Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

স্কুলশিক্ষায় বিবর্তন বাদ: বিবর্তন নিয়ে কিছু ভুল ধারণা

জয়ন্ত দাস

 



চিকিৎসক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

আমরা এলাম কোথা থেকে, একজন মানুষের সঙ্গে অন্যদের ফারাক কোথায়, কেমন করে মানুষের উন্নতি হয়েছে ও হবে, কোভিড-১৯ ভাইরাস কীভাবে বিবর্তিত হচ্ছে— আমরা চাই বা না-চাই, এই সব ব্যাপারগুলো নিয়ে আমরা নানা ধারণা করে ফেলি। বিজ্ঞানের ওপরে ভিত্তি করে, বা ধর্মগ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে। ধর্মগ্রন্থ হল এক সময়পর্বের জ্ঞানের আধার। কিন্তু মানুষের জ্ঞান এগিয়ে চলছে। নতুন নানা জ্ঞানের একটা বড় অংশ হল বিজ্ঞান। তাই স্কুলে পড়ানো হোক আর না হোক, বিজ্ঞান কী বলে সেটা না জানলে আমাদেরই ক্ষতি

 

২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং তথা এনসিইআরটি বিদ্যালয়ের ‘পাঠক্রমকে যুক্তিযুক্ত করে সাজানো’-র জন্য নানা বিষয়ে স্কুল-সিলেবাস কমিয়ে দিয়েছে। চালু এনসিইআরটি সিলেবাস অনুসারে, দশম শ্রেণিতে বিবর্তনবাদ পাঠ্য ছিল, তাকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়ারা ডারউইনীয় বিবর্তনবাদের কিছুই জানবে না। কিন্তু প্রতিটি মানুষই যে জানতে চায়, আমরা এলাম কোথা থেকে? সেই আদি প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?

আমরা এলাম কোথা থেকে? মানুষ যেদিন মানুষ হয়েছে সেদিন থেকেই সে এই কথাটা ভেবেছে অবাক বিস্ময়ে। উলটো করেও কথাটা বলা যায়। যেদিন একটি আধা-মানুষ অবাক বিস্ময়ে ভাবতে পেরেছে, আমি এলাম কোথা থেকে, সেদিনই সে আধামানুষ থেকে পুরোমানুষ হয়ে উঠেছে। তারপর সে নিজেই এর উত্তর দিয়েছে, আর সেই উত্তরগুলো ধরে রেখেছে নানা উপাখ্যান আর গল্পে। একদিন এগুলো হয়ে উঠেছে তাদের পূর্বসূরিদের জ্ঞানের প্রতীক, এক সময়ে হয়তো হয়ে উঠেছে পবিত্র, হয়ে উঠেছে ধর্ম। জ্ঞাত প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠীর এক বা একাধিক সৃষ্টিকাহিনি নিয়ে উপকথা আছে।

 

মানুষের উদ্ভব— ধর্ম থেকে বিজ্ঞান

বিশ্ব ও মানুষের উদ্ভব নিয়ে নানা ধর্মের নানা মত। খ্রিস্টান, ইসলাম আর ইহুদি, এই তিন ‘আব্রাহামিক’ ধর্ম ওল্ড টেস্টামেন্টের জেনেসিস আখ্যান অনুসরণ করে বলে, ঈশ্বর পাঁচদিনে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করলেন, আর ষষ্ঠ দিনে তার নিজের রূপের মতো করে সৃষ্টি করলেন পৃথিবীর প্রথম পুরুষ আদমকে। ঈশ্বর মানুষকে গোটা পৃথিবী ও তার ওপরে বাস করা সমস্ত জীবের উপরে কর্তৃত্ব করার অধিকার দিলেন। হিন্দুদের সৃষ্টিতত্ত্ব একটিমাত্র গ্রন্থে বিধৃত নেই, তবে মোটের ওপর চালু বিশ্বাস হল, নিজ দেহ থেকে মহাবিশ্ব ও মানব সৃষ্টি করেছেন ব্রহ্মা।

ঈশ্বরের সৃষ্টি হল ‘পরম’। তার উন্নতি সম্ভব নয়। তাই জীব অপরিবর্তনীয়, ঈশ্বর একরকমের জীব সৃষ্টি করার পরে তারা একইরকম আছে। মানুষের সাধারণ অভিজ্ঞতাও একে সমর্থন করে— সত্যিই তো, কেউ কোনওদিন বানরের পেট থেকে মানুষ জন্মাতে দেখেনি। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে অনেক ইউরোপীয় পণ্ডিত ভাবতে শুরু করলেন, ঈশ্বর এতরকমের জীব তৈরি করার খামোখা খাটুনি কেন করবেন? হয়তো একরকম জীব থেকে অন্যরকম জীব তৈরি হতে পারে। কেমনভাবে? পিতামাতার থেকে সন্তান সামান্য আলাদা হল, আবার তার সন্তান হল আরেকটু আলাদা। এরকম করে অজস্র প্রজন্মের পরে আদি পূর্বসূরিদের সঙ্গে উত্তরসূরিদের বিরাট পার্থক্য তৈরি হয়। এতটাই পার্থক্য যে তাদের আলাদা জীব বলা যেতে পারে। এটাকেই বলা হল জীবের বিবর্তন। এক জীব থেকে আরেক জীবের উদ্ভব হওয়ার মতবাদকে বলা হয় বিবর্তনবাদ। এই মতবাদ ক্রমে ঈশ্বরের ভূমিকা ছাড়াই জীবের উদ্ভবের ভাবনার দ্বার খুলে দিল। কিন্তু ডারউইনের আগে পর্যন্ত বিবর্তনের সম্ভাব্য পদ্ধতি কেউ বলতে পারেননি।

আমরা এখানে প্রথমে বিবর্তনের মূলকথাগুলো জেনে নেব। তারপরে বিবর্তন সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো নিয়ে আলোচনা করব।

 

ডারউইনবাদের মূলকথা

কেমন করে বিবর্তন ঘটে, সে-কথা চার্লস ডারউইনই প্রথম বলতে পেরেছিলেন। ডারউইনের দেওয়া বিবর্তন-প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা ডারউইনবাদ বলে পরিচিত। ডারউইন ১৮৫৯ সালে ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পেসিস’ বইটিতে প্রাকৃতিক নির্বাচন ও বিবর্তনের সপক্ষে অকাট্য তথ্য ও যুক্তি পেশ করেন। তবে ‘ডারউইনবাদ’ বলতে একা ডারউইনের অবদান বোঝায় না, অন্য অনেক বিজ্ঞানীর অবদানে ডারউইনবাদের বর্তমান রূপ গড়ে উঠেছে। ডারউইনবাদের মূল বক্তব্য হল, বাইরের কোনও হস্তক্ষেপ ছাড়াই মানুষ সহ জীবজগতের উদ্ভব হতে পারে।

ডারউইন খুব সরল তিনটে সূত্র দিয়েছিলেন। প্রথম সূত্র অনুসারে, জীবের বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা খুব বেশি। একটা বা একজোড়া জীবের প্রচুর বাচ্চাকাচ্চা হয়, সব বাচ্চা বাঁচে না। দ্বিতীয় সূত্র বলেছে, একই ধরনের জীবের সব সদস্যরা একরকমের নয়, তাদের একজনের বৈশিষ্ট্য অন্যদের থেকে আলাদা— কেউ লম্বা, কেউ বেঁটে। বৈশিষ্ট্য পৃথক হওয়ার ফলে সদস্যদের বাঁচা ও বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতার ফারাক ঘটে। বেঁচে থাকার জন্য সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য যাদের থাকে কেবল তারাই বাঁচে। তৃতীয় সূত্র অনুসারে, কিছু বৈশিষ্ট্য বংশগত। মা-বাবা যেসব বৈশিষ্ট্যের ফলে বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধির সুবিধা পায়, সেই বৈশিষ্ট্যগুলো ছেলেমেয়েরা উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। ফলে তারাও বেশি বংশবৃদ্ধি করতে পারে। এইভাবে সেই সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য পরের প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। একে বলে প্রাকৃতিক নির্বাচন

প্রাকৃতিক নির্বাচন সুবিধা-দেওয়া বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সংখ্যা বাড়ায়। যেমন লম্বা গলার জিরাফ উঁচু গাছ থেকে বেশি পাতা খেতে পারে, তাই বেঁটে গলার জিরাফের চাইতে সে বেশি বাঁচে ও বেশি বাচ্চার জন্ম দিতে পারে, সেই বাচ্চারা উত্তরাধিকার-বলে লম্বা গলা পায় ও তাদেরও বেশি বাচ্চা হতে পারে— এইভাবে পরের প্রজন্মের জিরাফদের মধ্যে লম্বা গলার বৈশিষ্ট্য বাড়ে। আবার, প্রাকৃতিক নির্বাচন একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত জীবেরও সংখ্যা বাড়ায়— যেমন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লম্বা গলার জিরাফের সংখ্যা বেঁটে-গলার জিরাফের তুলনায় বেড়ে যায়।

 

ডারউইন পেরিয়ে

প্রাকৃতিক নির্বাচন একটি সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যকে নির্বাচিত করে, এবং সেই বৈশিষ্ট্যটি বংশগত। কিন্তু একটি নতুন বৈশিষ্ট্য কেমন করে আবির্ভূত হয়? কীভাবে একটি বৈশিষ্ট্য বাবা-মায়ের কাছ থেকে সন্তান-সন্ততির মধ্যে যায়? ডারউইন তা বলতে পারেননি। গ্রেগর ইয়োহান মেন্ডেল ও তাঁর পরবর্তীকালের গবেষকদের কাজ থেকে আমরা এখন জানি, জীবের বৈশিষ্ট্যগুলো কোষের মধ্যেকার ক্রোমোজোমের ডিএনএ অণুর সঙ্কেতে লিখিত থাকে। ডিএনএ অণুর এইরকম খণ্ডকে বলে ‘জিন’। জননের সময়ে জিনের মাধ্যমে বাবা-মায়ের বৈশিষ্ট্য সন্তানের কাছে যায়। আবার, জিনের এলোমেলো বা ‘র‍্যান্ডম’ বদল, যাকে বলে মিউটেশন, তার ফলে নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটে।

জিনতত্ত্ব আবিষ্কারের পরে ডারউইনবাদের সংক্ষিপ্ত রূপ দাঁড়াল এইরকম। জিন দেহকোষে থাকে ও তা জীবের বৈশিষ্ট্য প্রভাবিত করে। যে সব জীব যৌন জনন করে, অর্থাৎ ব্যাকটিরিয়া বাদে আমাদের পরিচিত প্রায় সব জীব, তাদের দেহকোষ থেকে বিভাজনের মাধ্যমে জননকোষ তৈরি হয়। পুরুষ জননকোষ হল শুক্রাণু আর স্ত্রী জননকোষ হল ডিম্বাণু। ডিম্বাণু ও শুক্রাণু তৈরি হওয়ার সময়ে তাদের মধ্যে যথাক্রমে মা ও বাবার জিন থাকে। এই দুই জননকোষের মিলনে তৈরি হয় বাচ্চার প্রথম কোষ, ও সেই কোষ বারংবার নির্দিষ্ট নিয়মে বিভাজিত ও বিশেষায়িত হয়ে তৈরি করে বাচ্চার দেহ। বাচ্চার কোষে তাই মা ও বাবার জিন থাকে, আর সেই জিন মা ও বাবার বৈশিষ্ট্যসমূহ বহন করে। ব্যাকটিরিয়া ও কিছু জীব অযৌন জননের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে, তাদের ক্ষেত্রে পিতা আর মাতা একই, ও তার কোষের জিন সন্তানের শরীরে নিজের বৈশিষ্ট্যগুলো বহন করে।

মা-বাবার বৈশিষ্ট্যগুলো পরিবেশে বাঁচার জন্য এবং বেশি বংশধর রাখার পক্ষে সুবিধাজনক হলে দুটো ঘটনা ঘটে। এক, অন্যদের বাচ্চার সংখ্যার তুলনায় সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যযুক্ত মা-বাবার সন্তান বেশি হয়। দুই, সেই সন্তানেরা অন্যদের তুলনায় সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য জিনের মাধ্যমে পায়, ফলে ভবিষ্যতে তাদের বাচ্চার সংখ্যাও বেশি হয়। এইভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বংশধর বেশি হয়, ও সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য-দেওয়া জিন বাড়ে। এ হল জিনস্তরে প্রাকৃতিক নির্বাচন, বা জিনের সংখ্যার কমা-বাড়া দিয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচন বোঝা।

জিনের বদল বা মিউটেশন হয়। এটা হয় এলোমেলো বা ‘র‍্যান্ডম’-ভাবে, কিন্তু সব মিউটেশন প্রাকৃতিক নির্বাচনের ছাঁকনির মধ্যে দিয়ে গলে যেতে পারে না। জিনের মিউটেশনের ফলে নতুন নানা জিন, নতুন নানা বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটে, সেটা জীবের পক্ষে ভাল বা মন্দ হতে পারে। জিনের মন্দ মিউটেশন হলে জীবের মোট বংশধর-সংখ্যা কমে যায়, আর জিনের ভাল মিউটেশন হলে জীবের মোট বংশধর-সংখ্যা বাড়ে। মন্দ জিন এভাবে পরের প্রজন্মে বাদ পড়ে যায়। অন্যদিকে, ভাল বদল ঘটানো ভাল জিন বংশানুক্রমে বেড়ে চলে। জিরাফের লম্বা গলার জন্য দায়ী জিন এসেছিল জিরাফের জিনের এলোমেলো মিউটেশনের ফলে, সেই মিউটেশন-যুক্ত জিন জিরাফকে সুবিধা দিয়েছিল বলেই তা টিকে গেছে ও পরের প্রজন্মে সংখ্যায় বেড়েছে। কিন্তু যদি র‍্যান্ডম মিউটেশনের ফলে কোনও জিরাফের চারটে ঠ্যাঙের জায়গায় তিনটে ঠ্যাং হয়, সেই জিরাফ বেশিদিন বাঁচবে না, বা বাঁচলেও বংশবৃদ্ধি করবে না, বা বংশবৃদ্ধি করলেও চার-ঠ্যাঙের জিরাফের চাইতে কম করবে— এভাবে পরের প্রজন্মে তিন-ঠ্যাং জিরাফের অবলুপ্তি ঘটবে, তার সঙ্গে জিরাফদের মধ্যে তিন-ঠ্যাং জিনেরও অবলুপ্তি হবে।

 

বিবর্তন নিয়ে ভুল ধারণা

প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে আমাদের প্রত্যেকের আগ্রহ রয়েছে। আমরা এলাম কোথা থেকে, একজন মানুষের সঙ্গে অন্যদের ফারাক কোথায়, কেমন করে মানুষের উন্নতি হয়েছে ও হবে, কোভিড-১৯ ভাইরাস কীভাবে বিবর্তিত হচ্ছে— এসব প্রশ্ন আমাদের প্রত্যেকের। আমরা চাই বা না-চাই, এই সব ব্যাপারগুলো নিয়ে আমরা নানা ধারণা করে ফেলি। অনেকে ধারণা করেন বিজ্ঞানের ওপরে ভিত্তি করে, আর অনেকের ধারণার ভিত্তি হল ধর্মগ্রন্থ। ধর্মগ্রন্থ হল এক সময়পর্বের জ্ঞানের আধার। কিন্তু মানুষের জ্ঞান এগিয়ে চলছে। নতুন নানা জ্ঞানের একটা বড় অংশ হল বিজ্ঞান। তাই স্কুলে পড়ানো হোক আর না হোক, বিজ্ঞান কী বলে সেটা না জানলে আমাদেরই ক্ষতি। একে বিবর্তন বিষয়ে নানারকম ভুল ধারণা অনেকের মাথায় জমে আছে, তার ওপরে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিবর্তন পড়ানো বন্ধ হবার ফলে সঠিক ধারণা ঢোকার রাস্তা কমল। তাই আমরা এখানে কয়েকটা সাধারণ ভুল ধারণা নিয়ে আলোচনা করব। ভুল ধারণা ও তার সংশোধনা আমরা পাশাপাশি রাখব।

ভুল ধারণা: বিবর্তন তত্ত্ব জীবনের উত্স সম্পর্কে একটি তত্ত্ব।
সংশোধন: বিবর্তন তত্ত্বের মধ্যে জীবনের উত্স সম্পর্কিত ধারণা ও তার প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করা হয়, তবে বিবর্তন তত্ত্বের মূল কথা এটা নয়। জীবন একবার সৃষ্টি হয়ে গেলে তার পরিবর্তন ও বিকাশ কী করে হয়েছিল, সেটাই বিবর্তন বিজ্ঞানের মূল আলোচ্য বিষয়।

ভুল ধারণা: বিবর্তনের অভিমুখ প্রগতির দিকে। বিবর্তনের মাধ্যমে সর্বদাই জীবের ‘উন্নতি’ ঘটছে।
সংশোধন: প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে জীবের বেঁচে থাকার দক্ষতা ও প্রজনন দক্ষতার উন্নতি হয়। অভিযোজন হল জীবের পরিবেশে খাপ-খাওয়ানো পরিবর্তন। কিন্তু বিবর্তনের ফলে অন্য ধরনের পরিবর্তনও হয়। কোনও একটি জনসমষ্টির মধ্যে বা প্রজাতির মধ্যে এমন মিউটেশন ছড়িয়ে পড়তে পারে যা তার পক্ষে ক্ষতিকারক। যেমন অ্যাঞ্জেলিনা জোলির ক্যানসার জিন। তাছাড়া জীবের পরিবেশ বদলায় ও আগেকার লাভজনক বৈশিষ্ট্য নতুন পরিবেশে ক্ষতিকারক হতে পারে। এছাড়া আছে জিনে ঘটনাচক্রে হয়ে যাওয়া পরিবর্তন, সেটা সুবিধাজনক নাও হতে পারে।

এছাড়া উন্নতির ধারণা নিয়ে সমস্যা আছে। আমরা ভাবি, বুদ্ধি বাড়লে, গায়ের জোর বাড়লে, সেটাই হল উন্নতি। কিন্তু প্রত্যেক জীবের জন্য উন্নতির মাপকাঠি পৃথক। যে সব পরিবর্তন একটি জীবকে টিকে থাকতে সাহায্য করে সেগুলোই তার উন্নতি— যেমন মাকড়সার জন্য উন্নতি হল আরেকটু কার্যকর জাল বানানো।

ভুল ধারণা: একটি জীব তার জীবদ্দশায় বিবর্তিত হয়।
সংশোধন: একটি জীব বিবর্তিত হয় না, অনেক জীবের সমাহারে গঠিত জীবগোষ্ঠী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বিবর্তিত হয়। এক প্রজন্মে বিবর্তন হয় না, তার জন্য একাধিক প্রজন্ম লাগে। পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জিনে উপযুক্ত পরিবর্তন এলে ভালই হত, শীতের দেশে বেড়ানোর সময়ে গায়ে ঘন লোম গজালে সুবিধা হত। কিন্তু বিবর্তন সেভাবে কাজ করে না।

ভুল ধারণা: জীব নিজেকে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করে, আর তার ওপর ভিত্তি করে প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে।
সংশোধন: প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে একটি জীব পরিবেশে বেশি করে খাপ খাওয়াতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়াটি ঘটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। জীবের সচেতন বা অচেতন প্রচেষ্টা, চাহিদা ইত্যাদির দ্বারা প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয় না।

ভুল ধারণা: যোগ্য বা ফিট জীব হল শক্তিশালী, স্বাস্থ্যবান, দ্রুত এবং বৃহৎ।
সংশোধন: একটি জীবের বিবর্তনীয় যোগ্যতা (ফিটনেস) তার স্বাস্থ্য দিয়ে মাপা হয় না, সে পরবর্তী প্রজন্মে কত বেশি ও কত উর্বর বংশধর রাখতে পারল তাই দিয়ে মাপা হয়। এটি সর্বদা শক্তি, গতি বা আকারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

ভুল ধারণা: প্রাকৃতিক নির্বাচন কেবল সবচাইতে বেশি যোগ্য বা যোগ্যতমকে বাঁচিয়ে রাখে।
সংশোধন: ‘যোগ্যতমের বেঁচে থাকা’ প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের জনপ্রিয় শব্দবন্ধ। কিন্তু ‘যথেষ্ট যোগ্য হলে বেঁচে থাকা’, এটাই ঠিক কথা, এবং ‘যথেষ্ট যোগ্য হলে বংশবৃদ্ধি’— এটা আরও বেশি সঠিক। কোনও মানুষ হয়তো লম্বা আর চটপটে, কেউ হয়তো ছোটখাট কিন্তু সামাজিকভাবে খুব দক্ষ। কেউবা কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতাধারী। এরা প্রত্যেকেই দরকারি গুণের অধিকারী, কিন্তু কেউই শ্রেষ্ঠতম মানুষ নন। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এদের সবার জিন প্রয়োজনীয়। সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ অতিমারি দেখিয়ে দিয়েছে, এক-একরকম পরিস্থিতিতে এক-একধরনের জিনগত গুণাবলি ‘যোগ্যতা’ নির্ধারণ করে, এবং তা সামাজিক অবস্থানের মাপকাঠি নিরপেক্ষ।

ভুল ধারণা: প্রাকৃতিক নির্বাচন এমন জীব সৃষ্টি করে যারা তাদের পরিবেশের জন্য নিখুঁতভাবে উপযুক্ত।
সংশোধন: অনেকগুলি কারণে প্রাকৃতিক নির্বাচন ‘নিখুঁতভাবে তৈরি’ বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করতে পারে না। যেমন একটা প্রয়োজনকে নিখুঁতভাবে পূরণ করতে গেলে অন্য এক প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যকে অনেক সময়ে বজায় রাখা যায় না। হাতির বিশাল চেহারা হলে তাকে শিকারি জন্তু মারতে পারবে না। কিন্তু চেহারা যতই বড় হবে ততই বেশি খাদ্যের প্রয়োজন হবে, আর বেশি বড় দেহ নিয়ে খাদ্য সংগ্রহ ততই সমস্যাজনক হবে। সিংহের হাত থেকে বাঁচা আর সহজে যথেষ্ট খাদ্য জোটানো— এই দুই বিপরীতমুখী চাহিদার মধ্যে হাতির চেহারা ভারসাম্য বজায় রাখে। তাই হাতি সিংহের কাছ থেকে বাঁচার জন্য নিখুঁত নয়, আবার যথেষ্ট খাদ্য পাওয়ার জন্যও সে ‘নিখুঁত’ বা সেরা নয়— সে এই দুইয়ের মাঝামাঝি।

ভুল ধারণা: বিবর্তন কেবল ধীরে ধীরে এবং ছোট ছোট ধাপে ঘটে। তাই মানুষ একে প্রভাবিত করতে পারে না।
সংশোধন: বিবর্তন অনেক সময়ে মানুষের মাপে দ্রুত ঘটতেও পারে, যেমন মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে অনেক ব্যাকটিরিয়া পেনিসিলিন প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেছে। কেবল জীবাণু নয়, বড় জীবের ক্ষেত্রেও দ্রুত বিবর্তন ঘটতে পারে। গত ৫০ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দ্রুত বিবর্তনের ফলে কাঠবিড়ালির প্রজনন-ঋতু বদলে গেছে। মানুষ এগুলোকে প্রভাবিত করেছে।

ভুল ধারণা: মানুষ বর্তমানে বিবর্তিত হচ্ছে না।
সংশোধন: মানুষের মধ্যে ম্যালেরিয়া থেকে রক্ষা করার মিউটেশন বা শৈশবের পরেও দুধ খেয়ে হজম করার জন্য প্রয়োজনীয় মিউটেশন বিগত কয়েক হাজার বছরের মধ্যে এসেছে। বিবর্তনের সময়ের মাপে এগুলোকে খুব দ্রুত পরিবর্তন বলা যায়। কেউ কেউ ভাবেন, মানুষের প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে তার প্রজনন ও বেঁচে থাকা খুব বদলে গেছে; যেসব মানুষ জীবনে টিকে থাকার নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সফল, তাদের বংশধর বেশি হবে, এখন আর একথা বলা যায় না। আসলে কিন্তু এমন কথা এখনও বলা যায়। নানা মহামারির বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতার জন্ম দেওয়া জিনগুলি থাকলে সেই মানুষের বংশধর এখনও গড়পড়তা হিসেবে বেশি হবে। এটাই বিবর্তন। মানুষ অন্য প্রজাতির তুলনায় দ্রুত হারে বিবর্তিত হচ্ছে।

ভুল ধারণা: বিবর্তন তত্ত্ব একটি তত্ত্ব মাত্র।
সংশোধন: এই ভুল ধারণাটি ‘তত্ত্ব’ শব্দটির দৈনন্দিন ব্যবহার এবং বৈজ্ঞানিক ব্যবহারের মধ্যে গুলিয়ে ফেলে। দৈনন্দিন ভাষায়, ‘তত্ত্ব’ শব্দটি দিয়ে আমরা স্বল্প প্রমাণ থেকে তৈরি করা ধারণা বোঝাই। অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, বা ইংরাজিতে ‘থিওরি’, হল বহু ঘটনার ব্যাখ্যা করার মতো প্রমাণিত ধারণা। একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে বিভিন্ন দিক থেকে যাচাই করে দেখা হয়। বিবর্তন তত্ত্ব নানাদিক থেকে যাচাই করা এবং সমস্ত বিজ্ঞানী দ্বারা গৃহীত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। এটি স্বপ্নাদ্য মাদুলি বা গোমূত্রে ক্যানসার সারার মতো কোনও অপ্রমাণিত বিশ্বাস নয়।

ভুল ধারণা: একটি জীবের বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সব কিছুই প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা পাওয়া যায়।
সংশোধন: প্রাকৃতিক নির্বাচন কোনও প্রজাতি বা কোনও ব্যক্তির প্রয়োজন বুঝতে পারে না। জীবের প্রয়োজনমাফিক তার পরিবর্তন হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। পরিবেশে নতুন চ্যালেঞ্জ এলে অন্তত কয়েকটি জীবের সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার বৈশিষ্ট্য সাধারণত থাকে, অথবা জিনের মিউটেশনের ফলে সেরকম বৈশিষ্ট্য নতুন করে তৈরি হয়। কিন্তু তার কোনও নিশ্চয়তা নেই— জীবটি ডোডোপাখির মত বিলুপ্ত হয়ে যেতেও পারে। পরিবেশ বদলে গেলে মানুষ সেইমতো বদলে টিকে থাকতে পারে, আবার বিলুপ্তও হতে পারে। পরিবেশ দ্রুত বদলালে টিকে থাকার সম্ভাবনা কমে।

ভুল ধারণা: বিবর্তন তত্ত্ব বলে, জীবন এলোমেলোভাবে স্রেফ ঘটনাচক্রে বিকশিত হয়েছিল এবং এখনও তাই হচ্ছে।
সংশোধন: এলোমেলো (র‍্যান্ডম) প্রক্রিয়া বিবর্তন এবং জীবনের ইতিহাসকে বিভিন্ন উপায়ে প্রভাবিত করে, তবে প্রাকৃতিক নির্বাচন এলোমেলো বা যথেচ্ছ প্রক্রিয়া নয়। ‘ডারউইন পেরিয়ে’ শিরোনামে আমরা এটা আলোচনা করেছি।

ভুল ধারণা: বিবর্তন একটিমাত্র জীবের ভালর জন্য কাজ করে না, তা একটি জীবগোষ্ঠী বা প্রজাতির ভালর জন্য কাজ করে— যথা, মানুষের বিবর্তন মানুষ প্রজাতির ভাল করে।
সংশোধন: কীভাবে একটি প্রজাতি প্রাকৃতিক নির্বাচনের লক্ষ্য হতে পারে, তার কোনও ব্যাখ্যা কোনওদিন পাওয়া যায়নি। কিন্তু একই প্রজাতির জীবেরা পরস্পরকে সহযোগিতা করে বেঁচে থাকে। এর ব্যাখ্যা অন্য। একটি প্রাণী তার আত্মীয়দের উপকার করে, তাই যার উপকার করা হচ্ছে তার মধ্যে সেই ‘উপকারক’ জিনটির প্রতিলিপি থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি। এভাবে ‘উপকারক’ জিনটি নিজেই নিজের কপির সংখ্যা বাড়িয়ে তোলে, ও ‘উপকারক’ আচরণ প্রজাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া ‘পারস্পরিক পরার্থপরতা’ হল উপকারী আচরণের আরেকটি ব্যাখ্যা। এতে একই প্রজাতি বা ভিন্ন প্রজাতির জীবেরা পরস্পরকে সাহায্য করে দুজনেরই জীবন ও বংশবৃদ্ধি বাড়ায়।

ভুল ধারণা: বিবর্তন তত্ত্ব অকেজো, কারণ এটি অসম্পূর্ণ এবং আমাদের চারপাশের জীববৈচিত্র্যের পুরো ব্যাখ্যা দিতে পারে না।
সংশোধন: বিবর্তন তত্ত্ব হোক বা পরমাণু তত্ত্ব, কোনও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই সম্পূর্ণ নয়। নতুন প্রমাণ আবিষ্কার হয়, নতুন ধারণার বিকাশ ঘটে, আমাদের উপলব্ধি আরও পূর্ণতা পায়। এভাবেই সমস্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এগোয়। কোনও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই প্রকৃতির সমস্ত কিছুকে একসঙ্গে ব্যাখ্যা করে না, তা কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়। আবার, একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে অন্যান্য প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হয়। বিবর্তন তত্ত্ব বহু ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়, ও তা প্রতিদিনই নানা অব্যাখ্যাত ঘটনার ব্যাখ্যা তৈরি করে পূর্ণতর হয়; এই তত্ত্ব পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন ইত্যাদির সমস্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণও।

ভুল ধারণা: বিবর্তন তত্ত্বটি ত্রুটিযুক্ত, তবে বিজ্ঞানীরা ভুল স্বীকার করেন না।
সংশোধন: বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কঠোর প্রতিযোগিতা চলে। ত্রুটি থাকলে বিজ্ঞানীরা নিজেরাই সেই ত্রুটি ধরে তা সংশোধন করতে আগ্রহী— তা সেই বিজ্ঞানীর খ্যাতি বাড়ায়।

ভুল ধারণা: বেশিরভাগ জীববিজ্ঞানী ‘ডারউইনবাদ’ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সংশোধন: আমরা ডারউইনের পরে বিবর্তন সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছি। আমরা এখন বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকারের আণবিক ভিত্তি জানি, জীবাশ্ম ও দেহ-অবশেষ থেকে অনেক বেশি কিছু আমরা সঠিকভাবে বলতে পারি, ও আণবিক স্তরে বিবর্তন আমরা বুঝতে পারি। অকল্পনীয় এই অগ্রগতি বিবর্তন তত্ত্বকে আরও শক্তিশালী করেছে। তবে ডারউইন এবং ওয়ালেস যে প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং সাধারণ বংশধারার উল্লেখ করেছিলেন, বিবর্তনের সেই মূলনীতিগুলি পালটে যায়নি। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সম্প্রসারণ, পরিবর্তন এবং প্রসারণ বিজ্ঞানপ্রক্রিয়ার একটি স্বাভাবিক অঙ্গ।

ভুল ধারণা: বিবর্তন তত্ত্ব অনৈতিক আচরণের দিকে মানুষকে পরিচালিত করে।
সংশোধন: বিবর্তন তত্ত্ব সঠিক-বেঠিকের ব্যাপারে নৈতিক বক্তব্য রাখে না। মানুষ সহ সমস্ত প্রাণীর আচরণ বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে। অনেকের ভুল ধারণা হল, কোনও আচরণ যদি ‘প্রাকৃতিক’ কারণে হয়, তাহলেই তাকে ‘সঠিক’ বলে অভিহিত করা যায়। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। অনৈতিক ও নৈতিক আচরণের মানদণ্ড প্রকৃতির নিয়ম দ্বারা ঠিক হয় না; তা ঠিক করে ব্যক্তিমানুষ এবং সমাজ।

ভুল ধারণা: বিবর্তন তত্ত্ব ‘জোর যার মুল্লুক তার’ ধারণাটিকে সমর্থন করে, এবং কিছু লোকের দ্বারা অন্যের নিপীড়নের পক্ষে যুক্তি খাড়া করে।
সংশোধন: ঊনবিংশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ‘সামাজিক ডারউইনবাদ’ নামে একটি মতবাদ খ্যাতিলাভ করেছিল। এই মতবাদ ছিল বিবর্তন তত্ত্বকে সমাজের ক্ষেত্রে ভুলভাবে প্রয়োগের প্রচেষ্টা। আপাতদৃষ্টিতে এই মতবাদ প্রাকৃতিক নির্বাচনে ‘যোগ্যতমের জয়’ ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। বলা হয়েছিল, যারা সমাজে ভাল আছে তারা ‘যোগ্য’, যারা খারাপ আছে তারা ‘অযোগ্য’। সামাজিক ডারউইনবাদ আসলে ডারউইনের তত্ত্বের সঙ্গে মেলে না, তা ‘যোগ্যতা’ শব্দের অপব্যাখ্যা করে। ‘যোগ্যতা’ বলতে ডারউইনের তত্ত্ব মোটেই শক্তিশালী বা বুদ্ধিমান বা ধনীকে বোঝায় না। এর আগে আমরা যোগ্যতার বিবর্তনীয় ব্যখ্যা আলোচনা করেছি। সামাজিক ডারউইনবাদ হল একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। ঐতিহাসিক কারণে তার গায়ে ডারউইনের নামটি রয়ে গেছে, কিন্তু ডারউইন বা ডারউইনবাদের সঙ্গে তার প্রকৃত সম্পর্ক নেই। সামাজিক ডারউইনবাদকে বিজ্ঞান হিসেবে চালানোর চেষ্টা সামগ্রিকভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তাতে ডারউইনীয় বিবর্তন তত্ত্বের কোনও ক্ষতি হয়নি।

ভুল ধারণা: যদি শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় যে তারা আর পাঁচটা প্রাণীর মতোই এক প্রাণী, তবে তারা পশুর মতো আচরণ করবে।
সংশোধন: বিবর্তন তত্ত্বে বলা হয়েছে যে পৃথিবীর সমস্ত জীব পরস্পর সম্পর্কিত। জৈবিক অর্থে মানুষ এক ধরনের প্রাণী, আর মানুষের অন্যান্য প্রাণীর অনুরূপ শারীরবৃত্তীয়, জৈব-রাসায়নিক এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্য আছে। অন্য অনেক প্রাণীর মতোই আমরা শিশুদের যত্ন নিই, পরস্পরকে সাহায্য করার দল গঠন করি, আবার একে অপরকে আক্রমণও করি। প্রতিটি প্রাণীর কিছু আচরণ অন্যদের মতো, আবার কিছু আচরণগত বৈশিষ্ট্য সেই প্রাণীর জন্য বিশেষ, অনন্য। মানুষ মানুষের মতো আচরণ করে, হাতিরা হাতির মতো এবং কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালির মতো আচরণ করে। ছোটরা বিবর্তনের কথা শুনে শিম্পাঞ্জির মতো আচরণ শুরু করবে বা ভালমন্দ বুঝতে পারবে না, এমন সম্ভাবনা নেই।

ভুল ধারণা: শিক্ষকদের বিবর্তন সমস্যার ‘উভয়পক্ষের মতবাদ’ শেখানো উচিত এবং শিক্ষার্থীদের সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিত। অন্য ভাষায় বিবর্তন এবং ধর্মীয় সৃষ্টিবাদকে বিজ্ঞানের ক্লাসে সমান সময় দেওয়া উচিত।
সংশোধন: ধর্ম এবং বিজ্ঞান ভিন্নধর্মী প্রচেষ্টা। বিজ্ঞান প্রাকৃতিক বিশ্বের ঘটনা ও প্রক্রিয়া অধ্যয়ন করে। বিজ্ঞানের শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের আওতার মধ্যে যুক্তি এবং প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করার কথা। ধর্মীয় ধারণাগুলি বিশ্বাসের ওপরে ভিত্তি করে তৈরি। ধর্মপাঠের ক্লাসে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব পড়ানোর জন্য সময় দাবি করার মতোই এই দাবি অযৌক্তিক।

 

উপসংহার

আমাদের একটাই গৃহ, তার নাম পৃথিবী। আমরা এখনও পর্যন্ত অন্য কোনও বাঁচার মতো গ্রহ খুঁজে পাইনি, সম্ভবত কোনওদিনই পাব না। অথচ আমরা এই গ্রহকে বদলে দিচ্ছি, উষ্ণ করছি, অসংখ্য প্রজাতিকে গ্রহের বুক থেকে মুছে দিচ্ছি, আর এইভাবে পৃথিবীকে ক্রমশ আমাদের বসবাসেরও অযোগ্য করে তোলার দিকে ঠেলে দিচ্ছি।

বিবর্তন বুঝলে বোঝা যায়, আমরা এই পৃথিবীর অন্য সমস্ত সন্তানের মতোই আরেক সন্তান— বুদ্ধিমান, ক্ষমতাসম্পন্ন। কিন্তু অল্প কয়েকজনের লোভের সামনে আমরা অসহায় দর্শক। এই বিশ্বকে বাঁচানোর কাজটা হয়তো তেমন কঠিন নয়। তবে আমাদেরই ঠিক পথটা বুঝে নিতে হবে, এবং সমস্ত লোভ আর অদূরদর্শিতার মধ্যে নিজেদের রাস্তা তৈরি করে নিতে হবে।