টোদিকে কী? যাঁরা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে শিখে গেছেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদির কর্মসংস্কৃতির প্রশংসায় মুখর হয়েছেন, তাঁরা অনেক নম্বর পেলেন, তাঁদের ডাবল প্রোমোশন হল। অবাধ্য বেড়ালছানার বদলে অর্ণব গোস্বামী, নভিকা কুমার থেকে সুধীর চৌধুরী হয়েছে পোষা বাধ্য সুশীল গাধা। তাঁদের অসভ্যতা অন্যত্র, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী থেকে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীসান্ত্রীদের সামনে এঁরা নিজেদের ডায়াপার খুলে দেখানো অভ্যেস করছেন। করেই চলেছেন। অর্ণব গোস্বামীর সাম্প্রতিক নেওয়া মোদির সাক্ষাৎকার তার প্রমাণ।
এখন এই অবস্থায় প্রেস ফ্রিডম কি কেবলই সোনার পাথরবাটি? তা বললে অত্যুক্তি হবে না। বাঙালি এক বিনোদন সাংবাদিক বিজেপির স্পষ্ট প্রোপাগান্ডা ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ দেখে গদগদ হয়ে লিখেছেন, ইহাই সত্য। এই সত্যকে গ্রহণ করতে হবে, কারণ ইহা সর্বশক্তিমান। হায় রে বাঙালি! হায় রে সত্য! প্রোপাগান্ডা দেখে যে নির্বোধ সাংবাদিক (না কি স্বার্থান্বেষী শয়তান?) মনে করে সত্য, সেই দেশে প্রেস ফ্রিডম?
এই নিয়ে আরও কথা তোলা থাক। কারণ দেশের অবস্থা সহজে পাল্টাচ্ছে না। ফলে এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই লিখে চলা যাবে। পিকচার আভি বাকি হ্যায়।
*মতামত লেখকের নিজস্ব