Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নোটবন্দি ২.০- হাতে টাকা থাকা মানে একজন মানুষ রাজা, মোবাইলে টাকা থাকা মানে নয়

সুমন সেনগুপ্ত

 



 


প্রাবন্ধিক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার

 

 

 

 

 

সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিটি মানুষের একটি ডিজিটাল পরিচয়পত্র যদি বাধ্যতামূলক করা যায়, এবং সেই পরিচয়পত্রের উল্লেখ করা বা তার মাধ্যমেই যদি প্রতিটি লেনদেন করাতে যদি নাগরিকদের বাধ্য করানো যায়, তাহলে যদি দেশে কখনও কোনও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়, তাহলে সরকারের কাছে যেকোনও মুহূর্তে সমস্ত মানুষকে নিজের হাতের পুতুল বানানোর ক্ষমতা থাকবে।

একটা দেশের অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভর করে কী করে একজন নাগরিক কোনও বস্তুকে কিনে বা বিক্রি করে সম্মানজনকভাবে পয়সা মেটাচ্ছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পেমেন্ট এবং সেটেলমেন্ট আইন ২০০৭ অনুযায়ী দেখা গেছে যে বেশ কিছু মানুষ গত এক দশকে ক্যাশ থেকে ডিজিটাল লেনদেন পদ্ধতিতে সরে এসেছেন। তাদের লক্ষ্য ছিল ২০১৯-২১ সালের মধ্যে এই বিষয়ে দেশের মানুষকে যাতে আরও বেশি বেশি টাকার থেকে ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। এই লক্ষ্যে পৌঁছতে তাদের দাওয়াই ৪টে “সি”: কম্পিটিশন (প্রতিযোগিতা), কস্ট (খরচ), কনভিনিয়েন্স (সুবিধা), কনফিডেন্স (ভরসা)।

২০১৬ থেকে ২০১৯- এই তিন বছরে ভারতে ডিজিটাল লেনদেন যথেষ্ট পরিমাণে বেড়েছে, এই মুহূর্তে ভারতে প্রায় ৮৪০ লক্ষ ডেবিট কার্ডের ব্যবহার করা হয়, সেই তুলনায় ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ। এছাড়াও আছে, ইউপিআই পেমেন্ট পদ্ধতি, অর্থাৎ জিপে, ফোন পে ইত্যাদির মতো ব্যবস্থা। আজকের সময়ে দেখা যাচ্ছে, বহু মানুষ ধীরে ধীরে এই ধরনের পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। যদিও গ্রাম এবং শহরে এখনও এই সংক্রান্ত ব্যবহারে ফারাক আছে, কিন্তু তাও সরকারের তরফে চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই, কীভাবে মানুষকে আরও ডিজিটাল বানানো যায়, সেই বিষয়ে।

এই কথাগুলো কেন আবার নতুন করে বলতে হচ্ছে? কারণ গত ১৯ মে ২০২৩ সালে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, ২০০০ টাকার নোটটি তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। যদিও তাঁরা বলেছে, এখনই হুড়োহুড়ি করে ঐ ২০০০ টাকার নোট বদলানোর প্রয়োজন নেই, এখনও ৩০শে সেপ্টেম্বর অবধি এই টাকা বদল করা যাবে। শুধু তাই নয়, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এও বলেছে, ঐ ২০০০ টাকার নোট কিন্তু ‘লিগাল টেন্ডার’ হিসেবে এখনও আছে, অর্থাৎ যতদিন না রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলছে, ঐ টাকা বাতিল হল, ততদিন ঐ টাকা ব্যাঙ্ক নিতে বাধ্য।

রাজনৈতিক নেতানেত্রী থেকে শুরু করে অনেকেই আবারও সরব হয়েছেন, এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে। অনেকেই বলছেন এই প্রক্রিয়া আবারও সাধারণ মানুষকে অসুবিধায় ফেলবে। অনেকে বলছেন বিষয়টি আদপেই নোটবন্দির দ্বিতীয় পর্যায় নয়, এত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। মানুষজন, আবারও প্রথম নোটবন্দির দিনগুলো নিয়ে চর্চা শুরু করেছে। আবারও সেই আতঙ্ক। আবার সেই কালো টাকা ফেরানোর কথা শুরু হয়েছে। অনেকে বলছেন, যে তাহলে কি ঐ ২০০০ টাকার নোট দিয়েই টাকা ‘খাটের তলায়’ জমিয়ে রাখার প্রক্রিয়া চলছিল, সেটা প্রধানমন্ত্রী এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এতদিনে বুঝতে পারলেন? তাহলে তখন যে বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, ঐ ২০০০ টাকার নোট দিয়েই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হবে- এতদিনে সেই কথাটাই সরকার স্বীকার করে নিলেন? তাহলে কি সরকার বকলমে, তাঁদের আগের ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়েই এই নতুন সিদ্ধান্ত নিলেন?

প্রাক্তন আমলা কান্নান গোপিনাথন, যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন একটি সভায় বক্তব্য রাখার সময়ে তিনি বলেছিলেন, যেদিন প্রথম ২০১৬ সালে নোটবন্দি করা হয়েছিল, সেদিন বলা হয়েছিল এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে কালো টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হবে। সেদিন কিন্তু একজন মানুষও প্রশ্ন করেননি, কালো টাকা কী? যদি কোনও ব্যক্তি, অসৎ উপায় অবলম্বন করেও কিছু টাকা রোজগার করেন, তাহলেই কি তা কালো টাকা বলে গণ্য হবে? যদি তা হয়, তাহলে, ঐ টাকা দিয়ে যদি কিছু কেনাকাটা করা হয়, তাহলে কি তখন সেটা আর কালো টাকা থাকে? আমরা সেদিন ঐ প্রশ্নটা করতে পারিনি বলেই, আমাদের ঐ রকম দুরবস্থা হয়েছিল। হিসেব বর্হিভূত আয় আর কালো টাকা এক নয়। কোনও টাকাই কালো নয়, যদি তা দিয়ে কিছু না কিছু কেনা হয়। ইডি বা ইনকাম ট্যাক্স নিজেই, হিসেব বর্হিভূত আয় সম্পর্কে তদন্ত করতে পারে, তার জন্য নোটবন্দি করতে হয় না। আসলে নোটবন্দির উদ্দেশ্য ছিল, ছোট এবং মাঝারি ব্যবসা বন্ধ করা এবং একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সুবিধা করে দেওয়া, তাতে তারা পরিপূর্ণভাবে সফল।

আজকেও অনেকে ভাবছেন, বাংলার কিছু নেতা মন্ত্রীদের জন্যেই নাকি, সাম্প্রতিক এই ২০০০ টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাদের জন্য একটাই কথা, তারা আগেও যেমন নোটবন্দির কারণ বুঝতে পারেননি, আজও পারছেন না। হয়তো বেশ কিছু বিরোধী নেতাদের কাছে, ঐ ২০০০ টাকার নোট আছে, কিন্তু সেটা তুলে নেওয়াই কি একমাত্র উদ্দেশ্য এই সরকারের? যদি খেয়াল করা যায়, গত কয়েকবছর ধরেই কিন্তু এই ২০০০ টাকার নোট কম দেখা যাচ্ছিল, অর্থাৎ সরকার নিজেই এই টাকা ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছিল। তথ্য বলছে ২০১৮ সালে এই ২০০০ টাকার নোটের মূল্য ছিল ৩৩৬ কোটি টাকা যা ২০২৩ সালে ১৮১ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। আরও যদি খেয়াল করা যায়, ছোট মূল্যের টাকাও কমে এসেছে বাজারে। দশ টাকা বা কুড়ি টাকার নোটও বাজারে দেখা যাচ্ছে না, অর্থাৎ সরকার কার্যত এই টাকা ছাপানো থেকে সরে আসছে এবং নাগরিকদের বাধ্য করছে ডিজিটাল পেমেন্টে ঢুকতে, প্রথমে ডেবিট কার্ড তারপর ইউপিআই এইভাবে।

এবার আসা যাক, এই ধরনের ডিজিটাল পেমেন্টের দিকে কেন নাগরিকদের ঠেলতে চাইছে সেই প্রসঙ্গে। সরকার চাইছে, মানুষ আরও বেশি ডিজিটাল হোক। সেই ডিজিটাল লেনদেন দিয়ে, প্রতিটি নাগরিককে চিহ্নিত করা খুব সহজ হবে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিটি মানুষের একটি ডিজিটাল পরিচয়পত্র যদি বাধ্যতামূলক করা যায়, এবং সেই পরিচয়পত্রের উল্লেখ করা বা তার মাধ্যমেই যদি প্রতিটি লেনদেন করাতে যদি নাগরিকদের বাধ্য করানো যায়, তাহলে যদি দেশে কখনও কোনও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়, তাহলে সরকারের কাছে যেকোনও মুহূর্তে সমস্ত মানুষকে নিজের হাতের পুতুল বানানোর ক্ষমতা থাকবে। আজকে মণিপুরে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, সরকার সেখানে ইন্টারনেট বন্ধ রেখেছে। তাহলে সেখানকার মানুষজন কীভাবে সাধারণ দৈনন্দিন কেনাকাটা করছেন? পাকিস্তানে এবং কানাডাতেও কিছুদিন আগে এইভাবে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ দমন করতে, ডিজিটাল লেনদেন বন্ধ করা হয়েছিল। আগামীদিনে আমাদের দেশেও যে এই রকম কোনও পদ্ধতি নেওয়া হবে না, তা কি জোর গলায় বলা যায়? সুতরাং, যারা বলছেন এই ২০০০ টাকার নোট বন্ধ করাতে চিন্তার কোনও কারণ নেই, তারা কি এই বিপদটা বুঝতে পারছেন? ২০০০ টাকার নোট বন্ধ হলে বা সেই অর্থে যেকোনও টাকা বন্ধ হলে, আগামীতে সাধারণ মানুষের সমূহ বিপদ, তা যদি এখনও না বোঝা যায়, তাহলে আর কবে বোঝা যাবে?