প্রবীর মুখোপাধ্যায়
প্রাবন্ধিক, শিক্ষক
বিনায়ক সাভারকরের জন্মদিনেই নতুন পার্লামেন্ট ভবনে দ্বারোদ্ঘাটন – অবাক হবার কিছু আছে কি? মনে থাকা দরকার ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এই তারিখেই শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন
পার্লামেন্টের নতুন ভবন উদ্বোধন হবে ২৮ মে তারিখে। ওই তারিখকেই কেন বেছে নেওয়া হল? কারণ ঐ তারিখেই জন্মেছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর – ভারতের রাজনীতিতে যিনি দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা। আর কে না জানে ঐ সাভারকরই আজকের সঙ্ঘ পরিবারের তাত্ত্বিক গুরু ও পথপ্রদর্শক।
১৯৩৭ সালে আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে সাভারকর বললেন: “এখন যেমন দেখা যাচ্ছে ভারতে দুটি পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন জাতি পাশপাশি বাস করছে …… আসুন আমরা সাহসিকতার সঙ্গে স্বীকার করি এই অপ্রিয় সত্য যে ভারতকে আজ ঐক্যবদ্ধ ও সমসত্ত্ব এক জাতি হিসাবে গণ্য করা যায় না, বরং বিপরীত দৃষ্টিতে দেখতে গেলে এখানে প্রধানত দুটি জাতি আছে: হিন্দু এবং মুসলিম।”
সাভারকরের এই বাণীর প্রতিধ্বনি করে ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র দাবি করল। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন অংশে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হল, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনে বিভাজন হল এবং ব্রিটিশ সরকার এর সুযোগ নিয়ে লক্ষ লক্ষ মৃতদেহ আর গৃহহারা মানুষের ওপর দিয়ে দেশকে দু-টুকরো করে দেশভাগ চাপিয়ে দিল। কিন্তু ভারতের জনগণের ব্যাপকতর অংশ এত সব ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও জাত-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষ সকল ভারতবাসীর জন্য ধর্মনিরপেক্ষ এক সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থার সূচনা করল।
এই ব্যবস্থার সূচনাকালেই প্রথম আঘাত এল কট্টরপন্থী ধর্মান্ধদের কাছ থেকে মহাত্মা গান্ধিকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। হত্যাকারী নাথুরাম গডসে সাভারকরের নিষ্ঠাবান অনুগামী – এ সত্য সর্বজনস্বীকৃত। এই হত্যাকাণ্ডে স্বয়ং সাভারকর অন্যতম অভিযুক্ত থাকলেও তার বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থিত না করায় আদালতের বিচারে সন্দেহের অবকাশে তিনি ছাড়া পেয়ে যান। কিন্তু জনতার বিশ্বাস অন্যরকম ছিল বলে সুদূর দিল্লিতে গান্ধিজীর হত্যাকাণ্ডের খবর প্রচারিত হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বোম্বাইতে জনরোষ আছড়ে পড়ে সাভারকরের বাসভবন ‘সাভারকর সদন’-এ। পুলিশ এসে সাভারকরকে তখন রক্ষা করলেও কয়েকদিন বাদে গ্রেপ্তার করে। আর এর অনেক পরে গান্ধি হত্যা ষড়যন্ত্রের তদন্তে গঠিত জীবনলাল কাপুর কমিশন সব সাক্ষ্য প্রমাণ বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করে সাভারকরকে অন্যতম দোষী হিসাবে নিশ্চিতরূপে চিহ্ণিত করে। এই রায় প্রকাশিত হবার আগে আগেই সংবাদ মাধ্যমে যখন সাভারকরের অপরাধ প্রমাণিত বলে কথা উঠতে আরম্ভ করেছে তখন সাভারকর অন্ন-জল ত্যাগ করে কয়েকদিনের মধ্যে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন।
সেই বিনায়ক সাভারকরের জন্মদিনেই নতুন পার্লামেন্ট ভবনে দ্বারোদ্ঘাটন – অবাক হবার কিছু আছে কি? মনে থাকা দরকার ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এই তারিখেই শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন।
এবার আরেকটা দিকে নজর দেওয়া যাক। আমাদের সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থার উৎস ও কেন্দ্রস্থল হচ্ছে পার্লামেন্ট। রাষ্ট্রপতি, রাজ্যসভা এবং লোকসভাকে নিয়ে গঠিত এই পার্লামেন্ট। এবং এর ক্রমতালিকায় রাষ্ট্রপতির পরেই রাজ্যসভা, লোকসভার স্থান তৃতীয়। সেই কারণে রাজ্যসভাকে পার্লামেন্টের উচ্চতর কক্ষ বা Upper House আর লোকসভাকে নিম্নতর কক্ষ বা Lower House বলা হয়। কিন্তু এই ভবন উদ্ঘাটনের আমন্ত্রণলিপিতে রাজ্যসভার কোনও উল্লেখমাত্র নেই। লোকসভার সেক্রেটারি-জেনারেল আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন অনুষ্ঠানে যেখানে এই ভবন জাতির উদ্দেশ্যে সমর্পণ করবেন প্রধানমন্ত্রী লোকসভার স্পিকারের উপস্থিতিতে। পার্লামেন্ট থেকে কী রাজ্যসভার অবলুপ্তি ঘটল?
প্রোটোকল অনুসারে রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে বা অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি তাঁর সব কাজের দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। ভারতে নির্মিত প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ আইএনএস বিক্রান্ত নৌবাহিনীতে যোগ দিল। সংবিধান অনুসারে ভারতের রাষ্ট্রপতি সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ প্রধান। কিন্তু ২ সেপ্টেম্বর ২০২২ বিক্রান্ত-এর নৌবাহিনীতে আনুষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তির এই অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন না, এমন কি উপরাষ্ট্রপতিও ছিলেন না, ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আবার, এই ঘটনার মাত্র ছ’দিন পরেই, ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে ইন্ডিয়া গেটে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের মুর্তির আবরণ উন্মোচনও করেন প্রধানমন্ত্রী। নেতাজির মতন মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এই অনুষ্ঠান রাষ্ট্রপতির দ্বারাই হওয়া উচিত ছিল না কি?
আসলে ভারতের রাজনীতিতে আজকের জমানায় কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত বোঝা খুবই মুশকিল। সংখ্যাগুরুত্বের জোর দেখিয়ে, ধর্মের দোহাই দিয়ে, পেশিশক্তির আস্ফালনে আর প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ‘যা-ইচ্ছে-তাই’ করে চলেছে শাসকদল। সুতরাং নেতার ‘ইমেজ বিল্ডিং’-এর এই কাজ ততক্ষণ চলতে থাকবে যতক্ষণ না সচেতন জনগণ এই সব অ-কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সে দিন কত দূরে কে জানে!
প্রসঙ্গত, প্রধান বিরোধী কংগ্রেস-সহ কুড়িটি রাজনৈতিক দল সেন্ট্রাল ভিস্টা-র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ উদ্বোধনে তিরিশ শতাংশ উপস্থিতি কম থাকার সম্ভাবনা। তা সত্ত্বেও, বিজেডি, অকালি দল ইত্যাদি জোটসঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একক প্রদর্শনী ম্লান হওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। পরিতাপের বিষয়, নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে সংসদীয় রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে একজন একনায়কের উত্থান আমরা প্রত্যক্ষ করব।