Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সত্যপালের ‘সত্যবচন’ এবং কিছু অনিবার্য প্রশ্ন

তিষ্য দাশগুপ্ত

 



ছাত্র, গদ্যকার

 

 

 

সত্যপালের সত্যবচনে বিরোধীদের পালে যারপরনাই হাওয়া লাগবে একথা ভাবা হয়ত সত্যের অপলাপ নয়, কিন্তু রাজনীতির ভোজবাজিতে মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। কংগ্রেস লাগাতার বিজেপি সরকারকে মালিক প্রশ্নে আক্রমণ করে গেলেও বাকি বিরোধীদের খুব একটা গা লাগাতে দেখা যাচ্ছে না

 

“আপনি কি মনে করেন, দেশের স্বার্থে হলেও প্রেসিডেন্টের নীতিবহির্ভুত কোনও কাজ করা আদৌ সমীচীন নয়?”
“যখন প্রেসিডেন্ট কোনও সিদ্ধান্ত নেন, তখন সেটাই ধ্রুব। তার মধ্যে অন্যায় বা অনৈতিক কিছু নেই।”

১৯৭৭ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত নিক্সন-ইন্টারভিউয়ের কিছু অংশ, তার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় এরকমই খানিকটা। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে ভুতপূর্ব আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের এই বিখ্যাত সাক্ষাৎকার সিরিজটি আজও পৃথিবীর অন্যতম বিতর্কিত সাক্ষাৎকারগুলির মধ্যে একটি।

এরকমই একটি বড়সড় বোমা ফাটতে পারত ভারতবর্ষে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে, যখন বিখ্যাত সাংবাদিক করণ থাপারের মুখোমুখি বসেছিলেন জম্মু ও কাশ্মিরের প্রাক্তন রাজ্যপাল, সত্যপাল মালিক। কিন্তু তথাকথিত মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার উদাসীনতাই কি অঙ্কুরে উৎপাটন করে দিল মালিকের যাবতীয় অভিযোগ? যা কিনা ২০২৪ লোকসভা ভোটের আগে হতে পারত বিরোধীদের কাছে লক্ষণের আদর্শ শক্তিশেল। আসব, বিস্তারিত আলোচনায়, তার আগে একটু বুঝে নেওয়া দরকার ঘটনা ও তার পটভূমি।

সত্যপাল মালিকের নির্বাচনী রাজনীতিতে আগমন চৌধুরী চরণ সিং-এর হাত ধরে। চরণ সিং-এর ভারতীয় ক্রান্তি দল, ভিপি সিং-এর ভারতীয় লোকদল, জনতা দল, মাঝে কিছুদিনের জন্য কংগ্রেস ঘুরে সত্যপাল বিজেপিতে যোগদান করেন ২০০৩-০৪ সাল নাগাদ। একবারের এমএলএ, দুইবারের রাজ্যসভার এমপি ও একবারের লোকসভার মেম্বার মালিক আবার মূলস্রোতের রাজনীতিতে ফিরে আসেন ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির হাত ধরেই। প্রথমে ক্যাবিনেট লাভ ও তারপরে ২০১৭ সালে বিহারের গভর্নর হিসেবে পাটনায় অধিষ্ঠান। নীতীশ সরকারের সঙ্গে টুকটাক ঝামেলার পর কিছুদিনের জন্য অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে ওড়িশা এবং ২০১৮ সালের মাঝামাঝি জম্মু ও কাশ্মিরের রাজ্যপাল পদে অভিষেক। জম্মু-কাশ্মিরের রাজ্যপাল থাকাকালীনই বিধানসভার বিলুপ্তি, রাষ্ট্রপতি শাসন এবং অবশেষে ৩৭০ ধারা লোপ এবং কাশ্মিরের রাজ্য হিসেবে তকমা খোয়ানো। ২০১৯-এ কাশ্মিরের রাজ্যপালের প্রয়োজন ফুরোনোর পর গোয়া, আর সবশেষে শিলং পাহাড়ে আরোহন। সত্যপালই বোধহয় একমাত্র গভর্নর, যিনি পাঁচ বছরের মধ্যে চার-চারটি রাজ্যের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এহেন পরিযায়ী রাজ্যপালের রাজ্যপাট ক্ষণস্থায়ী হওয়ার একটি অন্যতম কারণ সময় অসময়ে তিনি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে সরাসরি তোপ দেগেছেন গণমাধ্যমে। মেঘালয়ের রাজ্যপাল থাকাকালীন কৃষি বিল ইস্যুতে সত্যপাল একাধিকবার বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী মোদির সমালোচনা করেছেন বিভিন্ন মিটিংয়ে, এবং ন্যাশনাল টেলিভিশনে। বিভিন্ন ইস্যুতে বেসুরো বাজা এই সত্যপাল মালিক মোক্ষম বোমাটি ফাটালেন চলতি বছরের এপ্রিল মাসে, দ্বিতীয় সপ্তাহে।

দেশবন্ধু ইউটিউব চ্যানেলে প্রশান্ত ট্যান্ডন, “দ্য ওয়ার”-এর তরফে করণ থাপার এবং সাংবাদিক রভিশ কুমারকে দেওয়া পরপর তিনটি সাক্ষাৎকারে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করে তোপ দাগেন সত্যপাল। এর মধ্যে করণ থাপারকে দেওয়া প্রায় এক ঘন্টার ইন্টারভিউতে মূলত তিনটি অভিযোগ করেন তিনি:

  1. পুলওয়ামার ঘটনা সম্পূর্ণরূপে “ইন্টেলিজেন্স ফেলিওর”, এবং এর দায় এড়াতে পারেন না প্রধানমন্ত্রী মোদি, তৎকালীন গৃহমন্ত্রী রাজনাথ সিং।
  2. প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশ্মির ইস্যুতে একজন “Ill-informed Person”।
  3. দুর্নীতি প্রসঙ্গে আপসে মোদিজি খুব একটা পিছপা হন না সময়ে সময়ে।

তিনটি মারাত্মক অভিযোগ, এবং মালিকই বোধহয় প্রথম রাজ্যপাল যিনি দেশের তথা নিজের দলের সর্বাধিনায়ককে প্রকাশ্যে কাঠগড়ায় তুললেন। পুলওয়ামা প্রসঙ্গে মালিক আরও বলেন যে, সিআরপিএফ পাঁচটি এয়ারক্রাফটের দাবি জানিয়েছিল হোম মিনিস্ট্রিকে এবং শেষে তা নামঞ্জুর হওয়ার কারণেই নজিরবিহীনভাবে ৭৮টি বাসের কনভয়ের জম্মু থেকে শ্রীনগর যাত্রা এবং পথে পুলওয়ামার হৃদয়বিদারক ঘটনা। জানুয়ারি মাসের শুরু থেকেই বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে হাই অ্যালার্ট থাকা সত্ত্বেও হোম মিনিস্ট্রি কর্ণপাত করেনি, কনভয়ের যাত্রাপথ ঠিকভাবে “স্যানিটাইজ” পর্যন্ত হয়নি। ঘটনার সন্ধেবেলাতেই প্রধানমন্ত্রী মোদি ও অজিত দোভালকে মালিক জানান যে এই ঘটনার সম্পূর্ণ দায় রাষ্ট্রের এবং গভর্নর হিসেবে তিনিও দায় এড়াতে পারেন না, উভয়েই মালিককে বলেন আপাতত এই বিষয়ে মুখ না খোলাই শ্রেয়, যাতে ভোটের আগে এই ঘটনার তির পাকিস্তানের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। পুলওয়ামা নিয়ে নানান অস্বস্তিকর প্রশ্ন দেশবাসীর মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল সেই ২০১৯ থেকেই, সত্যপালের হঠাৎ সত্যবচন কার্যত সেই থিওরিগুলোতেই সিলমোহর লাগিয়ে দিল।

৩৭০ ধারা অবলুপ্তি প্রসঙ্গে মালিকের বক্তব্য, তিনি ২ আগস্ট ২০১৯ অব্দি কিছুই জানতেন না। এএনআই-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ২ আগস্ট তিনি বলছেন ৩৭০ অবলুপ্তি আপাতত কেবল “স্পেকুলেশন” মাত্র, যদিও ২০১৯-এর ম্যানিফেস্টো অনুযায়ী বিজেপি আজ না হোক কাল তা করেই ছাড়বে। ৩ আগস্ট সন্ধেবেলা অমিত শাহর বার্তা পান সত্যপাল, আগামীকাল অর্থাৎ ৪ তারিখ বেলা এগারোটার মধ্যেই বিল পাশ করিয়ে দেওয়ার নির্দেশ কার্যকর করতে হবে। ৩৭০ রদ সমর্থন করে মালিক বলেন যে জম্মু-কাশ্মির আর লাদাখের বিযুক্তিকরণ প্রয়োজন ছিল কিন্তু কাশ্মিরের রাজ্য স্ট্যাটাস বিলোপ করা আরেকটি পলিটিক্যাল ব্লান্ডার।

দুর্নীতি বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কাশ্মিরে রিলায়েন্সের হেলথ স্কিম পলিসি রদ প্রসঙ্গে সরাসরি মালিক কাশ্মিরের আরএসএস প্রধান রাম মাধবের নাম প্রকাশ্যে আনেন, এবং এও বলেন যে এই প্রকল্প কার্যকর হলে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা তাঁর পকেটস্থ হত। দুর্নীতির নানা খতিয়ান প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর ফলস্বরূপই গোয়ার রাজ্যপাল পদটি খোয়ান মালিক, এমনই মত তিনি ব্যক্ত করেন করণ থাপার এবং পরবর্তীতে “দ্য ওয়ার”-এর সিনিয়র এডিটর আরফা খানুম শেরওয়ানির সামনে।

এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ অবধি বিবিসি, দ্য ওয়ার সহ একাধিক তথাকথিত “টুকরে টুকরে” সংবাদসংস্থার সামনে “সত্যবাণ” হেনেছেন মালিক। কখনও মোদি সম্পর্কে সরাসরি বলেছেন, রাজনীতির প্রয়োজনে দুটো ফেজ টুপি পরে নিতে দু মিনিটও সময় লাগবে না তাঁর। আবার কখনও বলেছেন, দেশ অনেক আগেই ঝুঁকেছে, চব্বিশে মোদিকে না সরাতে পারলে বিক্রি হয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না। কখনও রাহুল গান্ধির “ভারত জোড়ো” যাত্রার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন, আবার কখনও বা বলছেন বিরোধীদের উচিত ভিপি সিং-এর ফর্মুলা মেনে চব্বিশের নির্বাচনে “একের বিরুদ্ধে এক” প্রার্থী দেওয়া। আজ ছিয়াত্তর বছর বয়সে এসে তাঁর ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে বলেছেন তিনি কোনও দলে যোগদান করবেন না, বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধীদের এককাট্টা হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুতিতে সাহায্য করবেন কেবল। বুক ঠুকে বারবার বলেছেন সত্যপাল, সত্যের সঙ্গে আপসে তিনি নারাজ এবং পুরস্কারস্বরূপ বারংবার সিবিআই-এর সামনে উপস্থিত হতে প্রস্তুত তিনি।

সত্যপালের সত্যবচনে বিরোধীদের পালে যারপরনাই হাওয়া লাগবে একথা ভাবা হয়ত সত্যের অপলাপ নয়, কিন্তু রাজনীতির ভোজবাজিতে মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। কংগ্রেস লাগাতার বিজেপি সরকারকে মালিক প্রশ্নে আক্রমণ করে গেলেও বাকি বিরোধীদের খুব একটা গা লাগাতে দেখা যায়নি। অঙ্গরাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম বিরোধী, পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস মোটের ওপর নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করছে। বর্তমানে রাজ্যজুড়ে নিয়োগ দুর্নীতিতে ইডি-সিবিআই-এর আনাগোনা, এর মধ্যে বিপুল অর্থব্যয়ে যুবরাজের অশ্বমেধের রথ ছুটে বেড়াচ্ছে দার্জিলিং থেকে দমদম। ২০২৫-এ রাজ্যে ভোট, এহেন পরিস্থিতিতে অতি-বিপ্লবী হতে গিয়ে উত্তরসূরিকে উৎসর্গ করার মতো হারাকিরি যে করবেন না ঝানু রাজনীতিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সে কথা অনুমান করতে জ্যোতিষ লাগে না। তাই মহুয়া মৈত্রর ইতিউতি টুইটের মাধ্যমেই দায় সেরেছে তৃণমূল কংগ্রেস। ন্যাশনাল মিডিয়া খুব সঙ্গত কারণেই সন্তর্পণে মুখে কুলুপ এঁটেছে এবং আদানি প্রসঙ্গের মতোই মোদি এবং ভাজপা মালিক প্রসঙ্গে স্পিকটি নট।

জাতীয় সংবাদমাধ্যমের নিস্পৃহতা এবং বিরোধীদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব দেশের মানুষকে কতটা “সত্যের পথে অবিচল” থাকতে সাহায্য করবে, সেটা বুঝতে এখনও এক বছর দেরি। কিন্তু রাজনৈতিক কেরিয়ারের সায়াহ্নে এসে পুলওয়ামা ঘটনার প্রায় চার বছর পর সত্যপাল হঠাৎ রত্নাকর থেকে বাল্মীকি হয়ে উঠলেন কোন অদৃশ্য মালিকের ইশারায়? ভাজপা-বিরোধী জোটের মুখ হওয়ায় বাসনা, নাকি সঙ্ঘের কোনও অদৃশ্য চালিকাশক্তির অঙ্গুলিহেলনে লখনৌ থেকে সাত লোক কল্যাণ মার্গের পথ সুগম করার কৌশল— অনুমান করা কঠিন বটে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে সত্যপাল করণ থাপারের মুখোমুখি হন ১৩ এপ্রিল, আর যোগীরাজ্যে গ্যাংস্টার সাংসদ আতিক আহমেদ খুন হন ১৫ এপ্রিল। একদিকে “দ্য ওয়ার”-এর সিনিয়র এডিটরকে মালিক বলছেন সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে সরাসরি জড়িত “ওরা”, আবার এবিপি নিউজের সামনে দাঙ্গা-বিরোধী ভূমিকায় যোগী আদিত্যনাথের অকুণ্ঠ প্রশংসা করছেন— এও কি নিছক সমাপতন? কী জানি, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা হয়তো বলতে পারবেন গুছিয়ে।

তবে সব শেষে এটুকুই বলার থাকে যে, মানুষের স্মৃতি যতই দুর্বল হোক না কেন— উত্তর খোঁজার দিন আগতপ্রায়। ইতিহাস সাক্ষী, হাতে লেগে থাকা রক্তের রং গাঢ় হতে হতে পোশাকের রঙে মিলিয়ে গেলে, সাধারণ মানুষ মানুষের মাঝখান থেকেই খুঁজে নেয় ভবিষ্যতের নেতা, সত্যপালের “সত্যভাষণ”ও কিন্তু সেই ভাবীকালের দিকেই নির্দেশ করছে।