Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

হড়পা খরা— এক অনাহূত অতিথি

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 


বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে যেভাবে উষ্ণতা বাড়ছে, আবহিক তন্ত্রটি বিশৃঙ্খল হওয়ায় যেভাবে জলচক্রের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, তাতে করে আগামী দিনে এক গহীন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে পৃথিবীবাসীকে। অসহনীয় তাপপ্রবাহের ফলে কৃষিজমি হারাবে তার স্বাভাবিক আর্দ্রতা, জমির ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হ্রাস পাবে, ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে ফসলের উৎপাদন, খাদ্যশস্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি বাধ্য করবে বহু মানুষকে অনাহার-অর্ধাহারে থাকতে, বাড়বে মানুষের আর্থসামাজিক বৈষম্য

 

সাতসকালে অভিধান খুলে বসেছি কয়েকটা চেনা শব্দের জট ছাড়াব বলে। ভোররাতে আধোঘুম আর আধো-জাগরণের দোলাচল চলে বেশ কিছুটা সময়। এমনই এক মাহেন্দ্রক্ষণে শব্দগুলো চিত্তপটে ভেসে উঠতেই শরীরটা কেমন ছটফট করতে থাকে উঠে পড়ার জন্য। বিষয়টা আমার কাছে বেশ আকস্মিক বলে মনে হয়— তাই তাড়নাটাও যেন একটু অন্যরকম। আচ্ছা, আকস্মিক মানে কি অপ্রত্যাশিত? পূর্বানুমান ছাড়াই যা ঘটে তা-ই কি আকস্মিক? প্রকৃতির রাজ্যে রোজই তো কত ঘটনা ঘটমান। কার্যকারণ আলোচনাসূত্রে কিছু ঘটনার আগাম ভবিষ্যদ্বাণী হয়তো করা যায়, তবে সব ক্ষেত্রে যে একশোভাগ সফলতা মেলে তেমনটাও নয়। অথচ ঘটনার অনুষঙ্গটুকু স্মৃতি হিসেবে কিছুদিনের জন্য থেকে যায় আমাদের মনে। তারপর একসময়ে তাও হারিয়ে যায়। আচ্ছা, ‘হড়পা’ শব্দটি কি আমাদের চেনা শব্দভুবনে নতুন বলে মনে হচ্ছে? মোটেই না, তাই তো? গত বছরের অমরনাথ বিপর্যয়ের কথা মনে করলেই ‘হড়পা বান’ বা আকস্মিক বন্যার কথা মাথায় আসবে। ‘হড়পা’ শব্দটি নিতান্তই একটি দেশি শব্দ যার গোদা অর্থ হল আকস্মিক। নদীমাতৃক বাংলাদেশে বান, বন্যার প্রকোপ বেশি, তাই হয়তো এমন শব্দের প্রয়োগ। হড়পা শব্দটির সঙ্গে যদি খরা শব্দটিকে জুড়ে দিই তাহলে দাঁড়ায় ‘হড়পা খরা’ শব্দবন্ধটি— যার সরলার্থ আকস্মিক অনাবৃষ্টি— আকস্মিক বন্যার বিপরীত অক্ষে তার অবস্থান। বলা বাহুল্য এমন ঘটনা ঘটছে সাম্প্রতিক সময়ে— এক অনাসৃষ্টির কালে— এবং অবধারিতভাবে এর প্রতিক্রিয়াও সুদুরপ্রসারী ও গভীর নেতিবাচক। একবার দেখে নেওয়া যাক।

 

ঝরা-খরা আর ধরার গপ্পো

ডাকনাম ধরা, ভাল নাম ধরিত্রী। আরও অনেক নাম অবশ্য রয়েছে, তবে সহজে বানান আর উচ্চারণ করা যায় বলে ধরা নামটাই সকলের বেশ পছন্দ। ধরার মতিগতির থই পাওয়া অবশ্য মোটেই সহজ নয়। এই খুশির রোশনাই, তো পরক্ষণেই বিষাদের বেহাগী মূর্চ্ছনা। মর্জি বদলের সঙ্গে সঙ্গে ধরার সঙ্গীসাথীদের চরিত্রও যায় বদলে। কখনও কখনও এই বদলের বিষয়টা এত দ্রুত ঘটে যে, ধরার খাসতালুকে বসবাসকারীদের তাল সামলানো বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে। ঝরার কথাই ধরা যাক। ঝরা বিনে গতি নেই। গণকঠাকুরের দল পাঁজিপুঁথি মিলিয়ে বছরের দুটি মাসকে ঝরার পালা গাওনার জন্য নির্দিষ্ট করেছেন বটে, তবে ইদানিং সব তালগোল পেকে যাওয়ায় ঝরার গমনাগমনের সেই চেনা পরিচিত ছান্দিক চলনটাই যেন বেমালুম বদলে গেছে। এই গেল সনের কথাই ধরো। ঝরার আগমনের প্রতীক্ষায় দিন গুজরান করতে করতে সে এক নাজেহাল দশা। ঝরা যে অনেক অনেক স্বপ্নের পসরা নিয়ে আসে। তাই ঝরা ঠিক-ঠিক সময়ে এসে হাজির হলে ধরার আঙিনা ভরে ওঠে। ঝরা যে ধরার বিশ্বস্ত সই! তাই ঝরার প্রতীক্ষায় প্রহর কাটে ধরার। আর না এলে?

না এলেই খরার চোখরাঙানি বাড়ে। ঝরা আনে স্বস্তি। সবাইকে মুক্তি দেয় খরার খরশাসন থেকে। কিন্তু একালের হালহকিকত বোঝা ভার। নিয়ম ছেড়ে একালে অনিয়মের বাড়বাড়ন্ত, আর তাই খরার দাপট বেড়েই চলেছে দিনকে দিন। তাপমান যন্ত্রের পারদ চড়তে থাকা মানেই ধরাবাসীর মনে আশঙ্কার মেঘ জমতে থাকা। খরার আয়ু যতই বাড়তে থাকে ততই যেন কমতে থাকে ধরার সমৃদ্ধি, সুস্থিতির সম্ভাবনা। আতঙ্কের আবহে তটস্থ সবাই।

অবশ্য ধরা বিলক্ষণ জানে তার শরীর জুড়ে থাকা এলাকার কোথায় কার দাপট বেশি। যেমন জম্বুদ্বীপের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, দক্ষিণে সহ্যাদ্রি পর্বতের লাগোয়া অংশে ঝরার দাপট বেশি। সেখানে বলাহকেরা দল বেঁধে গাভীর মতো চড়ে বেড়ায়, আর কাঁদুনে কন্যার মতো অনর্গল বারি বর্ষণ করে। অন্যদিকে জম্বুদ্বীপের পশ্চিম প্রান্তভাগে খরার দাপট এমনই প্রখর যে ঝরার প্রাধান্য যখন একেবারে তুঙ্গে তখনও ওখানকার ধরাবাসীরা চাতকপাখির মতো আকাশের দিকে মাথা উঁচিয়ে ‘ম্যাঘ দিয়ে পানি দে’ বলে হা-পিত্যেস করে। এসব ধরার গোচরে আছে, তাই এদের নিয়ে অস্বস্তি থাকলেও বাড়তি উদ্বেগ নেই। আশঙ্কা এদের আকস্মিক প্রাদুর্ভাবকে নিয়ে— হড়পা বান, হড়পা খরা— সব কেমন তালগোল পাকিয়ে দেয়। হড়পা বানের সঙ্গে পরিচয় থাকলেও আজ কথা হবে হড়পা খরাকে নিয়ে। বর্গি আক্রমণের মতো সে হঠাৎ হঠাৎ করে উদয় হচ্ছে আর তার দাপটে বিশৃঙ্খল হচ্ছে ধরার শস্য উৎপাদন, পানীয় জলের স্থিতি। পৃথিবীর আবহমণ্ডলের ভারসাম্যের অযাচিত পরিবর্তনের ফলেই যে এমন অনিয়মিতি তা জেনেও চলবে খোঁজখবর নেওয়ার জরুরি কাজ।

 

বড় আশা করে…

নামদেও তারালে বড় আশা করে তার পাঁচ একর জমিতে তুর (অড়হর) আর ছোলার চাষ করেছিল। আশা ছিল, এবারের ফসল বিক্রির টাকায় গত মরশুমের লোকসান মিটিয়ে কিছু লাভের মুখ দেখতে পাবে। তাতে ধারদেনা শোধ হবে, নড়বড়ে হয়ে পড়া বাড়িঘর মেরামত হবে, ছেলেমেয়েদের ছোটখাটো আবদারগুলো মেটানো যাবে। বিদর্ভের এই অঞ্চলের কৃষকেরা এমনই সব ছোট ছোট আশার পুঁজি নিয়ে দিন গুজরান করে। কিন্তু কথায় বলে না— আশায় মরে চাষা। নামদেওর বুঝি তেমনই হাল হতে চলল। মহারাষ্ট্রের পূর্ব প্রান্তভাগে থাকা বেরার বা বিদর্ভ অঞ্চলে এমনিতেই বৃষ্টির পরিমাণ বেশ কম, তার ওপর বিগত কয়েক বছর সমানেই কমছে বৃষ্টি। শুখা প্রবণতার কথা মাথায় রেখে এই অঞ্চলে সেচব্যবস্থার প্রসার ঘটেছে বটে, তবে ট্যান্টেলাসের পেয়ালার মতো সেই জল আর ক্ষেতের তৃষিত দরিয়ায় এসে পৌঁছায় না। খরিফের ঘাটতি অনেকটা মেটানোর আশা নিয়েই রবিখন্দে তুর আর ছোলার চাষ করেছিল নামদেও। এ অঞ্চলে এমনটাই যে দস্তুর! কিন্তু বিধি এবারও বাম। জলের সামান্য পরশ পেলে যেখানে ফসলের দানাগুলি পুরুষ্টু হয়ে উঠতে পারে সেখানে হঠাৎ করে উদ্ভূত বৃষ্টিহীন খরা পরিস্থিতি নামদেওর স্বপ্নগুলিকে শুকিয়ে দেয়। খরাপ্রবণ অঞ্চলের অধিবাসী হয়েও এই হড়পা খরা-পরিস্থিতির মোকাবিলা কীভাবে করবে বুঝে উঠতে পারে না সে। স্থানীয় কৃষি আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলেও খুব লাভবান হয়নি নামদেও সহ এই শুখাপ্রবণ অঞ্চলের কৃষকরা। সবাই আকাশের দিকে হাত তুলে ওপরওয়ালার কৃপা প্রার্থনার পরামর্শ দিয়েছে।

 

খরার সারকথা

সমস্যা কেবল নামদেওর একার তেমন বোধহয় নয়। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা দাপিয়ে এমন খরা এখন হাতছানি দিচ্ছে আমাদের রাজ্যেও। খরা মানে এক বৃষ্টিহীন পরিস্থিতি। বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অংশে এমন আকস্মিক বা হড়পা খরার প্রকোপ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এক গভীর সঙ্কটের সম্মুখীন। এই বিষয়ে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনার আগে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে খরা বিষয়ে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। হড়পা বানের মতো হড়পা খরাও যে আজ গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে।

প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে খরার সংজ্ঞা নিয়ে বিজ্ঞানীমহলেই যথেষ্ট টানাপোড়েন রয়েছে। আসলে দেশকাল ভেদে তথাকথিত সঙ্কটের তীব্রতা নানারকম, ফলে বাস্তব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিষয়টিকে বিচার করতে গিয়ে বিজ্ঞানীদেরও নানান দৃষ্টিতে সমস্যার মূল্যায়ন করতে হয়েছে। বিজ্ঞানী উইলহাইট এবং গ্লান্টর চার ধরনের খরার কথা জানিয়েছেন:

  1. আবহিক খরা বা মিটিওরোলজিক্যাল ড্রট;
  2. জল সম্পর্কিত খরা বা হাইড্রোলজিক্যাল ড্রট;
  3. কৃষি সম্পর্কিত খরা বা এগ্রিকালচারাল ড্রট;
  4. আর্থসামাজিক খরা বা সোসিও-ইকনমিক ড্রট।

বলা বাহুল্য, প্রথম তিনটি ভাগের মধ্যে প্রাকৃতিক কার্যকারণের প্রভাবের বিষয়টিই প্রাধান্য পায়, অর্থাৎ বদলে যাওয়া বাতাবরণের কারণে খরা-পরিস্থিতির তীব্রতা কীভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তার ওপর নির্ভর করে প্রথম তিন ধরনের খরা পরিস্থিতির বিচার করা হয়। অন্যদিকে খরা-পরিস্থিতি মানুষের আর্থ-সামাজিক জীবনকে কতটা প্রভাবিত করছে তার নিরিখে হয় চতুর্থ প্রকার খরার মূল্যায়ন।

আবহিক খরা পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা হয় কোনও অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক অবস্থার প্রেক্ষিতে। ধরা যাক কোনও অঞ্চলে ১০০ সেমি বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক। এবার ওই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গিয়ে ৮০ সেমির আশেপাশে হলে ওই অঞ্চলটিকে সম্ভাব্য আবহিক খরাকবলিত বলে ঘোষণা করা যেতে পারে। অবশ্য এমন অবস্থা কতদিন চলছে সেই বিষয়টিও এখানে মান্যতা পায়। এই বিষয়টি মনে রাখতে হবে যে পৃথিবীর সর্বত্র বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সমান নয়। যেমন ক্রান্তীয় অঞ্চলে বা মধ্য অক্ষাংশের আর্দ্র কিছু অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের মাত্রা বেশি। কিন্তু কোনও কারণে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ন্যূনতম স্বাভাবিক মাত্রা থেকে কম হলে সেখানে আবহিক খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তবে পরিমিত বৃষ্টিপাতের মাত্রাটির পরিবর্তন হলে খরা-অবস্থার মূল্যায়নেও পরিবর্তন ঘটবে। এজন্য কোনও বিশেষ অঞ্চলের গড় বৃষ্টিপাতের মাসিক বা বার্ষিক পরিমাণ ও সেই অঞ্চলের প্রকৃত বৃষ্টিপাতের পার্থক্যের উপর ভিত্তি করেও খরা-পরিস্থিতির নির্ধারণ করা যেতে পারে।

জলসম্পর্কিত খরা-পরিস্থিতির মূল্যায়নে কোনও অঞ্চলের মোট অধঃক্ষেপণের পরিমাণ এবং সেই অঞ্চলের পৃষ্ঠীয় ও ভূগর্ভস্থ জলভাণ্ডারের আপেক্ষিক অবস্থার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। বৃষ্টিপাত ও তুষারপাতের মাধ্যমে পৃথিবীর স্বাভাবিক জলচক্রের ভারসাম্য বজায় থাকে। অধঃক্ষিপ্ত জলের একটা অংশ ভূপৃষ্ঠ ও ভূপৃষ্ঠ-গর্ভে জমা হয়, ফলে মাটি সিক্ত হয় ও চাষাবাদের উপযুক্ত হয়ে ওঠে এবং শুষ্কতার মাত্রা হ্রাস পায়, খরা-পরিস্থিতির সম্ভাবনা কমে। কিন্তু কোনও কারনে জলচক্রের এই স্বাভাবিক ছন্দ বিঘ্নিত হলে খরার ভ্রূকুটি লক্ষ করা যায়। তবে কেবল বৃষ্টিপাত হ্রাস পেলেই তাকে খরাগ্রস্ত বলা যাবে না। উদকবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে সমগ্র পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে হবে। যেমন মাটির আর্দ্রতার পরিমাণ, নদীর প্রবহনমাত্রার হ্রাস, ভৌম জলস্তরের অবনতি, জলাধারে মজুত জলের পরিমাণ, ইত্যাদি অবস্থার প্রেক্ষিতে বিষয়টির মূল্যায়ন করে খরা-পরিস্থিতির ঘোষণা করা হয়। কৃষি ছাড়াও যেসব ক্ষেত্রে জলের ব্যবহার অপরিহার্য সেইসব ক্ষেত্রে জলের চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্যের অভাব দেখা দিলেই উদকবিদ্যার দৃষ্টিতে খরাকবলিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

কৃষিসম্পর্কিত খরা-পরিস্থিতি আসলে আবহিক খরা ও উদকীয় খরার মিশ্র ফল। কৃষির সাফল্য তথা ফসলের উৎপাদন জলের পরিমিত জোগানের উপর নির্ভর করে। তবে সমস্ত ফসলের জলের চাহিদা সমান নয়। তাপীয় প্রভাব বেশি হলে বাষ্পীভবন ও বাষ্পীয় প্রস্বেদনের মাত্রা বেড়ে যায়, ফলে কৃষি-খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ফসলের উৎপাদন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। একটি ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে জলের চাহিদা ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় হয়ে থাকে। বীজের অঙ্কুরোদ্গমের সময়ে যে পরিমাণ জলের প্রয়োজন হয় ফসলের বৃদ্ধির মধ্য পর্যায়ে বা পাকার সময়ে তার পরিমাণ আলাদা। ফলে এক্ষেত্রে খরার বিষয়টি একান্তভাবেই আপেক্ষিক ও পর্যায়সাপেক্ষ। কৃষি উৎপাদনের কোনও একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ জলের জোগানে ঘাটতি দেখা দিলে কৃষি-খরার সৃষ্টি হয়। ন্যূনতম জলের জোগানে টান পড়লে কৃষককে এমন খরা-পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।

জল একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান এবং এর ব্যবহার ব্যাপক ও বহুমুখী। একথা মানতেই হবে যে জলের জোগান, বিশেষত নিত্যব্যবহার্য জলের জোগান পরিমিত এবং ক্ষীয়মান। পৃথিবীর জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে করে জলের জন্য মানুষের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সমতা বজায় রাখা কোনওভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। এই কারণে জলের অভাব অধিবাসীদের আর্থসামাজিক জীবনে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই অবস্থাকে আর্থসামাজিক খরা বলা হয়। ১৯৮৮-৮৯ সালে উরুগুয়েতে এই ধরনের খরা-পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। পর্যাপ্ত পরিমাণে জলের অভাবে সেই দেশের জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা একরকম ভেঙে পড়ে। প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের অভাবে সেই দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গভীর সঙ্কট নেমে আসে। পরিস্থিতির মোকাবিলায় সরকার বিদেশ থেকে শক্তিসম্পদের আমদানি বাড়ায়। বিদ্যুতের জন্য দেশের মানুষজনকে আরও বেশি ব্যয় করতে হয়। ফলে তাদের আর্থসামাজিক জীবনে নেমে আসে বিশৃঙ্খলা।

 

কেপটাউন সিনড্রোম

ইদানিং এই শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিবেশ-প্রকৃতিসচেতন মানুষজনের বিলকুল পরিচয় ঘটেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের নগর প্রশাসনের তরফে আগাম ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৮ সালের মধ্যে কেপটাউন শহর জলশূন্য নির্জলা হয়ে যাবে। কেপটাউনবাসীকে এই বিষয়ে সচেতন করার জন্য লাগাতার প্রচারের সাহায্য নেওয়া হল। অনুরোধ করা হল যথেচ্ছভাবে জল ব্যবহার না করে হিসেবি ব্যবহারে জোর দিতে। এইসব প্রচারের মূল লক্ষ্যই ছিল জলহীন হয়ে যাওয়ার পরম ক্ষণটিকে বিলম্বিত করা এবং পাশাপাশি সম্ভাব্য খরা-পরিস্থিতির সঙ্গে ব্যবহারিক ও মানসিকভাবে যুঝবার জন্য শহরবাসী নাগরিকদের প্রস্তুত করা। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কেপটাউনবাসী জলাভাব তথা খরা পরিস্থিতিকে সামলে নেওয়ার জন্য নিজেরাই নানা উপায় উদ্ভাবন করেছিল। সমস্যা এতটাই জটিল হয়ে পড়েছিল যে একসময়ে নাগরিক পরিষেবাকৃত্যক মাথাপিছু জলের ব্যবহার দিন প্রতি মাত্র ৫০ লিটারে বেঁধে দিয়েছিল। কেপটাউনবাসীর দাঁতে দাঁত চেপে হার না মানা লড়াই এক পরম উদাহরণ হয়ে সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে এক চরম বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল আবহিক পরিস্থিতির কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ না করে কেপটাউনবাসী শেষ প্রাণবিন্দু দিয়ে লড়াই করেছে কারও প্রতি অসহিষ্ণু অভিযোগ না করে।

কেপটাউনের ঘটনা একটা শিক্ষা দিয়ে গেছে সমগ্র ধরিত্রীবাসীদের। নড়েচড়ে বসেছেন পৃথিবীর তাবৎ গবেষক আর বিজ্ঞানীরা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট গবেষক লুইস স্লেটার এই অভাবিত খরা-পরিস্থিতির বিষয়ে সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে এক আগাম সতর্কবার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর মতে— সমগ্র পৃথিবীর ৯০ শতাংশ অধিবাসীকে এক নির্জলা নিয়তির অপেক্ষা করতে হবে। বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে যেভাবে উষ্ণতা বাড়ছে, আবহিক তন্ত্রটি বিশৃঙ্খল হওয়ায় যেভাবে জলচক্রের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, তাতে করে আগামী দিনে এক গহীন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে পৃথিবীবাসীকে। অসহনীয় তাপপ্রবাহের ফলে কৃষিজমি হারাবে তার স্বাভাবিক আর্দ্রতা, জমির ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হ্রাস পাবে, ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে ফসলের উৎপাদন, খাদ্যশস্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি বাধ্য করবে বহু মানুষকে অনাহার-অর্ধাহারে থাকতে, বাড়বে মানুষের আর্থসামাজিক বৈষম্য। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতির মূল বনিয়াদ ভেঙে পড়ায় অকল্পনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে জমির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকা কৃষিজীবী মানুষেরা তথা গ্রামসমাজ। বিপদ আছে আরও। তবে সেই আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে হড়পা খরা নিয়ে কয়েকটা জরুরি কথা ইত্যবসরে নিবেদন করব।

 

হড়পা খরা— এক অনাহূত বিপর্যয়

মানুষের জীবনে প্রকৃতির রাজত্বে ঘটে যাওয়া যেকোনও বিপর্যয়ের গভীর প্রভাব পড়ে। হড়পা খরা বা আকস্মিক খরা পরিস্থিতিও যে এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয় তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। বিভিন্ন ধরনের খরা পরিস্থিতির কথা আলোচনার পরও এমন খরার আকস্মিক আবির্ভাবের বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীমহলের উদ্বেগের অন্ত নেই। তাঁদের পরিভাষায় হড়পা খরা হল এক অনাহূত অতিথি। এক নিঃশব্দ ঘাতক যা তিলে তিলে একটি অঞ্চলের অর্থনীতি, সামাজিক সুস্থিতি, অন্তর্লীন সাংস্কৃতিক যাপন, তার একান্ত বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করে। খরা শব্দের অর্থ যদি হয় বৃষ্টিহীন শুষ্কতা, তাহলে হড়পা খরা হল আকস্মিক শুষ্কতা পরিস্থিতির উদ্ভব। চৈত্র-বৈশাখে আমাদের দেশগাঁয়ের পুকুর, নদী, নালা, খাল, বিল সব জল শুকিয়ে ফুটিফাটা মাঠে পরিণত হয়— এ-দৃশ্য হয়তো আমাদের কাছে খুব অপরিচিত ছিল না। কালবৈশাখীর দৌলতে যে বৃষ্টি পেতাম তাতেই মিলত সাময়িক স্বস্তি। কিন্তু এই বর্ষণহীন পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি তপনতাপের মাত্রাহীন বাড়বাড়ন্ত হয় তাহলেই বাড়তে থাকে বাষ্পীয় প্রস্বেদনের মাত্রা— মাটির কণায় আবদ্ধ জল ক্রমশই কমতে থাকায় এক আকস্মিক খরা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন হড়পা খরা।

বিষয়টি একান্তভাবে পৃথিবীর আবহমণ্ডলীয় শৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও এর আবির্ভাব হঠাৎ আসা অনাহূত অতিথির মতো যা তাপমানের ক্রমবৃদ্ধির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। এমন অবাঞ্ছিত অতিথির আগমনের বিষয়টি নেহাতই একালের তেমনটা কিন্তু নয়। এখন যেমন এমন বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছি আমরা, অতীতেও তেমন ঘটনার সাক্ষী হয়েছে পৃথিবীর নানা অঞ্চল এবং শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে হচ্ছে আগামী দিনে এমন ঘটনা আরও বেশি বেশি করে ঘটতে থাকবে আমাদের মাতৃভূমি ভারতবর্ষ সহ পৃথিবীর নানা দেশে। ইতিমধ্যেই এল নিনো এসে কড়া নাড়ছে আমাদের ধরিত্রী অ্যাপার্টমেন্টের দরজা। এই খেলা আগামীদিনে গোটা পৃথিবীকে কোন রিক্ততার পথে নিয়ে যাবে তা দেবা ন জানন্তি কুতো নিবন্ধকার!