জয়জীৎ দাস
লেখক একজন স্বাধীন সাংবাদিক। নির্বাচনের সময়ে গোটা কর্নাটকে নিবিড়ভাবে তথ্যানুসন্ধান চালানোর পরে তিনি এই নিবন্ধটি লেখেন যেটি ২৭ মে গ্রাউন্ডজিরো পত্রিকায় ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। লেখাতে সাক্ষাৎকার নেওয়া ব্যক্তিদের নামগুলি পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে
এবারের এপ্রিল মাসে কর্নাটকে বেশ গরম ছিল। বেঙ্গালুরুতে ৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু অন্যদিকে রাজনৈতিক উত্তাপ ছিল বেশ সন্দেহজনকভাবে কম। মাত্র একমাসের মধ্যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, কিন্তু রাস্তাঘাট বা বসত এলাকাগুলিতে প্রায় কোনও হেলদোলই নেই। পার্টিগুলির রংবেরঙের পতাকার ঝলমলানি নেই, নেতানেত্রীদের ঢাউস ঢাউস কাট-আউট নেই। রাস্তাঘাটে পেল্লায় মিছিল বা রোড শো… কিছুই নেই।
‘জাতীয়’ সংবাদমাধ্যম যখন এই নির্বাচনকে সাম্প্রতিককালের মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন আখ্যা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তখন বহিরাগত সাংবাদিক এবং পর্যবেক্ষকদের কাছে এ এক নিরাশার ছবি বইকি! তাঁদের একটা অংশ তো এমনও ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলেন যে ভোটাররা সম্পূর্ণ নিরুত্তাপ এবং ভোটের হারও যথেষ্ট কম থাকবে।
যদিও ১০ মে রেকর্ড ৭৩.১৯ শতাংশ ভোট পড়তে দেখা গেল। বোঝা গেল, প্রচার যতই লো-ভোল্টেজ হোক না কেন, কন্নড় জনগণ দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েই এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। যে-সব পণ্ডিতেরা এতদিন একটা স্পষ্ট সিদ্ধান্তহীন রায় আসতে চলেছে বলে আসছিলেন, তাঁরা জমানা বদলের পূর্বাভাস দিতে শুরু করলেন। ভোট পড়ার হার বেশি হলে যা অনেকটা স্বতঃসিদ্ধ। বিভিন্ন একজিট পোল সার্ভেগুলিও তাঁদের সঙ্গে একমত হল।
তিনদিন পরে ফল প্রকাশ হলে বিষয়টা নিশ্চিত হল: ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার বরখাস্ত; পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কংগ্রেস ক্ষমতায়। বেঙ্গালুরুর আম্বেদকর ভিধি-তে বিধান সৌধের নিম্নকক্ষে কংগ্রেসের এখন ১৩৫টি আসন। ১৯৮৯-এর পর থেকে এত আসন আর কোনও দল পায়নি; ১৯৯৯-এর পর এই প্রথম কোনও দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল।
জনতার রায় তো পরিষ্কার। কিন্তু এ কি নিছকই অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সির মতো সহজসরল? আমাদের মনে রাখতে হবে কর্নাটকের কিন্তু নিয়মিত সরকার বদলানোর ঐতিহ্য আছে। বেঙ্গালুরুকে পুওর ম্যান’স সিলিকন ভ্যালিতে রূপান্তরিত করার কারিগর যাঁকে বলা হয়, সেই এসএম কৃষ্ণের মতো শক্তিশালী মুখ্যমন্ত্রীও ২০০৪ সালে ২২৪টি আসনের মধ্যে মাত্র ৬৫টি জিততে পেরেছিলেন। শেষ মুখ্যমন্ত্রী, যিনি একটা মেয়াদ ক্ষমতা ধরে রাখতে পারতেন, তিনি হলেন রামকৃষ্ণ হেগড়ে। কিন্তু হেগড়ে ১৯৮৪ সালে তাঁর প্রথম মেয়াদ চলাকালীনই ইস্তফা দেন, কারণ সে-বছরের লোকসভা ভোটে জনতা পার্টি খুবই খারাপ ফল করেছিল, এবং পরের বছর আবার জিতে এসে মুখ্যমন্ত্রী হন দ্বিতীয়বারের জন্য।
বা এই ফল কি কোনও বৃহত্তর প্রবণতার ইঙ্গিতবাহী? রাজ্যসভা সাংসদ শরদ যাদবকে এখনও অনেকেই বৃহত্তর বিরোধী ঐক্যের সম্ভাব্য নিউক্লিয়াস বলে মনে করেন। তিনি সম্প্রতি বলেছেন কর্নাটকের ফল “সারা দেশেই হতে পারে” যদি “শ্রমজীবী জনতা শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ থাকে”। তিনি ঠিক বা ভুল যাই হোন, কর্নাটকে বিজেপির হার যে বিরোধীদের উৎসাহিত করবে তা নিয়ে সংশয় নেই। অন্যদিকে চিকমাগালুর কেন্দ্রে হারের খবর আসতেই বিজেপির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক সিটি রবি তড়িঘড়ি দাবি করেছেন যে “এই হার ব্যক্তিগত হার, আদর্শের হার নয়।”
প্রকৃত বাস্তবতা সম্ভবত, এই দুইয়ের মধ্যবর্তী কোনও স্থানে অবস্থান করছে। এবং যুযুধান দুই পক্ষেরই এর থেকে যথেষ্ট শিক্ষা নেওয়ার রয়েছে। বিজেপি যেমন তাদের ঝুলির একমাত্র দ্রাবিড়ীয় রাজ্যটিকে ধরে রাখার সুযোগ ফস্কেছে, কংগ্রেসও তেমনই বিজেপিকে হটানোর জন্য তীব্র, উদ্দেশ্যমুখী প্রচার চালিয়েছে। দুটো বিষয়ই কিন্তু স্বভাববিরুদ্ধ।
খুব হার্ডকোর বিজেপি সমর্থকের কাছেও বাসবরাজ বোম্মাই সরকারের কোনও ভাল ভাবমূর্তি যে ছিল না তা অস্বীকারের কোনও জায়গা নেই। নির্বাচনের আগে আগে তো বটেই, এমনকি তার বেশ কিছু মাস আগে থেকেই সাধারণ কথাবার্তার মধ্যেই এর স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। পূর্বসূরি বিএস ইয়েদুরিয়াপ্পা যে শূন্যস্থান ছেড়ে গিয়েছিলেন বোম্মাইয়ের জন্য তা একটু বেশিই বড় হয়ে গেছিল।
কর্নাটকের বিজেপির ‘সাকসেস স্টোরি’র ঢক্কানিনাদে এই সত্যটা চাপা পড়ে গেছিল যে এই রাজ্যে বিজেপির ট্র্যাক রেকর্ড কখনওই বিশেষ সুবিধের ছিল না। একজন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীও এই রাজ্যে নিজের মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। এখানে তাদের প্রথম নির্বাচনী সাফল্য ১৯৯১-তে, আডবানির রথযাত্রার ফলশ্রুতিতে। সে-বছর তারা এখানে ৪টি লোকসভা আসনে জয়লাভ করেছিল। ১৯৯৪ সালের বিধানসভা ভোটে অবিভক্ত জনতা দল কংগ্রেসকে হারিয়ে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করে এবং বিজেপি ৪০টি আসন জিতে প্রধান বিরোধী দল হয়। পাঁচ বছর পর কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় ফিরলেও প্রধান বিরোধী দল বিজেপিই থেকে যায়। সেই সময়ে কেন্দ্রে বিজেপিকে সমর্থনের প্রশ্নে জনতা দল দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। জনতা দল (সংযুক্ত) এনডিএ-তে যোগ দেয়, এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়ার নেতৃত্বে জনতা দল (সেকুলার) বিজেপি এবং কংগ্রেস উভয়ের থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখার অবস্থান নেয়।
এই সময় থেকেই বিজেপি এই রাজ্যে বড় কিছু করার কথা ভাবা শুরু করে। ১৯৯৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বেল্লারিতে সুষমা স্বরাজ সোনিয়া গান্ধির বিরুদ্ধে ভোটে লড়েন— যদিও পরাজিত হন। ২০০৪-এর বিধানসভা ভোটে বিজেপি এ-রাজ্যে ৭৯টি আসন জিতে একক বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে আসে। কংগ্রেস জেডি(এস)-এর সমর্থনে সরকার গড়লেও সেই সরকার দু বছরও টেকেনি।
২০০৬-এর প্রথমদিকে জেডি(এস) চমকপ্রদভাবে বিজেপির সঙ্গে একটি ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তিতে সামিল হয়। দেবগৌড়া-পুত্র কুমারস্বামী মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন, এবং চুক্তি হয় ২০ মাস পরে তিনি কুর্সি বিজেপির রাজ্যপ্রধান ইয়েদুরিয়াপ্পাকে ছেড়ে দেবেন। ঘটনাচক্রে তিনি সেই চুক্তি ভঙ্গ করেন এবং ২০০৭-এ প্রথম দফায় মুখ্যমন্ত্রী পদে ইয়েদুরিয়াপ্পার স্থায়িত্ব হয় মাত্র এক সপ্তাহ। তারপর রাজ্যবাসী আরও নানা রাজনৈতিক নাটক প্রত্যক্ষ করেন এবং শেষমেশ রাজ্যে কয়েক মাসের জন্য রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়।
কিন্তু পরের বছর বিজেপিকে ১১০টি আসনে জিতিয়ে ইয়েদুরিয়াপ্পা আবার ফিরে এলেন। বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণের কোনও রাজ্যে বিজেপির এটিই প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকা। এই মেয়াদের মাঝপথেই যদিও দুর্নীতির অভিযোগে ইয়েদুরিয়াপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয় (রেড্ডিভাইদের মনে আছে নিশ্চয়ই?)। কিন্তু রাজ্য পার্টিতে তাঁর প্রভাব অক্ষুণ্ণ রইল। তাঁর উত্তরসূরি ডিভি সদানন্দ গৌড়ার সঙ্গে যখন তাঁর মতবিরোধ তৈরি হয় তখন গৌড়াকে কুর্সি ছাড়তে হয় এবং মুখ্যমন্ত্রী হন জগদীশ সেত্তার।
অনৈতিকতা এবং ঘনঘন মুখ্যমন্ত্রী বদলের অভিযোগে ২০১৩-র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ধরাশায়ী হয়, ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস। অন্যদের টপকে মুখ্যমন্ত্রী হন সিদ্দারামাইয়া। তিনি আগে ছিলেন জেডি(এস)-এ, এবং জেডি(এস) যে দুবার রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছে, দুবারই তিনি উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। সিদ্দারামাইয়া হলেন কর্নাটকের কেবলমাত্র দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী যিনি মুখ্যমন্ত্রী পদে পুরো পাঁচ বছরের মেয়াদ কাটাতে পেরেছেন।
কিন্তু এই ঘটনা কর্নাটকের ক্ষমতাসীন সরকারকে বদলে ফেলার প্রবণতাকে নস্যাৎ করে না। ২০১৮-তে নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহের নেতৃত্বে দেশজুড়ে ওঠা বিজেপি-ঝড়ে কংগ্রেস টালমাটাল হয়ে গেছিল। বিজেপি সে-বছর এ-রাজ্যে বিধানসভায় আবার একক বৃহত্তম পার্টি হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ৯টি আসন আগেই তাদের থেমে যেতে হয়। কংগ্রেস সুযোগটা নেয়, এবং বিজেপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার জন্য জেডি(এস)-কে— যারা মাত্র ৩৭টি আসন জিতেছিল— সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেয়। কুমারস্বামী দ্বিতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হন।
এই ব্যবস্থা ভেঙেছিল কুখ্যাত ‘অপারেশন লোটাস’। কংগ্রেসের ১৫ জন এবং জেডি(এস)-এর দুজন বিধায়ককে ভাঙিয়ে বিজেপি ফের কুর্সির দখল নেয়। ২০১৯ সালে ইয়েদুরিয়াপ্পা আবার ফিরে আসেন কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। কিন্তু সেও মাত্র দু-বছরের জন্য।
২০২১-এর ২৮ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়ে বাসবরাজ বোম্মাই ইয়েদুরিয়াপ্পার কাছ থেকে একটি রাজনৈতিক বদ্ধ ডোবা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন। বিজেপি দলটা একসময়ে গর্ব করে বলত যে তারা হল ‘আ পার্টি উইথ ডিফারেন্স’। কিন্তু এখন দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ হওয়াটা তাদের একটা রুটিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্নাটকেও যেভাবে তারা দলত্যাগ বিরোধী আইনকে পাশ কাটিয়ে কুর্সি দখল করেছিল, বোঝা গেছিল এখানেও ব্যতিক্রমী কিছু ঘটছে না।
১৭ জন বিধায়ক পদত্যাগ করায় কর্নাটক বিধানসভার শক্তি ২২৩ (স্পিকার বাদে) থেকে কমে দাঁড়ায় ২০৬-এ। ফলে আস্থাভোটে কুমারস্বামী পরাস্ত হন। অধিকাংশ পদত্যাগী বিধায়কই যখন উপনির্বাচনে বিজেপি-টিকিটে জিতে এলেন এবং ক্যাবিনেটেও সামিল হলেন, তখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে ঘোড়া কেনাবেচার অভিযোগ নিছক গুজব ছিল না। এঁদের মধ্যে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকও পেলেন। যেমন রাজস্ব (কে গোপালাইয়া), শ্রম (এএস হেব্বার), পর্যটন এবং পরিবেশ (আনন্দ সিং), সেচ (রমেশ জারকিহোলি), কো-অপারেশন (এসটি সোমশেখর), নগরোন্নয়ন (বি বাসবরাজ)। উপনির্বাচনে হেরে যাওয়া দুজন বিধায়ককে বিধান পরিষদে নিয়ে আসা হল। লোভনীয় মন্ত্রক দেওয়া ছাড়াও সরাসরি নগদ অর্থ বিনিময়ও যে হয়েছে, সে অভিযোগও বাড়তে লাগল দ্রুতগতিতে।
রাজ্য যখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসতে চাইছে, তখনও একের পর এক ঘটনা শিরোনামে উঠে আসতে থাকল। সাধারণ সরকারি কর্মচারী থেকে মন্ত্রীদের নাম পর্যন্ত— যাঁদের মধ্যে বেশ কিছু দলত্যাগী— উঠে আসতে লাগল বিভিন্ন দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের তালিকায়।
সরকারি ঠিকাদাররা অভিযোগ করলেন যে সরকারি প্রকল্পের কাজ করার জন্য তাঁদের প্রকল্প-মূল্যের ৪০ শতাংশ ‘কমিশন’ হিসেবে দিতে হচ্ছে। কর্নাটক স্টেট কন্ট্রাকটরস’ অ্যাসোসিয়েশন (কেএসসিএ) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছেও এই নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে এবং বিভিন্ন প্রতিবাদসভারও আয়োজন করেছে। কেএসসিএ প্রেসিডেন্ট আর মঞ্জুনাথ জানুয়ারি মাসে অভিযোগ জানালেন যে, যে-সমস্ত সরকারি প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছরের বেশি সেগুলির জন্য সরকারকে ২৫০০০ কোটি টাকা করে ঘুষ দিতে হচ্ছে। ঘটনা চূড়ান্ত আকার নিল যখন সন্তোষ পাটিল নামে এক ঠিকাদারকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। তিনি তার আগেই গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী কেএস ঈশ্বরাপ্পার বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ করেছিলেন। এই ঈশ্বরাপ্পা আবার রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন প্রধান। বোম্মাই তাঁকে ক্যাবিনেট থেকে সরিয়ে দিলেও তাতে সরকারের ভাবমূর্তি খুব একটা মেরামত হয়নি।
সাব-ইনস্পেকটর (পিএসআই) নিয়োগের পরীক্ষায় প্রতারণার দায়ে কর্নাটক পুলিশ ১০০ জনেরও বেশি লোককে গ্রেপ্তার করেছে। এই পিএসআই কেলেঙ্কারিতে পরীক্ষার্থীদের ৮৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে বলে রাজ্যের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) মেনে নিয়েছে। কংগ্রেসের অভিযোগ উচ্চশিক্ষামন্ত্রী অশ্বথ নারায়ণের আত্মীয়রা এই কেলেঙ্কারিতে যুক্ত। বিরোধীদের আরও অভিযোগ কোভিড-১৯ অতিমারির সময়ে জনসাধারণের মধ্যে যে ফুড কিট এবং শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে যে টুল কিট বিতরণ করা হয়েছিল তাতে কোটি টাকার কেলেঙ্কারি হয়েছে এবং শ্রমমন্ত্রী হেব্বার এর সঙ্গে যুক্ত। কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে অতিমারির সময়ে অক্সিজেন এবং বেড সরবরাহ নিয়ে; স্কুলশিশুদের জন্য ডিম সরবরাহ নিয়ে; আর্থিক ক্ষেত্রে এবং জমি অধিগ্রহণ নিয়েও।
বোম্মাইয়ের ওপর ব্যক্তিগতভাবে কোনও অভিযোগ না থাকলেও নির্বাচনী প্রচারে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দলের ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন করাটা তাঁর কাছে যথেষ্ট কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মিডিয়া রিপোর্ট থেকে এরকমও জানা যাচ্ছে যে, মোদিকেও নির্বাচনী প্রচারে স্থানীয় নেতাদের বেশি সামিল না-করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
ভোটারদের অনেকেই পূর্ববর্তী ইয়েদুরিয়াপ্পা-আমলের সঙ্গে বোম্মাই-আমলের মিল পেতে শুরু করে দিয়েছিলেন। বিজেপির পক্ষে কেবল কয়েকজন মাত্র মন্ত্রীকে ইস্তফা দিইয়ে কংগ্রেসের “৪০% সরকারা” প্রচারের মোকাবিলা করা বেশ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষত যেখানে একগাদা দাগী মন্ত্রী শেষতক ক্যাবিনেটে বহাল রয়ে গেছিলেন।
রাজ্যের অর্থনীতি এবং অতিমারি-সঙ্কটকে বোম্মাই সরকার যেভাবে পরিচালনা করেছে, তা নিয়েও বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত জনগণের বিস্তর অভিযোগ। মুদ্রাস্ফীতি এবং ভাল উপার্জন করা যায় এমন কাজের অভাবের বিষয়গুলি নিয়ে নির্বাচনের সময়ে ব্যাপক চর্চা হয়েছে। কৃষকদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আয় দ্বিগুণ হওয়া তো দূরের কথা জীবনধারণ করার জন্য ন্যূনতম উপার্জনটুকু করতেই নাভিশ্বাস উঠেছে।
“কোনও সাহায্যের কথা বাদই দিন, লকডাউনের সময়ে আমরা কেমন আছি তার খোঁজ নিতেও কেউ আসেনি”— বেঙ্গালুরু গারমেন্ট সেকটরের এক অত্যন্ত দক্ষ শ্রমিক জয়াম্মা বলছিলেন— “আমরা বেঁচে থাকার জন্য এদিক-ওদিক ঘুরে মরেছি, যদিও সব কারখানাই বন্ধ ছিল।”
মঞ্জুলা, বেঙ্গালুরুর দক্ষিণ শহরতলিতে একটি খাবারের দোকান চালান, বলছিলেন দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলি খাবার এবং অন্য কিছু সাহায্য টুকটাক করলেও সরকারের তরফে কোনও উদ্যোগই দেখা যায়নি। উত্তর কর্নাটকের গাদাগের একটি বছর কুড়ির মেয়ে কাজের সন্ধানে নামার জন্য কলেজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর কথায়, “রেশন থেকে চাল-গম তোলাটাও দুঃসাধ্য হয়ে গেছিল কারণ অনেক সময়েই আঙুলের ছাপ মিলছিল না।”
আইটি ইন্ডাস্ট্রি সংক্রান্ত পরিষেবার জন্য কর্নাটকের সারা বিশ্বে নাম আছে। সাম্প্রতিকতম বাজেট এস্টিমেট অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবর্ষে কর্নাটকের আর্থিক বৃদ্ধি বেশ স্বাস্থ্যকর— ৯.৫ শতাংশ। রাজ্যের প্রায় ২৩ লক্ষ কোটি টাকার জিডিপি-র দুই-তৃতীয়াংশই পরিষেবা ক্ষেত্রের অবদান। ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে জিডিপি-র ক্ষেত্রে কর্নাটকের স্থান এখন পঞ্চম এবং মাথাপিছু জিডিপি-র ক্ষেত্রে অষ্টম।
এখন এই বহুখ্যাত সিলিকন ভ্যালি রাজ্যের রাজস্ব তো বাড়াচ্ছে— রাজ্যের জিডিপি-র এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসে বেঙ্গালুরু শহর জেলা থেকে— কিন্তু তা একই সঙ্গে উপার্জনের ক্ষেত্রে এক ব্যাপক অসাম্যও তৈরি করছে। এই ক্ষেত্রের বেশিরভাগ মোটা মাইনের কর্মচারীই রাজ্যের বাইরে থেকে আসা। এক স্থানীয় শ্রমিক সংগঠক আফশোস করছিলেন, “আমাদের ছেলেরা বড়জোর ড্রাইভার বা হাউসকিপিং-এর ঠিকা কাজ পাচ্ছে।” ২০২১-২২-এ বেঙ্গালুরু শহর জেলার মাথাপিছু উপার্জন ছিল ৬.২ লক্ষ টাকা। কর্নাটকের বাকি ২৯টি জেলার মধ্যে মাত্র ৫টি জেলা এই সংখ্যার অর্ধেক ছুঁতে পেরেছে।
স্বাধীনতার পরে কেন্দ্রের উদ্যোগে কর্নাটকে অনেক সরকারি ভারি শিল্প গড়ে ওঠে। যেমন হিন্দুস্থান এরোনটিকস লিমিটেড, ইন্ডিয়ান টেলিফোনস, ইত্যাদি। এর সঙ্গে অনেক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পও গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে এয়ারবাস, টয়োটা মোটর কর্পস-এর মতো বহুজাতিক কোম্পানির ভারতীয় শাখাগুলিও ছিল। রাজ্য একটি ম্যানুফ্যাকচারিং হাব-এ পরিণত হয়। কিন্তু বর্তমানে আইটি সেক্টরের ওপর অত্যধিক নির্ভরতার ফলে এই ক্ষেত্রের গুরুত্ব অনেক কমে গেছে। রাজ্যের জিডিপি-তে ম্যানুফাকচারিং শিল্পের অবদান বর্তমানে মাত্র এক-পঞ্চমাংশ। এর সঙ্গেই এই ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে ভিনরাজ্যের সস্তা শ্রমিকদের অভিবাসন। এই শ্রমিকরা আসছেন মূলত উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে। এঁদের দিয়ে অনেক কম পয়সায় কাজ করিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। ফলত রাজ্যের মানুষদের জন্য আইটি সেক্টরের হোয়াইট কলার কাজের সঙ্গে সঙ্গে এই ব্লু কলার কাজের ক্ষেত্রেও একটা সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।
ফলে যখন ঘরভাড়া ইত্যাদি খরচ বেড়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে, মানুষের সাধারণ উপার্জন তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। জয়াম্মা এবং তাঁর সহকর্মীরা মাসে ১১০০০ টাকার আশেপাশে আয় করেন। তিনি বলছিলেন, “ঘরভাড়ার জন্য মাসে কম করে ৬০০০ টাকা লাগে; রান্নার গ্যাসের একটা সিলিন্ডারের দাম ১২০০ টাকা; চাল ডাল থেকে শুরু করে ইলেকট্রিসিটি, বাসভাড়া সবকিছুরই খরচ অনেক বেড়ে গেছে।”
কিন্তু সম্ভবত সবচেয়ে দুর্দশায় রাজ্যের কৃষকরা। রাজ্যের জিডিপিতে মৌলিক ক্ষেত্রগুলির অংশ মাত্র ১৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। কৃষি এবং ফুলচাষের ভাগ তার মধ্যে ১০ শতাংশ মাত্র। কিন্তু রাজ্যের জনসংখ্যার একটা বিপুল অংশ— কোনও কোনও হিসেব অনুযায়ী তো অর্ধেকেরও বেশি— এখনও কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। আর কৃষকদেরও ৮০ শতাংশ প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র চাষি।
২০২২-এ প্রধানমন্ত্রী কৃষকদের উপার্জন দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছিলেন। কর্নাটকের বিপুল সংখ্যক কৃষক জনগণের কাছে সেই ঘোষণা অনেকটা বিদ্রূপের মতো শোনাচ্ছে। ২০২২-২৩-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী কৃষি থেকে রাজ্যের জিডিপি-র মাত্র ৩.২ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা। অনেকের মতেই চাষের খরচ বেড়ে যাওয়া আর ফসলের দাম না-পাওয়ার ফলেই কৃষির এই দুরবস্থা। সরকারের অধিগ্রহণ-তালিকায় অনেক ফসলই আছে। কিন্তু তাতে এত দেরি হয় যে ধান বা রাগির মতো খাদ্যশস্য চাষ করেন যে কৃষকরা তাঁদের খোলা বাজারে কম দামে ফসল বিক্রি করে দিতে হয়। আখ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় অর্থকরী ফসল। কিন্তু আখচাষিদের মূলত প্রাইভেট মিলগুলির ওপরেই নির্ভর করতে হয়। ক্ষতিপূরণের জন্য তাঁরা প্রায় এক দশক ধরে আন্দোলন করছেন এবং বর্তমানে তাঁদের বক্তব্য আখচাষ ক্রমশই অনাকর্ষণীয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মান্ডিয়ার এক আখচাষি এস কৃষ্ণ, যিনি একটি কৃষক সংগঠন কর্নাটক রাজ্য রায়ত সংঘের সঙ্গে এবং কো-অপারেটিভ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, জানালেন, “সরকার আমাদের গুরুত্বই দিচ্ছে না। আমাদের হয়তো এক বছর চাষ বন্ধ রাখতে হবে।”
“কৃষি-সমস্যা একটা বড় সমস্যা এবং ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ-নিয়ে কথা হয়েছে সবচেয়ে কম।” বলছিলেন সিপিআই(এম)-পরিচালিত কৃষক সংগঠন কর্নাটক প্রান্ত রায়ত সংঘ-এর সাধারণ সম্পাদক যশবন্ত। তিনি আরও জানালেন, এই সরকারের আমলে সরকারের ফসল অধিগ্রহণের সহায়ক মূল্য প্রায় বাড়েইনি এবং কৃষকরা প্রায়শই সেটুকু মূল্যও পান না। সারের দাম প্রচুর বেড়ে গেছে এবং গবাদি পশুর খাবারের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। “ক্রপ প্রাইস কমিশন এখন একটি মুণ্ডহীন সংস্থা,” বললেন তিনি।
কৃষকদের আরও অভিযোগ খাদ্যাভাব, খরা এবং রোগ ছড়ানোর মতো সমস্যাগুলির মোকাবিলা করার জন্যও সরকার কিছু করেনি। মান্ডিয়ার মাদ্দুর তালুকার একটি গ্রাম চাতরালিঙ্গানাডোড্ডির এক কৃষক বলছিলেন, “আমাদের গ্রামের একর একর জমি এখন ফাঁকা পড়ে আছে। জমির মালিকরা সবাই শহরে চলে গেছে।” কম বৃষ্টিপাত এবং অপ্রতুল সেচব্যবস্থার অর্থ হল বোরওয়েল বসানোর জন্য কৃষকদের মোটা টাকা ধার করতে হয়। অনেকের কাছেই সেই ঋণের ফাঁদ অসহনীয় হয়ে উঠছে। পাশের গ্রাম মাল্লানয়াকানাহাল্লির মঞ্চাইয়া এমএস বলছিলেন, “কয়েক লাখ টাকা দেনার দায়ে ডুবে আমার ছেলে গত বছর আত্মহত্যা করেছে।” তাঁর ছেলে সন্দেশ গৌড়া মালবেরি চাষ করার জন্য অনেক টাকা ঋণ করেছিলেন।
কৃষিতে আয় কমার ফলে মজুরিও কমেছে, যার ফল ভোগ করছেন কৃষি-শ্রমিকরা। এবং এক্ষেত্রেও অভিবাসী কৃষিশ্রমিকরা অনেক কম টাকায় কাজ করার ফলে সমস্যা বাড়ছে। মাদিকেরির বাসিন্দা এস আলি বলছিলেন, “কুর্গে এখন অসম থেকে আসা শ্রমিকদের দিয়ে কফি চাষ করানো হচ্ছে কারণ তারা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরিতে কাজ করতে রাজি।” মান্ডিয়ার আর এক কৃষকের বক্তব্য, “কিছু করার নেই। আখ চাষে এখন যথেষ্ট লাভ হয় না। খরচ তো কমাতেই হবে।” তিনিও দেখালেন সার, বিদ্যুৎ, পেট্রোল সব কিছুরই দাম বাড়ছে, আর ওদিকে ফসলের দাম রয়ে গেছে প্রায় একই। তাঁর কথা, “যে-ই আগামী সরকার গড়ুক না কেন, তাকে আমাদের সাহায্য করতেই হবে।”
এইসব সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বোম্মাই সরকারের তরফে কিছু উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা ছিল। মঞ্জুলা বলছিলেন, “জিএসটি চালু হওয়ার পর থেকে আমি আর মুদ্রাস্ফীতি সামালই দিতে পারছি না।” জয়াম্মার এক সহকর্মী শ্বেতা বলছিলেন, “এখানকার সরকারের এসব নিয়ে আদৌ কোনও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।”
এই সমস্ত সমস্যার সমাধান খোঁজার বদলে রাজ্যের দক্ষিণপন্থী সরকার একমাত্র যেটা করে গেছে সেটা হল সাম্প্রদায়িক বিভেদ ছড়ানো। এই সময়ের মধ্যে কর্নাটক বড় বড় কিছু সাম্প্রদায়িক বিতর্ক প্রত্যক্ষ করেছে— শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করা, কিছু নির্দিষ্ট মেলা বা ধর্মসভায় মুসলিম ব্যবসায়ীদের অংশ নিতে বাধা দেওয়া। স্থানীয় স্তরে বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। বেঙ্গালুরুর এক ছোট ব্যবসায়ী সাদাত বলছিলেন, “আমাদের এখন সব সময় আতঙ্কের মধ্যে কাটাতে হচ্ছে। নজরে পড়ার ভয়ে আমরা দোকানের সাইনবোর্ডে নিজেদের নাম লেখা বন্ধ করে দিয়েছি।” মাদ্দুরের এক শোরুম-কর্মী শোয়েব আফশোস করছিলেন, “দেখুন, স্থানীয় মানুষ, সে হিন্দু বা মুসলিম যা-ই হোন, শান্তিতে থাকতে চান। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলিই লোককে উস্কাতে থাকে। আর একবার সংঘর্ষ শুরু হলে সে গিয়ে প্রাণহানিতে থামে।”
পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বিজেপি-র শেষ চাল ছিল রাজ্যের সংরক্ষণ নীতির পরিবর্তন ঘটানো। স্বাভাবিকভাবেই, কোপটা পড়ে মুসলিমদের ওপর— ওবিসি-র মধ্যে তাঁদের জন্য যে ৪ শতাংশ সংরক্ষণ ছিল তা বাতিল করা হয়, এবং সেটা সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয় ভোক্কালিগা এবং বীরশিব-লিঙ্গায়েতদের মধ্যে। এর ফলে রাজ্যে তফসিলি জাতিদের জন্য যে ১৭ শতাংশ সংরক্ষণ তাতে সামিল হল ১০১টি জাত বা সম্প্রদায়: ‘এসসি লেফট’— দলিতদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া, যেমন মাদিগা সম্প্রদায়— তাঁদের জন্য ৬ শতাংশ; ‘এসসি রাইট’— তুলনামূলকভাবে কম পিছিয়ে পড়া, যেমন হোলিয়া সম্প্রদায়— তাঁদের জন্য ৫.৫ শতাংশ; বানজারা-দের মতো সম্প্রদায়, যাঁদের অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ অস্পৃশ্য মনে করে না— তাঁদের জন্য ৪.৫ শতাংশ; এবং বাকি সবার জন্য মোট ১ শতাংশ।
কিন্তু এই পদক্ষেপও বিজেপির পক্ষে যায়নি। ২৫ মার্চ ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ শুরু হয়। মুসলিমরা ক্ষুব্ধ হবেন জানাই ছিল, কিন্তু ভোক্কালিগাদের একাংশ, এবং বিশেষ করে বানজারা সম্প্রদায়ের মানুষজন বিক্ষোভ দেখান। মূল অভিযোগটি ছিল, এরকম একটা পদক্ষেপের আগে সরকার সম্প্রদায়গুলির সঙ্গে কোনওরকম আলোচনা করেনি।
এটা অনুমান করা যেতে পারে যে বিজেপি যদি কোনওভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গড়েও ফেলত, তাহলেও সরকার পরিচালনা নিয়ে তাদের ঝুলিতে বলার মতো নতুন কিছু থাকত না। ফলে যেটা তাদের একমাত্র পুঁজি, সেই মোদি-ক্যারিশমাকে সম্বল করেই তারা ভোটযুদ্ধে নেমেছিল। এই মঞ্জুলা যেমন লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতির জন্য জিএসটি (একটি কেন্দ্র সরকারের প্রকল্প)-কে দায়ী করেও বলেন, “আমি মোদিস্যারকে স্যালুট করি। তিনি দেশের জন্য ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে চলেছেন।” এতেই বোঝা যায় মোদি এখনও প্রচুর ভোটারের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে পেরেছেন।
প্রথমদিকে বিজেপির প্রাণহীন প্রচারের মধ্যেই তাদের নেতৃত্বহীনতার সঙ্কট ফুটে উঠেছিল। তারপরেই, খবরে প্রকাশ, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সমস্ত রাশ নিজেদের হাতে তুলে নেয়। সে-খবর যদি সত্যি হয়, তবে বলতে হবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে স্থানীয় নেতৃত্বকে গুরুত্বহীন করে দেওয়ার অভিযোগ এটাই প্রথম নয়। এর আগে বহুবার তারা এহেন কাণ্ড করেছে, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মতো বড় রাজ্যেও (২০২১)। যাই হোক, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিন্তু বেশ জোরেসোরেই এখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, মোদি-অমিত শাহ-যোগী আদিত্যনাথ সহ সব বড় নেতাই একাধিকবার করে রাজ্যে প্রচারে এসেছেন, কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয়নি। ভোটের অল্প কিছুদিন আগেও তারকাসমৃদ্ধ সভায় চেয়ার ফাঁকা পড়েছিল বলে খবরে জানা যাচ্ছে। এরই চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ভোটের আগের শেষ রবিবার, যেদিন মোদি বেঙ্গালুরু শহরে একটি ফ্লপ রোড শো করেন।
বিজেপির প্রচারের লক্ষ্যহীনতা দিল্লির একটি গবেষণা সংস্থা লোকনীতি সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজ-এর করা একটি সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়: প্রচার শুরুর আগে কর্নাটকের ৩৯ শতাংশ ভোটার নিশ্চিত ছিলেন কাকে ভোট দেবেন, ৬১ শতাংশের মনস্থির ছিল না। এর থেকে অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সির ভাল প্রভাব বোঝা যায়, যদিও বিজেপি তখনও কংগ্রেস এবং জেডি(এস)-এর চেয়ে এগিয়ে ছিল। প্রচার শুরুর আগেই বিজেপি-ভোটারদের প্রায় অর্ধেক (৪৭ শতাংশ) তাঁদের মনস্থির করে নিয়েছিলেন, রাজ্যের মোট ভোটার-সংখ্যার হিসেবে ধরলে যেটা ১৭ শতাংশ। সেখানে কংগ্রেস এবং জেডি(এস)-এর এক-তৃতীয়াংশের মতো (৩৭ এবং ৩৪ শতাংশ যথাক্রমে) ভোটারের মনস্থির করা ছিল, মোট ভোটারের হিসেবে যে সংখ্যা দুটো দাঁড়ায় ১৬ এবং ৪ শতাংশ।
এর থেকে দুটো বিষয় স্পষ্ট হয়:
- বিজেপির বহুখ্যাত ইলেকশন মেশিনারি, যারা শোনা যায় ভোটার তালিকার প্রতিটি পাতা ধরে ধরে কাজ নির্দিষ্ট করে দেয়, এবং ইলেকটোরাল বন্ডের সিংহভাগ অর্থ যাদের পেছনে খরচ হয়, তারা দোদুল্যমান এবং সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের নিজেদের পক্ষে টানতে একটা ‘গোলিয়াথ গ্রান্ড ওল্ড পার্টি’র কাছে পরাস্ত হয়েছে।
- ভোটের অনেক আগে থেকেই সাম্প্রদায়িক তাস খেলা হলেও সম্ভবত কর্নাটকের মাটিতে সেগুলি প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে। নিজেদের আদি ভোটব্যাঙ্ক মোটের ওপর ধরে রাখতে পারলেও এই কৌশল নতুন কোনও সমর্থক টেনে আনতে পারেনি। রাজ্যের হিন্দুত্বের পরীক্ষাগার বলে খ্যাত উপকূলবর্তী কর্নাটকেও বিজেপি আসন হারিয়েছে।
পার্টিগুলির প্রার্থী ঘোষণার পরেই ১৪ শতাংশ ভোটার তাঁদের মনস্থির করে নেন। তিনটি পার্টির ক্ষেত্রেই এই হার মোটের ওপর সমানই ছিল, ‘অন্যান্য’দের কিছুটা বেড়েছিল। সব মিলিয়ে, বিজেপি এবং কংগ্রেস এই স্তরে একইরকম লাভবান হয়েছিল।
প্রচার চলাকালীন আরও ১৫ শতাংশ ভোটার তাঁদের মন স্থির করে ফেলেন। এই সময়েই কংগ্রেস বিজেপিকে টপকে যায়, যদিও সেটা কিছু অপূরণীয় ব্যবধান ছিল না। বাদবাকি যে ২৮ শতাংশ ভোটার একদম শেষ পর্যায়ে মনস্থির করেন সেখানেই দাঁড়িপাল্লা সম্পূর্ণভাবে কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকে যায়।
রাহুল গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেসের প্রচারের জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ তাদের দেওয়া পাঁচটি গ্যারান্টি:
- দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা পরিবারের প্রতি সদস্যকে ১০ কেজি করে চাল
- প্রতিটি বাড়িতে প্রতি মাসে ২০০ ইউনিট করে বিদ্যুৎ বিনামূল্যে
- পরিবারের প্রধান মহিলাদের প্রতি মাসে ২০০০ টাকা করে
- ২৫ বছর পর্যন্ত বেকার স্নাতক এবং ডিপ্লোমা-হোল্ডারদের মাসে ৩০০০ এবং ১৫০০ টাকা করে
- সরকারি বাসে মহিলাদের নিখরচায় ভ্রমণ
সিদ্দারামাইয়া সরকার তার প্রথম ক্যাবিনেট মিটিং-এই এই সমস্ত প্রতিশ্রুতিগুলি নীতিগতভাবে পাশ করেছে। এই গ্যারান্টিগুলি সমস্ত বয়সের নিম্নমধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র জনগণের কাছে সদর্থক বার্তা হিসেবে যাবে। এর ফলে ২৫-এর কমবয়সি সহ সমস্ত বয়সের ভোটারদের কাছেই বিজেপির তুলনায় কংগ্রেস খুব স্বল্প হলেও ব্যবধান বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হবে। মনে রাখা দরকার, এরকম একটা কথা চালু আছে যে, জাতীয় রাজনীতিতে মোদি আসার পর থেকে প্রথমবারের সমস্ত ভোটাররাই বিজেপিকে ভোট দেয়। একইভাবে বিজেপির আর এক শক্ত ঘাঁটি শহুরে ভোটারদের মধ্যেও কংগ্রেস এই ব্যবধান বাড়াতে সক্ষম হবে— আবারও, স্বল্প হলেও। বিজেপি এগিয়ে থাকবে কলেজপড়ুয়াদের মধ্যে, কিন্তু সেখানেও একটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার। কম শিক্ষিতরা— সাধারণভাবে তাঁরা কম বেতনের কোনও কাজ করেন বা কৃষিতে যুক্ত থাকেন— বেশি পরিবর্তনের পক্ষে থাকেন।
পার্টির সঙ্গে একাত্মতার প্রশ্নেও কংগ্রেস বিজেপিকে টেক্কা দিয়েছে। কংগ্রেসের ভোটারদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট দিয়েছেন পার্টিটা কংগ্রেস বলেই। বিজেপির ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা তাদের মোট ভোটারের অর্ধেক। সম্প্রদায়গত হিসেবে দেখা যাচ্ছে বিজেপি স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে ভাল ফল করেছে ব্রাহ্মণ (৬০ শতাংশ) এবং লিঙ্গায়েতদের (৫৬ শতাংশ) মধ্যে। লোকনীতি-সিএসডিএস-এর বক্তব্য অনুযায়ী, এর ফলেই তারা নিজেদের আগেরবারের প্রাপ্ত ভোট-শতাংশ ধরে রাখতে পেরেছে। কুরুবা ছাড়া অন্য ওবিসি-দের মধ্যেও তাদের ফল কংগ্রেসের চেয়ে কিছুটা ভাল (বিজেপি ৩৭ শতাংশ, কংগ্রেস ৩৪ শতাংশ)। কিন্তু তাদের পক্ষে এর বেশি আর কিছু বলার নেই।
এটা পরিষ্কার ছিলই যে জেডি(এস)-এর সিংহভাগ ভোটই কংগ্রেসের ঝুলিতে গেছে। এখন এটা আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, কংগ্রেস ৪৯ শতাংশ ভোক্কালিগা ভোট পেয়েছে, যেখানে বিজেপি পেয়েছে ২৪ শতাংশ এবং জেডি(এস) ১৭ শতাংশ। রাজ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার সম্প্রদায়ের আনুগত্য যে দেবগৌড়া-কুমারস্বামীর থেকে কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি ডিকে শিবকুমারের দিকে ঘুরে গেছে, এই ফলই তার নির্ধারক প্রমাণ।
কংগ্রেস ৭০ শতাংশ মুসলিম ভোট পেয়েছে, যা জেডি(এস)-এর জন্য আরও একটা ধাক্কা। সমীক্ষা বলছে ৬৩ শতাংশ দলিত এবং ৪৫ শতাংশ আদিবাসী ভোটও কংগ্রেসের ঝুলিতে গেছে। ‘অহিন্দা’ (AHinDa)-র চ্যাম্পিয়ন বলে পরিচিত সিদ্দারামাইয়া যথেষ্ট বড় ব্যবধানে জিতেছেন। অহিন্দা অর্থে আল্পাসানখ্যাতারু (সংখ্যালঘু), হিন্দুলিদাভারু (পিছিয়ে পড়া) এবং দলিতারু। তাঁর নিজের কুরুবা সম্প্রদায় ব্যাপকভাবে তাঁর সঙ্গে থেকেছে (৫৬ শতাংশ)। যদিও এক-তৃতীয়াংশ কুরুবা ভোট বিজেপিও পেয়েছে।
নির্বাচনের ফলে সব পক্ষের জন্যই অনেক শিক্ষা রয়েছে।
বিজেপি যে একবগগা পার্টি হয়ে উঠছে এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির ওপর অতি-নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এ-বিষয়ে তাদের সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। এটাও বুঝতে হবে যে, হিন্দুত্বের তাস দিয়ে সবসময়ে সরকার পরিচালনার, নেতৃত্বের এবং রাজনৈতিক পরিপক্বতার অভাব ঢাকা যায় না। অত্যধিক কেন্দ্রিকতা এবং মাইক্রো-ম্যানেজমেন্টের ফলে তাদের সৃজনশীলতাও হ্রাস পেয়েছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই একজন রক্ষণশীল নেতার প্রয়োজন হয় এবং বিজেপির সামনে আজ পৃথিবীর বৃহত্তমে গণতন্ত্রে অবদান রাখার এক ঐতিহাসিক সুযোগ এসেছে। তারা আরও ভাল করতে পারে।
জেডি(এস)-এর কাছে এই নির্বাচন একটা সতর্কঘন্টি। ১৯৯৯-এ আত্মপ্রকাশের বছরে তারা ১০.৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। তারপরে এই নির্বাচনে পাওয়া ১৩.৩ শতাংশ ভোটই তাদের সবচাইতে খারাপ ফল। দল গৌড়াদের পরিবার-পরিচালিত হওয়ায় অন্য কোনও নেতাই উঠে আসতে পারেন না। ফলে নতুন এনার্জি এবং সৃজনশীলতার অভাব স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে। এবং এইভাবে তারা বেশিদিন টানতেও পারবে না। মনে রাখতে হবে এর আগেই ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কুমারস্বামীর পুত্র নিখিল গৌড়া মান্ডিয়াতে ১.৩ লাখ ভোটের বিশাল ব্যবধানে পরাস্ত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে ভোক্কালিগাদের একটা বড় অংশ জেডি(এস)-কে সমর্থন করেছিলেন তাঁদের হাতে ক্ষমতা আসবে এই আশায়। এসেওছিল, কিন্তু পার্টি তার ফায়দা তুলতে পারেনি। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি নরম মনোভাব সংখ্যালঘুদের একটা বড় অংশকে তাদের পাশ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। এগুলি শুধু তাদের জন্যই নয়, পুরনো জনতা দলের আরও সব উত্তরসূরিদের জন্যই একটা বড় শিক্ষা।
ভারত জোড়ো যাত্রা-র সাফল্যের পর কংগ্রেসকে দৃশ্যতই অনেক উদ্দীপ্ত এবং আত্মবিশ্বাসী লাগছিল। রাহুল গান্ধি একদিকে যেমন দলের সবচেয়ে বড় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনই পার্টি পরিচালনার দৈনন্দিন চাপ থেকে মুক্ত হয়ে প্রচারে অনেক বেশি মনোযোগ দিতে পেরেছেন। তাদের পরিষ্কার স্ট্র্যাটেজি, সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান খুব ভালভাবেই তাদের পক্ষে গিয়েছে। তবে তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য সম্ভবত সেই পরিণতিবোধের প্রদর্শন যে পরিণতিবোধ নিয়ে শিবকুমার এবং সিদ্দারামাইয়া একে অন্যের কাজে নাক না গলিয়ে একসঙ্গে কাজ করলেন। তাঁদের এই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠা দেশের বাকি কংগ্রেস নেতাদের কাছে একটা শিক্ষা হয়ে থাকল। বিশেষ করে রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশের নেতাদের জন্য তো বটেই, কারণ এই দুই রাজ্যে নির্বাচন আসন্ন। প্রিয়াঙ্কা গান্ধিও বিশেষ করে মহিলাদের সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্রে দলের সম্পদ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করলেন। পার্টি-সভাপতি হিসেবে মল্লিকার্জুন খাড়্গেও দৃঢ় ভূমিকা পালন করলেন। যদি নিজের রাজ্যের বাইরেও তিনি একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন তবে নিশ্চিতভাবে কংগ্রেস যারপরনাই উপকৃত হবে। আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, এবং উপদলীয়তাকে নির্মূল করে দলকে সঠিক অবস্থায় ধরে রাখা।