রবীশ কুমার
সম্প্রতি ৩ মে বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বতন্ত্রতা দিবসে ব্রাসেলস-এ সাংবাদিক রবীশ কুমারকে ‘ডিফারেন্স ডে হনারারি টাইটেল ফর ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন’ দিলেন ভ্রাই ব্রাসেলসের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরেরা। সৎ এবং বলিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য এই পুরস্কার গ্রহণ করে রবীশ কুমার সেখানে যে অভিভাষণটি দেন গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা তার বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করছি। বক্তৃতাটি প্রকাশিত হয়েছে রবীশ কুমার অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছেন সত্যব্রত ঘোষ
এই সম্মান তাঁদেরই প্রদান করা হয় যারা সাংবাদিকতার এবং অভিব্যক্তির স্বাধীনতার জন্য অনবরত লড়ে যাচ্ছেন। আমার মহান দেশ যখন তার স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ উদযাপন করছে, আমি তখন আমার স্বাধীনতা আপনাদের মাঝে প্রকাশ করতে চাই।
গতকাল আপনাদের সুন্দর ব্রাসেলস শহরটির রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আমি ১ মে-র প্যারেড দেখেছি। নানান বয়সের আন্দোলনকারীদের হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে শ্রমিক ঐক্যের স্লোগানে সোচ্চার হওয়ার দৃশ্যটি সুন্দর ছিল। তবে যে মুহূর্তটি আমার হৃদয়কে সবচেয়ে তৃপ্তি দিয়েছে তা হল সেই লাল ব্যানারের সমুদ্রের মধ্যে একটি নীল ব্যানারের উপস্থিতি। যে ব্যানারটিতে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ-এর মুক্তির দাবি তোলা হয়েছে এবং তাঁকে অন্য দেশে প্রত্যর্পনের বিরুদ্ধে কিছু কথা লেখা রয়েছে।
সেটি দেখে আমার একটি উপলব্ধি হল। অধিকারের জন্য যে লড়াই, তা একই সঙ্গে মুক্তকথা আর বিরোধিতা করবার স্বাধীনতারও লড়াই। কারণ, কোনও লড়াই বা সংগ্রামই সম্ভব নয় যদি না মতের বিপক্ষে যাওয়ার এবং বিরোধিতা করবার স্বাধীনতা পাই, এমন কিছুর বিরুদ্ধে যাকে আমরা ভুল বলে বুঝতে পারছি। কিন্তু বিরোধী কণ্ঠস্বরের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী জুড়েই আক্রমণ শানানো হচ্ছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলি বিরোধী কণ্ঠস্বর এবং সেই কণ্ঠস্বরের অধিকারীদের রক্ষা করতে পারছে না। শুধু প্রতিষ্ঠানগুলিই নয়, নতুন ধরনের নজরদারির এক গুচ্ছ প্রযুক্তির প্রয়োগও শুরু হয়েছে, যা সব ধরনের বিরোধী কণ্ঠস্বরকে ধামাচাপা দিতে তৎপর যাতে তা সমাজের অন্য স্তরগুলিতে ছড়িয়ে না যেতে পারে।
যারা বয়সে বড়, তারা ছোটদের উপর নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে। নজরদারি এখন শুধু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই আবশ্যিক এক উপায় নয়, প্রতিবেশীদের উপরেও নজরদারি করা হচ্ছে ধর্মের জিগির তুলে। পাশের বাড়ির মানুষ কী খাচ্ছে, তার দিকেও নজরদারি চালানো হচ্ছে।
আমি লক্ষ করছি, তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এখন বিরোধী কণ্ঠস্বর তোলবার বিরোধী হয়ে উঠছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির চত্বরগুলিতেও সমালোচনার পরিসর ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। এখন কেউ বিরোধী হলেই তাকে বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে— যা রাজনৈতিক এবং সামাজিক— দুটি ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
একটি পরিসরেই বিরোধিতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সেটি হল গণতান্ত্রিক পরিসর। যদি গণতন্ত্রকেই বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়, তাহলে আপনার মনেই হবে না বিরোধিতার কোনও প্রয়োজন থাকতে পারে। বৈদ্যুতিন মাধ্যমই হোক বা সমাজমাধ্যম— কোনওখানেই নয়।
আমাদের দেশে মানুষের পরিচয় চিহ্নিত করবার জন্য একটি নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে— আমরা যাকে বলি আধার কার্ড। গণতন্ত্রকে ক্ষইয়ে দেওয়ার জন্য ক্ষমতাশালীদের হাতে নানানরকম উপায় রয়েছে। গণতন্ত্র বজায় রাখবার জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম ব্যবস্থার প্রয়োজন। কিন্তু মিডিয়া এখন রাষ্ট্রের কুক্ষিগত— একটি যন্ত্রবিশেষ। যদি আপনি একজন ভারতীয় কৃষক হন এবং আপনি যদি রাষ্ট্রের একটি নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, মিডিয়া হয়তো আপনার উপর একটি লেবেল সেঁটে দেবে— আপনি উগ্রবাদী। আপনার যাত্রাপথকে কাঁটাতারের বেড়া এবং কংক্রিটের চাই বসিয়ে আটকে দেওয়া হবে। অথবা আপনি হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলেন, আপনার ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমন ধরনের দুটি ঘটনা দেশে ইতিমধ্যে ঘটে গেছে।
আজকাল একটি বিষয় নিয়ে বিতর্কের সুর ক্রমশ চড়া হচ্ছে চারপাশে। রাষ্ট্রীয় নীতির বিরোধিতা বা সমালোচনা যাই হোক না কেন, দেশের মধ্যেই তা করতে হবে। বিদেশে নয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই আমি বলেছি যে দেশের মধ্যে নীতিগত বিরোধিতা অথবা সমালোচনা করাটা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু এই যুক্তি মেনে নিলে তো বলতে হয় প্রতিবেশী বা দূরবর্তী দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ জারি থাকলে সেই যুদ্ধ নিয়ে কোনও বক্তব্যই আরেকটি দেশে বসে প্রকাশ করা উচিত নয়। কেউ আর সেই জার্মানির কথা বলবে না যে জার্মানি হিটলারের আমলে তৈরি হয়েছিল, যেখানে সাধারণ মানুষরাই গণহত্যাকে সমর্থন জোগায়। বেলজিয়ামে বসে সেই নিয়ে আলোচনা করা উচিত নয়, যেখানে হিটলারের নাৎসি বাহিনি আক্রমণ করেছিল। তাহলে কি আমাকে মিউনিখে গিয়ে সেখানকার নাৎসি বাহিনির কথা বলতে হবে?
কেমনভাবে আমরা গণতন্ত্র সংক্রান্ত চিন্তাভাবনাগুলিকে ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক সীমারেখার মধ্যে আটকে রাখতে পারি? আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন গণতন্ত্র নাকি একটি ব্যবস্থা নয়, একটি মানসিক উদ্দীপনা। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন ধারণাকে সমর্থন করি না। সে যাই হোক। কয়েক মুহূর্তের জন্য না হয় মেনে নেওয়া যাক উনি ঠিক বলছেন। সেইক্ষেত্রেও কি আমরা উদ্দীপনাকে ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি? আপনারা পারেন কি? স্বাভাবিকভাবেই আপনি বলবেন, যে গণতন্ত্র অথবা রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর যদি কোনও আঘাত আসে, তাহলে অবশ্যই স্থানীয় স্তরে আক্রমণটি ঘটেছে। তবে তা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে যদি শোরগোল হয়, তাহলে ক্ষতি কী?
তবে আমি একটি বিষয় স্পষ্ট বুঝি। কোনও দেশের ক্ষমতাসীন সরকারই আর গণতন্ত্র রক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। কাগজে-কলমে গণতান্ত্রিক হিসেবে প্রমাণ করলেও, কিন্তু তাঁদের মূল উৎসাহ ব্যবসা, এবং তা ওঁরা যথেষ্ট ভালই করতে পারেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে। সেই বিষয়ে কোনও অসঙ্গতি নেই। সুতরাং গণতন্ত্র শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র, জনগণের জন্য গণতন্ত্র। তাই, বিশ্বের সমস্ত সাধারণ মানুষদেরই ঠিক করে নিতে হবে যে তাঁরা গণতন্ত্রের থেকে ঠিক কী চাইছেন। বিশ্বনেতারা এখন শুধুমাত্র নিজেদেরই নেতা হিসেবে সীমাবদ্ধ করে নিয়েছেন। যদিও তাঁরা বিভিন্ন ধরনের শ্রেণিতে নিজেদের বিভাজিত করে নিয়েছেন।
তাহলে, বিরোধিতাকে কে বা কারা ভয় পাবেন? কারা সবচেয়ে বেশি বিরুদ্ধ মতকে ঘৃণা করেন? ঘৃণা করেন তাঁরাই, যাঁরা সবার আগে সবচেয়ে বেশি মুনাফা নিজের পকেটে ভরতে চাইছেন। যে মানুষটি দেশের মানুষদের মধ্যে এমনভাবে বিভাজনকে বিস্তৃত করতে পারে যাতে দেশের জনসংখ্যার নব্বই শতাংশ মানুষ ভর্তুকি এবং সরকারি সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে ওঠে, যাকে আজকালকার ভাষায় ‘ফ্রিবিজ’ বলা হয়। তবে এই মুনাফাখোরেদের উদ্দেশ্যটি অত্যন্ত সরল। এরা চাইছেন, দেশের ক্রমবর্ধমান বিশাল সাধারণ মানুষদের অবস্থা একবারে তলানিতে পৌঁছায়, যাতে কোনওক্রমে জীবনধারণটুকু করতে পারে, এবং টিকে থাকবার জন্যে ন্যুনতম কিছু পেলেই মানুষরা যেন তাঁদের উদারতার নমুনাটুকু পেয়ে কৃতজ্ঞ থাকতে পারেন।
এর পাশাপাশি, জাতিবিদ্বেষী, জাতপাতে বিশ্বাসী মৌলবাদী উন্মাদেরা রয়েছে, যারা সবসময়ই কিছু না কিছু কাণ্ড ঘটিয়ে সাধারণ মানুষদের সেইগুলিতে ব্যস্ত রাখতে তৎপর। যাতে এই মানুষগুলি সেই বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলতে না পারেন, যেগুলির সঙ্গে তাঁদের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সমাজে যত দারিদ্র বাড়ছে ততই জ্ঞান এবং তথ্যের মধ্যে দূরত্ব চওড়া হয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা বিশ্বাসযোগ্য কোনও স্কুলে ভর্তি হতে না পারার ফলে সঠিক তথ্য এবং জ্ঞান আহরণ করতে পারছে না। তাহলে গণতন্ত্র প্রক্রিয়ায় ওরা কেমনভাবে অংশগ্রহণ করবে, যদি না প্রকৃত তথ্য এবং জ্ঞান তাদের কাছে পৌঁছায়।
বিভিন্ন মাধ্যমগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, যাতে দেশের দরিদ্র মানুষদের কাছে সঠিক বার্তাগুলি না পৌঁছায়। এবং আদৌ যদি পৌঁছায়, সেগুলি যেন ভুল তথ্যে ভরা থাকে। সেই কারণে, বিশ্বের যে কোনও সরকার নীতিগতভাবে যতই প্রকাশ্যে দাবি করুক না কেন, দারিদ্র দূরীকরণ এখনও বাস্তবে হয়নি। অসাম্য যত বাড়ছে সঠিক তথ্য ও বার্তা প্রেরণের মধ্যে ফারাকও তত ক্রমশ বাড়ছে।
ধনী ও দরিদ্র দেশগুলিতে গণতন্ত্রের যে বিপন্নতা, তার ধরনগুলি একেবারে আলাদা। অন্য কোনওভাবে এই অবস্থাটিকে বোঝানো যাবে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দরিদ্র মানুষরা কখনওই সমান অংশগ্রহণ করছে না। শুধু একটি উপায়েই তা নিশ্চিত হতে পারে। যদি ধনীদের পাশাপাশি, দরিদ্রদের কাছেও বিশ্বাসযোগ্য সমকালীন তথ্য সুলভে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়।
দেশগুলি নিজেকে স্বাধীন বলতেই পারে। তবে গণতন্ত্র সর্বত্রই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাচ্ছে। আদৌ যদি তা সজীব থেকে থাকে, তাহলে তা শুধুমাত্র সেই মানুষদের হয়েই কথা বলছে, যারা ক্ষমতার অধিকারী এবং তাদের যারা অন্ধ ভক্ত। অন্যদের জন্য গণতন্ত্রের কোনও অস্তিত্বই আর নেই। বিশেষ করে যারা কর্তৃপক্ষের একপেশে সিদ্ধান্তগুলির বিরোধিতা করেন। সেই কারণে সাংবাদিকদের কাজ ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। সৎ সাংবাদিকতার পথটি এখন তাই কারাগারের অন্ধ উপত্যকার ছায়ার মধ্যে দিয়ে যায়। ভারতে অনেক সাংবাদিকদের দীর্ঘ সময়ের জন্য কারাগারে বন্দি করা হচ্ছে অথবা তাঁদের বিরুদ্ধে নানান ধরনের মামলা সাজানো হয়েছে।
যখন কাশ্মিরে কর্মরত ফটো-জার্নালিস্ট সানা ইরসাদ মাট্টু পুলিৎজার পুরস্কার পান, তখন ভারতের কোনও বিমানে তাঁকে চড়তে দেওয়া হয়নি, যাতে তিনি পুরস্কারটি গ্রহণ করতে পারেন। কোভিড অতিমারির সময়ে চূড়ান্ত অব্যবস্থার সমালোচনা করার পর দানিশ সিদ্দিকি যখন আফগানিস্তানে সংবাদ সংগ্রহের সময়ে নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে প্রাণ হারান, তখন ভারতের রাষ্ট্রনেতার পক্ষ থেকে কোনও শোকপ্রস্তাব রাখা হয়নি। প্রয়াত সাংবাদিক পবন জয়সওয়াল সংবাদপত্রে লেখেন উত্তরপ্রদেশের একটি গ্রামের বিদ্যালয়ে সরকারের ভুল-প্রচারিত মিড-ডে মিল প্রোগ্রামে স্কুলে আসা শিশুদের শুধু রুটি আর নুন খাওয়ানো হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপত্র দায়ের করা হয় পুলিশ থানায়। তিনি নাকি রাজ্য সরকারের প্রতিচ্ছবিকে ভূলুণ্ঠিত করছেন। যথেষ্ট ঔদার্য দেখিয়ে অবশ্য তাঁকে পরবর্তীকালে সেই অভিযোগ থেকে মুক্ত করা হয়।
কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান একটি ভয়াবহ বলাৎকার ও হত্যা বিষয়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্য উত্তরপ্রদেশে পৌঁছান। রাস্তাতেই তাঁকে মিথ্যা অভিযোগে বন্দি বানানো হয় এই বলে যে তিনি নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভঙ্গ করতে এসেছেন এবং বেআইনি টাকা লেনদেন ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মে লিপ্ত আছেন। পরের ২৮ মাস তিনি জেলে বন্দি থাকেন। তারপরে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর জামিন মঞ্জুর করে বলে, “বিচারের জন্য যদি কোনও কণ্ঠস্বর সোচ্চার হয়ে ওঠে, সেটিকে অপরাধ বলা যাবে না। প্রতিটি মানুষেরই মুক্তকণ্ঠে কথা বলবার অধিকার রয়েছে।”
ভারতের গণতন্ত্রকে সাবালক বানানোর জন্য এবং এই মুক্তকন্ঠের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংবাদমাধ্যম (প্রেস) একটি সমন্বিত ভূমিকা পালন করে এসেছে। এবং আজ একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে ভারতীয় প্রেস তার স্বতন্ত্রতা খুইয়েছে। আজ সেই প্রেস গণতন্ত্রকে ধ্বংস করবার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, সাম্যতার আদর্শগুলিকে প্রচারের বিরুদ্ধে আক্রমণ করছে, প্রেমকে কলঙ্কিত করে ঘৃণা ও মিথ্যা চারদিকে ছড়াচ্ছে, বিরোধী কণ্ঠস্বর এবং প্রতিবাদকে স্তব্ধ করবার কাজে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আন্দোলনরত কৃষকদের উগ্রপন্থীর এবং বিরোধী কণ্ঠস্বররদের রাষ্ট্রবিরোধী দল হিসেবে আমাদের দেশের মিডিয়া তকমা লাগিয়ে দেয়। সংবিধানপ্রদত্ত কোনও মূল্যবোধকে সে পাত্তা দেয় না, যে মূল্যবোধ মুক্তকন্ঠের আইনি অধিকার দিয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়েই আমরা লক্ষ করছি কতটা ধূর্ততার সঙ্গে ইচ্ছাকৃত অপরাধীকরণের পরিসরে প্রবেশ করছে মিডিয়া। তাদের রাজনৈতিক প্রভুদের ইশারায় ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া এবং ধর্মান্ধতাকে আহ্বান করে আনার বিষয়ে তারা দ্বিধাহীন। যদি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীরা গণতন্ত্র এবং তার মূল্যবোধ নিয়ে এতটুকুও যত্নশীল হন, তাহলে নিডিয়ার সঙ্গে তাঁদের আলোচনা করা উচিত যে তথাকথিত মিডিয়া টাইকুন-রা একের পর এক রাষ্ট্রে মিডিয়াকে কীভাবে ব্যবহার করছে।
একবার কল্পনা করুন, ভারতের সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলির ব্যবহারকারীরা জানতে চাইছে, আমরা কি অপরাধীদেরকেই সাংবাদিককে পরিণত করছি অথবা সাংবাদিকদেরই অপরাধী বনে যেতে দেখছি? সাংবাদিকদেকরই অপরাধীতে পরিণত করা হয়ে থাকে, অন্তত যেভাবে তাঁরা এক সম্প্রদায়কে আরেক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উসকে চলেছে। সম্প্রতি একটি সংবাদ চ্যানেলের মালিক শপথ নিলেন প্রধানমন্ত্রীর সামনে, যে তাঁর চ্যানেলটি প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা-চিন্তাগুলিকে বাস্তবায়িত করবার চেষ্টায় রত থাকবে।
তাহলে আপনারা বুঝতেই পারছেন মিডিয়ার ব্যবস্থাপনা আর প্রশ্ন তোলবার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না, হচ্ছে আদেশ পালনের জন্য। পার্টির ক্যাডার আর সাংবাদিকের মধ্যে যে বিভেদরেখা আছে, তা অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে দুরবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি বিশেষ মিডিয়াচালিত ঘৃণামুখ্য বক্তৃতার বিরুদ্ধে বলেছে যে টেলিভিশনের যে অ্যাঙ্কররা দর্শকদের মধ্যে ঘৃণার বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছেন, তাঁদের অনুষ্ঠান যেন সম্প্রচার না করা হয়।
সাংবাদিকতা আর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ হিসেবে চালিত হয় না। এটি এখন শুধু ব্যক্তিবিশেষ দ্বারা পরিচালিত হয়। যাঁরা সততার সঙ্গে মানুষদের কাছে সংবাদ পৌঁছে দিতে চান, হয় তাঁদের ছাটাই করা হচ্ছে, নয়তো কম মাইনে দেওয়া হচ্ছে, এমনকি তাঁদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আমি ধন্যবাদ দিই সেই সাংবাদিকদের, যারা সরকারি নীতির প্রতি ভিন্নমত পোষণ করেন, এবং কর্তৃপক্ষদের কাজের সমালোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন সারা পৃথিবী জুড়ে। আদৌ যদি গণতান্ত্রিক ভাবধারার এখনও কোনও অস্তিত্ব থাকে, তাহলে তা সরকারি প্রচারযন্ত্রে পাওয়া যাবে না। সেই ভাবধারা এখন সেই নিঃসঙ্গ নির্ভীক মানুষগুলির হাতে রয়েছে, যাঁদের অনেককেই নিজেদের সাংবাদিক বৃত্তটির থেকেও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। ওঁদের সঙ্গে আমাদেরও দাঁড়াতে হবে, ওঁদের পাশে আমাদের দাঁড়ানো প্রয়োজন।
উদ্যোক্তারা আমার সঙ্গে হয়তো সহমত হবেন যে আমাদের এই সম্মান প্রদান শুধু আমাদের একার কাজকর্মের জন্য নয়, সেই সাংবাদিকদের জন্যেও যারা আমাদের চেয়ে ঢের কম পুঁজির ভরসায় এবং অনেক বেশি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে অসামান্য কাজ করে চলেছেন। এই সম্মান প্রদান উপস্থিত দর্শকদেরও একটি স্বীকৃতি যে তাঁরা আমার মতো সাংবাদিকদের সহায়তা করছেন। আপনাদের করতালি, শুধু আমাদের জন্যেই নয়, সেই অস্বীকৃত সাংবাদিকদের জন্যেও।
এখানে আমার বক্তব্য শেষ করবার আগে আমি আমার স্ত্রী নয়নাকে এই মঞ্চ থেকে ধন্যবাদ জানাই এত বছর ধরে আমার প্রতি বিশ্বাস নিয়ে আমার পাশে আছেন এবং আমার মেয়েদের, যারা আমার এই যাত্রাপথে আমার সঙ্গেই এগিয়ে চলেছে। আমার সহকর্মী বৃন্দাকেও ধন্যবাদ জানাই, যিনি আমার এই বক্তব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিয়েছেন।
আজ যখন আমি আপনাদের সামনে কথা বলছি, আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে আমার ‘মা’, যিনি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে গতকাল প্রয়াত হয়েছেন। আজ আমার এই বক্তব্য নিজের কানেই কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে, কারণ আমার মা আর আমার এই দুনিয়ার শরিক নন। মহিলা হিসেবে আমার মা ছিলেন অত্যন্ত ভাল মানুষ, নির্ভীক ছিলেন উনি। আমি বিশ্বাস করি উনি নিজের শক্তির কিছুটা আমার মধ্যেও সঞ্চারিত করেছেন, যেভাবে মায়েরাই করতে পারেন। আমার ভাইবোনেরা এবং আমি এমন এক মহিলাকে দেখে বড় হয়েছি, যাঁর দায়বদ্ধতা এবং ধৈর্যের তুলনা হয় না। সম্ভবত, তাঁর আশীর্বাদ ছিল বলেই আমি এখানে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আজ কথা বলতে পারছি।
বাড়িতে কখনও আমরা ওঁকে ‘মা’-এর নাম ধরে ডাকিনি। আজ আমি তাঁর নাম উচ্চারণ করব আপনাদের উপস্থিতিতে, এই সম্মান আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে। যশোদা, আমার মা— যশোদা পাণ্ডে।
ধন্যবাদ।