তথাগত দাশমজুমদার
পঁচিশ লক্ষ বছর আগে, দক্ষিণ আফ্রিকা, দিনালেদি নদীর উপত্যকা
মাহর প্রসবকাল আসন্ন, তাই তাকে আর খাদ্যসংগ্রহে যেতে হয় না। গোষ্ঠীবদ্ধ জীব হওয়ার এই একটা বড় সুবিধা, তার ওপর আবার মাহ দলপতির সঙ্গিনী, তাই আগত শিশু এবং শিশুর মায়ের খাদ্যাভাব হয় না। একটা পাথরের ছায়ায় ডিসেম্বরের অসহনীয় গরম থেকে তাই নিজেকে রক্ষা করছিল মাহ। গোষ্ঠীর প্রায় সকলেই খাদ্যসংগ্রহে গেছে, কিছু শিশু আর সদ্যমাতা ছাড়া কেউ নেই আশেপাশে। মাহরা যে রক আউটক্রপটার ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিল, তার ঠিক পেছনে আরেকজন মা তার বাচ্চাদের জন্য শিকারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
এই দু’পেয়ে লেজকাটা বাঁদরগুলোকে শিকার করা সবচেয়ে সোজা যদি না এদের দলটা বড় হয়। অসুবিধা হয় তখনই যখন এরা জাদুবলে দূর থেকে নিজেদের থাবা ছুঁড়ে দেয় বা সরু লম্বা থাবা দিয়ে খোঁচাতে আসে। আজ সুবর্ণ সুযোগ, এদের দলের একটা বড় অংশ কোথায় একটা গেছে, এই সুযোগে একটা বাচ্চাকে যদি শিকার করে আনা যায় তাহলে দিনদুয়েকের জন্য মা সেবারটুথের চিন্তার অবসান হয়।
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, জোহানেসবার্গের অদূরে
রিক আর স্টিফেন অনেকক্ষণ ধরে ঘুরতে ঘুরতে রক আউটক্রপটার তলায় এসে বসেছিল।
“আজকের দিনটা মনে হয় বৃথাই গেল, একটা গুহা পেলাম না যেটা ইন্টারেস্টিং…”
ওয়াটার বটলটাকে গলায় উপুড় করে দিয়ে বলল রিক।
“যা বলেছ, পেড্রো বলেছিল ১২৭ আওয়ার্স সিনেমায় দেখানো গুহার মতো গুহা পাওয়া যাবে এখানে যা নাকি রাইজিং স্টার কেভ সিস্টেমের অংশ, কিন্তু কোথায় কী?”
হাতের লাঠিটা দিয়ে সামনের ধুলোয় আঁকিবুকি কাটতে কাটতে উত্তর দিল স্টিফেন।
রিক বলল–
“স্টিভ, এক কাজ করি চলো, একটু বিশ্রাম নিয়ে এই আউটক্রপটার ওপরে উঠে চারদিকটা শেষবারের মতো সার্ভে করে নিই, যদি কিছু নজরে আসে…”
স্টিফেন বলল,
“হুম, ঠিক বলেছ, আরেকটু বসে নিলে হয় না? যা গরম… একটা বিয়ার দাও তো…”
ঘণ্টাখানেক পরে দুই ক্লান্ত অ্যামেচার কেভার রক আউটক্রপটার ওপরে উঠে দেখল ওপর থেকে একটা গর্ত নিচে নেমে গেছে। আনন্দে লাফিয়ে উঠল দুজনে, এখানে এরকম একটা গুহা আছে বলে তো জানা ছিল না।
পঁচিশ লক্ষ বছর আগে, দক্ষিণ আফ্রিকা, দিনালেদি নদীর উপত্যকা
মাহরা এই রক আউটক্রপটার ছায়াতে বাস করে একটা বিশেষ কারণে। গাছে রাত্রিবাস করলে যদিও বিপদের সম্ভাবনা কম থাকে, কিন্তু ফল পাড়া ছাড়া শাখামৃগবৃত্তি তারা আর তেমন করে না, যদিও মাটির সাথে গাছেও তারা সমানভাবে স্বচ্ছন্দ। মা সেবারটুথের লক্ষ্য এখন মাহর মধ্যম সন্তান সেথের দিকে স্থির। সেথ তখন একটা কাঠি মুখে নিয়ে চুষছিল, লালায় ভিজে গেলে সেটা সে ঢোকাবে উইঢিপির মধ্যে, উঠে আসবে স্বাদু পোকাগুলো।
আসন্ন মুখরোচক খাবারের লোভে সে বেশ অন্যমনস্ক। মা সেবারটুথ ঘাসের আড়ালে গুঁড়ি মেরে ততক্ষণে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে, মাহ যখন তাকে দেখতে পেল ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। মা সেবারটুথ সেথের গলা লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। গর্ভিনী মাহ হাতের কাছে থাকা পাথরটাকেই ছুঁড়ে দিল মা সেবারটুথের চোখটা লক্ষ করে। তার লক্ষ্য ভুল হয় না, লক্ষভেদে এই দক্ষতাই তার দলপতির প্রধান সঙ্গিনী হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ।
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, জোহানেসবার্গের অদূরে
দড়িদড়া বেয়ে কোনওরকমে নিচে নামল দুজনে, গুহার অভ্যন্তর বেশ অপ্রশস্ত আর ততোধিক অন্ধকার। স্টিফেন টর্চটা জ্বালিয়ে একটু ভাল করে দেখে নিতে চাইল চতুর্দিক। যা দেখল তাতে তার মনটা আনন্দে প্রায় নেচে উঠল, যে খাড়াই অংশটা বেয়ে তারা নেমেছে সেটাকে বড়জোর মুখ বলা চলে, গুহাটা এরপর ঢালু হয়ে মিশে গেছে গভীর অন্ধকারে।
রিক বলল–
“এগোবে নাকি?”
“এগোতে তো হবেই… আমার মনে হয় আগে গিয়ে এই গুহাটা মূল রাইজিং স্টার কেভ সিস্টেমের সাথে যুক্ত হয়েছে…”
“চলো, দেখি গিয়ে…”
বেশ কিছুটা এগোনোর পর তারা দেখল সামনে পাথুরে দেওয়াল। তারা হতাশ হয়ে ফিরেই আসত, যদি না রিকের নজর পড়ত দেওয়ালের একদম তলার একটা গর্তের দিকে, যার উচ্চতা বড়জোর দশ ইঞ্চি।
“যাবে নাকি?”
“যদি এটা ডেড এন্ড হয়?”
“এক কাজ করি চলো, আগে টর্চের আলো ফেলে দেখি?”
“ভালো আইডিয়া।”
টর্চের আলো আঁধারিতে গর্তটার অন্যদিকে আরেকটা বড়সড় চেম্বার আছে বলেই বোধ হল দু’জনের। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় দুই যুবকের রক্ত ততক্ষণে গরম হয়ে উঠেছে, তাদের মনে পড়ে যাচ্ছে ১২৭ ঘণ্টার কথা। কে জানে, অপর প্রান্তের চেম্বারে ১২৭ ঘণ্টার মতো কোনও ভার্জিন লেক আছে কিনা।
পঁচিশ লক্ষ বছর আগে, দক্ষিণ আফ্রিকা, দিনালেদি নদীর উপত্যকা
চোখের নিচে প্রবল আঘাত পেয়ে মা সেবারটুথ পিছু হঠল বটে, কিন্তু তার আগেই সেথের গলায় অতিবৃহৎ শ্বদন্তগুলো বসিয়ে দিয়েছিল। ততক্ষণে মাহর গোষ্ঠীতে প্রবল চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে, একটু বড় বাচ্চারা হাতে তুলে নিয়েছে গাছের ডাল, অন্যান্য গর্ভিনী মহিলাদের হাতেও উঠে এসেছে পাথর। পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানে যে একমাত্র বাধ্য না হলে সেবারটুথরা তাদের আক্রমণ করে না, কারণ তাদের কাছে যে আকাশের হলদে গোলক প্রদত্ত লাল ফুল আছে। তাই সেবারটুথ হয়ত আবার ফিরে আসবে।
সেথের মৃতদেহ ঘিরে বসে রইল একদল গর্ভিনী ও বাচ্চা, আজ আর ফল ও মধু সংগ্রহে যাওয়া হবে না, সৎকার করতে হবে যে।
এই সাভানার অন্য বাঁদরদের থেকে তারা এখানেই আলাদা। মৃত মানে মৃত নয় তাদের কাছে, মৃত মানে এক গভীর অন্ধকারের পথে যাত্রা, যে যাত্রার শেষে মৃতরা আকাশের হলুদ গোলকের পথে প্রার্থনা করে এমন এক দেশে পৌঁছয়, যেখানে শ্বাপদ নেই, রাত নেই।
ইতিমধ্যে গোষ্ঠীর বাকি নারী পুরুষেরা ফিরে এসেছে। আজকের দিনটা বেশ ভাল ছিল, শিকারের প্রয়োজন হয়নি, একটা হায়নার দলকে তাড়িয়ে তাদের শিকার করা মোষের মাংস খুব সহজেই জোগাড় করা গেছে।
কিন্তু আজ মহাভোজের দিন নয়, সেথকে অন্ধকারের পথে যাত্রা করাতে হবে যে।
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, জোহানেসবার্গের অদূরে
গুঁড়ি মেরে গর্তটার ভেতরে ঢুকে পড়ল দুজনে, প্রথমে রিক, তার পেছনে স্টিভেন। গর্তটা এতটাই অপ্রশস্ত যে হাতদুটোকে পর্যন্ত শরীরের পাশে রাখা যাচ্ছে না। একটা হাতকে সামনে এগিয়ে রাখতে হচ্ছে।
রিক মনে মনে হেসে বলল–
“স্টিভেন, কেমন যেন মনে হচ্ছে সুপারম্যানের স্টাইলে উড়ছি, এই গর্তটার নাম সুপারম্যানস ক্রস দিলে কেমন হয়?”
স্টিভেন বহু কষ্টে শরীরটাকে সামনের দিকে টানতে টানতে বলল–
“যা বলেছ…”
সামান্য এগোতেই দুজনে এসে পড়ল বেশ বড় একটা চেম্বারের মধ্যে। কিন্তু এ তো ফাঁকা, কিচ্ছু নেই। আবার হতাশা। এত কষ্ট করে শেষে এই?
এদিক ওদিক টর্চ ফেলে দেখা গেল যে সামনে একটা পাথুরে দেওয়াল ধাপে ধাপে ওপরে উঠে গেছে। রোগা রোগা চেহারার দুই দামাল দমল না। ড্র্যাগনের পিঠের মতো খাঁজকাটা দেওয়ালটার ওপরে ওঠা পর্যন্ত ওদের শান্তি নেই যে।
দেওয়ালটার একদম ওপরে আরেকটা গর্ত, গর্তের বদলে ক্র্যাক বলাই ভাল যেটা কিনা সোজা নিচে নেমে গেছে।
রিক বলল–
“এখানকার রক ফর্মেশনগুলো কিন্তু অসাধারণ, কিছু ছবি তুলে রাখতেই হবে। স্টিফেন, একটু ক্র্যাকটায় নেমে যাবে? তুমি যা রোগা, ক্র্যাকটায় নিশ্চয় ফিট করে যাবে।”
রিককে জায়গা করে দেওয়ার জন্য স্টিফেন একটু নিচে নেমে গেল। কিন্তু একি, পায়ের নিচে মাটি নেই যে। না পড়ে সে যাবে না, এতদিনের কেভিংয়ের অভিজ্ঞতায় সে জানে যে বড়জোর সাত ইঞ্চি চওড়া এই ক্র্যাকে নিজেকে কী করে স্থির রাখতে হয়। কিন্তু পায়ের নিচে মাটি না থাকার অর্থ একটাই, এই গুহার বিস্তার আরও অনেক বড়। স্টিভেন ঠিক করল আরেকটু নিচে গিয়ে দেখবে। রিককে সে কথা জানিয়ে তাই শরীরটাকে একটু একটু করে ছাড়তে শুরু করল সে। প্রায় চল্লিশ ফুট নিচে যাওয়ার পর গুহার তলদেশ খুঁজে পেল সে। টর্চের আলোতে চারিদিকটা দেখে সে রিককে উদ্দেশ্য করে বলল–
“রিক, এখানকার স্ট্যালাকটাইট ফর্মেশনগুলো আরও সুন্দর…”
তখনও সে জানে না যে গুহার মূল বিস্ময় কিন্তু মাথার ওপরে বা পাশের দেওয়ালে নয়, পায়ের নিচে।
পঁচিশ লক্ষ বছর আগে, দক্ষিণ আফ্রিকা, দিনালেদি নদীর উপত্যকা
সযত্নে লালিত লাল ফুলের অংশ শুকনো ডালের মুখে জন্ম দিল তার সন্তানের। আর সেই নতুন লাল ফুল মৃতকে নিয়ে যাবে অন্ধকারের পথে, যে পথ শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়ে যাবে হলুদ গোলকের দেশে। গোষ্ঠীপতি মাহস পথ দেখাল। পেছনে পেছনে আরও দুজন বহন করছে সেথের মৃতদেহ। তারও পেছনে লাল ফুল হাতে আরও একজন। মিছিলটা ধীরে ধীরে ঢুকে গেল গুহার অভ্যন্তরে। মাহ ও মাহসদের বহু পূর্বপুরুষের ব্যবহৃত এই পথ বড়ই দুর্গম। সাভানা তার সন্তানদের ছাড়তে চায় না যে, তাই হয়ত যাত্রাপথ এত দুর্গম। লাল ফুলের আলোয় আলোকিত গুহার অভ্যন্তরে তখন নীল ও সবুজ রঙের খেলা। প্রাচীন আত্মারা হাত বাড়াচ্ছে সেথকে কাছে টেনে নেওয়ার জন্য। সাভানা যেখানে ঝুঁকে পড়ে মৃতদের আটকানোর শেষ চেষ্টা করে, সেই অংশে তাদেরকে নত হতে হয়। প্রায় শুয়ে পড়ে বুক ঘষে এগোতে এগোতে সাভানার কাছে চাইতে হয় মৃতকে হলুদ গোলকের রাজ্যে পাঠাবার অনুমতি। এরপর আর তেমন বাধা নেই, মশালের আলোয় পূর্বপুরুষদের অনেক অনেক হাত যেন ডাকছে সেথকে। ওই তো, সামনেই যাত্রাপথের শেষ, পরলোকের দরজা, অন্ধকার সেই গর্তের মধ্যে মাহরা ধীরে ধীরে নামিয়ে দিল সেথের মৃতদেহ। সেথের দেহ যখন গভীর অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে, মাহসের চোখে তখন বাষ্পের আগমণ। সেথ যে মাহর সাথে সাথে মাহসেরও ছেলে।
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, জোহানেসবার্গের অদূরে
টর্চের আলো নিচে পড়ামাত্র চমকে উঠল স্টিভেন। এত হাড়!!!!! কিসের হাড় এগুলো? ভাবতে ভাবতেই স্টিভেনের চোখে পড়ল একটু দূরেই কার যেন চোয়ালের অংশ। স্টিভেন নৃতত্ত্ববিদ না হলেও বহুদিনের কেভিংয়ের অভিজ্ঞতা থেকে সে এটা অন্তত বোঝে যে এই চোয়ালটা সম্ভবত কোনও মনুষ্যজাতীয় প্রাণীর। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে গেল পেড্রোর কথা। স্টিভেন রিককে ডেকে বলল–
“এই ট্রিপটা বেশ লাভজনক হবে বলে মনে হয়, পেড্রো যা চেয়েছিল সেরকম অনেক ফসিল এখানে…”
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আরও চিত্তাকর্ষক। গুহা থেকে বেরিয়ে রিক আর স্টিভেন ফোন লাগাল পেড্রোকে। শখের ফসিল হান্টার পেড্রো দু’জনের তোলা ছবি দেখে এতটাই উত্তেজিত হয়ে হয়ে পড়ল যে রাত একটার সময় দৌড়ে গেল লি বার্জারের বাড়ি। জোর জোর ধাক্কা পড়ল বার্জারের দরজায়। বার্জার ঘুম থেকে উঠে কিছু বলার আগেই পেড্রো একটা ল্যাপটপের স্ক্রিন খুলে ধরল বার্জারের সামনে। স্ক্রিনের ছবিগুলো দেখে বার্জারের তো চক্ষু চড়কগাছ। এ তো প্রায় কমপ্লিট স্কেলিটন মনে হচ্ছে, সম্ভবত হোমো বা অস্ট্রালোপিথেকাসদের।
ক’দিন পরে বার্জার ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলেন। যার বয়ান অনেকটা এরকম–
“খ্যাংরাকাঠি অ্যানথ্রোপলজিস্ট চাই, যার ক্লস্টোফোবিয়া নেই”
তিপ্পান্নটা অ্যাপ্লিকেশন এসেছিল, যার মধ্যে থেকে সিলেক্ট করা ছ’জনই ছিল রোগাপাতলা চেহারার মহিলা। রোগাপাতলা না হলে যে গুহায় ঢোকাই যাবে না।
উপসংহার, আপাতত
এখন এটা মোটামুটি সবাই জানে যে মানব বিবর্তনের সূত্রপাত হয় মোটামুটি ষাট থেকে সত্তর লক্ষ বছর আগে যখন শিম্পাঞ্জী ও মানুষের পূর্বপুরুষরা আদিম কোনও এপ পূর্বপুরুষদের থেকে দুটো আলাদা পথে যেতে শুরু করে। এই ভাগ হয়ে যাওয়ার পর থেকে মানুষের পূর্বপুরুষরা দু’পায়ে চলার কৌশল আবিষ্কার করে আর শিম্পাঞ্জীদের পূর্বপুরুষরা বেছে নেয় নাকল ওয়াকিংকে। তবে মানুষের এই পূর্বপুরুষরা দু’পায়ে চলা শুরু করলেও আদতে তারা ছিল এপই। কোমরের নিচ থেকে দু’পায়ে হাঁটার অভিযোজন থাকলেও কোমরের উপরের অংশতে তারা তখনও বানর। তাদের মস্তিষ্কের আকার অত্যন্ত ছোট, তারা যে অস্ত্র ব্যবহার করত এরকম কোনও প্রমাণও মেলেনি। এই জাতীয় প্রাণীদেরকেই আমরা অস্ট্রালোপিথেকাস বলি, যে গ্রুপের সবচেয়ে বিখ্যাত সদস্য হল লুসি। এই অস্ট্রালোপিথেকাসদেরই একটা অংশ ক্রমে বিবর্তিত হয়ে জন্ম দেয় প্রথম যুগের হোমো ইরেকটাসদের। কিন্তু মুশকিল হল এই অস্ট্রালোপিথেসিন আর হোমোদের সময়কালের মধ্যে প্রায় দশ লক্ষ বছরের ফারাক, আর এই সময়কালের মধ্যেকার যে ট্রানজিশন, যেখানে কিছু কিছু অস্ট্রালোপিথেসিন গোষ্ঠী ক্রমে হোমো গোষ্ঠীতে পরিবর্তিত হতে শুরু করল, সেই সময়ের ফসিল বড়ই অপ্রতুল। ফলে এই সময়কালটা বড়ই ধোঁয়াশায় ঢাকা। এই সময়ের প্রতিভূ হিসেবে মূলত যে দুটি প্রাণীকে চিহ্নিত করা হয়, তারা হল হোমো হ্যাবিলিস আর হোমো রুডলফেনসিস। কিন্তু এদের ফসিল যতটা না পাওয়া গেছে তার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে এদের ব্যবহৃত অস্ত্র। ফলে মোটামুটি এটা ধারণা করা হয়েছিল যে কিছু অস্ট্রালোপিথেকাস যখন ক্রমে হোমো গোষ্ঠীতে বিবর্তিত হতে থাকে তখন তাদের মূল পরিবর্তন হয় মস্তিষ্কের আকারবৃদ্ধিতে এবং যার ফলে এরা অস্ত্র তৈরি করতে শেখে। কিন্তু মুশকিলটা হল যখন অস্ট্রালোপিথেকাস গারহির ফসিল আবিষ্কার হল। তখন দেখা গেল তারা অস্ট্রালোপিথেকাস হলেও সম্ভবত অস্ত্র ব্যবহার করত। লি বার্জারের আবিষ্কৃত (আসলে তাঁর ন’বছরের ছেলে ম্যাক্সের আবিষ্কৃত) অস্ট্রালোপিথেকাস সেডিবার ফসিলের সাথে অস্ত্র না পাওয়া গেলেও দেখা গেল যে তাদের হাতের বুড়ো আঙ্গুল কিন্তু অপেজেবল (যেরকমটা মানুষের হয়), অর্থাৎ তারা কিন্তু চাইলে অস্ত্র ব্যবহার করতেই পারত। মহা মুশকিল।
আসলে ত্রিশ থেকে বিশ লক্ষ বছরের মধ্যবর্তী সময়ে পৃথিবীর জলবায়ু এত দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছিল যে অস্ট্রালোপিথেকাসদের নিজেকে অতি দ্রুত পরিবর্তিত করতে হয়েছিল। তাই প্রায় কুড়ি থেকে ত্রিশ লক্ষ বছর তারা এপ হিসেবে থেকেও মাত্র দশলক্ষ বছরের মধ্যে নিজেদের পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেইসময়ের ইতিহাসটা বড়ই ধোঁয়াশায় ঢাকা। আর এই অবস্থাতেই সম্ভবত রিক আর স্টিভেনের ফসিলগুলোর আবিষ্কার।
সাধারণত একটা ফসিল পাওয়া সমস্যাজনক। কিন্তু দিনালেদি গুহা থেকে প্রাপ্ত ফসিলগুলোতে অন্তত পনেরোজন আদিমানবের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে, শুধু তাই নয়, পাওয়া গেছে তাদের প্রায় সম্পূর্ণ কঙ্কাল। কিন্তু এরা কারা?
উত্তর পাওয়া গেল তাদের খুলির গড়ন থেকে। তারা অস্ট্রালোপিথেকাস নয়, বরং তারা যাত্রা শুরু করেছে হোমো হওয়ার পথে। কিন্তু তাদের শরীরের বাকি অংশতে আবার অস্ট্রালোপিথেকাসদের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যেমন তাদের কাঁধের গঠন, বাঁকা আঙুল দেখে মনে হয় যে তারা সম্ভবত গাছে চড়তেও বেশ দক্ষ ছিল। এদিকে তাদের মস্তিষ্কের আকার অস্ট্রালোপিথেকাসদের চেয়ে কিছুটা বড়। এককথায় এদের হোমো আর অস্ট্রালোপিথেকাসদের বৈশিষ্ট্যের নকশিকাঁথা বলা যায়।
খুব সম্ভবত প্রকৃতি সে সময় হোমো গোষ্ঠী তৈরির আগে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছিল। তাই একই সময়ে হোমো হ্যাবিলিস, হোমো রুডলফেনসিস এবং সদ্য আবিষ্কৃত এই ফসিল, যার নাম দেওয়া হয়েছে হোমো নালেদি, তাদের উদ্ভব।
কিন্তু সদ্য আবিষ্কৃত হোমো নালেদির সবচেয়ে চমকে দেওয়া বৈশিষ্ট্য অন্য জায়গায়। রিক আর স্টিভেন আবিষ্কৃত গুহা, যেখানে হোমো নালেদির এই ফসিলগুলো পাওয়া গেছে, সেই গুহা সম্ভবত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে একইরকম আছে। তাহলে ফসিলগুলো ওখানে এল কেমন করে? একটা সম্ভাবনা হতে পারে যে কোন শ্বাপদ শিকার করে এনেছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনাটাকে বাদ দেওয়া যায় এ কারণেই যে গুহার ভেতরে একটিমাত্র পেঁচার ফসিল ছাড়া বাকি সবকটাই কিন্তু হোমো নালেদির। এমন কোনও শ্বাপদের অস্তিত্ব কল্পনা করা সত্যিই মুশকিল যে শ্বাপদ শুধুমাত্র আদিমানবদের শিকার করত। তাহলে?
আরেকটা সম্ভাবনা হতে পারে যে জলের সাথে ভেসে এসেছে। কিন্তু তাহলেও যে সমস্যাটা দেখা দিচ্ছে সেটা হল শুধুমাত্র হোমো নালেদির ফসিল এল কী করে? অন্য কোনওরকম প্রাণী, এমনকি গাছপালার চিহ্নও নেই কেন? এটাও টিকছে না। তাহলে?
তৃতীয় সম্ভাবনা হল যে হোমো নালেদির একটা দল গুহার ভেতরে প্রবেশ করার পর কোনওভাবে গুহার ছাদ ধ্বসে পড়ে, তাই তারা সেখানে আটকা পড়ে মারা যায়। কিন্তু লি বার্জার ভূতত্ত্ববিদদের মতামত নিয়ে দেখেছেন যে দিনালেদি গুহায় সম্ভবত এরকম কিছু ঘটেনি।
শার্লক হোমসের পদ্ধতি অবলম্বন করলে বলা যায় যে, সমস্ত সম্ভাবনা যখন ভুল প্রমাণিত হয়, তখন পড়ে থাকা একমাত্র সম্ভাবনা, তা যতই অবিশ্বাস্য হোক না কেন সেটাই সত্যি।
তাহলে এক্ষেত্রে সত্যটা কি?
দিনালেদি গুহার ফসিলগুলো মূলত বৃদ্ধ ও শিশুদের। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে যেন কবরস্থান থেকে তোলা দেহাবশেষ। তাহলে কি এই গুহাকে হোমো নালেদিরা কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করত? যদি তাই হয় তাহলে অস্ট্রালোপিথেকাস থেকে হোমো গোষ্ঠীর বিবর্তনের ইতিহাসটাই অন্যভাবে ভাবতে হয়। প্রাচীনতম মাস গ্রেভের প্রমাণ যা পাওয়া গেছে তা হল স্পেনে। হোমো হাইডেলবার্গেনসিসরা প্রায় পাঁচ লক্ষ বছর আগে এরকম মাস গ্রেভে তাদের আপনজনদের কবর দিত। কিন্তু তারা তো প্রায় মানুষই বলা চলে, সেক্ষেত্রে তাদের এরকম ব্যবহার আমাদের কাছে অতটা আশ্চর্যজনক মনে হয় না। কিন্তু কুড়ি থেকে পঁচিশ লক্ষ বছর আগের এক প্রাণী, যাদের মস্তিষ্কের আকার বড়জোর সাড়ে পাঁচশো কিউবিক সেন্টিমিটার তাদের কাছ থেকে বারোশো কিউবিক সেন্টিমিটার মস্তিষ্কের হোমো হাইডেলবার্গেনসিসের সমতূল সাংস্কৃতিক রিচ্যুয়ালের অস্তিত্ত্ব পাওয়া শুধু অস্বাভাবিক নয়, অবিশ্বাস্যও বটে। লি বার্জারের প্রস্তাবিত হোমো নালেদির এই রিচ্যুয়ালিস্টিক ব্যবহার নৃতত্ত্ববিদদের মধ্যে এখনও হটলি ডিবেটেড যাকে বলে।
কিন্তু অন্যভাবে যদি ভেবে দেখা যায়, তাহলে কি এই ব্যবহার সত্যিই এতটা আশ্চর্যজনক? শিম্পাঞ্জীদের মধ্যেও কিন্তু মৃতদের জন্য শোকপ্রকাশের কিছু কিছু লক্ষণ দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা মৃতদেহকে ফেলে রেখে যেতেই চায় না, মা শিম্পাঞ্জীরা অনেকসময় মৃত বাচ্চাদেরকে বুক থেকে ছাড়তেই চায় না। এমনকি হাতিদেরও কিন্তু মাস গ্রেভ হয়। সেক্ষেত্রে এদের তুলনায় উন্নততর মস্তিষ্কের অধিকারী এই হোমো নালেদিদের মধ্যে তাদের থেকে উন্নতততর রিচ্যুয়ালের অস্তিত্ত্ব থাকাটা কিন্তু ততটাও অস্বাভাবিক নয়। হোম নালেদিরা সত্যিই কবর দিত কিনা তা অবশ্যই সময় বলবে, কিন্তু দু’পায়ে হাঁটা বানরদের থেকে হোমো ইরেকটাসে বিবর্তনের, এককথায় মানবজনমের ধোঁয়াশাভরা ইতিহাসে হোমো নালেদিরা অবশ্যই আলো ফেলবে। যাদের কথা হয়ত জানাই যেত না যদি না দু’জন অ্যামেচার কেভার অত্যন্ত রোগা হত।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)