Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচন: বিজেপি এবং বিরোধী শিবিরের অ্যাসিড টেস্ট

দেবব্রত শ্যামরায়

 



গদ্যকার, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

 

 

সারা দেশ কর্নাটক ভোটের ফলের দিকে তাকিয়ে আছে, কেননা ২০২৪-এ আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনই হল শাসক দল বিজেপি ও বিরোধী শিবির— দুজনেরই অ্যাসিড টেস্ট

 

আজকের, অর্থাৎ ৯ মে ২০২৩-এর রাত পোহালেই কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচন। গতকাল নির্বাচনী প্রচার শেষ হয়েছে। ১০ মে-র ভোটদানের বাক্স খোলা হবে ১৩ মে, সেদিনই জানা যাবে, কর্নাটকের জনতা কাকে আশীর্বাদ করলেন, ২২৪ আসনের বিধানসভায় ১১৩-এর ম্যাজিক সংখ্যা কার হাতে এল, নাকি বিধানসভা ত্রিশঙ্কু হল। সারা দেশ কর্নাটক ভোটের ফলের দিকে তাকিয়ে আছে, কেননা ২০২৪-এ আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনই হল শাসক দল বিজেপি ও বিরোধী শিবির— দুজনেরই অ্যাসিড টেস্ট।

এবারের নির্বাচনী প্রচারে কংগ্রেস আগাগোড়া বিজেপি সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনকে পাখির চোখ করে আক্রমণ চালিয়ে গেছে। বাসবরাজ বোম্মাই সরকারকে সরাসরি ‘৪০% কমিশনের সরকার’ বলে বিদ্রূপ করেছে কংগ্রেস। রাহুল গান্ধির প্রকাশিত বিজেপির দুর্নীতি রেট কার্ড অনুযায়ী গত চার বছরে বোম্মাই সরকার কর্নাটকের জনসাধারণের থেকে ১৫০,০০০ কোটি টাকা লুট করেছে। বোম্মাই সরকারের আমলে রাস্তার কাজে শাসক দল বিজেপির কমিশনের রেট নাকি ৪০ শতাংশ, কোভিডকালে জরুরি পরিষেবা সরবরাহের সময় এই ‘লভ্যাংশ’-এর পরিমাণ সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশে পৌঁছেছিল। আকাশছোঁয়া দুর্নীতি ছাড়াও বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের আক্রমণে আরও দুটি বুনিয়াদি বক্তব্য ছিল, রাজ্যে অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান বেকারিত্ব। এছাড়াও গুজরাতের বিখ্যাত দুধের ব্র্যান্ড আমুল-কে কর্নাটকের বাজারে এনে স্থানীয় ব্র্যান্ড নন্দিনী-কে গ্রাস করার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। শুধু আমুল-ই নয়, কর্নাটকের স্থানীয় লঙ্কার বাজারকেও গুজরাতি লঙ্কা পুষ্পা-কে এনে করায়ত্ত করার চেষ্টা চলছে। স্থানীয় বৈদাগি বাজারে বিগত কয়েক মাসে প্রায় ২০০০০ কুইন্টাল গুজরাতি লঙ্কা বিক্রি হয়েছে বলে অভিযোগ। সব মিলিয়ে কর্নাটকের দুধ-বিক্রেতা ও লঙ্কাচাষিরা, উভয়েই বোম্মাই সরকারের কার্যকলাপে যারপরনাই অসন্তুষ্ট। তাঁদের বক্তব্য— কর্নাটকের স্থানীয় বাজারের নিয়ন্ত্রণের রাশ সুকৌশলে গুজরাতি বেনিয়াদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এ অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। গত কয়েক বছরে এই সমস্ত ইস্যুগুলি নিয়ে কর্নাটকের রাজনীতিতে এতবার আলোড়ন উঠেছে যে এগুলির মোকাবিলা করার মতো তথ্য বা যুক্তি কোনওটাই বিজেপির হাতে নেই। ফলত, রাজ্য বিজেপি ভুলেও নিজেদের নির্বাচনী প্রচারে সেসব মোকাবিলা করার রাস্তাতেও হাঁটেনি।

অথচ বিজেপির রাজ্য নেতারা এই নির্বাচনের আগে ২৩১টি সভা ও ৪৮টি রোড শো করেছেন, অন্যদিকে দলের জাতীয় নেতারা রাজ্যে মোট ২০৬টি সভা করেছেন, ৯০টি রোড শো করেছেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদি স্বয়ং ১৭টি নির্বাচনী সভা ও ৫টি রোড শো করেছেন, সবকটিই প্রচারের শেষ দশদিনের মধ্যে। অতএব মোদিজি-সহ গোটা দল দক্ষিণ ভারতের বিজেপির একমাত্র দুর্গটি রক্ষা করতে কতখানি উদগ্রীব তা বোঝাই যাচ্ছে। তাহলে কী ছিল বিজেপি-র প্রচারের উপজীব্য? প্রথম থেকেই তারা আসন্ন নির্বাচনটিকে বিরোধীদের আনা বুনিয়াদি সমস্যার ময়দান থেকে সরিয়ে হিন্দুত্ববাদ ও মেরুকরণের রাজনীতির অপেক্ষাকৃত সহজ মাঠে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে গেছে, এবং বেশ কিছুটা সফলও হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাঁর প্রচারে এবার ভোটে জিতে আসার পর মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। নিজের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী অপ্রাসঙ্গিকভাবে বারবার সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ চলচ্চিত্রের কথাও তুলে আনছেন। মোদিজির নির্বাচনী প্রচারে আরেকটি ইস্যু তো রীতিমতো অভিনব, যদিও এই অস্ত্রটি কংগ্রেসই বিজেপির হাতে তুলে দিয়েছে বলা যেতে পারে। নিজেদের নির্বাচনী ইস্তেহারে কংগ্রেস এক প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেছে যে ভোটে জিতে এলে তারা বজরং দলকে কর্নাটকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে। প্রসঙ্গত, গত চার বছরে অর্থাৎ বিজেপি জমানায় রাজ্যে খুন, মব লিঞ্চিং, সংখ্যালঘু পীড়ন, কলেজে তাণ্ডব থেকে এমন কোনও অপরাধ নেই, যার সঙ্গে বজরং দলের নাম জড়ায়নি। কিন্তু তার জন্য কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহারে সেই দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কিনা— এই প্রশ্ন উঠছেই। কিন্তু কংগ্রেসের ঘোষণা যদি বা বিতর্কিত হয়, এই ইস্যুতে বিজেপির বিরোধিতার সুরটিও চূড়ান্ত বালখিল্য-সুলভ। মোদিজি তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বলেছেন- বজরং দলকে নিষিদ্ধ করা নাকি স্বয়ং বজরংবলী হনুমানকে কারাগারে আবদ্ধ করার নামান্তর। যে দলের সদস্যই হোন না কেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি এধরনের সস্তা যুক্তি সাজাতে পারেন, তাহলে সে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির হাল যে কত করুণ (পরিস্থিতি অবশ্যই করুণ, কারণ কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খড়্গেও প্রধানমন্ত্রীকে বিষাক্ত সাপ বলে ব্যক্তি-আক্রমণ করেছেন, যদিও তারপর তিনি নিজের মন্তব্য ফিরিয়ে নেন।), তা সহজেই অনুমান করা যায়। যাই হোক, বিজেপির হাতে জনগণের মন জয় করার মতো অস্ত্র যে অতি সীমিত তা তাদের প্রচারের মালমশলাতেই প্রমাণিত।

বিগত কয়েক মাস ধরে আয়োজিত বেশ কয়েকটি ‘ওপিনিয়ন পোল’ কর্নাটকের ভাগ্য নির্ধারণে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করার চেষ্টা করেছে। সেগুলির বেশিরভাগই এবারের নির্বাচনে দুর্নীতিগ্রস্ত বোম্মাই সরকারের বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে এগিয়ে রাখছে। গত নির্বাচনে (২০১৮)-তে বিজেপির আসনসংখ্যা ছিল ১০৪, কংগ্রেসের ৮০, এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়া ও তাঁর পুত্র এইচডি কুমারস্বামীর দল জনতা দল (সেকুলার) পেয়েছিল ৩৭টি আসন। শতাংশের বিচারে প্রাপ্ত ভোট ছিল যথাক্রমে বিজেপি— ৩৬.৩৫ শতাংশ, কংগ্রেস— ৩৮.১৪ শতাংশ এবং জনতা দল (সেকুলার)— ১৮.৩ শতাংশ। এবার নির্বাচনের আগে তুলনামূলক রক্ষণশীল ইন্ডিয়া টিভি-সিএনএক্স আয়োজিত জনমত সমীক্ষাও (এই সমীক্ষার ফলাফল কর্নাটকের বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চল ও আর্থসামাজিক স্তরের ১১২০০ জন নাগরিকের (পুরুষ ৫৬২০ জন, মহিলা ৫৫৮০ জন) মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয় ও মে ৮ তারিখে ইন্ডিয়া টিভির চ্যানেলে ও পোর্টালে একযোগে প্রকাশিত হয়) জানাচ্ছে যে কংগ্রেস ১০৫টি আসন, বিজেপি ৮৫টি আসন, ও জনতা দল (সেকুলার) ৩২টি আসন পেতে পারে। ভোটের শতাংশের হিসেবে কংগ্রেস পাবে ৪০.৩২ শতাংশ ভোট, বিজেপি পাবে ৩৫.৫ শতাংশ ভোট, এবং জেডি(এস)-এর ভাগ্যে জুটবে ১৭.৮১ শতাংশ ভোট। এখানে স্থানীয় দল জনতা দল (সেকুলার)-এর ভূমিকাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। দেখা যাচ্ছে, কুমারস্বামীর দল স্বল্প হলেও নিজেদের একটি নির্দিষ্ট ভোটব্যাঙ্কের সমর্থন ধারাবাহিকভাবে পেয়ে আসছে। এবারের ভোটে তাদের ভোটের শতাংশ সামান্য কমলে তবেও তা কংগ্রেসকে কাঙ্খিত ম্যাজিক নাম্বার ১১৩ বা তার কাছাকাছি পৌঁছে দিতে পারে। অর্থাৎ সহজ কথায়, ভোটের শতাংশের হিসেবে ২০১৮-র তুলনায় কংগ্রেসের পক্ষে জনমতের সামান্য ‘সুইং’-ই কংগ্রেসকে কাঙ্খিত বহুমত এনে দিতে পারে। আর এখন পর্যন্ত প্রায় সবকটি সমীক্ষাই কংগ্রেসের অনুকূলে সুবাতাস বয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করছে। এই সুবাতাস মৃদুমন্দ হাওয়া নাকি গতিময় ঝড়— তা জানার জন্য আমাদের ১৩ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকতে হবে।