Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রাজ্যে প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ এবং আইনি মারপ্যাঁচ

সুজন ভট্টাচার্য

 

 

 



প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক

 

 

 

এখনও পর্যন্ত সবথেকে বেশি আলোড়ন উঠেছে, ২০১৬ সালের প্রাইমারি নিয়োগ নিয়ে। কারণ জাস্টিস অভিজিৎ গাঙ্গুলী প্রায় গোটা প্যানেলটাকেই বাতিল করে দিয়েছেন, আইন না মেনে নিয়োগের কারণে। প্রথমে সংখ্যাটা ছিল ৩৬০০০। পরে তা সংশোধন করে ৩২০০০ করা হয়েছে। এতবড় সংখ্যায় চাকরি বাতিল হলে আলোড়ন তো পড়বেই। বিশেষ করে যাদের চাকরি বাতিল হল, তারা যখন প্রায় সাত বছর কাজ করে যাচ্ছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই মানবিকতার দোহাই পাড়তে শুরু করেছিলেন। এই রায় কতদূর বিবেচনাপ্রসূত, কেউ কেউ আবার সেই প্রশ্নও তুলেছেন। পরবর্তীকালে মামলাটি ডিভিশন বেঞ্চেও ঘুরে বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে।

পশ্চিমবঙ্গের সরকারপোষিত স্কুলগুলোতে নিয়োগের প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরেই তীব্র নাটকীয় সমস্ত ঘটনা একের পর এক অভিনীত হয়ে চলেছে। একদিকে রাস্তায় চলছে ‘যোগ্য অথচ বঞ্চিত’ প্রার্থীদের ধর্না। অন্যদিকে হাইকোর্টের চত্ত্বরে চলছে একটার পর একটা মামলা। আর সেই সূত্রে জেলে চলে গেছেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী সহ বিবিধ পর্ষদের কর্তাব্যক্তিরা। সব মিলিয়ে এমন একটা সন্দেহ কারও কারও মনে দেখা দিয়েছে, আদৌ কি একজনও যোগ্য প্রার্থী স্কুলের প্রবেশপত্র পেয়েছেন! নাকি সকলেই বিশেষভাবে অনুগৃহীত? এমন একটা সন্দেহের বাতাবরণে আর যাই হোক স্কুলশিক্ষার পরিবেশ ভাল থাকতে পারে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, ঠিক সেটাই ঘটেছে।

এখনও পর্যন্ত সবথেকে বেশি আলোড়ন উঠেছে, ২০১৬ সালের প্রাইমারি নিয়োগ নিয়ে। কারণ জাস্টিস অভিজিৎ গাঙ্গুলী প্রায় গোটা প্যানেলটাকেই বাতিল করে দিয়েছেন, আইন না মেনে নিয়োগের কারণে। প্রথমে সংখ্যাটা ছিল ৩৬০০০। পরে তা সংশোধন করে ৩২০০০ করা হয়েছে। এতবড় সংখ্যায় চাকরি বাতিল হলে আলোড়ন তো পড়বেই। বিশেষ করে যাদের চাকরি বাতিল হল, তারা যখন প্রায় সাত বছর কাজ করে যাচ্ছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই মানবিকতার দোহাই পাড়তে শুরু করেছিলেন। এই রায় কতদূর বিবেচনাপ্রসূত, কেউ কেউ আবার সেই প্রশ্নও তুলেছেন। পরবর্তীকালে মামলাটি ডিভিশন বেঞ্চেও ঘুরে বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে। আপাতত জাস্টিস গাঙ্গুলীর রায় নিয়েই আলোচনাকরা যাক।

আলোচ্য রায় এসেছে WPA 21187 of 2022 মামলার সূত্রে। মামলাটির আবেদনকারী ছিলেন ১৪০ জন, যারা সকলেই ২০১৬ সালের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন এবং চাকরি পাননি। তাঁদের মূল বক্তব্যই ছিল ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়া আইন মেনে হয়নি। কাজেই সেই মামলার বিচার্য ছিল এই প্রশ্নটিই। তারই পরিপ্রেক্ষিতে রায় দিয়েছেন মাননীয় বিচারপতি। কী রায়?

রায়ে বলা হয়েছে ‘…the Board has violated the law declared by the Supreme Court and has committed extreme illegality’। অর্থাৎ ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়া আইন মেনে হয়নি। কেন? তার বিশ্লেষণও বিচারপতি করেছেন। কী বলেছেন?

১। রিক্রুটমেন্ট রুলসে বলা থাকলেও কোনও সিলেকশন কমিটি গড়া হয়নি। পরিবর্তে বাইরের একটি সংস্থাকে সেই দায়িত্ব দিয়ে তাকে বোর্ডের ‘কনফিডেনশিয়াল সেকশন’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

২। অ্যাপটিচুড টেস্ট ও ইন্টারভিউয়ের জন্য কোনও পরীক্ষককেই লিখিতভাবে নিয়োগ করা হয়নি। ফোনেই তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

৩/ অ্যাপটিচিউড টেস্টের জন্য কোনও গাইড লাইন দেওয়া হয়নি।

৪/ অ্যাপটিচুড টেস্টে পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ৩০ জন পরীক্ষকের জবানবন্দী নিয়েছেন স্বয়ং বিচারপতি। এদের মধ্যে ১৮ জন বলেছেন অ্যাপটিচুড টেস্ট হয়নি বা হবার কথা বোর্ড থেকে জানানো হয়নি। ৩ জন বলেছেন অ্যাপটিচুড টেস্ট হয়েছে। ৫ জন বলেছেন অ্যাপটিচুড টেস্ট হলেও তার জন্য কোনও গাইড লাইন বা পৃথক নাম্বারের ব্যবস্থা ছিল না। ১ জন বলেছেন অ্যাপটিচুড টেস্ট হয়েছিল এবং তার গাইডলাইনও ছিল। তার কাছে অ্যাপ্টিচুড মানে শিক্ষকের ‘Confidence and body language’। ১ জন জানিয়েছেন অ্যাপটিচুড টেস্টের অর্থই তার কাছে বোধগম্য নয়। একজনের বক্তব্য বিচারপতি বিবেচনায় আনেননি। অর্থাৎ ৩০ জন পরীক্ষকের মধ্যে ২৩ জন বাস্তবত অ্যাপটিচুড টেস্ট পৃথকভাবে না হওয়া কিংবা তার জন্য পৃথক নাম্বার না থাকার কথা জানিয়েছেন। কাজেই অ্যাপটিচুড টেস্টের নামে প্রার্থীদের যে নাম্বার দেওয়া হয়েছে তা বেআইনি এবং মিথ্যে।

৫/ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রার্থীদের বেছে নেবার জন্য মোট ৩০ নম্বরের ঘোষিত মাপকাঠি ছিল। এর মধ্যে ২০ নম্বর ইন্টারভিউয়ের আগেই সুনির্দিষ্ট। সেই ঘোষিত মাপকাঠি হল –

মাধ্যমিক – প্রাপ্ত নম্বরের শতাংশের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ৫,

উচ্চ মাধ্যমিক – প্রাপ্ত নম্বরের শতাংশের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ১০,

টেট – প্রাপ্ত নম্বরের শতাংশের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ৫

এর সঙ্গে যুক্ত হবে ইন্টারভিউ ও অ্যাপটিচুড টেস্ট মিলিয়ে ১০।

বিচারপতি গাঙ্গুলী নাম না করেই একজন নিযুক্ত প্রার্থীর উদাহরণ দিয়েছেন তার মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে মার্কস ১.৪৬২ (অর্থাৎ মাধ্যমিকের প্রাপ্ত নম্বর ২৯.২৪%), উচ্চ মাধ্যমিকে ৩.০৫০ (অর্থাৎ উচ্চ মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বর ৩০.৫০%), টেট পরীক্ষার সূত্রে ২.৮৬৬ (অর্থাৎ টেটের নম্বর ছিল ৫৭.৩২)। বোঝাই যাচ্ছে আলোচ্য প্রার্থী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক কোনওরকমে পার করেছেন। তুলনায় তাঁর টেট পরীক্ষার নম্বর অনেক ভদ্রস্থ। সে অবশ্য হতেই পারে। যাই হোক,  ইন্টারভিউয়ে ডাক পাবার আগে তার প্রাপ্ত মার্কস ছিল ৭.৩৭৮ অর্থাৎ ৩৬.৮৯%। সেই নিযুক্ত প্রার্থীর ইন্টারভিউ ও অ্যাপটিচুড টেস্ট সূত্রে নাম্বার ছিল ৯.৫ অর্থাৎ ৯৫%। তার মোট নাম্বার হয়ে গেল ১৬.৮৭৮ অর্থাৎ ৫৬.২৬%।

বিশেষ কারও ক্ষেত্রে এমনটা হতেই পারে, অন্তত তর্কের খাতিরে। একদা তিনি হয়তো নানা কারণে পড়াশুনোয় মন দিতে পারেননি। এখন অর্থাৎ ২০১৬ সালে সামলে নিয়েছেন। তবে সেই ব্যতিক্রম কখনওই হাজারে হাজারে হতে পারে না। তাই যদি হয়, তাহলে অনুসিদ্ধান্ত চলে আসবে, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে যারা ফেল করেছিলেন, তাদের যোগ্যতা আরও বেশি হতেই পারে। ব্যাপারটা সেক্ষেত্রে আরও ঘুলিয়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, ২০১৬ সালের প্রার্থীদের  নম্বর বিভাজন সহ যে তালিকা হাই কোর্টের নির্দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করতে বাধ্য হলেন, তাতে দেখা যাচ্ছে এমন ব্যতিক্রমীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর সন্দেহের বীজ লুকিয়ে আছে এখানেই। যাই হোক, আমরা আবার রায়ের প্রসঙ্গে আসি।

৬/ আস্টিস গাঙ্গুলী তাঁর রায়ে আরও বেশকিছু নিযুক্ত প্রার্থীর নাম ধরে ধরে এই গরমিল নিয়ে আলোচনা করেছেন।

৭/ স্পষ্টভাষাতেই লিখেছেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে SC/ST/OBC সংরক্ষণের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়নি।

এক্ষেত্রে বোর্ডের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবত বোর্ডই এক্ষেত্রে এক ও একমাত্র কর্তৃপক্ষ। তাদের ভূমিকাও যে স্বচ্ছ ছিল না, সেই কথাও রায়ে লিখেছেন বিচারপতি। তাহলে দেখাই যাক, কোন কোন অস্বচ্ছতার কথা তিনি বলেছেন।

১। আদালত নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও বোর্ড এফিডেবিট-ইন-অপোজিশনে সংরক্ষিত ক্ষেত্রগুলোতে (SC/ST/OBC)  সর্বনিম্ন স্থানে নিযুক্ত প্রার্থীদের নাম্বার জানায়নি যা আসলে সত্য লুকিয়ে রাখার প্রয়াস।

২। যারা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং টেট সূত্রে খুব কম নম্বর পেয়েছেন, তারাই কীভাবে ইন্টারভিউয়ে ৯.৫ বা ১০ পেয়ে গেলেন, সেই প্রশ্নেরও কোনও জবাব বোর্ড দেয়নি।

৩। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বোর্ড স্থানীয় ক্লাবের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে এবং প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বিক্রি করা হয়েছে।

৪। নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুর্নীতির অভিযোগের প্রসঙ্গে বোর্ড এফিডেবিট-ইন-অপোজিশনে কোনও স্পষ্ট কথা না বলে আইনের সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা করে গেছে।

৫/ বোর্ড তার এফিডেবিট-ইন-অপোজিশনে নিয়োগ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ বা বাস্তব তথ্য প্রসঙ্গে উচ্চবাচ্য করেনি।

অর্থাৎ নিয়োগের ক্ষেত্রে যাই হোক, মামলা চলাকালীন সময়েও বোর্ডের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিচারপতি। সেই অভিযোগের দায় তো বোর্ডকেই নিতে হবে। এখনও পর্যন্ত বোর্ডের তরফে তেমন কোনও স্বচ্ছ বক্তব্য শোনা যায়নি। আলোচ্য মামলার বিচার্য ছিল ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়া আইনানুগ ছিল কিনা। আলোচ্য বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতেই বিচারপতি রায় দিয়েছেন সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া আইনানুগ ছিল না। তাহলে যারা চাকরি পেয়ে গেলেন, তাদের কী হবে? যে নিয়োগ প্রক্রিয়া ছিল বেআইনি, স্বভাবতই তার মাধ্যমে হওয়া প্রতিটি নিয়োগই বেআইনি। তাহলে বিচারপতি তাদের চাকরিতে বহাল রাখার কথা বলবেন কীভাবে? বলতে পারেন না এবং বলেনওনি। তাই তাঁর রায় –

১/ আগামী চার মাস এরা প্রত্যেকেই চাকরিতে বহাল থাকবেন এবং প্যারা টিচারের সমান মাইনে পাবেন।

২/ বোর্ডকে ৩ মাসের মধ্যে নতুন করে ইন্টারভিউ ও অ্যাপটিচুড টেস্টের ব্যবস্থা করে নতুনভাবে প্যানেল প্রকাশ করতে হবে। ২০১৬ সালের ইন্টারভিউ প্রক্রিয়ায় যারা অংশ নিয়েছিলেন, কেবলমাত্র তারাই তাতে অংশ নিতে পারবেন। অন্য কেউ সুযোগ পাবেন না।

৩/ বয়সের উর্ধসীমা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

৪/ বেআইনিভাবে নিযুক্তরা যদি নতুনভাবে ইন্টারভিউ ও অ্যাপটিচুড টেস্টে উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগের জন্য মনোনীত হন, তাদের চাকরির ছেদ পড়বে না।

এমন নয় যে পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথম কোনও প্যানেল বাতিল হল। সম্প্রতি আরও দুয়েকটি ক্ষেত্রে এমন হয়েছে। যে নিয়োগ প্রক্রিয়াই স্বচ্ছ ও আইনানুগ নয়, তাতে যারা নিযুক্ত হয়েছেন, সকলেই সেই বেআইনি কারবারের সুবিধাপ্রাপ্ত। ফলে তাদের সেই বেআইনি সুবিধা বাজেয়াপ্ত করাই কোর্টের কাজ। কেউ কেউ বলছেন, দায় তো বোর্ডের। এদের কেন ক্ষতি করা হবে! এমন সেন্টিমেন্টাল মেলোড্রামা সিনেমায় চলে, বাস্তবে নয়। যারা বেআইনি সুবিধা পেয়েছেন, তারা প্রত্যেকে একজন করে যোগ্যতর প্রার্থীকে বঞ্চিত করেছেন। সেই দায় কে নেবে?

অনেকেই বলছেন, এরা তো ইতিমধ্যেই ট্রেনিং সেরে ফেলেছেন। তাহলে আর অযোগ্য হবেন কীভাবে? বিচারপতি এই প্রসঙ্গে নিয়োগ আইনের উল্লেখ করলেও আর অগ্রসর হননি। রিক্রুটমেন্ট রুলসে বলা আছে, “In the matter of appointment, priority shall be given to those eligible candidates who possess the minimum qualifications as specified by the National Council for Teacher Education and MHRD and thereafter, the eligible candidates with the relaxed qualification specified by the MHRD, may be considered…”।  অর্থাৎ উপযুক্ত সংখ্যায় প্রশিক্ষিত প্রার্থী না থাকলে তবেই অপ্রশিক্ষিতদের সুযোগ আসবে। এটাও ঘটনা, ২০১৬ সালে প্রশিক্ষিত পার্থীর সংখ্যা আজকের তুলনায় কমই ছিল। কিন্তু তার মানে কি ৪২ হাজারের মধ্যে প্রশিক্ষিত প্রার্থী ছিলেন মাত্র হাজারদশেক? আর একজনও প্রশিক্ষিত প্রার্থী পড়ে নেই? এই উত্তরটা কিন্তু খুব জরুরি এই বিষয়ে পরে আসছি। তার আগে ডিভিশন বেঞ্চের রায়টা একবার দেখে নিই।

মিডিয়া বড় বড় করে লিখে যাচ্ছে, ৩২০০০ চাকরি বাতিলের উপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন ডিভিশন বেঞ্চ। অবশ্যই দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত। তার মানে বিষয়টা ঝুলেই রইল। আর হ্যাঁ, যতটুকু বুঝলাম, বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলীর মূল রায় কিন্তু ডিভিশন বেঞ্চ অপরিবর্তিত রেখেছেন। তার মানে ২০১৬ সালের প্রাথমিকের অপ্রশিক্ষিতদের নিয়োগ যে আইন মেনে হয়নি, সিঙ্গল বেঞ্চের সেই রায়ে ডিভিশন বেঞ্চ সহমত। এমনকি, সিঙ্গল বেঞ্চের নির্দেশ মতো নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করে তিন মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে।

সিঙ্গল বেঞ্চের রায় ছিল, বর্তমানের চাকরিরতরা যদি যদি নতুন প্রক্রিয়াতেও যোগ্য বলে বিবেচিত হন, তাদের চাকরি জীবনে কোনও ছেদ আসবে না। আর যারা বিবেচনায় আসবেন না, তাদের চাকরি যাবে। তবে মাঝের সময়টুকু তারা প্যারাটিচারের সমান মাইনে পাবেন। ডিভিশন বেঞ্চ স্রেফ মাইনের অংশটুকুই সংশোধন করেছেন। তারা চলতি হারেই মাইনে পাবেন। তাহলে কি তাদের চাকরি জীবন অব্যাহত থাকবে? এখানেই আসল রহস্য। দেখাই যাক।

ডিভিশন বেঞ্চও রায় দিয়েছেন, আবার নতুন করে ইন্টারভিউ ও অ্যাপ্টিচুড টেস্ট হবে। তার ভিত্তিতেই নতুন প্যানেল প্রকাশিত হবে। ইতিমধ্যেই যারা চাকরি করছেন, তাদের মধ্যে যদি কেউ নতুন প্যানেলে জায়গা না পান, কী হবে? ডিভিশন বেঞ্চ পরবর্তী শুনানিতে সেই বিষয়ে রায় দেবেন। কিন্তু নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করার নির্দেশের অর্থই হল আগের প্রক্রিয়া বাতিল হয়ে যাওয়া। অতএব, চাকরি চলে যাওয়াটাই সম্ভাব্য পরিণতি। তাহলে ডিভিশন বেঞ্চে কতদিনের রিলিফ পাওয়া গেল? চার মাসের। সেক্ষেত্রে ডিভিশন বেঞ্চে এদের মার্সি প্লিড করতে হবে, মানবিক কারণ দেখিয়ে।

এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই, সকলেই ঘুরপথে চাকরি পেয়েছিলেন। কেউ কেউ নিশ্চয়ই নিজের যোগ্যতাতেই চাকরি পেয়েছিলেন। তাদের সুরক্ষার কথাও ভাবা দরকার। ২০১৬ সালে নিযুক্ত কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রত্যেকেরই অ্যাকাডেমিক স্কোর ৭০%-এর বেশি। অথচ ইন্টারভিউ ও অ্যাপটিচুড টেস্টে ( যা আদৌ হয়নি বলে কোর্ট রায় দিয়েছেন) ৪০% বা তারও কম। উল্টোদিকে সিঙ্গল বেঞ্চের রায়েই দেখা গেছে বিপরীত চিত্রটাও প্রচুর। অর্থাৎ অ্যাকাডেমিক স্কোর ৪০% বা তার কম আর ইন্টারভিউয়ে ১০০%। নতুন করে ইন্টারভিউ আর অ্যাপ্টিচুড টেস্ট হলেও এই জালিয়াতির রাস্তা কতদূর বন্ধ হবে, সন্দেহ আছে। হ্যাঁ, আদালতের নির্দেশে ভিডিওগ্রাফি হওয়ার পরেও।

এদের কাছে আমার পরামর্শ ছিল, ডিভিশন বেঞ্চে পার্টি হও। প্রেয়ার দাও, In relaxation to recruitment rules, proportionate score be given to cadidates on the basis of their academic score (Madhyamik out of 5 + HS out of 10 + TET score out of 5)। না, আমার এই প্রস্তাবে একজনও সহমত হননি। কেন, তারাই জানেন। তারা এখন সুপ্রিম কোর্টের ভরসায় বসে আছেন। বিভিন্ন পর্যায়ের আদালতের দ্বারস্থ হবার অধিকার সকলেরই আছে। কিন্তু একটা বিষয় ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। এরা সকলেই বোর্ডের কথামতোই চলছেন। উদ্দেশ্য কী, জানা নেই। আবার কেউ কেউ বলছেন, আমি বা আমরা কিন্তু অ্যাপটিচুড টেস্ট দিয়েছি। পর্ষদও তেমনটাই দাবি করেছে ডিভিশন বেঞ্চে। এবং ডিভিশন বেঞ্চও মৌখিকভাবে সেই নিয়ে কোনও সন্দেহ প্রকাশ করেননি। তবে মূল রায়ে অবশ্য নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করার কথা বলা হয়েছে। তাহলে এই প্রশ্নটাকেই একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।

সিঙ্গল বেঞ্চ পরিস্কার ভাষায় বলেছেন, ইন্টারভিউয়ারদের বোর্ড কোনও লিখিত নিয়োগপত্র দেয়নি।  SMS করেই তলব করা হয়েছিল। সঙ্গত প্রশ্ন হল, SMSগুলো কোন কোন নাম্বার থেকে করা হয়েছিল? সেগুলো কি বোর্ডের নামেই নেওয়া? বোর্ডের নামে নেওয়া হলে ১০ সংখ্যার নাম্বার হবে না। শুরুতে তিনটি বা চারটি অক্ষর থাকবে। তারপরে চারটি সংখ্যা। এই বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি তেমনটা না হয়ে থাকে, তাহলে পরীক্ষকদের নিয়োগটাও বেআইনি। সেই সূত্রে তাদের দেওয়া নাম্বারও। আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, যেসব নাম্বার থেকে SMS গেছে, প্রার্থী এবং ইন্টারভিউয়ারদের কাছে, সেই মোবাইলগুলো কাদের! বোর্ডের সাথে তাদের কী সম্পর্ক? বোর্ড কি তাদের এই অধিকার দিয়েছিল? এই বিষয়টাকে জোর দিলে কিন্তু গোটা প্রক্রিয়াটাই বাতিল হয়ে যেতে পারে। সম্ভবত সেই কারণেই এই আর ঘাঁটাতে চাননি।

শুনানি চলাকালীন জাস্টিস গাঙ্গুলী বোর্ডকে একবার প্রশ্ন করেছিলেন, প্রার্থীর সংখ্যা আর ইন্টারভিউয়ের সময়ের অনুপাত নিয়ে। সোয়া লক্ষের মত প্রার্থীর ইন্টারভিউ হয়েছিল। ইন্টারভিউ আর অ্যাপটিচুড টেস্টের জন্য ন্যূনতম ২০ মিনিট ধরলে সময় লাগবে প্রায় ৪২,০০০ ঘন্টা। মোট ২০টা জেলায় নিয়োগ হয়েছিল। মানে গড়ে জেলাপ্রতি গড়ে ২১০০ ঘন্টা। পারবেন তো বোর্ড সেই টাইম স্প্যান প্রমাণ করতে? কিন্তু এই বিষয়ে কোনও পক্ষই বিশেষ কোনও কথা বলেননি। কেন, তারাই জানেন। সম্ভবত ইন্টারভিউ আর অ্যাপটিচুড টেস্ট কেমন হয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে। আর একমাত্র এভাবেই আসল রহস্যের সমাধান হতে পারে।