Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বরাকের বাংলা ভাষা শহিদ দিবসে যে-ইতিহাস মনে পড়ে যায়

শান্তনু দত্ত চৌধুরী

 



প্রাবন্ধিক, ‘সপ্তাহ’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য

 

 

 

 

অসমের জটিল পরিস্থিতিকে বিজেপির নোংরা রাজনীতি আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে

 

অসম ১৮২৬ সালে অহম রাজা ও আরাকান রাজাদের হাত থেকে ব্রিটিশ শাসনে আসে। তার আগের ইতিহাসে যাচ্ছি না। ইংরেজরা প্রথমে এই রাজ্যটি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মধ্যে রেখেছিল। ওই সময় থেকে সরকারি কাজে নিয়োগের জন্য পূর্ববঙ্গ থেকে শিক্ষিত বাঙালিদের (মূলত হিন্দু) আনা শুরু হয়।

চা-বাগান পত্তন হওয়ার পর ক্লারিকাল সার্ভিসের ক্ষেত্রেও একই ধারা বজায় থাকে। অপরদিকে অসমের রেভিনিউ বাড়ানোর জন্য কৃষি উৎপাদন বাড়াতে পূর্ববাংলার কৃষকদের (মূলত মুসলমান) নিয়ে এসে এককালীন ২ টাকা খোরাকি ভাতা দিয়ে বসানো শুরু হয়। অহম ও অন্য জনজাতিগুলি অনগ্রসর জুম প্রথায় চাষ করত। অসমের কৃষিকাজ  ও কৃষির বিকাশে এই বঙ্গভাষী কৃষকদের বিশেষ অবদান আছে। এইভাবে অসমে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। চা-বাগানের শ্রমিকের কাজে নিয়ে আসা হয় বিহার (ঝাড়খণ্ড), মধ্যপ্রদেশ (ছত্তিশগড়) থেকে আদিবাসীদের।

১৮৩৮ সালে ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ভাষাকেও অসমের অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ করা হয়।

১৮৭৩ সালে অসমকে পৃথক প্রদেশ করা হয়। এই সঙ্গে বাংলাভাষী শ্রীহট্ট জেলাকে অসমের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। বাংলা ও অসমের মধ্যে গভীর আদানপ্রদান গড়ে ওঠে। অহম সমাজের মধ্যে থেকে এই সময় আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন, হেমচন্দ্র বড়ুয়া, গনাভিরাম বড়ুয়ার মতন সংস্কারকরা বেরিয়ে আসেন। তাঁদের চেষ্টায় অসমিয়া ভাষাকে এই সময় অসমের অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে বিংশ শতকে অসমিয়া ভাষার বিকাশে স্যার আশুতোষ মুখার্জি ও ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রভূত সহায়তা করেন।

১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর স্বাধীনতা আন্দোলনে ক্রমশ অসমের জনসাধারণও অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। আগস্ট আন্দোলনে অসমের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। শহিদ কনকলতা বড়ুয়া ও ভৃগুমণি ফুকনের বীরত্বগাথার কাহিনি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কুশল কোনোয়ারের ফাঁসি হয়। দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন অসমে কংগ্রেস ছিল প্রধান রাজনৈতিক দল। কিন্তু কংগ্রেসের ভিতরে ও বাইরে গড়ে উঠছিল তীব্র অসমিয়া জাত্যাভিমানী শক্তি, যারা মনে করত এবং এখনও মনে করে বাঙালি ও বাংলা ভাষা অসমিয়া ভাষা ও সংস্কৃতিকে গ্রাস করে নেবে।

এই উগ্র অসমিয়া শক্তির চাপে স্বাধীনতা ও দেশভাগের সময় ১৯৪৭-এর অক্টোবরে অসমের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলুই এক ছাত্রসমাবেশে বলেন “নিঃসন্দেহে অসম অসমিয়াদের জন্য।” মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মহাত্মা গান্ধি বলেছিলেন “অসম যদি হয় অসমিয়াদের জন্য তাহলে ভারতবর্ষটা কাদের জন্য?”

৭ মে, ১৯৪৯ তারিখে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বরদলুই প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে চিঠি দিয়ে বলেন “পূর্ববঙ্গ থেকে আগত বাঙালি উদ্বাস্তুদের অসমে পুনর্বাসন দিলে রাজ্যে জমির উপর চাপ বাড়বে।” ১৮ মে এর উত্তরে প্রধানমন্ত্রী নেহরু জানান অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অসমে জমি অনুযায়ী জনসংখ্যার ঘনত্ব কম। তাই এখানেই অসমের সীমান্তবর্তী পূর্ববঙ্গের মানুষরা এলে তাদের পুনর্বাসন দিতে হবে। জমি বণ্টনের ক্ষেত্রেও কেন্দ্র সরকার জানিয়ে দেয় স্থানীয় মানুষজন ও উদ্বাস্তুদের মধ্যে উদ্বৃত্ত খাসজমি ৫০:৫০ হারে বিলি করতে হবে। সমস্ত ক্ষেত্রেই পণ্ডিত নেহরুর উদ্বাস্তুদের পক্ষে গৃহীত কড়া মনোভাব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল সমর্থন করেন। উদ্বাস্তু সরকারি কর্মচারীদের অসম সরকারে চাকরি দিলে স্থানীয়রা চাকরি পাবে না— শ্রী বরদলুই-এর এই বক্তব্যও নেহরু গ্রহণ করেননি। তাঁর যুক্তি ছিল এই কর্মচারীরা দেশভাগের জন্য যেখানে যাবেন সেই রাজ্যেই চাকরি পাবেন এটাই প্রতিশ্রুতি। আর তাদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়।

হতাশ অসমিয়া উগ্রপন্থীরা প্রথম ১৯৫০ সালে বাঙালিদের ওপর প্রবল আক্রমণ চালায়। কয়েক হাজার বাঙালি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবাংলা ও বরাক উপত্যকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। আবারও ১৯৬০ সালে অসমিয়া জাত্যাভিমানী শক্তি বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। এদের চাপে অসম সরকার ১৯৬১ সালে বিধানসভায় রাজ্যভাষা বিল পাশ করে যাতে অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এরই বিরুদ্ধে বাংলাভাষীদের তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলনের ওপর ১৯ মে, ১৯৬১ অসম রাইফেলসের গুলিচালনা যার ফলে ১১ জন শহিদ হন। এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ হয়। এই গুলিচালনা সরকারের নীতি নয় বলা সত্ত্বেও অসমের বিমলাপ্রসাদ চালিহার মন্ত্রিসভা তীব্র নিন্দার সম্মুখীন হয়। সারা দেশে এর প্রভাব পড়ে। ওই সময়ে দুর্গাপুরে সর্বভারতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে পণ্ডিত নেহরু সহ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কাছাড়ে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালন করেন। কেন্দ্র সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী অসমে যান। তিনি অসম সরকারকে জানান বরাক উপত্যকার জন্য বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নিতে হবে। ফলে নূতন অধ্যাদেশ জারি করে বাংলা ভাষাকে বরাক উপত্যকার তিন জেলার প্রধান সরকারি ভাষা করা হয় যা এখনও জারি আছে।

কাছাড়ের শিলচরে ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতির দাবিতে যে একাদশ শহিদ জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একমাত্র নারী শহিদ

১৯৭৭ সালে কংগ্রেস দেশের কয়েকটি রাজ্যের মতন অসমেও ক্ষমতা হারায়। ক্ষমতায় আসে জনতা পার্টি। যার মধ্যে ছিল জনসংঘ (বিজেপি), সোশালিস্ট প্রভৃতি দল। এতদিনে অসমিয়া জাত্যাভিমানী শক্তি সম্পূর্ণ নিজেদের একটি সংগঠন পেল। এই জনতা দলের জঠরেই জন্ম নিল অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু) এবং অসম গণ পরিষদ (অগপ)। এবং এদের নেতৃত্বে শুরু হল নতুন করে ‘বঙ্গাল খ্যাদা’। ইন্ডিয়ান অয়েল-এর নবীন ইঞ্জিনিয়ার রবি মিত্রকে হত্যা করা হল। শুরু হল চূড়ান্ত অরাজক অবস্থা।

জনতা দলের শিথিল শাসনে আসু ও অগপ-র লাগাতার আক্রমণে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে। সকলেই নাকি অনুপ্রবেশকারী। এই প্রচার এখনও চলছে। ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অসমের ‘নেলি’তে এক ভয়াবহ আক্রমণে দুই সহস্রাধিক সংখ্যালঘুকে হত্যা করা হয়। তখন ওখানে রাষ্ট্রপতির শাসন ছিল। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাঙালিদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯৮৩-র নির্বাচনে কংগ্রেস জয়লাভ করে। হিতেশ্বর শইকিয়া মুখ্যমন্ত্রী হন। এই সুদক্ষ প্রশাসক ও সংগঠক এই অসমিয়া শভিনিস্টদের আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠেন।

অসমে স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য অত্যন্ত উদার মনোভাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি ১৯৮৬ সালে আসু-র সঙ্গে অসম চুক্তি সম্পাদন করেন। নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়। নতুন করে ১৯৮৬-তে নির্বাচন করার জন্য শইকিয়া পদত্যাগ করেন। অগপ ক্ষমতায় আসে। কিন্তু এই সরকার তথাকথিত বিদেশি চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৯১ সালে পুনরায় নির্বাচনে হিতেশ্বর শইকিয়ার নেতৃত্বে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৬ সালে তাঁর মৃত্যু দেশের পক্ষে এক বিরাট ক্ষতি। তিনি কঠোরভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ দিয়ে অহম প্রাদেশিকতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে পর্যুদস্ত করেছিলেন।

১৯৯৬ সালে পুনরায় অগপ সরকারি ক্ষমতায় এসে ২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে। কিন্তু এবারও তারা বিদেশি চিহ্নিত করতে ব্যার্থ হয়। পরবর্তী কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ২০০১ থেকে ২০১৬ সাল পযন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। এই সময়কালে তিনি অসমে শান্তি শৃঙ্খলা ও ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বজায় রেখেছিলেন। নিয়ম মেনে ১৯৭১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে নাগরিক পঞ্জিকরণের কাজ শুরুও করেছিলেন। কিন্তু তাঁর জন্য সমাজে অস্থিরতা ও অশান্তি সৃষ্টি হয়নি। কোনও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ-প্রচারকে উৎসাহ দেওয়া হয়নি। তাঁর শাসনামলেই শিলচরে অসম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি স্থাপিত হয়।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদি প্রচার চালান ক্ষমতায় এলে তাঁরা সব বিদেশিকে (পড়ুন মুসলমান) বিতারণ করবেন, ছিটমহল বিনিময় হতে দেবেন না ইত্যাদি। বাঙালি হিন্দুদের এক বড় অংশ বিজেপিকে এই ভরসায় ভোট দেয় এই ভেবে যে তারা বাঙালি হিন্দুদের ভালভাবে নিরাপত্তা দেবে। বিজেপি ভাল ফল করে।

২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে কিন্তু মোদিকে ছিটমহল বিনিময় করতে হয়েছে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অসমে বিজেপি, অগপ ও বোরো উগ্রপন্থীদের রামধনু জোট ক্ষমতায় আসে। বদরুদ্দিন আজমলের ইউডিএফ বাঙালি মুসলমানদের দল। এরা বহু আসনে প্রার্থী দেয়। কংগ্রেসের সঙ্গে ভোট বিভাজনের ফলে ওই ভোটে বিজেপি-জোট জয়লাভ করে। বাঙালি হিন্দুদের এক বড় অংশ বিজেপির প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে ওই রামধনু জোটকে ভোট দেয়। তারা ভেবেছিল নাগরিকত্বের প্রশ্নে হিন্দু বলে তারা রক্ষা পাবে। কিন্তু পরিস্থিতি ভয়াবহ। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যে নাগরিক পঞ্জিকরণের কাজ শুরু হয় তার প্রাথমিক তালিকায় তিনপুরুষের বাসিন্দাদের নামও বাদ পড়ে। অসমিয়া জাত্যাভিমানীদের মতে বাংলাভাষী মানেই অনুপ্রবেশকারী এবং বাংলাদেশি। এদের মতে ১৯৭১ সালকে যে ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়েছে তা আইন নয়, একটি চুক্তির (১৯৮৬ সালের অসম চুক্তি) গেজেট নোটিফিকেশন মাত্র। সংবিধান যেদিন গৃহীত হয়েছে সেদিন (১৯৪৯-এর ২৬ নভেম্বর) যারা এই ভূখণ্ডে ছিলেন তারা বা তাদের বংশধররা নাগরিক, এটাই আইন। অথচ সুপ্রিম কোর্ট বলেছে নাগরিক পঞ্জিকরণ হবে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ মধ্যরাতকে ভিত্তি করে।

কার্যত নাগরিক পঞ্জিকরণ আদৌ ১৯৭১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে হচ্ছে না। জমির দলিল, পূর্বপুরুষের ১৯৫১ সালের ভোটার লিস্টে নাম আছে কি না, আবেদনকারী প্রকৃতই তার/তাদের বংশধর কি না, বার্থ সার্টিফিকেট (সেটিও আবার জন্মানো মাত্র সংগৃহীত হতে হবে, পরে সংগৃহীত হলে হবে না) এরকম নানা শর্তাবলি।

এখন মোদি সরকার আরএসএস-এর পরামর্শে ভারতের নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ (সংশোধনী) বিল এনে বাঙালিদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজনের কৌশল নেয়।

এই বিলে বলা হয়েছে ২০১৪ সালের আগে প্রতিবেশী দেশগুলি, অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মায়ানমার থেকে ধর্মীয় ও সামাজিক হিংসার কারণে যেসব হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, খ্রিস্টান ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে তারা নাগরিকত্ব পাবে, কিন্তু কোনও মুসলমান পাবে না। প্রথমত এই আইন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার নীতির পরিপন্থী, দ্বিতীয়ত ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব ভারতীয় সংবিধান-বিরোধী।

এরপরই বিজেপির জোটসঙ্গী অগপ, বোরো ও অন্যান্য গোষ্ঠী জানিয়ে দেয় ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার চেষ্টা হলে তারা জোট ত্যাগ করবে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালও বলেন তিনিও এই বিল মানবেন না ও প্রয়োজনে পদত্যাগ করবেন। এদের বক্তব্য, এই বিলের দ্বারা অনুপ্রবেশকারী হিন্দু বাঙালিদের নাগরিকত্ব ও বৈধতা দেওয়া হবে। এর ফলে অসমিয়ারা চিরতরে সংখ্যালঘু হয়ে যাবে।

এই পরিস্থিতিতে তখনকার ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায় অসমের বাঙালিদের ভাষাভিত্তিক পরিচয় পাল্টে অসমিয়া হওয়ার পরামর্শ দেন। এরকম পরামর্শ পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশে বঙ্গভাষীদের দিয়ে বলেছিল “তোমরা উর্দু ভাষাকে তোমাদের মাতৃভাষা বলে গ্রহণ করো। তোমাদের মুসলমান পরিচয় রাখো, বাঙালি পরিচয় (ভাষাভিত্তিক পরিচয়) ত্যাগ করো।” এর বিরুদ্ধেই তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে (বাংলাদেশে) ভাষা আন্দোলন শুরু হয়।

এবার অসম সরকার ২৫ বৈশাখ কবিগুরুর জন্মদিনে স্কুল-কলেজে ছুটি দেয়নি। গত বছরও এই সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে তা বাতিল করেছিল। রাজ্যের এক মন্ত্রী বলেছেন রবীন্দ্রনাথ বাঙালি কবি, অসমে তার জন্মদিন কেন পালন করা হবে? কোনও দেশের কোনও সরকার তাদের জাতীয় সঙ্গীতের স্রষ্টাকে এমনভাবে অপমান করেনি।

অবস্থা এমন যে, ভাষা আন্দোলনের ধাত্রীভূমি শিলচরের বিজেপি বিধায়ক দিলীপ পাল ‘দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে’ ২০১৮ সালে রাজ্যের ডেপুটি স্পিকার পদ ছেড়ে দেন।

এদিকে সন্দেহজনক ভোটার (Doubtful voter) বলে বেশ কিছু মানুষকে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়েছে। অমানবিক পরিবেশ। আশ্চর্যের বিষয়, পরিবারের একজন সন্দেহজনক বলে বন্দি। কিন্তু অন্যরা মুক্ত।

নাগরিক পঞ্জিকরণের দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে ৪০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গিয়েছে। সকলেই বাঙালি। এদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষই রয়েছেন। আসু ও গণ সংগ্রাম পরিষদ-এর সদস্যরা নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেছে।

যাঁদের নাম বাদ গেল তাঁরা কোথায় যাবেন? বাংলাদেশ এঁদের গ্রহণ করবে? এর উত্তর হচ্ছে ‘না’। এঁরা কি তাহলে রাষ্ট্রহীন হয়ে থাকবেন? রোহিঙ্গাদের মতন?

ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সম্মিলিত সংখ্যালঘু পরিষদের সম্পাদক রানা সেনগুপ্ত এক বিবৃতিতে বলেছেন ভারতে  নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য ধর্মকে ভিত্তি করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা অতীব বিপজ্জনক। এই কাজ বাংলাদেশের ইসলামিক মৌলবাদী শক্তির হাতকে শক্তিশালী করবে।

বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন এই পঞ্জিকরণ সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে হয়েছে। তাঁদের কিছু করার নেই। কথাটি বাস্তবে সঠিক নয়। কাজটি করেছে রাজ্য সরকারি কর্মী ও আধিকারিকরা। প্রতীক হাজেলা যিনি এই পঞ্জিকরণের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন তিনি সেন্ট্রাল ক্যাডারের আইএএস অফিসার, তিনি কি প্রতিটি কেস নিজে ভেরিফাই করেছিলেন? এখন বিজেপি বলছে অসমের নাগরিক পঞ্জিকরণ ত্রুটিপূর্ণ। তাই আবার নতুন করে পঞ্জিকরণ হবে। উদ্দেশ্য ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করা।

২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে অসমে বিজেপি-জোট কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটকে পরাস্ত করে (১ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে) আবার ক্ষমতায় আসে। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন একদা কংগ্রেস থেকে দলত্যাগ করে আসা বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করেছেন। তিনি এখন মোদি, শাহ, যোগীর পর বিজেপিতে এক আদর্শ পুরুষ।

তাঁর আদর্শ অনুসরণ করেই বিজেপির স্থানীয় নেতা দিলীপ ঘোষ ২০২১ সালে আস্ফালন করে বলেছিলেন তাঁরা নাকি এই বঙ্গেও নাগরিক পঞ্জিকরণ করবেন ও সবাইকে মেরে বার করে দেবেন। এই দলটি ৯ বছর হল ক্ষমতায় এসে ভাষা, ধৰ্ম, বর্ণের ভিত্তিতে দেশ জুড়ে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। মণিপুরে কী চলছে তা সকলেই দেখছেন। খুনখারাপির গুজরাটি মডেল। এরা একটি শান্তিপূর্ণ স্থিতিশীল দেশকে অস্থিতিশীলতা, বিবাদ ও সংঘাতের লীলাভূমিতে পরিণত করেছেন। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতায় এসে এই কাজটিই করেছিল।

১৯ মে— বরাকের ভাষা শহিদ দিবস— আমাদের এইসবই বেশি করে মনে করায়।