Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভাঙন

ভাঙন | রাজেশ ধর

রাজেশ ধর

 

তিনটে টালিখোলার চালা উঠোনের তিনদিকে। ঢোলকলমির অযত্নের বেড়ায় ঘেরা ভিটে। অথচ সদর উদোম। বড় চালাটা সদর বরাবর। তার মেটে দাওয়ায় একটা খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে আছে এক মহিলা। ডিহাইড্রেশনে মরমর গোরাকে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল বুড়ো খতিয়ান। লুঙ্গির ছেঁড়া জায়গাগুলো দু হাত দিয়ে ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল সে।

—মরিয়মবু। এই বাবুডা মোজামরে খুঁজতি খুঁজতি আসতিছে। ওনারে এট্টু পানি দিতি লাগবে।

মহিলার নাম তাহলে মরিয়মবু!

যোগেশগঞ্জে বিসলেরির বোতল শেষ। তারপর তিন-চার ঘন্টা একে-তাকে জিজ্ঞেস করতে করতে এই খান পনেরো-কুড়ি ঝুপড়ির জটলা। লোকজন দূরের কথা, একটা আধন্যাংটো বাচাকাচ্চাও চোখে পড়ে না। মাথায় বাজ পড়েছিল গোরার। তখনই ওই খতিয়ান নামের বুড়ো ফিরছিল জঙ্গল থেকে কাঠের বোঝা মাথায় করে।

তেষ্টায় চোখদুটো ঝাপসা গোরার। তবুও সে দেখল মহিলার দু চোখের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সে উঠোন ছাড়িয়ে ঝোপঝাড় পেরিয়ে একটু দূরে বয়ে যাওয়া নদীটার ফ্রেম। খতিয়ান বলেছে এই সেই রায়মঙ্গল! কিন্তু ফ্রেমের ফোকাস কী? গলা সমেত সারা শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে তবুও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় গোরা। না কিছুই নেই! বর্ষার এই শেষ বিকেলে ছাইছাই আকাশের কোথাও কোথাও কালচে মেঘের জমাট। গোধূলির আলো বলেও নদীর জলে কোনও কিছু চুঁইয়ে পড়ছে না। কালচে ঘোলা স্রোত শুধু বয়ে যাচ্ছে। সেই স্রোতে না আছে কোনও নৌকা, না উড়ছে তার উপর কোনও জলচর পাখি।

—মরিয়মবু।

খতিয়ান ডাকে আবার। এবার তিনি তাকালেন ওদের দিকে। গোরাও দেখল তাকে। ওর নির্জলা চোখের ঝাপসাভাব এক লহমায় কেটে গেল। মেচেতাভরা বাদামী গোল মুখ। দু চোখের তারায় নদীর ভাটা। সে মুখ পাথরের নয়। সে মুখে রাগ, ঘৃণা, ক্ষোভ, যন্ত্রণা কোনও আবেগের একবিন্দু ছোঁয়া নেই। কিন্তু মোটেও সে মুখ মৃত নয়। নিস্পৃহতার এক অদৃশ্য কাজল অথবা সুরমার সীমানায় দু চোখ যেন বেঁধে রাখা। ওই দু চোখের নজরে কি পিপাসা হারিয়ে গেল গোরার? সে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছিল না। কিন্তু সে খুঁজছিল। তার সারা জীবনের মডেল স্টাডিতে একটাও এমন মুখ কি সে দেখেছে?

—মোজাম এঁয়ারে আসতি বলিছিলেন, এই দাদাবাবু সিনিমা করবেন, আমাদের গেরামে!

মহিলা চলে যায় ঘরের ভেতর। একটা কাঁসার গ্লাসে করে জল নিয়ে আসে। গোরার তখনই আবার নাড়ি পর্যন্ত শুকিয়ে আসে পিপাসায়। সে গ্লাসটা হাতে নেয়। তার আরও জল খেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু মরিয়মবু দাওয়াতে আগের জায়গায় ফিরে গেছে। বুড়ো খতিয়ান দুই হাত কচলে বলে—

—বু, মোজাম…

মুখ ঘোরায় না মহিলা।

—সে আর ফোন করে না খুড়ো।

গোরাদের কলোনির বাড়িতে তখন টিনের চাল। একটানা টিপটিপানি বৃষ্টিতে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হত কোরাসের কোনও শোকগীতি। জমাট বাঁধা সেই স্বরের সঙ্গে নিঝুম গোরস্থানের নৈঃশব্দ মিলেমিশে গোরার কানে বাজল। চুপ করে থাকে নিরুপায় খতিয়ান। কান চুলকায় তারপর বলে—

—তাহলে কী করবেন বাবু?
—যোগেশগঞ্জে ফিরে আর ট্রেকার পেতে হবে না। থাকতে হবে।

নির্লিপ্ত, অনিবার্য বিবৃতি। গোরা ফোন বার করে। বিদ্যুৎবিহীন এই জল-জংলায় স্ট্রং নেটওয়ার্ক!

 

দুই.

রাতেই মানসী বলে দিয়েছিল। লোকেশন দেখে দিনেদিনেই ফিরে আসতে হবে। কাঙ্কারিয়াদের টিএমটি বারের অ্যাডফিল্ম টিআরপি দিল না। মাস সাতেক কাজ নেই। মানসীর মাথা থেকেই বেরোল আইডিয়াটা। একটা আনকমন ডকুমেন্টারি যদি করা যায়! আর সেটা যদি ফরেন থেকে অস্কার, কান-ফান না হোক, টরেন্টোর মতো কোথাও একটা নমিনেশন পায়; তাহলেও কিছু কাজফাজ আসবে! গোরা তখন শেষ পেগটা ঢালতে ঢালতে ভাবছিল। সামনে কোথাও, কোনও সিঙ্গল মল্ট পার্টি আছে? মানসী ওর হাত থেকে বোতলটা কেড়ে নিয়ে বলেছিল—

—তোমার একটা বন্ধু আছে না, মুসলিম? সুন্দরবনের ওদিকে কোথায় থাকে। একদিন বলছিলে ওদিকে নদীগুলো হুড়মুড় করে ভাঙছে সব। গঙ্গা নিয়ে তো কত কাজ হচ্ছে! এগুলো তো কেউ ধরছে না!

মুখের মদ কেড়ে নিলে গোরার রাগ হয়! কিন্তু সামনে মানসী! কলেজের ফাঁকা কমনরুমে চুমু খাওয়ার সময়ে কিংবা প্রোমাটারের এগ্রিমেন্ট পেপারে সই করানোর জন্য মাকে ঠাটিয়ে চড় মারার রাতে; গোরা কখনওই মানসীর অবাধ্য হয়নি, হয় না। সে একটা সিপিইউ। মানসীর নতুন কমান্ড। ও মনে করার চেষ্টা করতে থাকে মোজাম্মেলটা কে, কোথায় দেখা হয়েছিল? কিন্তু হ্যাং করে যাচ্ছিল সব!

মানসী রাগে না! শেষ পেগটা নিজের হাতে বানিয়ে দেয়। গোরা তখনও মোজাম্মেলকে উদ্ধার করতে পারেনি। অবাক চোখে মানসীর দিকে তাকায়।

—চিন্তা কোরো না! প্রোডিউস কে করে? আমি তো! ছোড়দার কলেজের জিওগ্রাফি টিচারটাকে ধরব, তারপর সায়ন্তনকে দিয়ে স্ক্রিনপ্লে লিখিয়ে নেব।
—সায়ন্তন… ও তো, লাখ খানেকের নিচে রাজি হবে না?

গলা ভিজেছে। এবার কথা বলতে পারল গোরা।

—বলছি তো, সে তোমায় ভাবতে হবে না। দাসের সঙ্গে আমার কথা বলা আছে। ও শুধু বলেছে, একটা ইউনিক সাবজেক্ট আন।

দাস? মানে প্রবীর দাস? একগাদা ইঞ্জনিয়ারিং কলেজ, কন্ট্রাক্টরি ফার্মের শেষ নেই; সেই বদমাইশটা নদীর ভাঙন নিয়ে ডকুমেন্টারিতে টাকা ঢালবে।

ওরে বাপ রে…

নিঃশব্দে ডুকরে ওঠে গোরা। কচি ডবকা মেয়েছেলে কী করে ঢোকাবে ডকুতে? পেগ শেষ। বোতলও শেষ। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করে ওর।

—এত ভাবছ কেন? দাস আমাদের কতদিনের পুরনো বন্ধু ভাবো তো?

এরই মধ্যে কখন মানসীর দু চোখ পালটে গেছে। কাজল, আইশ্যাডো, আরও যা যা কিছু আছে সেসবের কোনটা এই নারীর চোখে আছে আর কোনটা নেই, গোরা তা বুঝতে পারে না। শুধু জানে এই পৃথুলা, কৃষ্ণবর্ণা, স্বল্প উচ্চতার মহিলা, শুধু চোখ দিয়ে অনেক কিছু ঘটিয়ে ফেলে। কিন্তু দাসকে জবাই করা? এত সহজ? ছাব্বিশ বছর আগে কুয়ো বসানোর ঠিকেদারি করত। কিন্তু কখন যেন, সুবীর সাহার নজরে পরে গেল। সুবীর সাহা, তখন জেলা সেক্রেটারিয়েট। গোরা মিনমিন করল,

—ও একবার দীপান্বিতার কথা বলেছিল। দীপান্বিতা একরাতে পাঁচ লাখ নিচ্ছে, তার ওপরে সিরিয়ালের লিড রোল! কীভাবে হবে?
—তুমি থামবে?

থেমে যায় গোরা। না থেমে উপায় নেই। মানসী যেমন সাপ আবার ওঝাও তো মানসী। রাওল্যান্ড পঞ্জি স্কিমে মানসীর বুদ্ধিতেই তো ও নামে। লাখ চল্লিশেক মাস কয়েকে কামিয়েও নেয়। সেটা ওয়েব সিরিজের শুরুর আমল। ও আর মানসী বোম্বে যাবে সব ঠিকঠাক। কিন্তু মানসী আটকাল। মামাতো শালির বরের টপলেভেল কানেকশন। খবর এল, চিটফান্ডগুলো একসঙ্গে ধসবে। তিনমাস গোরাকে আন্ডারগ্রাউন্ডে রাখল সেই মানসী। ম্যাটাডোর ভর্তি মালদা-কুচবিহারের লোক ঘিরে ফেলেছিল ওদের পুরনো কলোনির ফ্ল্যাট। পুলিস পাঠিয়ে সেটাও ঠান্ডা। সেই মানসী। তবে কাঁচাটাকাগুলোর অনেকটাই গেল।

সেইরাতে ঘুম এল না গোরার। নিজেই নিজের মাথায় বার কয়েক অ্যাটম-বম ফেলে ওর মনে পড়ল। মোজাম্মেল বলে একটা ছেলে, হালকা-পাতলা, টি-শার্ট, জিন্স, ব্ল্যাক গগলস। খুব স্মোক করত, কিং সাইজ। ট্রামডিপোর মোড়ে আড্ডা মারত। ফিল্ম ইন্সটিটিউটের কিছু ছেলেও থাকত। গোরাও তখন যেত সেখানে। বিদেশি ক্যামেরা, ফ্রেম, অ্যাকটিং এইসব নিয়ে কথাবার্তা হত। ছেলেটার সঙ্গে তেমন মেলামেশা হয়নি। কয়েকবার বারে গেছে এই পর্যন্ত। কিন্তু সে যে কী করত, অ্যাক্টিং, ডিরেকশন, এডিটিং, তা আর জানা হয়নি। বলেছিল উত্তরে দু-তিনটে নদী পেরিয়ে একেবারে সুন্দরবনের সীমানায় ওদের বাড়ি। আর ওই ভাঙনের কথা! তবে এও বলেছিল, ওই ভাঙন-টাঙন সব নর্মাল ওখানে। তারপর এত বছর কেটে গেছে। যাই হোক, সকালে আর দেরি করেনি গোরা। মানসী ঘুমজড়ানো চোখে বলেছিল,

—পাওয়ার ব্যাঙ্কটা নিয়েছ?

 

তিন.

—মরিয়মবু? কত বয়স? কে হয় তোমার ওই মোজাম্মেলের?

অডিও কল, তবুও মানসীর সরু দুই চোখ আর কপালের তিরতির করে কাঁপতে থাকা ভাঁজ দেখতে পাচ্ছিল গোরা। মহিলা যে কে হয় মোজাম্মেলের, সেটা জিজ্ঞাসা করার কোনও অছিলাই সে তখনও পায়নি।

এখন অবশ্য সেসবের বালাই চুকে গেছে। আর ঘন্টা দুয়েক বাদে ভাল করে আলো ফুটলেই সে চলে যাবে। কিন্তু যেভাবে এসেছিল ঠিক সেইভাবে ফিরতে পারবে তো, যোগেশগঞ্জ? বুড়ো খতিয়ান কালকেই ভেগেছে। যাওয়ার আগে লজ্জা-লজ্জা মুখে বলল,

—বাবু, সিগারেটের টুকরোগুলো এই কদিন খালাম! এট্টা গোটা সিগারেট দেন না!

গোরা কিং-সাইজ ছেড়েছে ছ মাস! এই ছোটগুলোর দাম আট টাকা। তাও একটা দেয় বুড়োটাকে। তাকে নিয়ে অনেক ঘুরেছে বুড়োটা। খাড়া পাড়বরাবর, কখনও জঙ্গলের মধ্যে, কখনও বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গেছে তাকে। মাটিতে অজস্র চুলের মত সরু সরু দাগই শুধু দেখাতে পেরেছে। আর কিছু না! যাবার সময় বুড়োটা বলল,

—বাবু মাটিতি কান পাতলি গুমগুমি শুনতি পাতিছি। আর থাকা যাবে না! আপনিও চলেন।

কিন্তু গোরার উপায় ছিল না। প্রথম সেই বিকেলে, মোজাম্মেলের বাড়ির বাইরে এসে মানসীকে ফোন করে সব জানায় গোরা! এখানে লোকজন নিয়ে এসে কাজ করা সম্ভব না। কতদিন এ-জায়গাটা থাকবে তার ঠিক নেই! মানসী কিছুক্ষণ চুপ।

—পাড় ভাঙছে, ঘর ভাঙছে এমন কিছু ফুটেজ নিয়ে এসো! তারপর সিন্থেটিক্যালি…
—কিন্তু ক্যামেরা কই আমার?
—ঊনষাট হাজার টাকার ফোন নিয়ে ঘুরছ কী করতে? পিউবিক হেয়ারের ডকু করবে? এখন মোবাইল-ডকুরও ভাল বাজার!
—কিন্তু থাকব কোথায়? মোজাম্মেল তো বাড়িতে নেই… শুধুই মরিয়মবু!

তখনই প্রশ্নটা করে মানসী—

—মরিয়মবু? কত বয়স? কে হয় তোমার ওই মোজাম্মেলের?

বু বা বুবু বলতে কাকে বোঝায়— মামি, পিসি নাকি দিদি, তা জানে না গোরা। আর ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে আর খতিয়ান বুড়ো চলে গেছে। মরিয়মবু যে তাকে থাকতে বলেছে সাহস করে সেটা বলেনি। ও অপেক্ষা করছিল মানসী কী বলে!

—বয়স কত বললে?
—দেখে মনে হয়, চল্লিশ-পঞ্চাশ!
—একগাদা বাচ্চা বিইয়ে, ওদের তিরিশেও পঞ্চাশ মনে হতে পারে!
—না, না বাচ্চাকাচ্চা কেউ নেই মনে হল! একজন বয়স্ক মহিলা!
—নিয়ম করে গরু খায় ওরা, ওদের আর্জ কতটুকু জানো? তবুও উপায় যখন নেই। ম্যানেজ করে ওখানেই থাক। কিন্তু ফুটেজ চাই!

আর্জের ব্যাপারটা যে গোরা জানে না সেটা ঠিক নয়। এক্সট্রা লাইনে সবরকমের মেয়েই আসে আজকাল। তবে, মানসীও জানে? ফোনটা মানসী নিজেই কেটে দিয়েছিল।

 

চার.

পাওয়ার ব্যাঙ্কে আর চার্জ নেই। মানসীর সঙ্গে টাইম ফিক্স করা আছে। তাই অকারণে এই দুদিন ফোন বন্ধ রাখছে গোরা। এসি নেই তার ওপর বর্ষার গুমোট। ঘুম হয়? তবু শেষ রাতের দিকে ছেঁড়াছেঁড়া। আর গতকাল রাতে যা হল! তাতে আর ঘুম? তবে নিজের কাছে একেবারে সত্যি কথা বলতে গেলে, এরকমই তো কিছু একটা চাইছিল সে!

সামনে দামাল রায়মঙ্গল। তার তীরে প্রায় পরিত্যক্ত একটা গ্রাম। সবাইকে চলে যেতে বলেছে সরকার। যখনতখন রায়মঙ্গলের পেটে চলে যাবে গ্রামটা। সভ্য সমাজেরও দরকার নেই এই মানুষগুলোকে। তাই নেই কোনও আন্দোলন, প্ল্যাকার্ড, মিছিল, অনশন। গাঁয়ের একেবারে মরা গরিব, তারাও ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাদের ভিটে, চাষের জমি, ডাঙা। সেখানে একজন একাকী মহিলা। নিশ্চিন্তে তার দাওয়ায় বসে তাকিয়ে রয়েছে রায়মঙ্গলের দিকে। নিস্পৃহ নজরের রঙে এই নদী আর গ্রাম নিয়ে সে কোন ছবি আঁকছে তার মনের মধ্যে? দু চোখের মণিতে তার রায়মঙ্গলের ভাটা বয়ে চলেছে কেন?

অনেক বিদেশি প্যারালাল মুভি দেখেছে গোরা। এই মহিলা, এই গ্রাম আর ওই নদী… মাথার মধ্যে আবছা একটা চিত্রনাট্য একটু করে আকার নিতে থাকে। যদি ডকুটা হয়ে পয়সাকড়ি ঠিকমতো আসে, তাহলে একটা নিউ-ওয়ার্ল্ড মুভি বানানো যেতেই পারে। শুধু মরিয়মবু— ওই ইনটারেস্টিং ক্যারেকটারটাকে অ্যানালিসিস করতে হবে। কেন তার ওই নিস্পৃহতা, কেন সে একটানা তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে! কোন আনকমন দুঃখ লুকিয়ে আছে তার মধ্যে?… এই কথাগুলো জানা দরকার। গিলে খেতে চাওয়া এক প্রকৃতি আর তার সামনে এক অচেনা, নির্ভীক নারী! ওফ্‌… চিত্রনাট্যটা জমে যেতে পারে।

কিন্তু গোরা মরিয়মবুর নাগালই পাচ্ছিল না। তার ঘরে হ্যারিকেন জ্বেলে দিয়েছে, বিছানা করে দিয়েছে, খেতে দিয়েছে একেবারে সময়মতো মরিয়মবু। গোরা বলেছে কেন আর কীভাবে সে এসে পড়েছে, কেন তাকে এই দু-তিনদিন থাকতে হচ্ছে। চুপ করে সব শুনেছে মহিলা। কোনও উত্তর দেয়নি। দিনেরবেলায় কিংবা রাতে, খতিয়ানের সঙ্গে বেরোনোর সময়ে বা ফিরে, এমনকি শুতে যাওয়ার আগেও যখনই তাকে দেখেছে; সেই একইভাবে দাওয়াতে বসে রয়েছে মরিয়মবু। পরনে একই সবজে-হলদে ছাপার মলিন শাড়ি। ঘর-গেরস্থালির কাজ কখন সে করে? সে কি রাতে শোয়? জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও সাহস পায়নি গোরা। গোরার প্রয়োজনটুকু পৌঁছে দেওয়ার পরেই ওই মহিলার কাছে দুনিয়া বলতে সামনের ওই রায়মঙ্গল। ফুটেজের শিকারে বেরিয়েও বারবার এই মরিয়মবুর মুখটাই মনে আসছিল। এ কেমন ব্যাপার? এই নারীহীন প্রান্তরে ওই অদ্ভুত দেখতে মেয়েছেলে কি ওর অবচেতনে কাম জাগাচ্ছে? ইস, আর কতটা নিচে নামবে সে? শেষে এই মাঝবয়সি মরিয়মবু? ছিঃ… না, না, অনেস্টলি, ক্যারেক্টার হিসাবেই ওকে এক্সপ্লোর করতে চাইছিল গোরা। আর চাইছিল রায়মঙ্গলের মত্তশক্তির ভাঙন-ফুটেজ। কিন্তু হচ্ছিল না কোনওটাই।

আর তারপর গতরাতে প্রায় সাড়ে বারোটা। দরজায় বেশ কয়েকটা টোকা। গোরা বেরিয়ে আসে। সামনে মরিয়মবু। হাতে হ্যারিকেন। স্টুডিও লাইনের পোক্ত খেলোয়াড় গোরা ঘোষ, ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। মরিয়মবু দেখে নেয় গোরার হাতে তার ফোন রয়েছে কিনা! তারপর ইশারা করে তার পিছনে আসতে বলে। উঠোন পেরিয়ে নদীপাড়ের জঙ্গল ধরে মরিয়মবু। হাঁটতে থাকে। পেছনে গোরা। মরিয়মবু মোটেই সিগারেটের কাউন্টারলোভী বুড়ো খতিয়ান না। সে পিছনে ঘুরে তাকায় না। তাড়াহুড়োতে রাতের হাফস্লিভ টি-শার্ট, নাইট ট্রাউজার আর স্যান্ডেলটা পরেই বেরিয়ে এসেছে গোরা। ঝোপঝাড়ের খোঁচায় হাত-পায়ের পাতা, গাল, কপালে বেশ জ্বালা করছে। একটু হাঁপও লাগছে। কিন্তু বলবে কাকে? হ্যারিকেনের আলোরেখার পেছন পেছন যাওয়াই তার কাছে তখন চ্যালেঞ্জ।

মিনিট পনেরো পরে একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায় মরিয়মবু। হ্যারিকেনটাকে মাটিতে নামিয়ে রাখে। জমাট গাছপালা এখানে বেশ ফাঁকা ফাঁকা। সামনে প্রায় একশো মিটার দূরে রায়মঙ্গল। সেই মাঝরাত, ঝিঁঝিঁপোকার ডাক আর রায়মঙ্গলের গর্জন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া গোরার আর কোনও কাজ নেই। একটু পরে মরিয়মবু মুখ খোলে,

—আপনার ফোন ঠিক করে নেন, আর দুই-তিন মিনিট, তারপরেই গিলতে শুরু করবে রায়মঙ্গল। আর এখানেই দাঁড়ান। সামনে যাবেন না!

কী বলে কী মহিলা! যা খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেল গোরা, সেটা এক্ষুনি হবে? কোনওমতে ফোনের স্ক্রিন, ফ্ল্যাশ সব ঠিক করে নিতে থাকে সে। আর তার মধ্যেই পায়ের তলার মাটি কাঁপতে থাকে আর নদীর দিক থেকে ঝপাস ঝপাস করে বুক কাঁপানো শব্দ। বেঁটে ম্যানগ্রোভগুলো সমেত ভেঙে পড়ছে বিশাল বিশাল চাঙর। গোরা ফোকাস ঠিক করে উঠতে পারে না। কী করবে সে? এমন ফুটেজ, কয়েকটা অ্যাঙ্গেলে না নিলে হয়? কী করবে? আর একটু কি এগিয়ে যাবে? সে কয়েক পা এগিয়ে যায়। কিন্তু ঠিক তখনই পায়ের তলার মাটি নিচের দিকে নামতে থাকে। সে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও পড়ে না, তার টি-শার্টের কলারে পেছন দিক থেকে হ্যাঁচকা টান পড়ে। মরিয়মবুর বুকে আশ্রয় পায় গোরা।

হ্যারিকেনটা নিভে গিয়েছিল। জংলা জায়গাটায় গোরার একেবারে পায়ের কাছে পরিতৃপ্ত রায়মঙ্গল। শান্ত কণ্ঠস্বর তার। গাছের পাতার ফাঁক আর নদীর বুকের আকাশে কৃষ্ণপক্ষের তারার আলো। একটু ধাতস্থ হলে ফোনটা ফিরিয়ে দেয় মরিয়মবু। তারপর হাঁটতে শুরু করে। পেছন-পেছন গোরা এই রাতটাকে কীভাবে ভিএফএক্সে আনা যায় ভাবতে থাকে। মাঝেমাঝে একটু লজ্জা লাগছিল, মরিয়মবুর বুকের মধ্যে গিয়ে একেবারে পড়ল! সে কেমন পুরুষ, নিজেকে রক্ষা করতে পারল না? কিন্তু আশ্চর্য, এই প্রথম কোনও মেয়ের বুক স্পর্শ করে তার মনে হয়নি, সেটা কোন নারীর? মৃত্যুর কবল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় কি এমন অনুভূতি হয়? চিন্তাগুলো জট পাকিয়েই যাচ্ছিল। নিজেকে বড়ই ছোট মনে হচ্ছিল। চিন্তাকে ঘোরানোর জন্য যে কাজে এসেছিল সেই কাজের কথা ভাবতে শুরু করল ও। আশা তো ছেড়েই দিয়েছিল তবুও মারাত্মক ফুটেজ একটা পাওয়া গেছে! ফ্ল্যাশের কল্যাণে কতটা কী হল পরে বোঝা যাবে। আচ্ছা, পরের যে প্রজেক্টটা মাথায় এসেছে, তার জন্য আজ রাতেই মরিয়মবুর একটা ইন্টারভিউ খুব সন্তর্পণে রেকর্ড করে নিলে হয় না! কিন্তু উনি কি কথা বলবেন? কেন বলবেন না? গোরার কাজের গুরুত্ব বুঝেই তো মাঝরাতে নিয়ে এলেন। তাহলে বোঝাতে পারলে, দুটো কথা বলবেন না? না, না… এই সুযোগ ছাড়া যাবে না। কয়েকটা কথা রেকর্ড করেই কাল সকালে হাওয়া। অখাদ্য খাবার, বিষাক্ত জল, গরম, মশা, কাদা, এসব আর সহ্য হচ্ছে না।

বাড়ির উঠোনে পৌছে গোরা নাক-মুখ দিয়ে সাহস ভরে নেয় বুকে। তারপর ডাকে,

—মরিয়মবু।

মহিলা দাঁড়ায়। টি-শার্টের বুক-পকেটে রেকর্ডার অন করা ফোনটা। বাইরে বলতে গেলে বইয়ের ভাষায় নিকষ অন্ধকার। কিন্তু সে আঁধার গোরার চোখে সয়ে গেছে। গাছ-গাছড়ায় ঘেরা উঠোনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রিতে মরিয়মবুর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পায় গোরা। নিস্পৃহ নদীস্রোত বয়ে যাচ্ছে দুচোখের তারায়। এত হিসাব করে এসেও গোরা বুঝতে পারে না, কোন প্রশ্নটা সে করবে, কোনটা করা উচিত হবে? কোনটা করা যাবে না? মরিয়মবুই বলে ওঠে—

—কী?
—আপনার ভয় করে না?

এটা বেশ পরের প্রশ্ন, তবুও আগেই করে নেয় গোরা। কখন মহিলার মর্জি হবে? চলে যাবে, তার তো কিছু বলার থাকবে না!

—কাকে? ওই রায়মঙ্গলকে?

প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন। গোরা কী উত্তর দেয়? শুধু কি রায়মঙ্গল, এই যে একটা নির্জন, নিস্পৃহ জীবন! সব মিলিয়ে যদি তাকে থাকতে হত, সে ভয় পেত না? আর কীভাবে, কেনইবা থাকেন মরিয়মবু এখানে?

গোরাকে আশ্বস্ত করে উত্তর দেয় মরিয়মবু,

—না।

গোরার চিন্তার জাল ছেঁড়ে,

—আপনি যাবেন না এখান থেকে? রায়মঙ্গল তো এসে পড়ল বলে!

মরিয়মবু দাওয়ায় উঠে তার ঘরে চলে যায়।

 

পাঁচ.

ভাল করে আলো ফুটে গেছে অনেকক্ষণ। ব্যাগ গুছিয়ে উঠোনে নেমে এসেছে গোরা। সকালের কাজ সারতে বেরিয়ে মরিয়মবুর দেখা পায়নি সে। একটু অপেক্ষা করছে তার জন্য। তার মধ্যেই দুটো ফোন এল। একটা মানসীর। রাতের ফুটেজের খবরে ফোনের ওপারে মানসীর বিরক্তি আর স্বস্তি দুটোই বুঝতে পারে গোরা। আরেকটা স্কুলের বন্ধু স্বপনের। হাজার নব্বই ধার নিয়েছিল, মাস ছয়েক আগে, দুদিনের মধ্যে দেবে বলে। নাহ… কিছুদিন এই সিমটা বন্ধ রাখতে হবে। নাহ, মরিয়মবুর কোনও খোঁজ নেই। আর দেরি করা ঠিক হবে না। গোরা সদরের দিকে মুখ করে। ক্রিং ক্রিং শব্দ পৌঁছোয় তার কানে। ঘাড় ঘোরাতেই হয় পেছনে। ভাঙাচোরা চালাঘরটার দরজা খুলে একটা রংচটা সবজে লেডিস সাইকেল নিয়ে উঠোনে নেমে এসেছে মরিয়মবু। গোরার ব্যাগটা নিয়ে সে সামনের বাস্কেটে রাখে। তারপর ইশারায় সাইকেলের কেরিয়ারে গোরাকে বসতে বলে।

প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার এবড়োখেবড়ো রাস্তা। খুঁজতে খুঁজতে হেঁটে যাওয়ার দুশ্চিন্তা আর নেই। গোরা কাজের কথা ভাবতে শুরু করে। কাল হয়নি, আজ জানতেই হবে উত্তরগুলো। মরিয়মবুর চরিত্রটাকে ভাঙতেই হবে। নাহলে স্ক্রিপ্ট হবে কীভাবে? সাইকেলে যেতে যেতে এই মহিলা উত্তর দেবে না। কিন্তু নামার পর যাহোক একটা কোনও কায়দা করে সে জিজ্ঞাসা করবে, মোজাম্মেল কে হয় মরিয়মবুর? কেন এই বাড়িতে কেউ থাকে না? কেন এই বাড়ি তাকেই পাহারা দিতে হচ্ছে? পঞ্চায়েত, বিডিও, এমএলএ, তারা কেন এই ভাঙন আটকাচ্ছে না? মরিয়মবুর কি বিয়ে হয়েছিল? বাচ্চাকাচ্চা? স্বামী কি তালাক দিয়েছে? তারপর কি আরেকটা বিয়ে-সংসার? তাই কি মরিয়মবুর এই বৈরাগ্য?

সাইকেল যোগেশগঞ্জে এসে যখন থামল ঠিক তখন একটা ট্রেকার ছেড়ে দিচ্ছে। পরেরটা নিশ্চয়ই এক ঘন্টা পরে। তারপর দু ঘন্টার বাসজার্নি, ট্রেনেও দু ঘন্টা। এ সু্যোগ কিছুতেই ছাড়া যায় না। গোরা দৌড়ে গেল ট্রেকারের সামনে। হেল্পার বকাঝকা দিয়ে কেবিনের একজনকে নামিয়ে ওকে ড্রাইভারের পাশে বসার সুযোগ করে দিল। ও উঠতে যাবে। তখন আবার লেডিস সাইকেলের ক্রিংক্রিং। ঠিক পেছনে মরিয়মবু।

—কাল জানতে চাইলে, যাব কিনা! কোথায় যাব? তোমাদের ওখানে? ওখানে… ভাঙন নেই?… ভাঙন?

প্রশ্নমালা। গোরার মুখটা ফ্যাকাশে হলেও ট্রেকারের কুড়ি বছরের পুরনো ইঞ্জিন মোটেও দমে না। প্রচণ্ড গর্জন করে ওঠে। বার পাঁচেকের চেষ্টায় স্টার্ট হয়েছে। ড্রাইভার আর দেরি করবে না। হেল্পারটা গোরাকে ভেতরে ঠেলে দেয়। মিনিট দশেক পরে ফোনটা খোলে গোরা। তিনদিন প্রায় নিউজ দেখা হয়নি। প্রথমেই ভেসে আসে, গঙ্গার বুকে একশো কিলোমিটার করে বাঁধের প্রকল্প ঘোষণা আর তার বিরুদ্ধে সাধু-সন্ন্যাসীর আত্মাহুতির ছবি, তারপর খাটের তলায় বান্ডিল-ডিলডো, ছ মাসের বাচ্চাকে গলা টিপে মা পালিয়েছে প্রেমিকের সঙ্গে। উহ্। ডিসগাস্টিং… পলিটিক্স আর ভায়োলেন্স! ফোন বন্ধ করে চোখ বোজে গোরা। কাজে লাগাতে হবে সময়টা। স্ক্রিপ্টের খসড়া করতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু ডকু আর ফিচার বারবার জড়াজড়ি করে মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে। ইস মরিয়মবুর ইন্টারভিউটা পুরো নেওয়া হল না! ট্রেকার থামিয়ে নামবে গোরা? ফিরে যাবে সেই জল-মাটিতে? যেখানে সামনাসামনি নিস্পৃহতার দাওয়ায় মরিয়মবু আর ভাঙনে মাতাল রায়মঙ্গল। কিন্তু মরিয়মবুর প্রশ্নটা? তার চেয়ে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করা যাক!