জয়ন্ত ভট্টাচার্য
প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যকর্মী
সরকারি ব্যবস্থায় ডাক্তারের অভাব কেননা সরকার দু বছর ধরে নতুন ডাক্তার নিয়োগ করেনি, দাঁতের ডাক্তার নিয়োগ করেনি ৭ বছর ধরে। সরকারি ব্যবস্থায় প্রায় ৪৬ শতাংশ ডাক্তারের পদ খালি। ৩ বছরের ডিপ্লোমা কোর্সের পেছনে শক্তিক্ষয় না করে সরকার শূন্যপদে নিয়োগ করুক
সম্প্রতি পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৩ বছরের ট্রেনিং দিয়ে ডাক্তার ও নার্স তৈরি করে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠিয়ে ডাক্তারের চাহিদা মেটানোর একটি প্রস্তাব শোরগোল ফেলেছে। সে বিষয়ে ইতিহাসকে মাথায় রেখে কিছু আলোচনা করা যায়। প্রসঙ্গত, মনে রাখা ভাল— কেন্দ্রীয় সরকার সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে পাশ করা প্রায় ৬ লাখ AYUSH (আয়ুর্বেদ-উনানি-সিদ্ধা-হোমিওপ্যাথি)-প্রশিক্ষিত চিকিৎসককে স্বাধীনভাবে প্রেসক্রিপশন করার লাইসেন্স দিয়েছে। ১৩ লাখের কিছু বেশি রেজিস্টার্ড ‘অ্যালোপ্যাথি’ ডাক্তারকে ধরলে ভারতে ১১০০ জনসংখ্যার জন্য ১ জন ডাক্তার হত। এঁদের যোগ করলে সেটা কমে দাঁড়ায় প্রতি ৮৩৪ জনের জন্য ১ জন করে ডাক্তার বরাদ্দ করেছে ভারত। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার (WHO) প্রস্তাব হল প্রতি ১০০০ জন মানুষের জন্য ১ জন ডাক্তার থাকবে, এ হিসেবকে ছাপিয়ে চলে যায় ‘মেক ইন’ এবং ‘আত্মনির্ভর’ ভারত। ফলে সমস্যার গোড়া অনেক গভীরে বিস্তৃত।
AYUSH-এর অন্তর্ভুক্ত আয়ুর্বেদের অংশটুকু নিয়ে যদি শুধু কথা বলি, তাহলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম শবব্যবচ্ছেদের পরে আয়ুর্বেদের কাঠামোর মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আসে। এ পরিবর্তনের কাণ্ডারিরা ছিলেন বাংলার গণনাথ সেন এবং আরও কয়েকজন, তামিলনাড়ুর গোপালাচার্লু এবং কেরলের পিএস ভেরিয়ার। এমনকি গণনাথ সেন মেডিক্যাল কলেজে ১৮৩৬ সালের প্রথম শবব্যবচ্ছেদকে “আয়ুর্বেদের পুনর্জাগরণের কাল” বলেও অভিহিত করেছিলেন। এর পরবর্তী সময়ে, ১৯২৩ সালের পর থেকে, ঐতিহ্যাশ্রয়ী আয়ুর্বেদের খোলনলচে বদলে গেল হাসপাতাল, শবব্যবচ্ছেদ, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অ্যানাটমি পুস্তকের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। এ সময়ের প্রধান ব্যক্তিত্ব গিরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়— একাধারে মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা এমডি এবং আয়ুর্বেদ ভিষগাচার্য। তাঁর লেখা বিখ্যাত বই হিস্টরি অফ ইন্ডিয়ান মেডিসিন (১৯২৪, ৩ খণ্ড)।
লক্ষ্যণীয়, ১৯শ শতকের মধ্য ভাগ থেকেই (বিশেষ করে ১৮৩৫-এ মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী সময়ে) আয়ুর্বেদ চর্চার ওপরে একদিকে ছিল মডার্ন মেডিসিনের প্রত্যক্ষ প্রভাব ও চাপ, অন্যদিকে আয়ুর্বেদের ঐতিহ্যগত জ্ঞানতত্ত্ব ছেড়ে আধুনিক হওয়ার জন্য শবব্যবচ্ছেদের মতো বিষয়কে নিয়মিতভাবে আয়ুর্বেদের কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার ঐকান্তিক প্রয়াস। এ দুয়ের টানাপোড়েন নিয়ে আয়ুর্বেদের পরবর্তী “নির্মাণ”, যাকে মান্য গবেষকেরা বলেছেন “নব্য আয়ুর্বেদ”। বর্তমান সময়ে আয়ুর্বেদের জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বলে মান্য মিউলেনবেল্ড (G Jan Meulenbeld. কিছুদিন হল প্রয়াত হয়েছেন) তাঁর magnum opus পাঁচ খণ্ডের History of Indian Medical Literature (HIML)-এ বলছেন— “ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে আয়ুর্বেদের “নবজাগরণ” ভারতীয় মেডিসিনের একটি একশৈলিক মডেল তৈরির দিকে যাত্রা শুরু করল, যে মডেলে ভারতীয় মেডিসিনের অসঙ্গতিসমূহ এবং অগ্রহণীয় ধারণাগুলো ছেঁটে ফেলা হবে… ইউরোপীয় মেডিসিনের থেকে আহরিত টার্মসমূহকে দিয়ে ফিজিওলজি এবং প্যাথলজি সংক্রান্ত প্রক্রিয়ার ও রোগের শ্রেণিবিভাগ সংক্রান্ত টার্মসমূহকে ধৈর্য ধরে পুনরায় ব্যাখ্যা করা হবে যাতে প্রাচীন শব্দসমূহ আধুনিক সরণীতে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে ওঠে।”[1]
তাহলে এখন যে ‘আধুনিক’ আয়ুর্বেদের চর্চা চলছে সেটা না হল প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, না হল আধুনিক মেডিসিনের সমকক্ষ কোনও চিকিৎসাব্যবস্থা। রাষ্ট্র-অনুমোদিত এ এক অদ্ভুত ‘হাইব্রিড’ চরিত্র যার ওপরে নির্ভর করছি আমরা।
এখানে সঙ্গত প্রশ্ন উঠবে— ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি কেন? একটি উত্তরই কার্যত দেওয়া যায়, তা হল আমাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল ‘reactive’ (ঘটনা ঘটার পরে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা)। রাষ্ট্রের পদক্ষেপ ‘proactive’, অর্থাৎ রাষ্ট্র আগাম ভেবে পদক্ষেপ নেয়। আমরা ঘটনার পেছনে ছুটতে থাকি। খুব সংক্ষেপে ভাবলে দেখা যাবে— ঐতিহাসিকভাবে রুশো, ভলতেয়ার, লেনিন বা টমাস পেইনরা ‘proactive’ পদক্ষেপ নিয়ে রাষ্ট্রকে পেছনে ফেলতে পেরেছিলেন বলে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন চিরস্থায়ী পরিবর্তন এসেছে, যার সুফল আমরা এখনও ভোগ করে চলেছি। আমার বলা কথার খানিকটা সমর্থন পাওয়া যাবে টমাস পিকেটির (প্রখ্যাত ফরাসি অর্থনীতিবিদ) কথায়। তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত A Brief History of Equality (২০২২) পুস্তকে বলেছেন— “সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন ছাড়া এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে পশ্চিমের সম্পত্তিভোগী শ্রেণি আদৌ ‘সামাজিক নিরাপত্তা’ এবং প্রগতিশীল আয়কর ব্যবস্থা গ্রহণ করত কিনা, এ কথাও বলা সম্ভব নয় যে ‘ডিকলোনাইজেশন’ এবং সিভিল রাইটসকে মেনে নিত কিনা।”[2]
আধুনিক মেডিসিনের অতি-সংক্ষিপ্ত রূপরেখা
প্রধানত ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পরে যখন সম্রাটের অপসারণ হয় এবং ক্ষমতা বহুলাংশে সাধারণ মানুষের হাতে আসে, সে সময় থেকে প্যারিসের হাসপাতালগুলিতে আধুনিক মেডিসিনের সূচনা হয়। প্যারিসের হাসপাতালগুলোতে, বিশেষ করে Hotel-Die-এ, গ্রাম থেকে উৎখাত হওয়া অসংখ্য দরিদ্র, ভিটেহারা মানুষের ভিড় জমে। রোগী এবং রোগকে বোঝার ক্ষেত্রেও এসময়ে দিকপাল ফরাসি চিকিৎসকদের মধ্যেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। রোগী তার যে উপসর্গ বলছে তার উপরে আর চিকিৎসকরা নির্ভর করছেন না। নিজের চোখে নিরীক্ষণ করা, শরীরে হাত দিয়ে দেহের অভ্যন্তরের সমস্যার সঠিক অনুধাবন করা এবং, সর্বোপরি, স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করে রোগের চরিত্র বোঝা— সবকিছুই একসঙ্গে চলতে থাকল। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর পরে রোগীর দেহের শবব্যবচ্ছেদ করে মৃত্যুর আগে যে ডায়াগনোসিস করা হয়েছিল তার সঙ্গে সাযুজ্য মেলানো শুরু হল। ৩টি মূল ভিত্তির ওপরে যে নতুন মেডিসিন (যাকে গবেষকেরা ‘হসপিটাল মেডিসিন’ বলেছেন) গড়ে উঠল সেগুলো হল— (১) রোগীর শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে রোগের বিবরণ শোনা, (২) মৃত্যুর পরে বাধ্যতামূলক অটোপসি বা পোস্টমর্টেম, এবং (৩) এর ভিত্তিতে রোগ এবং চিকিৎসার পরিসংখ্যান গড়ে তোলা যাতে পরবর্তীতে চিকিৎসার কাজে লাগে। ১৯শ শতকের শুরু থেকে চিকিৎসার এ ধরন বা ‘ক্লিনিকাল মেডিসিন’ সমগ্র পৃথিবী জুড়ে অনুসৃত হয়ে আসছে। এবং নিত্যনতুন আবিষ্কারের ফলে বিকশিত হয়ে চলেছে।
ঐতিহাসিকভাবে গৃহীত এ পদ্ধতিটি কোনও মূল্যেই ৩ বছরের প্রশিক্ষণে হওয়া সম্ভব নয়। এবং সাড়ে চার-পাঁচ বছরের লেখাপড়ার পরে রয়েছে ইন্টার্নশিপ এবং হাউসস্টাফশিপের কয়েক বছরের প্রশিক্ষণ। আমরা মানুষকে ফাঁকি দিতে না চাইলে এ পথে হাঁটা যায় না।
মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে দিয়ে ১৮৩৫ সাল থেকে ভারতে মেডিসিনের আধুনিকতার যে সূচনা সেটাও এ ধারারই ঔপনিবেশিক প্রতিসরণ। কিন্তু রোগীর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস নেওয়া এবং শব্যবচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে রোগের অঙ্গস্থানিকতা (organ localization of disease) বোঝা— এগুলো চিকিৎসাশিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ১৮৩৮ সালে মেডিক্যাল কলেজে প্রথম অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়েছিল সাড়ে তিন বছরের পড়াশুনোর পরে। কিন্তু এ পদ্ধতি সমালোচিত ও বাতিল হয়— প্রশিক্ষণে যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়নি বলে। পরে বেড়ে ৪ বছর এবং শেষ অব্দি ৫ বছরের শিক্ষাক্রম গৃহীত হয়— আন্তর্জাতিক মানের সমতুল্য করে তুলতে। মনে রাখতে হবে ১৮৪৫ সালেই (প্রতিষ্ঠার ১০ বছরের মধ্যে) মেডিক্যাল কলেজ রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনস, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এবং অ্যাপোথেকারি সোসাইটির অনুমোদন পেয়েছিল— ইউরোপ-আমেরিকার সীমান্তের বাইরে একমাত্র ঔপনিবেশিক মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে।
পরে এর সঙ্গে ল্যাবরেটরি যুক্ত হয়ে ‘ল্যাবরেটরি মেডিসিন’-এর যুগ সূচিত করেছে। নতুন নতুন টেকনোলজির ব্যবহারের ফলে (এক্স-রে থেকে যার সূত্রপাত) এখন তো আমরা ‘টেকনো-মেডিসিন’-এর যুগে রয়েছি। কিন্তু বোধের কেন্দ্রে সবসময়েই থেকেছে রোগকে বুঝতে পারার ক্ষমতা এবং একটি কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যতদূর সম্ভব কম ভুল করে সঠিক রোগ নির্ণয় করা।
বর্তমান সময়ের দাবি
ভারতে কি চিকিৎসকের ঘাটতি আছে? একেবারে শুরুতে দেখিয়েছি যে ঘাটতি নেই। ল্যান্সেট-এর মতো জার্নালে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত বেশ কিছু তথ্য উল্লেখে করে দেখানো যায়— (১) ২০১৪ থেকে ২০২২ সালে মধ্যে এমবিবিএস ডাক্তারের সংখ্যা ৭৫ শতাংশ বেড়েছে, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটদের বৃদ্ধি ৯৩ শতাংশ, (২) ভারতে প্রতিবছর অনুমিত ৯০০০০ ডাক্তার পাশ করে বেরোয়, (৩) রাজ্যগুলো জিডিপি-র ১ শতাংশেরও কম স্বাস্থ্যখাতে খরচ করে, (৪) নিজের পকেট থেকে (আউট অফ পকেট) স্বাস্থ্যের জন্য খরচ করতে বাধ্য হওয়ায় বছরে প্রায় ৬ কোটি ৩০ লাখ ভারতবাসী দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। এ সংখ্যাটি প্রায় ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার সমান।
আরও দুয়েকটি তথ্য দেখা যাক। বর্তমানে প্রাইভেট সেক্টর ইন-ডোর রোগীর ৮০ শতাংশ এবং আউটডোর রোগীর ৬০ শতাংশের পরিষেবা দেয়। এর ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্যখাতে ৭০ শতাংশ ভাগ খরচ নিজেদের পকেট থেকে মেটাতে হয়, মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ে। AIIMS-এর মতো সরকারি ভর্তুকিপুষ্ট আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা ছাত্রদের শতকরা ৫৪ জন পাড়ি দেয় বিদেশে, এদেশে থাকে না। ভারতের প্রসঙ্গে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে জনস্বাস্থ্যের জগতের মান্য ব্যক্তিত্ব শ্রীনাথ রেড্ডি মন্তব্য করেছেন— যত বেশি করে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থা শুকিয়ে যেতে ও হ্রাস পেতে থাকল, তত বেশি করে প্রাইভেট সেক্টর সক্রিয় ও কার্যকরী হয়ে উঠল।
আরেকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ Do We Care গ্রন্থের সুপরিচিত বিশেষজ্ঞ লেখিকা সুজাতা রাও বলেন—
একটি হার্ট সার্জারি, কানের একেবারে অন্তর্ভাগে “ইমপ্ল্যান্ট” বসানো কিংবা সিজারিয়ান সেকশনের জন্য অর্থ পাওয়া সহজলভ্য, কিন্তু সহজলভ্য নয় প্রয়োজনীয় এবং একেবারে প্রাথমিক ডায়াগনোসিসের জন্য, কীভাবে রোগ প্রতিরোধ করা যায় এ শিক্ষার জন্য, রোগ থেকে সেরে ওঠার পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য, বৃদ্ধদের দেখাশোনা এবং যত্নের জন্য, স্কুলে স্বাস্থ্যরক্ষা এবং বয়ঃসন্ধির যত্নের জন্য, অথবা communicable (যেমন ডায়ারিয়া, টিবি, শ্বাসকষ্টের রোগ) কিংবা non-communicable (যেমন ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক) রোগগুলোর যে সরাসরি কারণ (যেমন দূষিত পানীয় জল, দূষিত পরিবেশ বা বায়ু) সেগুলোকে আয়ত্তে আনার জন্য, কিংবা অর্থের জোগান নেই অ্যাক্সিডেন্টের চিকিৎসার জন্য, অর্থ নেই সামান্য জ্বরের চিকিৎসার জন্য, অর্থ নেই সাপে কাটা রোগীর জন্য— যে বিষয়গুলো দরিদ্র মানুষের জন্য নিতান্ত গুরুত্বপূর্ণ।[3]
এ প্রসঙ্গে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য—
আমাদের দেশ বা রাজ্যে কোথাও জনসংখ্যা অনুপাতে ডাক্তারের অভাব নেই। পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবছর ২৫টি মেডিকেল কলেজ থেকে প্রায় ৫০০০ ডাক্তার পাশ করে বেরোন। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৩। বছরে প্রায় ১০০০০ নতুন ডাক্তার।
সরকারি ব্যবস্থায় ডাক্তারের অভাব কেননা সরকার দু বছর ধরে নতুন ডাক্তার নিয়োগ করেনি, দাঁতের ডাক্তার নিয়োগ করেনি ৭ বছর ধরে। সরকারি ব্যবস্থায় প্রায় ৪৬ শতাংশ ডাক্তারের পদ খালি। ৩ বছরের ডিপ্লোমা কোর্সের পেছনে শক্তিক্ষয় না করে সরকার শূন্যপদে নিয়োগ করুক। একই শিক্ষক চিকিৎসককে কুমীরছানা দেখানোর মতো NMC (ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল) ভিজিট-এর সময় বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে না ঘুরিয়ে প্রতি কলেজে পর্যাপ্ত নিয়োগ হোক।
ডাক্তাররা গ্রামে যেতে চান না কথাটা অর্ধসত্য। গ্রামীণ এলাকায় পরিকাঠামোর উন্নয়ন হলে, গ্রামীণ এলাকায় কাজের যথাযথ পরিবেশ থাকলে, গ্রামীণ এলাকায় কাজ করার জন্য স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে বিশেষ সুবিধের মতো উৎসাহের ব্যবস্থা থাকলে, ডাক্তারের নিজের জেলা বা কাছের জেলায় নিয়োগ করলে গ্রামের জন্য ডাক্তারের অভাব হবে না। এটা শহর বা মফঃস্বলের সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
আমরা মনে করি কেবল ডাক্তার দিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থা চলে না। সমস্ত রোগ চিকিৎসার জন্য ডাক্তার লাগে এমনটাও নয়। ইউনিভারসাল হেলথ কেয়ার আছে এমন অনেক দেশেই দ্বাররক্ষক (Door Keeper) হিসেবে মাঝারি স্তরের চিকিৎসাকর্মী থাকেন। ডাঃ কে শ্রীনাথ রেড্ডির নেতৃত্বাধীন High Level Expert Group on Universal Health Coverage এই স্তরের চিকিৎসাকর্মী তৈরির কথা বলেছেন। তাদের পাঠের সময়সীমা ৩ বছর হতেই পারে!
তারা কিন্তু চিকিৎসাকর্মী, চিকিৎসক নন।
ভারতে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় এখনও ২ শতাংশের কম। ফলে সহজেই অনুমেয়, কি অতি সামান্য পরিমাণ অর্থবরাদ্দ পড়ে থাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য। বিভিন্ন রাজ্যের স্বাস্থখাতে খরচের চিত্রটি একবার দেখে নেওয়া যাক।
জুলাই, ২০১৯-এ Patient-Centerd Primary Care Collaborative নামের একটি স্বাধীন আমেরিকান সংস্থা এক রিপোর্ট তৈরি করে— “Investing in Primary Care” শিরোনামে। সে রিপোর্টে বলা হয়—
সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ক্রবর্ধমান প্রামাণিক তথ্য এটা দেখিয়ে দিচ্ছে যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা-কেন্দ্রিক স্বাস্থ্যকাঠামোতে শ্রেষ্ঠতর স্বাস্থ্যের ফলাফল লাভ করা যায়, অধিকতর স্বাস্থ্যের ন্যায্যতা (health equity) পাওয়া যায় এবং তুলনামূলকভাবে কম খরচ হয়। তবুও, এসমস্ত শক্তিশালী প্রামাণ্য তথ্য হাতে থাকা সত্ত্বেও— যেমন প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা রোগীরা বেশি বেশি করে চায় এবং নীতিনির্ধারকেরাও একে অস্বীকার করতে পারেন না— প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জগৎটি আমেরিকাতে লাগাতারভাবে নিতান্ত অপ্রতুল ফান্ডিং পায়। সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যখাতে যে ব্যয় হয় তার মাত্র ৫-৭ শতাংশ ব্যয়িত হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য। অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশে (যেমন OECD— ৩৭টি বাজার অর্থনীতি-নির্ভর দেশের একটি সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় আমেরিকার দ্বিগুণেরও বেশি— ১৪ শতাংশ।
আমার আলোচনা শুরু করেছিলাম, গ্রামের মানুষের জন্য অভিনব উপায়ে ৩ বছরের প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘ডাক্তার’ তৈরি করে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়ে। গ্রামের মানুষ কি আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ পাওয়ার উপযুক্ত নন? ১৯৪৬ সালের ভোর কমিটি থেকে শুরু করে পরবর্তী সমস্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্বাস্থ্য মূল্যায়ন কমিটিগুলো বারংবার প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার কথা বলেছে।
সে বিষয়ে আমাদের বাংলার সরকার কোনও মতামত দেবে কি? ইতিহাস আমাদের শেখায়, যথেষ্ট রসদ থাকা সত্ত্বেও তার ব্যবহার না করা এক ধরনের অপরাধ। আমাদের সামনে, এ আলোচনায় যা বলেছি, স্পষ্ট ইতিহাস আছে, আছে রসদ। নেই যেটা তা হল সদিচ্ছা— একটি জীবন্ত, সদা-ক্রিয়াশীল প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার লক্ষ্যে।
[1] HIML, IA, পৃঃ ২। নজরটান আমার
[2] পৃঃ ১৪।
[3] পৃঃ ২৪-২৫।
*মতামত ব্যক্তিগত